গত মৌসুমে অবিশ্বাস্য একটা সময় কাটিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। দলের মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইন বলছেন, এমন সময় ভবিষ্যতেও আর কখনো আসবে কি না, সন্দেহ আছে।
২০১৭-১৮ মৌসুমে সিটি শুধু শিরোপা জিতেছে, তা নয়। তারা অনেকগুলো রেকর্ড নিজেদের করে নিয়েছে। প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগের কোনো দল হিসেবে ১০০ পয়েন্টে পৌঁছেছে, ৩২ ম্যাচ জিতেছে এবং ১০৬টি গোল করেছে।
২০১৫ সালে সিটিতে যোগ দেওয়া ২৭ বছর বয়সী ডি ব্রুইন বলছিলেন, “গত বছরটা ছিলো প্রায় নিখুঁত একটা বছর। আমরা যদি মৌসুমের শেষ দিনে শেষ শটের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন হতাম, তা-ও আমি একইরকম খুশি হতাম।”
সিটির এই অবিশ্বাস্য যাত্রা নিয়ে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও তৈরি করেছে একটা প্রামাণ্যচিত্র- অল অর নাথিং। গত ১৭ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রটি। বিসিবির সাথে মূলত এই প্রামান্যচিত্র, পেপ গার্দিওলার কোচিং, নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেছেন ডি ব্রুইন।
“যতোটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি”
সিটি গতবছর অ্যামাজনের সাথে ১০ মিলিয়ন পাউন্ডে এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য চুক্তি করেছে। তারাই প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ক্লাব, যারা এত গভীর একটি প্রামাণ্যচিত্র ক্লাব নিয়ে বানানোর অনুমতি দিয়েছে। এখানে আট ঘন্টার কয়েকটি পর্ব থাকবে। অ্যামাজন এর আগে এএফএলের কয়েকটি দল, নিউজিল্যান্ডের অল ব্ল্যাকসকে নিয়েও এরকম প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে।
এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য সিটি খেলোয়াড়দের ক্যামেরা অনুসরণ করেছে খেলা ও খেলার বাইরে; এমনকি খেলার বিরতিতেও চলেছে শুটিং।
সেই শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডি ব্রুইন বলছিলেন, “শুরুর দিকে এটা একটু বেখাপ্পা মনে হতো। আমরা অনেক ক্যামেরার চোখের সামনে খেলে অভ্যস্ত। কিন্তু সেটা তো মূলত মাঠের ব্যাপার। কিন্তু পেছনে কী হয়, ট্রেনিংয়ে কী হয়- এগুলো সিটির কিছু নিজস্ব স্টাফ ছাড়া কেউ কখনো ভিডিও করে না। শুরুতে এটা একটু অদ্ভূতুড়ে মনে হয়েছে। কারণ, যাদের সাথে কাজ করছি, এদের আমরা ঠিকমতো চিনতাম না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা ভুলে গেছি যে, ওরা ওখানে আছে। প্রতিদিন ওরা ওখানে থাকতো। একসময় ওদের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। আর ওরা আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো।”
“এই অনুষ্ঠানে আমাদের দেখাতে হয়েছে, যতটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি ঘটনা। ভালো ব্যাপার, খারাপ ব্যাপার, হয়তো কিছু ঘটনা- যা-ই হোক না কেন। কারো জীবনই তো নিখুঁত না।”
“আমরা এক সুরে বাঁধা”
এই প্রামাণ্যচিত্র সিরিজের ট্রেলারে দেখানো হয়েছে, গার্দিওলা তার খেলোয়াড়দের কাছে প্রতিটি ট্রেনিং সেশনে জয়ের ক্ষুধা দেখানোর তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, যদি তাকে ঘৃণা করে কেউ ভালো খেলোয়াড় হতে পারে, প্রয়োজনে তা-ই করতে হবে।
ডি ব্রুইন বলছিলেন, তিনি সাবেক বার্সেলোনা ও বায়ার্ন মিউনিখ কোচের সাথে তর্ক করতে কখনো ভয় পান না, “সবার সাথে পেপ-এর ভিন্ন একটা সম্পর্ক আছে। আমি ভাগ্যবান যে, সে ইতিমধ্যে যে ঘরানার ফুটবল খেলিয়েছে, আমি সেই ধরনের ফুটবল খেলতে পছন্দ করি। ফলে আমার জন্য এই অন্তবর্তীকালীন সময়টা সহজ ছিলো; অনেক সহজাত ছিলো।”
“আমি এভাবেই ফুটবল খেলতে পছন্দ করি। আমরা একই সুরে বাঁধা। শেষ অবধি এটা অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার। কিন্তু তার সাথে মজাটা থাকলে কাজ আনন্দের হয়। পেপ খুব একাগ্রতা পছন্দ করে।”
“কখনো কখনো শেষ অবধি ওর কাছ থেকে অতিরিক্ত তথ্য পেয়েছি আমরা। কিন্তু সবার জীবনেই আসলে কাজের মধ্যে থাকলে এটা ঘটে। আমরা ভালো মানিয়ে নিয়েছি।”
(পেপের সাথে তর্ক করেছেন কি না)
“প্রয়োজন হলে অবশ্যই করবো। কিন্তু সত্যিটা হলো, এখন অবধি সেটা খুব বেশি ঘটেনি। কারণ, আমরা একটা বা দুটো বিষয়ে হয়তো দ্বিমত পোষণ করি। সেটা আলোচনায় সমাধান হয়ে যায়। ফুটবলে সবার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আর আমি সৌভাগ্যবান যে, বেশিরভাগ সময় আমি তার মতো চিন্তা করি। ফলে আমার জন্য সহজ হয়েছে ব্যাপারটা।”
