শূন্য থেকেই শুরু, শূন্যতেই শেষ। দারুণ প্রচলিত একটি কথা। কথাটা যেমন সত্যি, তেমনই অদ্ভুত। শূন্য সংখ্যাটি গণিতবিদদের কাছে আনন্দ ও রহস্যের খোরাক। আবার শূন্য রানে সাজঘরে ফেরার মতো লজ্জাজনক অভিজ্ঞতা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য আর হতে পারে না। ব্যাটসম্যানকে যতই লজ্জার মুখে ফেলে দিক না কেন, শূন্য রান কিন্তু ব্যাটসম্যানদের পিছু ছাড়তে চায় না কোনোভাবেই।
কোনো ব্যাটসম্যান ক্রিকেটে যখন শূন্য রানে আউট হন, তখন সেই স্কোরটিকে বলা হয় ‘ডাক’। তবে সেটা ঠিক উৎপত্তির শুরু থেকেই ডাক ছিল না। শুরুর দিকে একে বলা হতো ‘ডাকস এগ’। তা নাহয় গেল, কিন্তু ক্রিকেটের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঠিক কোথায়? তা জানতে হলে উলটাতে হবে ইতিহাসের পাতা।
ডাক! এলুম আমি কোথা থেকে?
অদ্ভুত এই নামকরণটির পেছনে রয়েছে বেশ মজার একটি গল্প। শুরুটা ছিল সেই ১৮৬৬ সালের ১৭ জুলাই। টেস্ট ক্রিকেট পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেনি তখনও। প্রিন্স অব ওয়েলস (যিনি পরবর্তীতে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত হন) একদিন শখ করলেন, ক্রিকেট খেলবেন। ব্যাটিংয়ে নামলেন বটে, তবে তাতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। রানের খাতা খোলার আগেই পাড়ি জমালেন সাজঘরে।
বিপদে পড়লো তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো। যুবরাজের ফেলটু মারার খবরটা তো আর সোজাসুজি লিখে দেওয়া চলে না! তখন দারুণ একটি লাইন দিয়ে গোটা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হলো, “The prince had retired to the royal pavilion on a duck’s egg.” ডাকস এগ শব্দগুচ্ছের অবতারণার কারণ মূলত হংসডিম্বের সঙ্গে শূন্যের বাহ্যিক সাদৃশ্য। ব্যস! সাপও মরলো, অথচ লাঠিও অক্ষত রয়ে গেল। সাথে ক্রিকেট ইতিহাসেও ঘটে গেল নীরব এক অধ্যায়। ইতিহাসের পাতায় ‘ডাকস এগ’ শব্দজোড়া অবিস্মরণীয় এক জায়গা পেয়ে গেল। দিন যত গিয়েছে, মানুষ তত ছুটেছে সংক্ষিপ্ততার পথে। ক্রিকেটই বা ছুটে চলায় পেছনে থাকবে কেন? হংসডিম্ব তাই আর হংসডিম্ব রইলো না, ডিম ফুটে আস্ত একটা হাঁস হয়ে উঠলো। ‘ডাকস এগ’ হয়ে উঠল শুধুই ‘ডাক’!
টেস্ট ক্রিকেট প্রথমবারের মতো ডাকের দেখা পায় ১৮৭৭ সালের মার্চে। ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে খেলতে নেমে অজি বোলার জেমস লিলিহোয়াইটের বলে অ্যান্ড্রু গ্রিনউডের হাতে লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিয়ে প্রথমবারের মতো সে অভিজ্ঞতা লাভ করেন বিখ্যাত গ্রেগরি পরিবারের অন্যতম সদস্য নেড গ্রেগরি। নিশ্চয় সে অভিজ্ঞতায় বিন্দুমাত্র স্বস্তি পাননি নেড!
