১.
বিশ্বকাপের গত দুই আসরের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ায়। দুটি আসরেই স্বাগতিক দেশ শিরোপা নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। এইবারের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে ইংল্যান্ডে। শুধুমাত্র এইজন্যই টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ইংল্যান্ডকে শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসাবে গণ্য করা হচ্ছিল না। তারা ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে সফলতা পাচ্ছে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বিপক্ষ দলের বোলিং লাইনআপকে নাস্তানাবুদ করতে তৈরি থাকেন তাদের ব্যাটসম্যানরা। দলে বেশ কয়েকজন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান থাকার কারণে তারা শুরু থেকেই দ্রুতগতিতে রান তুলতে থাকেন।
ইংল্যান্ড এইবারের আসর শুরু করেছিল শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসাবে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে জয় দিয়েই আসর শুরু করেছিল তারা। এরপর নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে নাটকীয়ভাবে হেরে গেলেও এরপর টানা তিন ম্যাচে জিতে সেমিফাইনালের দৌঁড়ে বেশ এগিয়ে ছিল। নিজেদের ষষ্ঠ ও সপ্তম ম্যাচে শ্রীলঙ্কা এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে নিজেদের সমীকরণ কঠিন করে তোলে তারা। শেষ পর্যন্ত সব নাটকের অবসান ঘটিয়ে ইংল্যান্ড শেষ দুই ম্যাচে ভারত এবং নিউ জিল্যান্ডকে পরাজিত করে শেষ চারে জায়গা করে নেয়।
২.
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে তাদের দুই ওপেনার জনি বেয়ারস্টো এবং জেসন রয়ের। চলতি বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে উঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন এই দুই ওপেনার। সেমিফাইনালে উঠতে হলে ইংল্যান্ডকে নিজেদের শেষ দুই ম্যাচ জিততেই হতো। এই দুই ম্যাচে দলকে শুরুতেই জয়ের ভিত গড়ে দিতে ভূমিকা পালন করেছিলেন রয় এবং বেয়ারস্টো। তারা দুইজন ভারতের বিপক্ষে ২২.১ ওভারে ১৬০ রান এবং নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮.৪ ওভারে ১২৩ রান যোগ করে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন। যার ফলে দু’টি ম্যাচেই শেষ হাসি হেসেছিল ইংল্যান্ড।
তারা এই বিশ্বকাপে টানা তিন ম্যাচে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে একশ’ রান যোগ করেছেন, যা বিশ্বকাপে এর আগে কখনো ঘটেনি। তারা বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে ৮৪.৮০ গড়ে ৪২৪ রান যোগ করেছেন, জুটিতে রানও তুলেছিলেন বেশ দ্রুতগতিতে। যার দরুন শুরু থেকেই বড় সংগ্রহের পথে থাকে ইংল্যান্ড। তাদের দ্রুতগতির ব্যাটিংয়ের কারণেই মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ কমে যায়। যাতে করে তারা ব্যর্থ হলেও দেখা যায়, দলীয় সংগ্রহ তিনশ’ অতিক্রম হয়ে যায়।
৩.
ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে নিজেদের উদ্বোধনী ম্যাচ খেলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি টসে জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সাময়িক সফলতা পেয়েছিলেন। জেসন রয় লেগ স্পিনারদের বিপক্ষে সাবলীল নন, তাই ইনিংসের প্রথম ওভার বল করতে এলেন ইমরান তাহির। তাহির উইকেট তুলে নিতে বেশি দেরি করেননি। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই জনি বেয়ারস্টোকে কিপারের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন তিনি। রয়ের জন্য আক্রমণে আনা হলেও তিনি বেয়ারস্টোকে আউট করে দলকে প্রথম উইকেট এনে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটিতে অবশ্য ইংল্যান্ড ১০৪ রানের সহজ জয় পেয়েছিল।
ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের আগে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপেও পাকিস্তানের শুরুটা ভালো হয়নি। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। ম্যাচ শুরুর আগে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। পাকিস্তানকে নিয়ে আগে থেকে কোন মন্তব্য করা যায় না। তারা সহজ প্রতিপক্ষের যেমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে পারে, তেমনি শক্তিশালী দলের বিপক্ষেও অনায়াসে জয় তুলে নিতে পারে।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও নাটকীয়ভাবে ১৪ রানের জয় পেয়েছিল পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে ৩৪৮ রান সংগ্রহ করার পর ইংল্যান্ডকে ৩৩৪ রানের মধ্যে আটকে রাখে তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পাকিস্তানও লেগ স্পিনার শাদাব খানকে দিয়ে বোলিং শুরু করেছিল। রয়, বেয়ারস্টোদের বিপক্ষে শাদাবও সফল ছিলেন। তিনি নিজে দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই আট রান করা রয়ের উইকেট তুলে নেন।
৪.
