মানবজাতির ইতিহাসে ফ্রান্সের স্থান শিল্প-সাহিত্য বা অন্য দিক দিয়েও অনেক উঁচুতে হলেও ফুটবল ইতিহাসে ফ্রান্স তেমন কেউকেটা না। হল্যান্ডের মতো টোটাল ফুটবল বা ব্রাজিলের মতো জোগো বনিতো বা এমন ঐতিহাসিক কিছু তারা ফুটবলকে দিতে পারেনি। জিদান-প্লাতিনির প্রতিভার ছটায় যা কিছু অর্জন। ১৯৯৮ আর ২০০০ এ বিশ্বকাপ ও ইউরো জয়ের পর হঠাৎ তাদের ফুটবলে স্থবিরতা চলে আসে। মাঝে স্রোতের বিপরীতে এক জিদান-মন্ত্রে ফ্রান্স ২০০৬ এ শিরোপার হাতছোঁয়া দূরত্বে গেলেও সেই জিদানেরই ভুলের জন্য স্পর্শ আর করা হয়নি!
এরপর কেবল অন্ধকার তাদের ফুটবলে। কোচের সাথে কলহ, নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে টালমাটাল ফ্রান্স ফুটবলে প্রায় হঠাতই নতুন বসন্ত চলে আসে। লিও একাডেমিসহ ফ্রান্সের ক্লাবগুলোয় একের পর এক দারুণ প্রতিভা উঠে আসতে থাকে। বিশ্বের সব বড় ক্লাবেই স্থান নিতে থাকে ফ্রেঞ্চ প্রতিভা। ফ্রান্স আবার ফুটবলে নিজেদের মাথা উচু করে দাঁড়ায়। পাঠক, প্রতিভা বিবেচনার এবারের আসরের সেরা দলটি নিয়ে এই লিখাটি।
আফ্রিকান ফ্রেঞ্চ কলোনিভুক্ত দেশগুলো থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গ অনেক লোকই একটু ভাল জীবনযাপনের আশায় নিজেরা ও তাদের ছেলেমেয়েদের খেলার জগতে পাঠাতে শুরু করে। ফ্রেঞ্চ রাজনীতি বা অর্থনীতিতে তাদের কী ভূমিকা তা না আলোচনা করেই নির্দ্বিধায় বলা যায়, এতে সবচেয়ে লাভবান হয় ফ্রেঞ্চ ফুটবল। ফ্রান্সের বর্তমান প্রতিভা ও পাইপলাইনে যেসব প্রতিভা আছে তা দিয়ে ফ্রান্স নিশ্চিতভাবেই আরো দশ বছর বিশ্বের যেকোনো দেশকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। আর এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় ফ্রেঞ্চ ক্লাবগুলো প্রচুর যুব প্রতিভাকে সুযোগ দিচ্ছে। ফ্রান্স যেসব খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপে নিয়ে আসেনি, শুধু তাদের নিয়ে একটি দল বানালেও তা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড পার হয়ে আসতে পারবে! প্রথমেই ফ্রান্সের পজিশনভিত্তিক শক্তিমত্তা দেখে নেয়া যাক।
রক্ষণ
ফ্রান্সের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক অধিনায়ক হুগো লরিস ইংলিশ লিগের সেরাদের একজন। তার সব গুণ বিবেচনায় বিখ্যাত ইংলিশ কোচ রেডন্যাপ বলেছিলেন, “লরিসের মতো খেলোয়াড়ের রিয়াল-বার্সায় যাওয়া উচিত, সে ঐ পর্যায়ের!” তার বদলি নামতে প্রস্তুত মাদান্দা ও আরিওলা। মাদান্দার রিফ্লেক্স নজরকাড়া হলেও আরিওলা বা তিনি কেউই লরিসের যোগ্য বিকল্প নন। লরিসের কোনো চোট ফ্রান্সের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
রাইটব্যাকে ফ্রান্সের প্রথম পছন্দ সিদিবে। মোনাকোর এই তরুণ রাইটব্যাক আক্রমণে প্রচুর দক্ষ, সমানে ওভারল্যাপ করে খেলেন। লিগে দলের হয়ে মোট ৯টি গোল বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার বদলি হিসেবে নামার জন্য থাকবেন পাভার্ড। মাত্র ২২ বছর বয়সী স্টুটগার্টের এই রাইটব্যাকের সাংখ্যিক রেকর্ড এত ভাল না। ৩২ ম্যাচে ক্লাবের হয়ে গোল মাত্র ১টি, অ্যাসিস্ট নেই, যদিও এতটা খারাপও খেলেননি তিনি!
