ক্রিকেট জগতে বাংলাদেশের বিচরণ খুব দীর্ঘ দিনের নয়। টেস্ট ক্রিকেটে সবেমাত্র যুবক হয়েছে বাংলাদেশ, সেদিন মাত্র ১৮ বছর হলো। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ওয়ানডেতে বর্তমানে বেশ শক্তিশালী বাংলাদেশ দল, সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত টেস্ট জিতছে ঘরের মাঠেও। আর এই সময়ের আবর্তে বাংলাদেশ দল এবং এই দলের খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কয়েকটি রেকর্ড নিজেদের করে নিয়েছেন। ক্রিকট্র্যাকারের সৌজন্যে আজ আপনাদের জানানো হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ৬টি রেকর্ডের কথা।
উইকেটরক্ষক হিসেবে টেস্টে দুটি দ্বিশতক
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি মুশফিকুর রহিম করেছিলেন ২০১৩ সালে, শ্রীলংকার বিপক্ষে গলে। এরপর ২০১৫ সালে খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে তামিম ইকবাল ২০৬ ও ২০১৭ সালে ওয়েলিংটনে সাকিব ২১৭ রানের দুটি দ্বিশতক হাঁকান। তবে এই বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে নিজের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেন মুশফিকুর রহিম, অপরাজিত থাকেন ২১৯ রানে। জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংসে কিপিং করতে নেমেই অনন্য এক রেকর্ডের মালিক হয়ে যান তিনি।
টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে সাতজন কিপার-ব্যাটসম্যান দ্বিশতক হাকিয়েছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই তা একবারের বেশি করতে পারেননি। কুমার সাঙ্গাকারা তার ১২টি ডাবল সেঞ্চুরির মাত্র একটি করেছিলেন উইকেটরক্ষক হিসেবে। জিম্বাবুয়ের কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে দুর্ভাগা বলতেই হবে, একবার তিনি অপরাজিত ছিলেন ১৯৯ রানে! তাই জিম্বাবুয়ের সাথে ২০০ রান ছোঁয়ার সাথে সাথেই মুশফিকুর রহিম পৌঁছে যান নতুন এক চূড়ায়, যেখানে আগে পৌঁছাননি কেউই।
অলরাউন্ডারদের দ্রুততম ডাবল
এই প্রজন্মের সেরা অলরাউন্ডারের কথা যদি বলতে হয়, তবে বলতে হবে সাকিব আল হাসানের কথাই। তবে শুধু এই প্রজন্ম হন, সাকিব আল হাসান নিজেকে সময়ের গন্ডি পেরিয়ে নিয়ে গেছেন মহাকালের খাতায়, তার নাম উঠে গেছে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট্ট তালিকায়। এই তালিকায় নাম ওঠানোর পথে সাকিব করেছেন একের পর এক রেকর্ড, নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেট ক্লাবের মাত্র তৃতীয় সদস্য সাকিব, বাকি দুজনের নাম জ্যাক ক্যালিস ও শহীদ আফ্রিদি। তবে তিনজনের মধ্যে দ্রুততম সময়ে এই ক্লাবে প্রবেশ করেছেন সাকিবই, তার লেগেছে মাত্র ৩০২ ম্যাচ, যেখানে ক্যালিস ও আফ্রিদির লেগেছিলো যথাক্রমে ৪২০ ও ৪৭৭ ম্যাচ।
আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ৫,০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ক্লাবে সাকিব প্রবেশ করেন ৫ম ক্রিকেটার হিসেবে, কিন্তু এখানেও তিনি দ্রুততম। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জ্যাক ক্যালিসের লেগেছিলো ২২১ ম্যাচ, যেখানে সাকিব এই ডাবল করেন মাত্র ১৭৮ ম্যাচে।
টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ১৪ জন ক্রিকেটার ৩,০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবল সম্পন্ন করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন স্যার গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, ইমরান খানের মতো কিংবদন্তিরা। উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে এই ক্লাবের চতুর্দশ সদস্য হিসেবে প্রবেশ করেন সাকিব আল হাসান। এখানেও তিনি দ্রুততম, মাত্র ৫৪ টেস্টে এই ডাবল অর্জন করে তিনি ভেঙে দিয়েছেন ইয়ান বোথামের ৫৫ টেস্টে করা রেকর্ড।
মিরপুর দুর্গ
সাম্প্রতিক সময়ে অন্য দলগুলোর জ্ন্য মিরপুর যেন বধ্যভূমি, এই মাঠে রীতিমতো ত্রাস ছড়ায় বাংলাদেশ দল। বাংলাদেশ দল যে ফরম্যাটে সবচেয়ে সফল, সেই ওয়ানডের কথা বাদ দিলেও, মিরপুরে টেস্ট ম্যাচেও বাংলাদেশকে হারানো দুরূহ কাজ। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয় দুটি এই মাঠেই। তবে শুধু দলের জন্য নয়, খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, মিরপুর বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের জন্য পয়মন্ত।
তিন ফরম্যাট মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাঠে সর্বোচ্চ রান করার রেকর্ডটি সাকিব আল হাসানের, শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামে বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের রান ৪,০৭৫। ৪,০০০ রান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন তামিম ইকবাল, তৃতীয় স্থানে থাকা মুশফিকুর রহিমের রান ৩,৬৯৭।
