৩০০ রান যে ক্রিকেট এর আগে দেখেনি, এমনটা নয়। ক্রিকেট তো চারশ’ রানও দেখেছে নয় বছর আগে। তাই বলে দলগুলো এভাবে মুড়ি-মুড়কির মতো তিনশ’ করে ফেলবে, সেই রান অনায়াসে তাড়া হবে, এর আগে এমনটা কেউ ভাবেননি, কেউ দেখেননি। ২০১৫ এমনই ভাবনাতীত এক বিশ্বকাপ ছিল।
ব্যাটিং উইকেট, দুই প্রান্তে দুই নতুন বল, বৃত্তের বাইরে চার ফিল্ডার, সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে সে বিশ্বকাপে ৩০০ থেকে বেশি রান উঠেছিল ২৮ ইনিংসে। বোলাররা এমনই ‘সৎ ছেলে’ হয়ে যাচ্ছিলেন ক্রিকেটের, বিশ্বকাপের পরপরই বেশ কিছু নিয়ম বদলে আইসিসি পরিস্থিতি অনুকূলে আনার এক চেষ্টা করে।
কিন্তু নিয়ম বদলালে কী হবে, ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা তো আর বদলায়নি! সেই যে কচুকাটা করা শিখেছেন, সে ধারা বজায় আছে এখনো। এমনই যে, রান তোলার ধীরগতি আর বোলারদের মন্থর বোলিংয়ের কারণে যে মধ্য ওভারগুলো ছিল দর্শকের দুই চোখের বিষ, সেই ১১-৪০ ওভারও আজ বেশ ভালো মানের দর্শক টানতে পারছে।
চার বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপ যখন কড়া নাড়ছে দুয়ারে, তখন বিশ্বকাপের ফেভারিট নির্ধারণ করে দিচ্ছে এই মাঝের ওভারের পারফরম্যান্সই। মনে তাই প্রশ্ন জাগতেই পারে, বাংলাদেশের মধ্য ওভারের পারফরম্যান্স কেমন ছিল বিগত দিনগুলোতে? বাকি দলগুলোর সাথে ব্যবধান ঠিক কতটা?
ক্রিকবাজের পরিসংখ্যানবিদ দীপু নারায়ণের সাহায্য নিয়ে এবং নিজের কিছু পরিশ্রমে এই ক্ষুদ্র লেখক জানাচ্ছেন সকল প্রশ্নের উত্তর।
বাকি বিশ্ব কেমন করছে?
২০১৫ বিশ্বকাপের ধাক্কা ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের চিন্তাভাবনাই বদলে দিয়েছে। ৭৭.১৬ স্ট্রাইকরেটধারী ব্যাটসম্যানদের ছেঁটে ফেলে ইংল্যান্ড মিডল অর্ডার পজিশনে দলে টেনেছে আক্রমণাত্মক এবং স্ট্রাইকের ফুলঝুরি ছোটানো ব্যাটসম্যানদের। মাঝ ওভারের বদলটা তাই সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের পানে তাকালে, আরও নির্দিষ্ট করে জো রুটের দিকে খেয়াল করলে।
২০১৩ এবং ২০১৪, ক্যারিয়ারের শুরুর দুই বছরে মোটে ৮০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা রুটের বর্তমান স্ট্রাইকরেট ৮৭.১৬। এ বছর খেলা ১১ ওয়ানডেতে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮.৬১তে। সবই ওই ২০১৫ বিশ্বকাপের প্রভাবে।
বদলেছেন ইংল্যান্ডের বাকি ব্যাটসম্যানরাও। এ সময় ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংসের উদ্বোধন করা তিন ব্যাটসম্যান জেসন রয়, অ্যালেক্স হেলস আর জনি বেয়ারেস্টো ১১-৪০ ওভারে ব্যাটিং করেছেন, অথচ স্ট্রাইকরেট ১০০ থেকে কম, এমন কিছু ক্রিকেট দেখেনি একটিবারের জন্যও। আপাদমস্তক ব্যাটিং উইকেটে ধাতস্থ হয়ে বোলারদের ওপর স্টিম রোলার চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন এদের সবাই। যদিও তারা বেশিরভাগ সময়ই আউট হয়ে গিয়েছেন মাঝের ওভারগুলোতে, উইকেট ছুঁড়ে এসেছেন হয়তো বা ১১ ওভারের শুরুতেই, কিন্তু আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সাথে আপোষ করেননি মোটেই। ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে, মাঝের ওভারগুলোতে বল সীমানার বাইরে গিয়েছে গড়ে দশ বলে।