লেফটব্যাকে দলের প্রথম পছন্দ বেঞ্জামিন মেন্ডি। প্রায় ৭ মাস মাঠের বাইরে থাকার পরও কোচের আস্থা কমেনি। এর পেছনে কারণও আছে। ফিট মেন্ডি গত মৌসুমে ফ্রান্স ও মোনাকোর হয়ে যা খেলেছেন তাতে তাকে বাদ দেয়ার কারণ ছিল না। শারীরিকভাবে শক্ত এই ম্যানসিটি লেফটব্যাকও মার্সেলোর মতো আক্রমণে দারুণ সাবলীল। গ্রাউন্ড ক্রস বা বাতাসে ভাসানো ক্রস সবকিছুতেই ভালো। গোল বানিয়ে দেয়া বা বক্সের বাইরে থেকে শট নেয়া দুটোই আছে তার তূণে। লেফটব্যাকে মেন্ডিকে সরাতে প্রস্তুত অ্যাটলেটিকোর লুকাস হার্নান্দেজ। লুকাস মেন্ডির মতো পুরো আক্রমণ নির্ভর নন, বরং দলের প্রয়োজনে সেন্টারব্যাকেও খেলতে পারেন- এমন ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি তার আছে। ক্লাবে তিনি ফিলিপে লুইসের বদলি খেলেন বলে এত নিয়মিত নন, কিন্তু খেলার ধরন লুইসের মতোই, ভারসাম্যপূর্ণ। ক্লাবের হয়ে রিয়ালের বিপক্ষে যেভাবে রোনালদোদের বিপক্ষে খেলেছেন তাতে ফ্রেঞ্চ কোচ খুশি হতেই পারেন। তাই এই পজিশনে কোচ কাকে খেলান তা-ও দেখার বিষয়।
সেন্টারব্যাক পজিশনে ফ্রান্সের জুটি নিশ্চিত, ভারানে-উমতিতি। রিয়ালে রামোস ও বার্সায় পিকের সাথে খেলা উমতিতি দুজনেই বয়সের তুলনায় বেশি পরিপক্ক। উমতিতি এবারের লা লীগার সেরাদের একজন আর ভারানে রিয়ালের হয়ে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন মাত্র ২৫ বছর বয়সেই, যার তিনটিতে নিয়মিত ছিলেন তিনি। তাত্ত্বিকভাবে এর চেয়ে ভালো জুটি খুব কম দেশেরই আছে। যদি রসায়ন জমে যায়, তবে ফ্রান্স রক্ষণ ভেদ করা কষ্টকর হবে, যদিও ফ্রান্স মিস করবে তাদের রক্ষণের আসল নেতা কশিয়েনলিকে, চোটের জন্য। সাথে আছেন পিএসজির কিম্পেম্বে। ক্লাবে বেশ অনিয়মিত, তবে সুযোগ পাওয়া ম্যাচগুলোতে তার ফর্ম বেশ ভালো। আছেন বর্ষীয়ান আদিল রামি। তবে ব্যাকআপ দুজনের কেউ ভারানে-উমতিতির মতো নন। চোটের কারণে এই জুটি ভেঙে গেলে ফ্রান্স বিপদে পড়বে বড় দলের বিপক্ষে।
মাঝমাঠ