“আপনাকে তার প্রতি চিৎকার করতে হবে না। আমরা প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ, আমরা দুজনই ওখানে এক হয়েছি দলের জয়ের জন্য। আপনি যদি তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, আপনি কী ভাবছেন, তাহলে কোনো সমস্যা তো হবে না।”
“আমি জন্মেছি নেতা হওয়ার জন্য”
প্রামাণ্যচিত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ভিনসেন্ট কোম্পানি ও ডি ব্রুইন ড্রেসিংরুমে খুব উচ্চকন্ঠ নেতা। উইগানের সাথে এফএ কাপে হারের ম্যাচে লিওরি শেনকে একপাশে নিয়ে ডি ব্রুইন বোঝাচ্ছিলেন, কেন তাকে গার্দিওলা মাঠ থেকে তুলে নিয়েছেন।
সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডি ব্রুইন বলছিলেন, “সেই সময়ে শেন ওকে তুলে নেওয়ায় বেশ ক্ষুব্ধ ছিলো। আমার মনে আছে, ও রাগটা একটু প্রকাশও করেছিলো এবং পেপ এটাতে খুশি ছিলো না। আমি ওকে বলেছিলাম, “এটা ঠিক আছে। তুমি খারাপ বলে তোমাকে তুলে নেওয়া হয়নি। এটা আসলে একটা ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত। তুমি এর পরেও অনেক ম্যাচ খেলবে। ফলে রাগটা বেশি দেখিও না।” কখনো কখনো কোনো কোনো কোচ এটা (রাগ প্রকাশ করা) খুব খারাপভাবে নেয়। আমি যখন আরও ছোট ছিলাম, তখন এটা করেছি। আমি লিওরিকে বলেছি, সে আরও ৩০-৪০টা ম্যাচ খেলবে এবং আমাদের হয়ে অনেক ম্যাচ জিতবে।”
“আমি এর মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছি; একজন নেতা হওয়ার জন্য। আমি যখন এখানে এসেছিলাম, তখন আমি এখনকার মতো ছিলাম না। তখন আমার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম ছিলো না। আমি জার্মানি থেকে এসেছি। আমি এর আগে ইংল্যান্ডে কখনো সাফল্য পাইনি।”
“আপনি যখন ভালো করবেন, কঠোর ট্রেনিং করবেন, কঠোর পরিশ্রম করবেন, আপনি মাঠে এমনিতেই বেশি নেতৃত্ব পেতে থাকবেন। আমি আমার শক্তিতে সর্বোচ্চ যা সম্ভব হয়, তার সবকিছুই ম্যাচ জেতার জন্য করি। আমি ভিনির (কোম্পানি) চেয়ে ভারমুক্ত থাকি। কিন্তু ম্যাচ জেতার জন্য সবকিছু করি।”
“কোচ হওয়াটা একটা নিষ্ঠুর কাজ”
বেলজিয়ামকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তোলায় ডি ব্রুইন একটা বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তিনি কি কোচ হবেন?
ডি ব্রুইন বলছিলেন, “আমি জানি না। আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। কখনো মনে হয়েছে, আমি পারবো। কখনো মনে হয়েছে, পারবো না। এটা (কোচিং করানো) খেলোয়াড়দের এই জীবনের মতোই। সবসময় পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়।”
“ভাগ্য ভালো যে, আমার এখনও ক্যারিয়ারের ওই অবস্থায় যেতে দেরি আছে। যত বয়স বাড়বে, তত বেশি ওটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। ভাবতে হবে, পরের জীবনে কী করবো, ফুটবলের পর কী করবো। কিন্তু আমি এখনও সাত বা আট বছর ভালো মানের ফুটবল খেলে যাওয়ার আশা করছি।”
“আমি মনে করি, এটা (কোচিং) নিষ্ঠুর কাজ। আপনি যখন বস হবেন, আপনাকে কাউকে কাউকে হতাশ করতে হবে, কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনাকে সেটার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।”
“একজন খেলোয়াড় হিসেবে আপনাকে সবসময় কোচের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। কিন্তু সেই সাথে সবসময় একটা দূরত্বও থাকে। কারণ, সে বস এবং সে ঠিক করবে, আপনি খেলবেন কি না। ফলে এটা নিষ্ঠুর।”
“আমাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে হবে না”
আবুধাবির ইউনাইটেড গ্রুপ সিটি কিনে নেওয়ার পর গত দশ বছরে সিটি তিন বার প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে সেমিফাইনাল পার করতে পারেনি। গত বছর ১৯ পয়েন্ট ব্যবধানে প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে তারা। কিন্তু সেই লিগেরই লিভারপুলের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে ৫-১ গোলে হেরেছে তারা। অনেকেই মনে করেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিতলে গ্রেট দল হতে পারছে না সিটি।
ডি ব্রুইন অবশ্য তা মনে করেন না, “আমি মনে করি না যে, আমাদের সফল হতে গেলে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে হবে। ওটা বড় একটা শিরোপা। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে আপনার প্রিমিয়ার লিগের মতো ধারাবাহিকতা দরকার হয় না।”
“আমরা সারা বছর দারুন ছিলাম। শুধু লিভারপুলের বিপক্ষে একটু কম ভালো খেলেছি এবং তাতেই বাদ পড়ে গেছি। এটা এমন একটা টুর্নামেন্ট, যেখানে আপনাকে সঠিক সময়ে ভালো খেলতে হবে।”