ডাক বৈচিত্র্য
ক্রিকেটে ডাক বলতে শূন্য বোঝালেও সে শূন্যেরও রকমফের আছে! শুধু রকমফের বললেও তাতে কিছুটা কম বলা হয়। রীতিমতো বৈচিত্র্যময় নামও রয়েছে নানারকম ডাক-এর জন্য। অঞ্চলভেদে এর ব্যবহার পরিবর্তিত হয়। এমনই কিছু ডাক বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করা হলো এখানে।
গোল্ডেন ডাক
সোনার ডিম পাড়া হাঁসের সঙ্গে বিশেষ সাদৃশ্য নেই, এমনকি পোলিশ রূপকথার সঙ্গেও কোনো যোগসাজশ নেই। বরং সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেটীয় পরিভাষাতেই যেন এটা সবচেয়ে মানানসই হয়ে উঠেছে। কোনো ব্যাটসম্যান যদি একটি ইনিংসে নিজের মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই কোনো রান না করে সাজঘরে ফিরে যায়, তাহলে এমন ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে গোল্ডেন ডাক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ডাক রীতিমতো বিব্রতকর এবং হৃদয়বিদারক হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর মূল কারণ থাকে স্নায়বিক চাপ এবং উদ্বিগ্নতা। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে দলের জন্য চালিয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটসম্যান বাধ্য হয়েই উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেন, সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
গোল্ডেন ডাকে সিদ্ধহস্ত ছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন, টেস্টে ১৪টি গোল্ডেন ডাক নিয়ে উইকেটের পাশাপাশি এদিকেও রয়েছেন সবার চেয়ে এগিয়ে।
ডায়মন্ড ডাক
যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতা এই ডায়মন্ড ডাক। কোনো বলের মুখোমুখি না হয়েই যদি ব্যাটসম্যান আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তাহলে তাকে বলা হয় ডায়মন্ড ডাক। কিন্তু কোনো বল না খেলেই কীভাবে আউট হতে পারেন ব্যাটসম্যান? দু’টি উপায়ে এ ঘটনা ঘটতে পারে-
- নন-স্ট্রাইকিং প্রান্ত থেকে কোনো বলের মুখোমুখি হবার আগেই ব্যাটসম্যানের রান আউট হয়ে যাওয়া।
- কোনো বল খেলার আগেই ওয়াইড ডেলিভারিতে রান আউট কিংবা স্ট্যাম্পড হলেও তা ডায়মন্ড ডাক হিসেবেই অভিহিত করা হয়।
১৯৯১ সালের পর থেকে আজ অবধি টেস্ট ক্রিকেটে সাকুল্যে ১৭ জন ব্যাটসম্যান এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন। এই দুর্ভাগাদের তালিকার সর্বশেষ ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন। ভারতের বিপক্ষে ২০১৫ সালের ফতুল্লা টেস্টে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে কোনো বলের মুখোমুখি না হয়েই সাজঘরে ফিরে যান জুবায়ের। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ডায়মন্ড ডাকের সংখ্যা টেস্ট ক্রিকেটের সংখ্যার তুলনায় মোটামুটি বেশিই। এ ফরম্যাটে এখন অবধি ১৪০টি নিদর্শন রয়েছে ডায়মন্ড ডাকের। এদের মাঝে বাংলাদেশেরই আছে সাত জন। ১৯৯৯ সালে আকরাম খান এই ক্লাবে প্রথম যোগদান করেন। তারপর একে একে এ তালিকায় প্রবেশ করেন হাবিবুল বাশার, নাইমুর রহমান দুর্জয়, এনামুল হক জুনিয়র, জুনায়েদ ইমরোজ সিদ্দীকী, নাঈম ইসলাম এবং মমিনুল হক।
ওয়ানডেতে সর্বশেষ এই ‘অর্জন’ জিম্বাবুয়ের পিটার মুরের, গত ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এ তালিকাতে সর্বশেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম তোলেন তিনি।
সিলভার ডাক
কোনো ইনিংসের দ্বিতীয় বলে কোনো ব্যাটসম্যান শূন্য রানে আউট হয়ে গেলে তাকে সিলভার ডাক বলা হয়ে থাকে। এটি গোল্ডেন ডাক কিংবা ডায়মন্ড ডাকের মতো এতটা প্রচলিত কিংবা জনপ্রিয় নয়। তবে নাম প্রচলিত না হলেও এ তালিকায় নাম তোলা ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়!