স্পেন ও জার্মানির সাথে যদি কোনো দেশের মাঝমাঠ তুল্য হয় তবে তা ফ্রান্স। গত বিশ্বকাপের ফ্রান্স দলের সাথে এবারের দলের মাঝমাঠের মূল ফারাক একজন- এনগোলো কান্তে। লিস্টার রূপকথার মতোই তারও উত্থান অকল্পনীয়। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময়ও কান্তে অজ্ঞাতকুলশীল একজন, আর আজ তিনি যেকোনো দলে মূল একাদশে খেলার যোগ্য। মাঠের প্রতি ইঞ্চি ঘাস দৌড়ে কভার করতে পারবেন ১২০ মিনিট করে, এত তার স্ট্যামিনা। পাস অ্যাকুরেসি, ট্যাকল রেট, টেক অন, থ্রু-বল সব মিলিয়ে বুস্কেটস বাদে এত ভালো কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কোনো দেশের আছে কি না সন্দেহ। তার পজিশনে বদলি খেলতে পারবেন এনজোজি, যিনি ভালো খেলোয়াড়, কিন্তু কোনোভাবেই কান্তে নন।
এরপর আছেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী মিডফিল্ডার পোগবা। ম্যানইউতে খেলা এই তারকার প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। বল বানিয়ে দেয়া, লংবল, টেকঅন, এরিয়াল ডুয়েল সব গুণই তার মাঝে বিদ্যমান কিন্তু প্রশ্ন হলো তার ধারাবাহিকতা। এত বহুমুখী গুণসম্পন্ন মিডফিল্ডার বিরল, কিন্তু যে ধারাবাহিকতা তাতে কবে তার দিন আসে তা বোঝাই ভার। প্রচুর ‘শো অফ’ করতে চান মাঠে, যার ফলে দল প্রায়ই বল হারায়। প্রায়ই মরিনহোর হাতে ক্লাবে বেঞ্চ হয়েছেন এ মৌসুমে, অনেক সাবেক তারকাই তার সমালোচনায় মুখর। অ্যাটাকিং মিড ও লেফট মিডে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারবেন তিনি, কিন্তু তার আগে তাকে স্বীকার করে নিতে হবে যে এই দলে তিনিই ‘বিশাল’ কিছু নন। তা না হলে দলের সাথে মিশে যেতে পারবেন না।
মাঝমাঠের বাকি একটি স্লটে কে তা নিয়ে সংশয় আছে। আছেন মাতুইদি, যিনি শারীরিকভাবে শক্ত, গতিশীল, দারুণ একজন ‘বক্স টু বক্স’ মিডফিল্ডার; গোল করার অভ্যাসও আছে, পাশাপাশি রক্ষণকাজেও ভালো। এছাড়া আছেন বায়ার্নের তলিসো। মূলত আক্রমণেই বেশি মন। থ্রু বল, শর্ট পাস সেসবে দক্ষ বলে ডিপ লায়িং প্লেমেকার হিসেবে খেলতে পারেন। তবে তলিসোর রক্ষণকাজ তেমন ভালো না, মাতুইদি বা কান্তের মতো না।
ফ্রান্সের কোচের পছন্দের লাইনআপ ৪-৩-৩ বা ৪-৪-২। ৪-৪-২ তে মাঝমাঠের দুই উইংয়ে খেলার জন্য বেশ দারুণ কিছু প্রতিভা আছে ফ্রান্সের। ফ্রেঞ্চ লিগের ৩য় ও ৪র্থ দলের সেরা খেলোয়াড় যথাক্রমে থুয়াভিন ও নাবিল ফেকির। থুয়াভিন ক্লাবের হয়ে এ মৌসুমে করেছেন ২২ গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট। নাবিল ফেকির ইনজুরি থেকে ফিরে করেছেন ২১ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট। ফেকির স্বাচ্ছন্দ্যে রাইট উইং, অ্যাটাকিং