ওয়ানডেতে এক মাঠে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি অবশ্য খান সাহেবের, মিরপুরে তিনি রান করেছেন ২,৬১৯। এই রেকর্ডের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন সাকিব আল হাসান, তার রান ২,৪৭২। ২,৩৫১ রান নিয়ে পঞ্চম স্থানে আছেন মুশফিকুর রহিম।
তিন ফরম্যাট মিলিয়ে কোনো নির্দিষ্ট স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটিও সাকিব আল হাসানের দখলে। মিরপুরে সাকিব এখন পর্যন্ত শিকার করেছেন ১৯১টি উইকেট, দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুত্তিয়াহ মুরালিধরন কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে শিকার করেছেন ১৮৮টি উইকেট।
ওয়ানডেতে একটি নির্দিষ্ট মাঠে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের তালিকায় মিরপুরে ১১৩ উইকেট নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে সাকিব আল হাসান। প্রথম দুটি স্থানে আছেন ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস; যথাক্রমে ১২২ ও ১১৪ উইকেট নিয়ে।
সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান
মোহাম্মদ আশরাফুলের ক্যারিয়ারে পরে যদিও ফিক্সিং কলঙ্কের দাগ লেগেছে, দীর্ঘদিন তিনিই ছিলেন এই দেশের ভক্ত-সমর্থকদের চোখের মণি। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেই স্মরণীয় জয়, কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা বধ, আশরাফুলের অবদান ছিলো দুই ম্যাচেই। তবে আশরাফুলের নাম রেকর্ডবুকে থাকবে অন্য একটি কারণে।
২০০১ সালের এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলংকার সাথে ম্যাচে অভিষেক হয় আশরাফুলের। সেই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ২১২ বলে ১১৪ রানের অসাধারণ একটি ইনিংস খেলেন তিনি, যদিও সেটা বাংলাদেশকে ইনিংস পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। তবে এই সেঞ্চুরিতেই রেকর্ডবুকে নাম উঠে যায় আশরাফুলের।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানের মুশতাক মোহাম্মদ ১৭ বছর ৮২ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছিলেন। শ্রীলংকার বিপক্ষে সেঞ্চুরির সময় আশরাফুলের বয়স ছিলো ১৭ বছর ৬৩ দিন, আর এতেই মুশতাক মোহাম্মদকে টপকে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের খেতাব বাগিয়ে নেন তিনি।
দুরন্ত ফিজের উড়ন্ত শুরু
২০১৫ সালটা দুর্দান্ত কাটিয়েছিলো বাংলাদেশ দল। বছরের শুরুতেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, এরপর ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ। আর ভারতের সাথে ও্যানডে সিরিজে পুরো বিশ্ব থমকে গেলো ২০ বছর বয়সী এক তরুণের বাম হাতের ভেল্কিতে, তরুণের নাম মুস্তাফিজুর রহমান। ওয়ানডে অভিষেকেই মুস্তাফিজ বাগিয়ে নেন ৫ উইকেট, পরের ম্যাচে তিনি আরেক কাঠি সরেস, তুলে নিলেন ৬ উইকেট। ভারতের বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপকে একাই ধসিয়ে দিয়ে সিরিজ শেষ করলেন ১৩ উইকেট নিয়ে, প্রথম দুই ম্যাচে ম্যাচসেরার পুরষ্কারের সাথে হাতিয়ে নিলেন সিরিজ সেরার ট্রফিটাও।
মাসখানেক পর সাউথ আফ্রিকার সাথে টেস্ট সিরিজে লাল বলে অভিষেক হয় ‘দ্য ফিজ’ এর, ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম ইনিংসে এনে দেন লিড। বৃষ্টিতে সেই ম্যাচ পরিত্যক্ত হলেও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন মুস্তাফিজ, আর সাথে নিজের করে নেন একটি অনন্য রেকর্ড, ক্রিকেট ইতিহাসে টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া প্রথম ক্রিকেটার বনে যান মুস্তাফিজ।
এখন পর্যন্ত এই রেকর্ডে কেউ ভাগ বসাননি, তবে টি২০ ও টেস্ট অভিষেকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়ার রেকর্ড করেছেন দুজন, দক্ষিণ আফ্রিকান লুঙ্গি এনগিডি ও বাংলাদেশি ইলিয়াস সানি। তবে এই দুজনের মধ্যে ইলিয়াস সানি প্রথমজন, যিনি ভিন্ন দুটি ফরম্যাটে অভিষেকেই ম্যাচসেরা হয়েছেন।
কৈশোরেই বাজিমাত
কিছুদিন আগে শেষ হওয়া উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে অভিষেক হয় অফ স্পিনার নাইম হাসানের। অভিষেকেই তাক লাগিয়ে দেন, ৬১ রানে তুলে নেন ৫ উইকেট। আর এতেই টেস্ট ক্রিকেটের ১৪১ বছরের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ৫ উইকেট শিকারী হয়ে যান নাইম। এই ৫ উইকেট শিকারের সময় তার বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর ৩৫৬ দিন। রেকর্ডটি এর আগে ছিলো অজি ফাস্ট বোলার প্যাট কামিন্সের। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে টেস্ট অভিষেকে যখন ৬ উইকেট নেন কামিন্স তখন তার বয়স ছিলো ১৮ বছর ১৫৬ দিন।