জো রুটের ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেট তো তাও নব্বই ছোঁয়নি, মিডল অর্ডারের বেন স্টোকস ব্যাটিং করছেন ৯৪.১০ স্ট্রাইকরেটে। জস বাটলারের ক্ষেত্রে যা ১২০ ছুঁইছুঁই। এদের ব্যাটে চেপে ইংল্যান্ড তাই বিগত চার বছরে মাঝের ওভারে রান তুলেছে ৫.৯৪ গড়ে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের চাইতে যা ০.৪০ বেশি।
ভারত অবশ্য দাবি করতে পারে, মাঝের ওভারগুলোতে সবচেয়ে বেশি রান তুলেছেন তাদের ব্যাটসম্যানরাই। এমনকি তাদের উইকেট তুলে নিতেও বোলারদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে যথেষ্টই। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, একবার উইকেট বিলানোর আগে গড়ে অন্তত ৬২ বল খেলেছেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইংল্যান্ডের চেয়ে যা অন্তত ২ ওভার বেশি।
এ কৃতিত্বের অধিকাংশই যাবে বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মার ঝুলিতে। ৯১ ছাড়ানো ব্যাটিং গড়ে আর প্রতি দশ বল অন্তর অন্তর বলকে একবার সীমানাছাড়া করে মাঝের ওই ১৮০ বলে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন বিরাট কোহলিই। এমনকি দ্বিতীয় অবস্থানে দাঁড়ানো জো রুটের সঙ্গে রানের পার্থক্যটা ৭৩৫। ইনিংসপ্রতি ডট বলের সংখ্যাও আশ্চর্য রকমের কম, মাত্র ৩৯.০৯ শতাংশ। উনি ছাড়া কেবল জো রুট আর কুইন্টন ডি ককই যে সংখ্যা রাখতে পেরেছেন চল্লিশের কমে।
কোহলি রান করেছেন ৩১৮৬, তবে এ সময়ে বোলারদের যম হয়ে উঠেছেন তারই সতীর্থ রোহিত শর্মা। প্রথম দশ ওভার পার করেছেন, এমন ম্যাচে তাকে আউট করতে বোলারদের গড়ে বল করতে হয়েছে আরও ১০৯টি। যার কারণে গড় দাঁড়িয়েছে অতিমানবীয় ১১২.৮৫। সাথে প্রতি ৯ বলে একবার বলকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠানোর কারণে স্ট্রাইকরেটটাও একশ’ ছাড়ানো। তবে এরপরও রানরেটে ইংল্যান্ডের চেয়ে ভারতের বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকার কারণ, মিডল অর্ডারে মহেন্দ্র সিং ধোনির উপস্থিতি। ২০১৫ এপ্রিল থেকে শুরু করে তার স্ট্রাইকরেট কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮.২২। এ সময়ের ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র আসগর আফগানই হতে পেরেছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী।
ধীরগতির খেলার কথা যখন উঠলোই, তখন চলে আসে পাকিস্তানের কথাও। আসিফ আলীকে শেষ মুহূর্তে দলে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে যে ফ্যাক্টরের রয়েছে বড় ভূমিকা। তাকে ছাড়া পাকিস্তানের মিডল অর্ডারের বাকি সব ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেটই বড্ড নাজুক। শোয়েব মালিকের ৮৬, মোহাম্মদ হাফিজের ৮৫, বাবর আজমের ৮৩ কিংবা সরফরাজের ৮০ স্ট্রাইকরেট কয়েক বছর আগের ক্রিকেটে মানানসই হলেও এখন আর ‘চলে না’। মরার উপরে খাড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ইমাম-উল-হকের ধীরস্থির ব্যাটিং। প্রথম পাওয়ারপ্লের দশ ওভারে যিনি ব্যাটিং করেন ৬২ স্ট্রাইকরেটে, মাঝের ওভারগুলোতে ৯১ স্ট্রাইকরেট তার জন্যে রীতিমতো ‘বিধ্বংসী’ হলেও আধুনিক ক্রিকেটের উপযোগী নয়। পাকিস্তান স্কোয়াডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যটি তাই আসিফ আলী, মারমার কাটকাট এই ক্রিকেটের যুগে তার মতো মারমুখী ব্যাটিংই তো চাই!