মিড ও রাইট সেন্টার মিডে খেলতে পারেন। বল পায়ে দারুণ, জমাট ডিফেন্সচেরা পাস দিতে পারেন আর এসব কারণেই বড় বড় অনেক ক্লাব তাকে দলে ভেড়াতে চাইছে। থুয়াভিনের গোল করা ও বানিয়ে দেয়ার ক্ষমতা দারুণ। তিনিও রাইট মিড ও এটাকিং মিডে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারেন। ঠিক এমনই একজন টমাস লেমার। ম্যানসিটি ও আর্সেনাল হন্যে হয়ে চাইছে এই মোনাকো তারকাকে। দুই উইংয়েই খেলতে পারা লেমারের এবারের লিগ ফর্ম তেমন ভালো না। সমস্যা হলো, তারা প্রত্যেকেই যার যার ক্লাবে ‘একাকী সৈনিক’। অনেক সময়েই দেখা যায় ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ খেলোয়াড়রা বড় ইউনিটে হারিয়ে যায়। এত এত উইঙ্গার, কিন্তু নিরেট লেফট উইঙ্গারের অভাব ফ্রান্স স্কোয়াডে আছেই!
আক্রমণ
মেসি, রোনালদো, নেইমারের পাশাপাশি যদি কারো নাম আসে তবে তিনি গ্রিজম্যান। অ্যাটলেটিকো তারকা ফ্রান্সের জার্সিতেও দারুণ। ইউরো ও বাছাইপর্বে ফ্রান্সের হয়ে সর্বাধিক গোল তারই। হেড, শ্যুট সবকিছুতেই দক্ষ গ্রিজম্যানই ফ্রান্সের মূল তারকা, মূল স্কোরিং শক্তি। এরপরই দলে আসবে এমবাপ্পের নাম। গত মৌসুমে নাটকীয় উত্থান হওয়া এই তারকাকে নিয়ে পিএসজি ও রিয়ালের বেশ লড়াই হয়েছিল। ১৮০ মিলিয়নে পিএসজিতে যোগ দেয়া এই তারকা দিনে দিনে নিজেকে শাণিত করছেন। ১৯৮২ এর ম্যারাডোনা বা ২০০৬ এর মেসির মতো এবারের আসরের সেরা যুব খেলোয়াড়ের দৌড়ে তিনি থাকবেনই। মোনাকোতে খেলেছেন স্ট্রাইকার হিসেবে, ফ্রান্সে খেলেন লেফট উইং ধরে, পিএসজিতে খেলেন রাইটে! সোজা হিসেবে এত মৌলিক যে আক্রমণভাগের প্রতি ইঞ্চিতে খেলার দক্ষতা তার আছে। ক্লাবে যেভাবে নেইমারকে জায়গা দিয়ে খেলেন নিঃস্বার্থভাবে, তাতে গ্রিজম্যানের সাথে জুটি করতে তেমন সমস্যা হবে না।
আরেক উইংয়ে থাকবেন বার্সার ডেম্বেলে। দুই পায়েই সাবলীল বলে দুই পাশেই ভালো খেলেন। পায়ে ভালো ক্রস আছে, আর ড্রিবলিং এর কথা না-ই বলা যাক! ডেম্বেলে-এমাবাপ্পের বয়স এখনো ২০ পার হয়নি, আর এ বয়সেই তারা জাতীয় দলের ভার বইছেন! ভাবা যায় ফ্রান্সের ২০২২ দলটা কেমন হবে? পিওর স্ট্রাইকার হিসেবে থাকবেন জিরুদ। জিরুদকে গোল দিয়ে বিবেচনায় আনলে হবে না, যদিও ফ্রান্সের জার্সিতে তার ফর্ম বেশ ভালো। জিরুদ শারীরিকভাবে শক্ত ও লম্বা বলে খুব ভালোভাবেই প্রতিপক্ষের দুজন সেন্টারব্যাককে ব্যাস্ত রাখতে পারেন আর এই ফায়দাটা নিতে পারে সেকেন্ড স্ট্রাইকার বা স্কোরিং উইংগাররা। ফ্রান্সের মাঝমাঠ ও আক্রমণে যে প্রতিভার ছড়াছড়ি, খেলোয়াড়দের জুটি জমে গেলে বা নিজেদের দিনে যেকোনো দলকে হারাতে সক্ষম তারা।