ব্রোঞ্জ ডাক
কোনো ইনিংসের তৃতীয় বলেই কোনো ব্যাটসম্যান শূন্য রানে আউট হয়ে গেলে তাকে ব্রোঞ্জ ডাক বলা হয়ে থাকে। এ নামটিও গোল্ডেন ডাক কিংবা ডায়মন্ড ডাকের মতো এতটা প্রচলিত কিংবা জনপ্রিয় নয়।
রয়্যাল বা প্ল্যাটিনাম ডাক
এর সঙ্গে বহুলাংশে মিল রয়েছে গোল্ডেন ডাকের। যখন কোনো ব্যাটসম্যান ম্যাচের প্রথম বলে কিংবা ইনিংসের প্রথম বলে রানের খাতা না খুলতেই ফিরে যেতে বাধ্য হন, তবে এ ধরনের ডাককে বলা হয় রয়্যাল বা প্লাটিনাম ডাক। গোল্ডেন ডাকের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য মূলত এখানে, রয়্যাল বা প্লাটিনাম ডাক বলা হয় তখনই, যখন ম্যাচের বা ইনিংসের নতুন বলে এ ঘটনাটি ঘটে।
পেয়ার এবং কিং পেয়ার
দুই ইনিংসে জোড়া সেঞ্চুরি যেমন কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য স্বপ্নীল এক অভিজ্ঞতা, তেমনই দুই ইনিংসে দুই শূন্যও রীতিমতো দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। যখন কোনো ব্যাটসম্যান টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য রানে সাজঘরে ফিরতে বাধ্য হন, এমন ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, ব্যাটসম্যান ‘পেয়ার’ পেয়েছেন। কিন্তু দুঃস্বপ্ন তার চূড়ান্ত সীমা ছুঁয়ে ফেলে, যখন দুই ইনিংসেই ব্যাটসম্যান প্রথম বলেই আউট হয়ে যান রানের খাতায় শূন্য রেখেই। ব্যাটসম্যানের জন্য যেন এটা রাজকীয় লজ্জা, তাই ক্রিকেটীয় পরিভাষায় এর নাম কিং পেয়ার। এ কীর্তি শেষবারের মতো গড়েছেন শ্রীলঙ্কার নুয়ান প্রদীপ, তিনি এ তালিকায় বিংশতম ক্রিকেটার। বাংলাদেশের জাভেদ ওমর বেলিমও এ লজ্জা পেয়েছেন একবার, ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ সালে দুই ইনিংসেই শূন্য মেরেছিলেন তিনি।
দুটো শূন্যকে যখন পাশাপাশি বসানো হয়, সেটা দেখতে অনেকটা চশমার মতো দেখায়। আর এ চিন্তা থেকেই ‘পেয়ার’ নামের ব্যুৎপত্তি। ১৮৮০ সালে ওভাল টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে ফ্রেড গ্রেস প্রথমবারের মতো এ ‘কীর্তি’ গড়েন। এরপর নিউ জিল্যান্ডের ক্রিস মার্টিন তো এই কাণ্ডকে রীতিমতো শিল্পে পরিণত করেছিলেন। সাতবার টেস্টের দুই ইনিংসেই কোনো রান না করে সাজঘরে ফিরেছেন তিনি। চারটি করে পেয়ার নিয়ে এ তালিকায় এরপরের অবস্থানে আছেন পাঁচজন- শ্রীলঙ্কার মারাভান আতাপাত্তু ও মুরালিধরন, ভারতের চন্দ্রশেখর, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারভিন ডিলন ও কোর্টনি ওয়ালশ। পরের চারজনেরই মূল পরিচয় বোলার হলেও উল্টোদিকে আছেন আতাপাত্তু। ক্যারিয়ারের প্রথম ছয় ইনিংসে রান করতে পেরেছিলেন একটিমাত্র, তাতেই পকেটে ঢুকে গিয়েছিলো দুটো পেয়ার। এরপর লম্বা ক্যারিয়ারে আরও দুটো জোড়া শূন্য নিয়ে এ তালিকায় ঢুকে গেছেন চিরকালের জন্য।
এখন অবধি ৪২ জন ক্রিকেটার ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই পেয়ার-এর স্বাদ পেয়েছেন। এ তালিকায় বাংলাদেশের কামরুল ইসলাম রাব্বী সর্বশেষ সংযোজন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে তিনি দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হন।
আনঅফিসিয়াল পেয়ার
এবার ভাবুন, টি-টোয়েন্টিতে পেয়ার পাওয়া সম্ভব কিনা? না না, অবাক হবার কিছু নেই। সেটা কেবল সম্ভব তা-ই নয়, দুজন তো রীতিমতো তা করেও দেখিয়েছেন। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে অধুনা প্রচলিত হয়েছে সুপার ওভার। কোনো ম্যাচ যদি টাই হয়, তবে টাইব্রেকার হিসেবে ম্যাচটি সুপার ওভারে গড়ায়। কোনো ব্যাটসম্যান যদি ম্যাচের পাশাপাশি সুপার ওভারেও ‘গোল্লা মেরে’ ফিরে যান, তবে সে আউটকে বলা হয় আনঅফিসিয়াল পেয়ার। ঠিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে না হলেও দুবার এ নিদর্শনের সাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট। দুজনই বিশ্ব ক্রিকেটে বেশ পরিচিত মুখ। ২০১৩ সালে হাবিব ব্যাংক লিমিটেডের বিপক্ষে খেলতে নেমে প্রথমবারের মতো এ কীর্তি গড়েন পাকিস্তানের শোয়েব মালিক, এরপর ২০১৪ সালে সিডনি সিক্সার্সের হয়ে শোয়েবের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন মোজেইজ হেনরিকস।
অনেক প্রকার ডাকের কথা শুনলাম এতক্ষণে। তবে সব থেকে জনপ্রিয় ডাকখানা কোনটা বলুন তো? ঠিক ধরেছেন, স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্টের সেই ‘মহাকাব্যিক’ শূন্য প্রাপ্তির ঘটনাকে অতিক্রম করার সাধ্য আর কারই বা আছে!
Featured Image Credit : Indiatvnews.com