রয় এবং বেয়ারস্টোর বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানের মতো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। দলে কোনো লেগ স্পিনার না থাকার কারণে বোলিং আক্রমণ শুরু করেছিলেন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের বিপক্ষে আর ভুল করেননি রয়-বেয়ারস্টো। সাকিবকে দেখেশুনে খেলে বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দিয়েছিল তারা। বেয়ারস্টো ৫১ রান করে আউট হলে ১৯.১ ওভারে গড়া ১২৮ রানের জুটি ভাঙে। তার বিদায়ের পরও রয় রানের চাকা সচল রেখেছিলেন। রয়ের ১২১ বলে ১৫৩ রানের ইনিংসের উপর ভর করে ইংল্যান্ড ছয় উইকেটে ৩৮৬ রানের বড় সংগ্রহ জমা করেছিল। বাংলাদেশ ১০৬ রান দূরে থাকতেই সবক’টি উইকেট হারায়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজেদের পরবর্তী ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েছিলেন ইংল্যান্ডের ওপেনার জেসন রয়, যার কারণে ঐ ম্যাচে তার ব্যাটিংয়ে নামা হয়নি এবং পরবর্তী তিন ম্যাচে একাদশের বাইরে ছিলেন। জেসন রয়ের অনুপস্থিতিতে রানে দেখা পাচ্ছিলেন না জনি বেয়ারস্টোও। রয় যে তিন ম্যাচ খেলতে পারেননি, তার মধ্যে দু’টি পরাজিত হয়ে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ইংল্যান্ডের। রয় ছাড়া যেই এক ম্যাচে জয় পেয়েছিল, তা ছিল টুর্নামেন্টের সব দলের কাছে পরাজিত হওয়া আফগানিস্তানের বিপক্ষে।
৫.
জেসন রয় এবং জনি বেয়ারস্টো এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ছয় ম্যাচ একসাথে খেলেছেন, যার মধ্যে পাঁচটিতে জয়লাভ করেছে ইংল্যান্ড। দলীয় সাফল্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সাফল্যের দিক থেকেও তারা বেশ সফল। জনি বেয়ারস্টো গ্রুপপর্বের নয় ম্যাচের সবক’টি ম্যাচ খেলে দু’টি শতক এবং দু’টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৯৭.২৬ স্ট্রাইকরেটে এবং ৫১.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৪৬২ রান সংগ্রহ করেছেন। তার ব্যাটিং পার্টনার জেসন রয় বিশ্বকাপে পাঁচ ইনিংসে ব্যাট করে একটি এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১১৪.০৪ স্ট্রাইকরেটে ও ৬৮.২০ ব্যাটিং গড়ে ৩৪১ রান সংগ্রহ করেছেন।
তারা দুইজন ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করছেন। এখন পর্যন্ত তারা ৩১বার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে দশবার শতরানের জুটি এবং সাতবার অর্ধশত রানের জুটি গড়ে ২,০৯৯ রান যোগ করেছেন। গড়ে প্রতি ইনিংসে তারা ৬৭.৭০ রান যোগ করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে কমপক্ষে এক হাজার রান যোগ করেছে, এমন উদ্বোধনী উইকেট জুটির মধ্যে তাদের গড় সবচেয়ে বেশি।
বেয়ারস্টো এবং রয় ধারাবাহিকভাবে রান করছেন। বড় ইনিংস খেলার পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য থাকে, কত দ্রুত রান সংগ্রহ করতে পারেন তারা। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৬৯ জন ওপেনার দুই হাজারের বেশি রান সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের স্ট্রাইক রেইট একশ’র উপরে। ওপেনিংয়ে নেমে কমপক্ষে দুই হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইকরেট জনি বেয়ারস্টোর, তিনি ২,১৪৪ রান করেছেন ১১০.৯৭ স্ট্রাইকরেটে। তারপরের স্থানে রয়েছেন জেসন রয়, তিনি ৩,২৭৯ রান করেছেন ১০৭.০৫ স্ট্রাইকরেটে।
৬.
জেসন রয়ের ওয়ানডে ক্রিকেট অভিষেক ঘটে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পরপরই। অভিষেকের পর থেকেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করে যাচ্ছেন তিনি। তার অভিষেকের পর ওপেনিংয়ে নেমে তার চেয়ে বেশি রান তুলতে পেরেছেন শুধুমাত্র রোহিত শর্মা। রয় এখন পর্যন্ত ৮২ ম্যাচ খেলে নয়টি শতক এবং ১৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.৫৮ ব্যাটিং গড়ে এবং ১০৭.০৫ স্ট্রাইকরেটে ৩,২৭৯ রান সংগ্রহ করেছেন। তার খেলা ৮২ ম্যাচের মধ্যে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়েছে মাত্র ২২ ম্যাচে, অন্যদিকে জয়ের সংখ্যা ৫৫টি। তার নয়টি শতকের সবক’টিতে ইংল্যান্ড জয় পেয়েছে। জয় পাওয়া ম্যাচে তিনি ১১০.৯৮ স্ট্রাইকরেটে এবং ৪৯.৫৬ ব্যাটিং গড়ে ২,৬২৭ রান সংগ্রহ করেছেন।
জনি বেয়ারস্টোর ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল ২০১১ সালে। তবে তিনি ওয়ানডে দলে নিয়মিত হন ২০১৫ সালের পর থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেটে নতুন রূপে তার আবির্ভাব ঘটে, যখন ২০১৭ সালে প্রথম ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন। ওপেনার হিসাবে তিনি ৪৬ ম্যাচ খেলে নয়টি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫২.২৯ ব্যাটিং গড়ে ২,১৪৪ রান সংগ্রহ করেছেন। তার খেলা ৪৪টি ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড, এই ৪৪ ম্যাচে তিনি সাতটি শতক এবং দশটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৯.৬৯ ব্যাটিং গড়ে ২,১৪৯ রান সংগ্রহ করেছেন।
ইংল্যান্ড ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের পর এই প্রথম বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠল। সেখান থেকে প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা জিতবে কি না, তার অনেকটাই নির্ভর করছে জনি বেয়ারস্টো এবং জেসন রয়ের উপর। তারা যদি নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেন, তাহলে ম্যাচের শুরুতেই ম্যাচের লাগাম নিজেদের আয়ত্তে রাখতে পারবে ইংল্যান্ড।