খেলার ধরন
ঐতিহাসিকভাবেই ফ্রান্সের সব দলই শক্ত ডিফেন্সিভ কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে গঠিত। ১৯৮৪ এর ইউরোজয়ী বা ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ- সবখানেই ফ্রান্সের মূল শক্তি ছিল রক্ষণ। ১৯৯৮-২০০০ এর সর্বজয়ী ফ্রান্সের মূল নেপথ্য শক্তি ছিলেন বর্তমান কোচ দেশম। কান্তের মতো পাওয়ারফুল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিলেন তিনি, কিন্তু তার দলেই তেমন কাঠিন্য নেই। দলে রক্ষণ-আক্রমণের ভারসাম্যের বেশ ফারাক আছে। মূলত তার পছন্দ ৪-৩-৩, যে ফর্মেশন নিয়ে তিনি দুটো টুর্নামেন্ট খেলিয়েছেন। বদলি অপশন হিসেবে থাকবে ৪-৪-২, যাতে জিরুদ-গ্রিজম্যান স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন। ডিফেন্সকে কভার দেবেন কান্তে আর মাতুইদি। মাতুইদি বা তলিসোর ভূমিকা হবে বক্স টু বক্স খেলা। ফ্রান্সের দুই ফুলব্যাক আক্রমণাত্মক বলে দলের মূল কৌশলে উইংপ্লে থাকবেই। মাঝমাঠে পোগবা যদি নিজেকে দলের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন তবে ফ্রান্সের এই মাঝমাঠ দারুণ ক্লাসিক এক মাঝমাঠ হবে।
এমবাপ্পে ডেম্বেলেরা প্রচুর জায়গা বদল করে খেলতে পারেন, তাই তাদের মার্ক করা বেশ কষ্টকর। আর গ্রিজম্যানের স্কোরিং সক্ষমতা সন্দেহের বাইরে, তাই ফ্রান্সের আক্রমণভাগ সত্যই দারুণ। ফ্রান্সের প্রতিভা যদি দলীয়ভাবে খেলতে পারে তবে এই দলের পক্ষে বহুদূর যাওয়া সম্ভব। যদিও এত প্রতিভার ছড়াছড়ি হাতে নিয়েও দেশম এতদিনেও আহামরি কোনো কাঠামো দাঁড়া করাতে পারেননি, যা নিয়ে খোদ ফ্রেঞ্চ মিডিয়াতেও সমালোচনা রয়েছে। ফ্রান্সের সারমর্মটা কলম্বিয়া ম্যাচেই স্পষ্ট। প্রথম ৩০ মিনিট নজরকাড়া আক্রমণ আর শেষ ৩০ মিনিট লজ্জাজনক ডিফেন্স, ফলাফল ৩-২ এ হার। যদিও প্রীতি ম্যাচ সেভাবে আমলে নিতে নেই, তা-ও এই অসম্ভব প্রতিভাবান ফ্রান্সের এমনই হয়। পরাক্রমশালী জার্মানিকে হারিয়ে দিতে পারে, আবার দুর্বল পর্তুগালের সাথে হেরেও বসতে পারে!