বলকে সীমানাছাড়া করার ক্ষেত্রে রোহিত শর্মার চেয়েও এগিয়ে আছেন তার ওপেনিং পার্টনার শিখর ধাওয়ান, গড়ে ৭.৫ ডেলিভারিতে বল অন্তত একবার সীমানাছাড়া করেছেন ‘গাব্বার’। অবশ্য এই তালিকায় তাদের ছাড়িয়ে সবার উপরে অবস্থান করছেন একজন আফ্রিকান। গড়ে ৭.৩ বলে অন্ততপক্ষে একবার বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করেছেন কুইন্টন ডি কক।
ব্যাটিং পারফরম্যান্স (১১-৪০ ওভারে)
এক কুইন্টন ডি ককই যা ব্যতিক্রম, তাকে ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বাকিরা যেন মাঝের ওভারের এই পরিবর্তনটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। ডু প্লেসি রান করেছেন ৮৯ স্ট্রাইকরেটে, কিলার মিলার ৮৫, জেপি ডুমিনি আরও কম, মাত্র ৭৫ স্ট্রাইকরেটে। ডি ভিলিয়ার্সের হঠাৎ অবসরের ধাক্কা যেন সাউথ আফ্রিকা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। (*৩০ এপ্রিল, ২০১৯ পর্যন্ত)
অবশ্য পারবেই কী করে! ক্রিকেট আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখা এই ক্রিকেটার মাঝের ওভারে রান তুলতেন ১০১ স্ট্রাইকরেটে। প্রতি দশ বলে চার বা ছয়, সাথে সিঙ্গেলস-ডাবলসে রানের চাকা সচল রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যভাগের মধ্যমণি হয়েই ছিলেন, যতদিন খেলেছিলেন। ক্রিকেটই তাকে খুঁজে ফেরে, সাউথ আফ্রিকা তো তার অভাব বোধ করবেই!
নিউ জিল্যান্ডের অবশ্য এই অভাববোধের কোনো তাড়া নেই। যদিও গত বিশ্বকাপের পরই অবসর নিয়েছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, তবে তার ভূমিকা তো শুরুর ঝড় তোলাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো বেশিরভাগ ম্যাচে। তার সময়েও মধ্য ওভারের দায়িত্ব তাই বর্তাতো রস টেলর আর কেন উইলিয়ামসন জুটির ওপর, এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এ ঘোষণা দেয়া যায়, তারা সে দায়িত্বটা পালন করেছেন এবং করছেন বেশ সার্থকতার সঙ্গে।
রস টেলর যেন ফিরে গিয়েছেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে। রান করছেন, উইকেটে টিকে থাকছেন, তার চেয়েও বড় কথা জুটি গড়ছেন। কেন উইলিয়ামসন, টম ল্যাথাম কিংবা জিমি নিশাম, যার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন, প্রতি জুটির গড়ই পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। মার্টিন গাপটিলের সঙ্গে সে গড় ছুঁয়েছে ৮১।
মাঝের ওভারগুলোতে টেলরের মতো অমনই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন কেন উইলিয়ামসন, রান তুলেছেন টেলরের চেয়েও দ্রুত। অবশ্য প্যাভিলিয়নেও ফিরেছেন তাড়াতাড়ি, টেলরকে আউট করতে যেখানে বোলারদের বল খরচা করতে হয়েছে ১১১টি, উইলিয়ামসনের বেলায় সে সংখ্যা মোটে ৫১।
অবশ্য নিউ জিল্যান্ডের জন্যে আশার কথা, টেলর, উইলিয়ামসনের সঙ্গে মিডল অর্ডারে ল্যাথামও খেলেন, অন্য যেকোনো ‘অ-এশীয়’ দেশের ব্যাটসম্যানদের চেয়ে যারা স্পিনটা ঢের ভালো খেলেন। বেশিরভাগ দল যখন মধ্য ওভারগুলোতেই স্পিনারদের কোটা পূরণের চিন্তা করে, সেখানে নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হবার আগে, তাদের তো দ্বিতীয়বার ভাবতেই হবে!
