ফিলিপে কৌতিনহোর লিভারপুল থেকে বার্সেলোনার আসা নিয়ে কম নাটক হয়নি। টানা তিনবারের চেষ্টার পর বার্সেলোনা তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফির বিনিমিয়ে কৌতিনহোকে দলে ভেড়ায়। কৌতিনহোর বার্সেলোনা আসার খবর রটাতেই ফুটবলবিশ্বের বোদ্ধারা সম্পূর্ণ দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। একভাগের মতামত ছিলো- কৌতিনহো বার্সেলোনার ফুটবলের সাথে মানানসই না, এবং অপর ভাগের মন্তব্য ছিলো- বৃহৎ অঙ্কের ট্রান্সফার ফি খরচ হলেও এই ব্রাজিলিয়ান বার্সেলোনার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন।
বার্সেলোনার ক্রীড়া সম্পাদক রবার্ট ফার্নান্দেজ কৌতিনহোকে আনার সময় বলা হয়েছিলো, বার্সেলোনা তাকে দলে নিচ্ছে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার শূন্যস্থানে। কিন্তু একজন সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে বার্সেলোনা কোন যুক্তিতে ইনিয়েস্তার মতো খেলোয়াড়ের স্থানে আনে, তা অনেকের কাছেই বোধ্যগম্য ছিলো না। ২০১৮ এর শীতকালীন ট্রান্সফার মৌসুমে দলে আসার কারণে সে বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সেলোনার হয়ে খেলতে পারেননি কৌতিনহো। বার্সেলোনার হয়ে তখন খেলেছেন কোপা দেল রে ও লিগের ম্যাচগুলোতে। গত মৌসুমের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে নেইমারের স্থানে আনা উইংগার উসমান দেমবেলে ইনজুরিতে ছিলেন। তাই আর্নেস্তো ভালভার্দে প্রায় সময় ব্যবহার করতেন ৪-৪-২ ফর্মেশন। ইনিয়েস্তা তখনও কাতালানদের সাথে। তাই কৌতিনহোর সৌভাগ্য হয়েছিলো তার পাশে খেলার। এমনকি বার্সেলোনার হয়ে প্রথম মৌসুমে তার পারফর্মেন্স দেখে অনেকেই ভেবেছিলো, ইনিয়েস্তার পজিশনে হোক আর না হোক, ১৬০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে তাকে কেনা বৃথা যায়নি।
কৌতিনহো বার্সেলোনার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন হাভিয়ের মাশ্চেরানোর রেখে যাওয়া ইয়োহান ক্রুয়েফের ঐতিহাসিক ‘১৪’ নম্বর জার্সি পরে। কিন্তু এ মৌসুমের নিলেন আর্দা তুরানের রেখে যাওয়া ‘৭’ নম্বর জার্সি। যে জার্সি নম্বর পরে ডেভিভ ভিয়ার পর আর কেউ সফলতার দেখা পায়নি। ২০১৮/২০১৯ মৌসুমটা তার শুরু হয়েছিলো ছন্নছাড়া অবস্থায়। মাঝে একবার ইনজুরিতে পড়লেন। তারপর ফিরে এসে শুরু হলো অধপতন। যেখানে তার প্রতি ম্যাচে বার্সেলোনার সাথে আরও মানিয়ে নেবার কথা, সেখানে তিনি ক্রমে ক্রমে নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন।
গত মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে কৌতিনহো ২২ ম্যাচে ১০ গোল করেছিলেন। দেমবেলের টানা ইনজুরি ও অফফর্মের কারণে লেফট উইং পজিশনটা নিজের করে নিয়েছিলেন কৌতিনহো। কিন্তু নতুন মৌসুমে তার ছন্নছাড়া ভাব দেখে ভালভার্দে দেমবেলেকে বেশি সুযোগ দিতে থাকলেন। ফরাসি উইংগারও হতাশ করেনি। ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচে যখন কৌতিনহো ইনজুরিতে পড়লেন, দেমবেলে ফিরে পেলেন তার হারানো স্থান। নিজের প্রতিভার দারুণ ঝলকানি তখন দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু তারপর! আবারও ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে মাঠের বাইরে চলে যাবার পর দলে নিয়মিত সুযোগ পেতে থাকলেও বরাবরই হতাশ করেছেন কৌতিনহো। শুধু হতাশ করেছেন বললে ভুল হবে। হতাশ করেই চলছেন। কারণ রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচ অথবা লা লিগার অ্যাটলেটিকো বিলবাওয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ। প্রত্যেক ম্যাচেই তার পারফর্মেন্স হতাশাজনক। শুধুমাত্র তার কারণে বার্সেলোনার সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোয় তাদের বামপ্রান্ত নিস্প্রভ হয়ে থাকছে। বর্তমানে তার বল হারানোর প্রবণতা বেশি, গোলমুখে ঠিকমতো শট নিতে পারছেন না, ড্রিবলিং করতে গিয়ে ভুল করছেন বারবার, আর ভুল পাসের উদাহরণ অহরহ। বর্তমানে মাঠের কৌতিনহোকে দেখলে মনে হবে, ভুল ক্লাবে, ভুল পজিশনে হুট করে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বার্সেলোনাভিত্তিক লেখক রামিও মার্টিনেজ বর্তমান এ পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন,
আমি লেফট-উইং পজিশনে সবসময় দেমবেলেকে দেখতে চাই। কারণে সে একজন সত্যিকারের উইংগার। এটাই মাঠে তার জন্য সঠিক পজিশন। আর কৌতিনহো? সে একজন উইংগারও নয়, আবার মাঝমাঠের খেলোয়াড় নয়। ডেমবেলের সাথেও তার যায় না, ইনিয়েস্তা বা জাভির সাথেও নয়। তার বার্সেলোনাতে সফল হবার সুযোগ খুবই কম।
তিনি আরও বলেছেন,
ইনিয়েস্তার কোনো গুণ তার ভেতর নেই। সে মাঝমাঠের কোনো প্রবর্তক নয়। কৌতিনহো একজন প্লে-মেকার, একজন সত্যিকারের নাম্বার টেন!