দুর্বলতা
ফুলব্যাক
দেশমের ফর্মেশন হলো ৪-৪-২ (দুর্বল দলগুলোর সাথে) ও ৪-৩-৩ (শক্তিশালী দলগুলোর সাথে)। সম্ভাব্য স্টার্টিং দুজন ফুলব্যাক হলো সিডিব (ডানে) ও মেন্ডি (বামে)। মেন্ডি এই সিজন প্রায় পুরাটাই ইঞ্জুরিতে ছিলেন। আর তার ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হার্নান্দেজও এত নিয়মিত ছিলেন না। মানে লেফটে দুই ফুলব্যাকেরই গেম টাইম নিয়ে সমস্যা ছিলো এই সিজনে। এখন রাইটব্যাকে আছেন সিডিবে, কিন্তু একটু বেশিই আক্রমণাত্মক। প্রচুর ওভারল্যাপ করেন, আক্রমণে যান, কিন্তু পরে সময়মতো ডিফেন্স কাভার করতে পারেন না। সিডিবের বদলি হিসেবে রাখা হইসে পাভার্ড স্টুটগার্টে মোটামুটি ভালো একটা সিজন গেলেও তার অনভিজ্ঞতা ঝামেলায় ফেলতে পারে।
দক্ষ সেন্টারব্যাকদ্বয়ের ভিন্ন সমস্যা
অনেকের মতেই ফ্রান্স দলের মূল সমস্যা হলো সেন্টার ব্যাক দুজন। উমতিতি মূলত বল প্লেয়িং ডিফেন্ডার, ট্যাকেলে ভালো, তবে বাতাসে ভেসে আসা বলে দুর্বল। আরেকজন ভারানে, যিনি বর্তমান সময়ে সেরা কয়েকজন সেন্টারব্যাকের মধ্যে একজন। মার্কিং, ট্যাকলিং, অন এয়ার, পেইস, পজিশনিং সবই দারুণ, কিন্তু বল প্লেয়িংয়ে খুব দুর্বল। এই কারণে উমতিতি, ভারান পার্টনারশিপ কেমন হবে তা নিয়ে সন্দেহে আছে অনেক ফ্রেঞ্চ বিশেষজ্ঞের। আর এটা সত্য যে, তাত্ত্বিকভাবে ভাল সব জুটিই ব্যবহারিকভাবে ভালো হয় না। ২০১৪ বিশ্বকাপ ও ২০১৬ ইউরোর পিকে-রামোস জুটি তার প্রমাণ। সত্যি কথা বলতে ফ্রান্সে ডিফেন্সে মেইন ম্যান কসিয়েলনি, দলের নেতা ছিলেন তিনি। তার ইঞ্জুরি দারুণ ভোগাবে দলকে। এর উপর আবার ভারানে-উমতিতির বিকল্প রামি ও কিম্পেম্বে! এই নিয়ে ফ্রান্স সমস্যায় পড়তেই পারে।
আক্রমণ
নিঃসন্দেহে ফ্রান্সের আক্রমণ দারুণ, কিন্তু দলে ওয়াইড প্লেয়ার কে? এমবাপ্পে সাম্প্রতিক সময়ে সব আক্রমণ মাঝমাঠ দিয়ে করেন, গ্রিজম্যান একজন নাম্বার ১০ মূলত, যদিও স্ট্রাইকার হিসেবেই ফ্রান্সে খেলেন; ফেকির, থাউভিন সবাই মাঝ দিয়েই বেশি আক্রমণ করে স্বচ্ছন্দ। ডেম্বেলেও ইনজুরিতে জর্জরিত একটি সিজন পার করলেন, তিনিও ডানেই স্বচ্ছন্দ! কোচ কোমান, মার্সিয়ালদের ডাকেননি, যারা লেফট উইংয়ে ভালোভাবেই ত্রাস তৈরি করতে পারতেন।
কান্তের বিকল্প কে?