নিউ জিল্যান্ডের জন্য সম্ভাবনার সঙ্গে মধ্য ওভারটা সমস্যারও। কারণ, কেবল ব্যাটিংয়ে রান করলেই তো হবে না, বোলিংয়ে উইকেটও নিতে হবে। ইনিংসের গোড়ায় উইকেট তুলে নেয়াকে যখন বোল্ট-সাউদি জুটি নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন, তখন মধ্য ওভারগুলোতে উইকেটের আশায় উইলিয়ামসনকে হাপিত্যেশ করতে হয়েছে মাঝেমাঝেই। দুই স্পিনার স্যান্টনার কিংবা সোধি, কেউই বোলিং গড়কে রাখতে পারেননি ৪০য়ের কমে। বোল্ট, সাউদি, হেনরি কিংবা ফার্গুসন, যে পেসারই এই মাঝের ওভারে বোলিংয়ে গিয়েছেন, প্রত্যেকেই ফেরত এসেছেন ত্রিশের বেশি গড় নিয়ে। ওভারপ্রতি রানও খরচ করতে হয়েছে ৫.৩৯ করে।
রিস্ট স্পিনার হিসেবে সোধিই যা ব্যতিক্রম, নইলে আজকের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের বাইরে যদি কেউ রাজ করেন, তা তো ওই কব্জি ঘোরানো স্পিনাররাই। গত চার বছরের শীর্ষ দশ উইকেট শিকারীর তালিকা থেকে জানা যায়, লিস্টে ঘূর্ণি বোলারদের সংখ্যা নয়জন এবং লেগ স্পিনার কিংবা চায়নাম্যান বোলার সাতজন। এ সময়ে ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন আদিল রাশিদ, অস্ট্রেলিয়া শেন ওয়ার্নের উত্তরসূরি খুঁজে পেতে চেয়েছে অ্যাডাম জাম্পার মাঝে, শাদাব খানের ইনজুরি সত্ত্বেও পাকিস্তান তার জন্যে অপেক্ষা করেছে শেষ অব্দি।
আদিল রাশিদ তো কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ভরসার জায়গা। গত বিশ্বকাপের পর থেকে এখন অব্দি তুলে নিয়েছেন ১২৭ উইকেট, যার ৯৭টিই এসেছে ১১-৪০ ওভারের মাঝে। রাশিদ খান তো বোলারকুলের শিরোমণি হয়ে রয়েছেন বেশ কিছুকাল ধরেই। এই ব্যাটসম্যানবান্ধব ক্রিকেটের যুগেও মধ্যওভারে যার ইকোনমি রেট মোটে ৩.৬৫। রাশিদ খানের সঙ্গে একজন করে মুজিব-উর রহমান এবং মোহাম্মদ নবী থাকায়, মাঝের ১৮০ বলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে রান তোলা হয়ে গিয়েছে রীতিমতো দুরূহ। প্রায় ৫৯ শতাংশ ডট বল, মাত্র ৪.৩১ ইকোনমি রেট কিংবা ৩৬ বল পরপর উইকেট আদায়, সবই বাকি দলগুলোর চাইতে বেশ কিছুটা ব্যবধানে এগিয়ে সেরা।
বোলিং পারফরমেন্স (১১-৪০ ওভারে)
বিশ্বের বাকি সব দলই যেন মেনে নিয়েছে, রিস্ট স্পিনার ছাড়া এ যুগে কিছু করা দায়। মানবে না-ই বা কেন! সমান বাউন্সের পাটা উইকেটে অফ স্পিনারদের করার থাকে সামান্যই। তার চেয়ে বরং কবজির মোচড়ে থাকে অনেক বেশি বৈচিত্র্য, থাকে অনেক বেশি উইকেট প্রাপ্তির সম্ভাবনা। ভারত যেমন এই দাবি মেনে নিয়েই বেঞ্চে বসিয়েছে জাদেজাকে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অভিজ্ঞ রবীচন্দ্রন অশ্বিন থেকে। তার বদলে দলে ডেকেছে দুই তরুণ তুর্কি, কুলদীপ যাদব আর যুজবেন্দ্র চাহালকে। পারফরমেন্সে যারা নিজেদের প্রমাণ করে হয়ে গিয়েছেন ভক্তদের ভালোবাসার ‘কুল-চা’ জুটি। (*৩০ এপ্রিল, ২০১৯ পর্যন্ত)
২০১৭ সালে আগমনের পরে কুলদীপ উইকেট তুলে নিয়েছেন ৬৭টি, বিপরীতে চাহাল আদায় করেছেন ৫১ উইকেট। তার চেয়েও বড় কথা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউ জিল্যান্ড, এই দু’জনের কাঁধে চড়েই জয়ের বরমাল্য বারবার গলায় তুলেছে ভারত। উইকেট প্রাপ্তির সাথে সাথে রানের চাকাতে বাধ দেয়ার কাজটাও যে ভালোই পারেন তারা, সে তো ৪.৬৭ আর ৪.৮১ ইকোনমি রেটই প্রমাণ করে। বিশ্বকাপেও ভারত কতটা সফল হবে, সে নির্ভর করছে এই মধ্য ওভারের বোলিং জুটির ওপরে।
বাংলাদেশ কেমন করছে?