বার্সেলোনার প্রস্তাবে কৌতিনহোকে লিভারপুল প্রথমে ছাড়তে চায়নি। কিন্তু ইয়ুর্গেন ক্লপের দলে কৌতিনহোকে কখনও দরকার ছিলো না। তার ট্যাকটিসের সাথে একজন প্লে-মেকার খেলানো বৃথা কাজ। তার দরকার একজন পরিশ্রমী খেলোয়াড়; যেমন- সাদিও মানে এবং একজন টেক্সটবুক মিডফিল্ডার; যেমন- নাবি কেইতা বা জর্জিনো ভাইনালদুম। তবুও কৌতিনহোকে কেন্দ্র করে ক্লপ তার দল সাজিয়েছিলেন। তাকে দিয়েছিলেন ফ্রি রোল। তাই ক্লপ ৪-৩-৩ বা ৪-২-৩-১ যে পজিশনে স্কোয়াড সাজাতেন বা লেফট উইংগার ও লেফট মিডফিল্ডার যে পজিশনেই কৌতিনহো মাঠে নামতেন, খেলা শুরু হবার পর তিনি চলে আসতেন মাঝমাঠে একজন যথাযথ প্লে-মেকারের ভুমিকায়। রক্ষণটা একেবারেই পারেন না তিনি। তাই মধ্যমাঠে একজন যথাযথ নাম্বার নাইনের ভূমিকায় কৌতিনহো সফলতা পেয়েছিলেন লিভারপুলে।
কৌতিনহোর নিয়মিত গোল ও অ্যাসিস্ট এবং নজরকাড়া পারফর্মেন্স দেখে বার্সেলোনা তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়। নেইমারকে বিক্রি করার পর বার্সেলোনা বোর্ডের তখন হাতে প্রচুর অর্থ। তাই একজন তথাকথিত স্টার খেলোয়াড় কেনার লোভ তারা সামলাতে পারেনি। বার্সেলোনা তখন নেইমারকে হারিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করছে। দেমবেলে ইনজুরিতে থাকার কারণে দলে আর কোনো উইংগার নেই। তাই আর্নেস্তো ভালভার্দে ৪-৪-২ ফর্মেশন ব্যবহার করা শুরু করলেন, যেখানে কৌতিনহো খেলতেন মধ্যমাঠের বামপাশে। বামপাশ থেকে নেমে মাঝমাঠে চলে আসার সুযোগ ছিলো, নতুন দলে আত্মবিশ্বাসও ছিলো পরিপূর্ণ। তাই প্রথমে কৌতিনহোর তেমন সমস্যা হয়নি তার স্বভাবগত খেলা খেলতে।
নতুন মৌসুমে ভালভার্দে ফিরে গেলেন পুরনো ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। কৌতিনহো দায়িত্ব পেলেন লেফট উইং সামলানোর দায়িত্ব। লেফট উইং পেলেও, পেলেন না বাম পাশ থেকে সরে এসে প্লে-মেকার হবার ভূমিকা। কারণ সে দায়িত্ব অনেকদিন ধরেই পালন করে আসছেন লিওনেল মেসি। কৌতিনহোও কোনো উইংগার নন। তাকে মাঝমাঠেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ তিনি কোনো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারও নন। তাই কৌতিনহো তার অচেনা একটি পজিশনে বোতলবন্দী হয়ে শুরু করলেন মানিয়ে নেবার যুদ্ধ। যে যুদ্ধে তিনি এখন পর্যন্ত ব্যর্থ।
দিয়ারিও গোলের সাংবাদিক হোয়াকিম পিয়েরার মতে,
বার্সেলোনা যেমন মেসিকে নিয়ে একটি খেলার ধরন তৈরি করেছে, সেটা আবারও কৌতিনহোকে দিয়ে সম্ভব নয়। এ পৃথিবীতে বর্তমানে এমন কোনো কোচ নেই যে একই ঘরনার দুজন খেলোয়াড়কে দলে এক স্থান দিতে পারে। আমি মনে করি কৌতিনহো একজন দারুণ ফুটবলার। এমন একজন ফুটবলার যিনি দলকে শিরোপা জেতানোর ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু বার্সেলোনায়, মেসির সাথে, মেসিকে রেখে একজন কোচ কখনও তার জন্য একটি পজিশন দিতে পারবে না।