আরেকটি দুর্বলতা হলো মাঝমাঠ। কান্তের সাথে কে পার্টনারশিপ করবেন? কে তার ব্যাকআপ? এনজোজি? এনজোজি লিংক আপে বাজে। মাঝমাঠে ফ্রান্সের মূল সমস্যা হচ্ছেন পোগবা। গত বিশ্বকাপের বেস্ট ইয়াং প্লেয়ার হওয়া এই পগবাকেই অনেকে ফ্রান্সের মূল দুর্বলতা মনে করেন! আত্মবিশ্বাস একদম তলানিতে তার। সমস্যা হলো, পোগবা দলগতভাবে খেলতে পারেন না ম্যাচ বাই ম্যাচ, তার প্রতিভা নিয়ে কেউ সন্দেহ করে না।
নেতৃত্ব
ফ্রান্সের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, কোনো যোগ্য নেতা নেই দলে। ২০০৬ এ ইতালির ক্যানাভারো, ২০১০ এ স্পেনের পুয়োল, ২০১৪ তে জার্মানির লাম বা শোয়েইনি। কিন্তু এই ফ্রান্স দলে তেমন কোনো নেতা নেই। এ জায়গাতেই কসিয়েলনিকে মিস করবে ফ্রান্স। কসিয়েলনি একজন ন্যাচারাল ছিলেন ফ্রান্সের জন্য। বিশ্বকাপের ম্যাচের দিন দুয়েক আগেও মূল তারকা গ্রিজম্যান ক্লাব ছাড়বেন কি না তা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মজা করেন, হেয়ালি করেন! ভাবতে পারেন, ২০০৬ সালের ইতালি দলের কেউ এমন করছে? গাত্তুসো একাই শায়েস্তা করে দিতেন! ফ্রান্সের মাঠের বাইরের কার্যকলাপ একটু বেশিই হচ্ছে।
যেমন হতে পারে লাইনআপ
(৪-৩-৩)
লরিস
সিডিবে-ভারানে-উমতিতি-মেন্ডি/লুকাস
তলিসো-কান্তে-পোগবা
ডেম্বেলে-গ্রিজম্যান-এমবাপ্পে
ম্যাচের সূচী
ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া (১৬ই জুন, বিকাল ০৪:০০ )
ফ্রান্স-পেরু (২১ জুন, রাত ০৯:০০)
ফ্রান্স-ডেনমার্ক (২৬ জুন, রাত ০৮:০০)
সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ
(ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়াম ও উরুগুয়েকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ধরে)
গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে: ক্রোয়েশিয়া (শেষ ১৬), পর্তুগাল (কোয়ার্টার), ব্রাজিল (সেমি)
গ্রুপ রানারআপ হলে: আর্জেন্টিনা (শেষ ১৬), স্পেন (কোয়ার্টার), জার্মানি (সেমি)
ফ্রান্স এমন একটি দল নিয়ে যাচ্ছে, কাগজে-কলমে যার থোড়াই দুর্বলতা। কম্পিউটার গেমস হলে এই দল নিশ্চিত কাপ ঘরে তুলতো! খেলোয়াড়দের তুলনায় ফ্রান্স ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার চেয়েও শক্তিশালী, এমনকি জার্মানির থেকেও। কিন্তু ফুটবলে জিততে গেলে একটি দল হয়ে দাঁড়াতে হয়, যেখানে একে অন্যের জন্য আত্মত্যাগ করবে। ফ্রান্স এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে কি? শুধু প্রতিভার ছড়াছড়ি বিশ্বকাপ জেতাতে পারে না। একঘরে দশজন গবেষক ছেড়ে দিলেই তারা বড় আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন না। দরকার টিম-ওয়ার্ক। আর এটাই ফ্রান্সের বিশ্বকাপ যাত্রার ভাগ্য গড়ে দেবে। পারবে কি ফ্রান্স একটি দল হয়ে দাঁড়িয়ে ১৯৯৮ এর পর প্রথম সোনালি ট্রফিটি ঘরে তুলতে? নাকি অমিত প্রতিভার দারুণ অপচয়ের রাশি রাশি উদাহরণের আরেকটি হবে তারা?
ফিচার ছবিসত্ত্ব: publimetro.com.mx