মাশরাফি বিন মর্তুজার অবশ্য রিস্ট স্পিনারদের ফর্ম নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। দলে যে একজন বিশেষজ্ঞ রিস্ট স্পিনারই নেই! আর রিস্ট স্পিনার নেই বলে মধ্য ওভারে উইকেটপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও যে কমতির দিকে, সে তো পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দেয়।
বাংলাদেশের মধ্য ওভারে বোলিংয়ের মূল দায়িত্বটা যার উপর বর্তায়, সেই সাকিব আল হাসান ঘরানার বোলারদের, তথা বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনারদের দায়িত্বটা মূলত রান আটকে রাখার। সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের ইমাদ ওয়াসিম কিংবা নিউজিল্যান্ডের মিচেল স্যান্টনার, প্রত্যেকে ঠিক এই দায়িত্বটাই পালন করেছেন বিগত ৪৮ মাসে। স্যান্টনার ওভারপ্রতি রান খরচ করেছেন ৪.৭০ করে, সাকিব আল হাসান ম্যাচ খেলেছেন ২৮টি, উইকেটসংখ্যাও ২৮।
সাকিব আল হাসানের বিগত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পারফরমেন্স বলে, বিশ্বকাপের ফ্ল্যাট উইকেটে তার কাছে উইকেটপ্রাপ্তির আশা করা কঠিনই। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ৪ ম্যাচের তিন ইনিংসে বল করার পরও উইকেটের কলাম শূন্যই দেখায় তার। শুধু সাকিব আল হাসানই নন, বিদেশের মাটিতে মধ্য ওভারে বাংলাদেশের বোলারদের বাকি সবার অবস্থাই এমন করুণ। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ড, এদের বিপক্ষে মধ্য ওভারের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন বাংলাদেশি বোলাররা।
পেসারদের অবস্থাও তথৈবচ। বিগত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়া হাসান আলীর মতো ৩.০৯ ইকোনমি রেটের কিংবা লিয়াম প্লাঙ্কেটের মতো জুটি ভাঙা বোলার কোথায়! ইংল্যান্ডের মাটিতে গত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে মধ্য ওভারে বাংলাদেশ তুলে নিতে পেরেছিল মোটে ৫ উইকেট। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মিরপুরের স্লো-লো উইকেট ছেড়ে ফ্ল্যাট ব্যাটিং উইকেটে গেলেই প্রকাশ পায় বোলিংয়ের যাবতীয় দুর্বলতা।
এবারের বিশ্বকাপ ৫০০ রান দেখবে কি না, এমন কথা যখন চারদিকে গুঞ্জরিত হচ্ছে, তখন বৈচিত্র্যহীন, গতিহীন বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ সেই রানের গতিতে কতটা বাধ দিতে পারবে, সেটাই প্রশ্ন।
আর যদি বাঁধ দিতে না-ই পারে, তবে সে রান করার দায়িত্বটা বর্তাবে ব্যাটসম্যানদের কাঁধে। তামিম-মুশফিক-সাকিব-মাহমুদুল্লাহ, চার সিনিয়র ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সের কারণে মধ্য ওভারে ততটা দিশাহীন মনে হয় না বাংলাদেশকে। পাওয়ারপ্লে’র ধীরস্থির শুরুটা তামিম ইকবাল সামলে নিয়েছেন এই সময়টায়, তেমনি সাকিব-মুশফিকের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে সেরা সময়টা পার করেছে এই ১১-৪০ ওভারের মাঝেই। তবে, একদিবসী ক্রিকেটে নতুন নিয়ম চালু হবার পরের পারফরমেন্স পর্যালোচনায় জানা যায়, এ সময়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কোনো রান নেননি, এমন বলের সংখ্যা ছিলো শতকরা ৫৫ ভাগ। বিশ্বকাপের বাকি দলগুলোর ভেতর উইন্ডিজ আর আফগানিস্তানের অবস্থাই এর চেয়ে বাজে।
শঙ্কার জায়গা তো আরও আছে। বিগত দুই বছরে, মিরপুর শেরে-বাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটে ওভারপ্রতি রান উঠেছে ৪.৮১ গতিতে। মাত্র ২৬.৭৮ গড়ের উইকেটে খেলা ব্যাটসম্যানেরা কি করে সাড়ে তিনশ’ রানের উইকেটে মানিয়ে নেন, কৌতূহলী চোখ চেয়ে থাকবে সেদিকেও।
রিস্ট স্পিনার নেই, মধ্য ওভারে জুটি ভাঙা পেসার নেই, ডট বলের সংখ্যা হুট করে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জেতার আশাই কি নেই?
ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পারি না বটে, তবে আশা করতে বারণ নেই!