তবে এতকিছুর পর কৌতিনহোর জন্য সমস্যা হলো তার আত্মবিশ্বাস। লা লিগায় অ্যাটলেটিকো বিলবারওয়ের বিপক্ষে তার আত্মবিশ্বাসের পারদ ছিলো শূন্যে। অথচ ভালভার্দে প্রতি ম্যাচে তাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। ক্যাম্প ন্যুতে এল ক্লাসিকোয় ম্যাচের ৬০ মিনিটে যখন কৌতিনহোকে ভালভার্দে তুলে নেন, তখন তিনি নিজেও বিরক্ত ছিলেন তার পারফর্মেন্সে। দলে পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া ম্যালকমও সেদিন তার থেকে হাজারগুণ ভালো খেলেছে, যেটা কৌতিনহোর খেলার কথা ছিলো। আর কৌতিনহো নিজেও জানেন, লেফট উইংগার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ কম। আর প্রতি ম্যাচে হতাশা ক্রমাগত ভয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। কারণ দেমবেলের অনুপস্থিতিতে তিনি যে হতাশাকে মেলে ধরলেন, দেমবেলে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা মাত্রই তার স্থান হবে বেঞ্চে। আর দেমবেলে তার স্বভাবগত খেলা খেলতে পারলে ধীরে ধীরে মাঠে নামার সুযোগ হারাবেন তিনি। আর ফর্ম না থাকলে ব্রাজিল দল থেকে তাকে বাদ দিতে তিতে এক মুহূর্ত সময় নেবে না।
আর বার্সেলোনা হয়তো কৌতিনহোকে নিয়ে বসেও থাকবে না। এর আগে সেস ফ্যাব্রেগাস যখন মানিয়ে নিতে পারেনি, বার্সেলোনা তাকে চেলসির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো দ্বিতীয়বার না ভেবেই। আন্দ্রে গোমেজও এসেছিলেন দারুণ সম্ভবনা নিয়ে। তিনিও একইভাবে দলে টিকতে পারেননি। কিন্তু এভারটনে গিয়ে ঠিকই নিজেকে ফেরত পেয়েছেন।
তবে কৌতিনহোর পরিণতি কী হতে পারে? পানেকা সংবাদপত্রের ক্রীড়া বিষয়ক সাংবাদিক মার্সেল বেলটার্ন এ সম্পর্কে বলেছেন,
বার্সেলোনায় আসার আগে কাতালান সমর্থকেরা কৌতিনহোর ইনজুরি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অ্যানফিল্ডে থাকাকালীন সময়েও তিনি নিয়ম করে ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি বার্সেলোনাতে এসেছিলেন ইনজুরি বয়ে নিয়ে। তাই এই ভয় আবার ফেরত আসতে পারে।
তবে বার্সেলোনা কৌতিনহোকে এত দ্রুত বিক্রি করে দেবে না। এই একইরকম দৃশ্য আমরা আগেও দেখেছি। দেমবেলে প্রথমে ইনজুরি ও ফর্ম নিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় ছিলেন। বার্সেলোনা তাকে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে বলেই দেমবেলে ফিরে আসতে পেরেছে।
মার্সেল বেলটার্ন বেশ ভালো বিশ্লেষণ করলেও বাস্তবতা হলো দেমবেলে নিজের পজিশনেই যুদ্ধ করে ফিরে এসেছেন। আর কৌতিনহোর জন্য কোনো স্থান নেই দলে। মেসি থাকতে তিনি কখনও বার্সেলোনার প্লে-মেকারের দায়িত্ব পাবেন না। আর এভাবে চললে তার পতন নির্ধারিত।
তবে ক্লাবটি যখন বার্সেলোনা। তারাই ইতিহাস ভেঙে সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফি দিয়ে কৌতিনহোকে কিনেছে। ১৬০ মিলিয়ন ইউরো তো আর এভাবে জলে ফেলে দেওয়া যায় না। কৌতিনহো নিজেও একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়। হয়তো কোনো একটি উপায় তারা ভেবে বের করতে সক্ষম হবে। নয়তো কৌতিনহোও একজন পুরোদমে লেফট উইংগার হয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারেন। তবে শেষপর্যন্ত যদি ব্যাটে-বলে না মেলে, তবে বিদায়ের দরজা খোলা আর প্রিমিয়ার লিগের অনেক বড় বড় দলই কৌতিনহোকে পাখির চোখ করে রেখেছে।