কার্ডিফের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অনেক সুখস্মৃতি। ইংল্যান্ডের এই মাঠেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম এবং একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও এই মাঠে জয়ের স্মৃতি রয়েছে বাংলাদেশের। দুই ম্যাচেই বাংলাদেশ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে পাঁচ উইকেটের জয় পেয়েছিল। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনসের পরিসংখ্যানের উপর লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এই মাঠে পরে ব্যাট করা দলই বেশি সফল। কার্ডিফে এখন পর্যন্ত মোট ২৬টি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যারমধ্যে প্রথমে ব্যাট করা দল জয় পেয়েছে সাতটি ম্যাচে এবং রান তাড়া করে জয় পেয়েছে ১৫ ম্যাচে। তিনটি পরিত্যক্ত এবং একটি ম্যাচ টাই হয়েছিল। প্রথমে ব্যাট করা দলের জয়ের সংখ্যা সাতটির জায়গায় ছয়টি হতে পারতো, যদি না শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে আফগানিস্তানের লেজেগোবরে অবস্থা না হতো।
পরিসংখ্যান বলে কার্ডিফে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে ব্যাটসম্যানরা বেশি সফলতা পায়। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় যেখানে ২৮.৪৫ রান, সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় ৩৫.৬০ রান। রান তোলার দিক থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামা ব্যাটসম্যানরা এগিয়ে আছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা ওভারপ্রতি ৫.৪৬ রান তুলে নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রথম ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা প্রতি ওভারে গড়ে ৫.২৩ রান তুলেছেন।
কার্ডিফে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ খেলেছিল ২০০৫ সালের ১৮ জুন। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে পাঁচ উইকেটে ২৪৯ রান সংগ্রহ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। জবাবে মোহাম্মদ আশরাফুলের দুর্দান্ত শতক এবং আফতাবের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ চার বল এবং পাঁচ উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নেয়। কার্ডিফে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচ খেলেছে ২০১৭ সালের ৯ জুন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বাঁচা-মরার লড়াইয়ে ২৬৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৬ বল এবং পাঁচ উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। কিউইদের দেওয়া ২৬৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে সাউদির বিধ্বংসী স্পেলে মাত্র ১২ রানে তিন উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর দলীয় ৩৩ রানে মুশফিক বিদায় নিলে বিপর্যয়ে পড়ে টাইগাররা। সেদিন ধ্বংসস্তূপ উদ্ধার করেছিলেন সাকিব এবং রিয়াদ তারা ৫ম উইকেট জুটিতে ২২৪ রান যোগ করে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালের টিকেট এনে দেন।
কার্ডিফে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দুটি ওয়ানডে খেলে দুটিতেই জয় পেয়েছে। এই মাঠে এখন পর্যন্ত ১১টি দেশ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে। তারমধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশরই শতভাগ জয়ের রেকর্ড রয়েছে। স্বাগতিক ইংল্যান্ড ১৩ ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে সাত ম্যাচে। এছাড়া নিউ জিল্যান্ড সাত ম্যাচে চারটি এবং অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা ছয় ম্যাচের মাত্র একটি ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে। ব্যাটসম্যানদের গড়ে রান তোলার দিক থেকেও বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে আছেন। কার্ডিফে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় ৪৭.৬০ রান। অপরদিকে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং ২৯.২১ রান। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি গড়ে রান করেছেন শুধুমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তারা ৪৯.৭১ গড়ে রান করেছেন।
কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনসে অনুষ্ঠিত ২৬ ম্যাচের মধ্যে ব্যাটসম্যানরা মোট শতক হাঁকিয়েছে আটটি। এরমধ্যে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা ১৩ ম্যাচ খেলে মাত্র একটি শতক হাঁকিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ছয় ম্যাচে একটি এবং নিউ জিল্যান্ড সাত ম্যাচে, শ্রীলঙ্কা ছয় ম্যাচে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান পাঁচ ম্যাচ খেলে কোন সেঞ্চুরিয়ানের দেখা পায়নি। কার্ডিফে শতক হাঁকানোর দিকে থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত আটটি শতকের মধ্যে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা হাঁকিয়েছেন তিনটি শতক। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুল এবং নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ শতক হাঁকিয়েছেন।
কার্ডিফে খেলা বাংলাদেশের দুটি ম্যাচেই একাদশে চার পেসার ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাপস বৈশ্য, নাজমুল হোসেন এবং আফতাব আহমেদ মিলে ৪০ ওভার বল করেছিলেন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও ছিল পেসারদের আধিক্যতা। মাশরাফি, রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান মিলে মোট ৩৭ ওভার বল করেছিলেন। এই দুই ম্যাচে বাংলাদেশের স্বীকৃত স্পিনার হিসাবে খেলেছিলেন যথাক্রমে মোহাম্মদ রফিক এবং সাকিব আল হাসান। দুইজনই উইকেট শূন্য ছিলেন। স্পিনারদের মধ্যে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন উইকেট শিকার করেছিলেন।
কার্ডিফে স্পিনারদের চেয়ে পেসাররাই বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচেও তা দেখা গিয়েছে। আসরের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিউ জিল্যান্ডের পাঁচ পেসার বল করে নয় উইকেট শিকার করেছিলেন। দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার পাঁচ পেসার বোলিং করেছিলেন। একটি রান আউট বাদে সবকটি উইকেট তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে শ্রীলঙ্কার জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
কার্ডিফে এখন পর্যন্ত ২৬ ম্যাচে মোট উইকেট পড়েছে ৩১৯টি। এখন পর্যন্ত কোন বোলার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করতে না পারলেও ১৪ বার ইনিংসে চার উইকেট নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ১৪ বার ইনিংসে চার উইকেট শিকারের মধ্যে পেসারদের সংখ্যা ১২। মাত্র দুইজন স্পিনার এখন পর্যন্ত কার্ডিফে ইনিংসে চার উইকেট শিকার করেছেন। যারমধ্যে সর্বশেষ ম্যাচে মোহাম্মদ নবী একবার করে দেখিয়েছেন। উইকেট সংখ্যার দিক দিয়েও পেসাররা অনেক এগিয়ে আছে। পেসাররা ৩১.৯৯ বোলিং গড়ে ২৪৫ উইকেট শিকার করেছে। বিপরীতে স্পিনাররা ৩৭.৪৩ বোলিং গড়ে পেয়েছেন ৭৩ উইকেট। খুব বেশি উইকেট না পেলেও স্পিনাররা রান দেওয়ার ক্ষেত্রে পেসারদের চেয়ে মিতব্যয়ী ছিলেন। পেসাররা যেখানে ওভারপ্রতি ৫.৩১ রান খরচ করেছেন, সেখানে স্পিনারদের ইকোনমি রেইট ৪.৯৫ রান।
বাংলাদেশ প্রথম দুই ম্যাচে তিনজন পেসার নিয়ে খেলেছে। খুব সম্ভবত ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও অপরিবর্তিত একাদশ রাখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একাদশে কোন পরিবর্তন না আসলে খেলা হবেনা গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের নায়ক রুবেল হোসেনের। দলে থাকা তিন পেসারের কেউই দ্রুতগতির বোলার নন। স্কোয়াডে থাকা একমাত্র দ্রুতিসম্পন্ন বোলার হলেন রুবেল। পরিসংখ্যানও বলে কার্ডিফে সোফিয়া গার্ডেনসে দ্রুতগতির বোলাররাই বেশি সফলতা পেয়ে থাকে। তাই একাদশে বাড়তি পেসার খেলানোটাই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচ খেলেছে কেনিংটন ওভালে। যারমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় পেলেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে নাটকীয়তায় ভরপুর দ্বিতীয় ম্যাচে শেষপর্যন্ত দুই উইকেটে পরাজিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডেরও একই অবস্থা। তারা নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজিত হয়েছে। তাই দুই দলই চাইবে কার্ডিফে জয় তুলে নিয়ে সেমিফাইনালের পথ সুগম করতে। বর্তমানে ওয়ানডেতে অপরাজেয় দলে পরিণত হওয়া স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকবে এইজন্য যে, ম্যাচটি বাংলাদেশের পয়মন্ত মাঠ কার্ডিফে এবং বিশ্বকাপের ম্যাচ বলে। কারণ কার্ডিফে বাংলাদেশের বড় দলদের হারানোর সুখস্মৃতি রয়েছে ও বিশ্বকাপে শেষ দুই মোকাবেলায় ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছিল বাংলাদেশ।