পেলের হাজারো সুনাম, তবে এই সব সুনামের মাঝেও একটি অন্যরকম কাঁটা হয়ে আছে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। পেলের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই সমূহ। ২০০২ সাল বাদে সাম্প্রতিক প্রায় সব বিশ্বকাপেই তাঁর ভবিদ্বাবাণী ছিল ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে। আর সেই ২০০২ সালেই ব্রাজিল জিতলো বিশ্বকাপ আর বাকি সবগুলোয় বিদায়! পেলে ২০০০ সালে বলেছিলেন,
“নতুন এক পেলে এসে গেছে যার মধ্যে সম্ভাবনা আমার চেয়েও বেশী আর সৌভাগ্যবশত সে আমার সাবেক ক্লাব সান্তোসেই খেলছে।”
আসলেই তখন ১৬ পেরোনো এক ছেলে সান্তোস একাডেমি কাঁপাচ্ছে। মোটামুটি নাম শোনা যাচ্ছিল, তবে তা আসল রাষ্ট্র করে দেন পেলে নিজেই। আর নিজের ব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণীর তালিকায় যোগ হয়ে গেল আরেকটি নতুন পালক কালের বিবর্তনে।
উত্থানপর্ব
পেলে কি ভুল বলেছিলেন? মোটেই না। আপনি যদি নেইমারের উত্থানের সময়টা দেখে থাকেন তবে সোজা হিসেবে বলা যায়, রবিনহো ছিল সেই আমলের নেইমার, বরং অনেক সান্তোস কর্মকর্তার মতে রবিনহো নেইমারের চেয়ে বেশী প্রতিভাধর ছিল। কেন পেলে বলা হবে না? সব ছিল তাঁর পায়ে। ব্রাজিলের ঐতিহ্য তাঁর ‘জিঙ্গা’ নামের খেলার স্টাইল, যার মানেই ছিল মনের আনন্দে খেলা, সেটা তখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। আচমকা এই ছেলেটির পায়ে ভর করে এল সে জিঙ্গা, মনে খুশিতে বল নিয়ে যা ইচ্ছে সব করে, বিশালদেহী ডিফেন্ডারদের হেলায় কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রবীণ ব্রাজিলিয়ানরা চুরুট ফুঁকে চলে, যেন মানসপটে পেলেকেই দেখছে। ১৮ বছরে সান্তোসে তাঁর অভিষেক হয়, সে মৌসুমে অল্প অল্প করে ২৩টি ম্যাচে মাঠে নামেন। অনেক সান্তোস ফ্যান বসেই থাকত ওই শেষ ১০-১৫ মিনিটের জন্য কখন তিনি নামবেন! এর পরের মৌসুমে ১৯ না পেরোনোর আগেই সান্তোস মূল দলে জায়গা পেয়ে যান রবিনহো।
শুরু হলো তাঁর আসল উত্থান। অনেকের মনে হতে পারে ব্রাজিলিয়ান লীগ আর এমন কি? বাস্তবতা হলো, আঞ্চলিক হিসেবেই ব্রাজিলিয়ান লীগের অর্ধেকের বেশী দল শক্ত ডিফেন্সিভ স্টাইলে খেলে থাকে। সেবার ব্রাজিলিয়ান লীগে উইঙ্গার হয়েও ২১ গোল করে লাইমলাইটে এসে যান। লাতিন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোপা লিবারতাদোরেসের ফাইনালে উঠান তাঁর সান্তোসকে। তবে পেরে উঠেননি তেভেজের বোকা জুনিয়রসের কাছে। তবে সেবার লীগ ঠিকই জিতে নেয় সান্তোস। মাত্র ১৯ বছরের রবিনহোর হেলায় ডিফেন্ডার কাটিয়ে যাওয়া, দারুণ সব স্কিল সব নজরে আসে ইউরোপের সব জায়ান্টদের। সান্তোস ছাড়েনি তাঁকে সে বছর। তবে ধাক্কাটা এলো পরেরবার, অপহৃত হলেন তাঁর মা। ৬ সপ্তাহ পরে মুক্তিপণ আদায় করেই তাঁকে ছাড়েন অপহরণকারীরা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবে মাঠে ফিরে লীগের শেষ ১২ ম্যাচে সেই আগের ফর্ম দেখিয়ে ৯ গোল করলে ইউরোপের জায়ান্টরা বুঝে নেয় তিনি অন্য ধাচের জিনিস। পেলের সাথে তুলনার চাপ, মায়ের অপহরণ কিছুই তাঁর খেলাকে আটকে রাখতে পারেনি; জায়ান্টরা ধরেই নিল তিনি বড় কিছুর জন্যেই জন্মেছেন। ২০০৫ সালে যোগ দিলেন রিয়াল মাদ্রিদে।
মাদ্রিদে তাঁর কোচ ফ্যাবিও কাপেলো, খুব কড়া লোক। প্রথমেই তাঁকে একম্যাচ নামিয়ে দেখলেন ইউরোপের জন্য এখনো রেডি না তিনি। তাই পাঠালেন বেঞ্চে। বেঞ্চ থেকে অনিয়মিত পারফর্মেন্স, একম্যাচ চোখ ধাঁধানো তো আরেক ম্যাচ একদম সাদামাটা। সাথে নাইটক্লাব তো আছেই। তাঁর ব্রেক-থ্রু এলো বার্সেলোনার সাথে এল ক্লাসিকোতে। দারুণ পারফর্মেন্সে কোচের মন জয় করে নিলেন। জায়গা হলো মূল একাদশেই। ৩য় অবস্থান থেকে উঠে এসে লীগ জিতে নেয় রিয়াল, তখনো রবিনহো ক্রেজ অটুট। কাপেলো বরখাস্ত হলেন, কোচ হিসেবে আসলেন সুস্টার। প্রচুর খাটান প্লেয়ারদের, আর ওদিকে রবিনহো পার্টি-বয়। দুই বৈপরীত্যেও তাঁর পারফর্মেন্স চলছিল বেশ। রিয়ালের ফ্যানরা তখনো তাঁকে নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত না, আবার রাগও না। অধারাবাহিকতা ছিল তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর এই কারণেই রিয়াল ফ্যানদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলেন না। সেবার যখনই তাঁর ফর্ম ধারাবাহিক হচ্ছিল, তখনই পড়ে গেলেন ইনজুরিতে। ফিরে এসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রিয়ালকে বাঁচিয়ে দিয়ে বার্সাকে আবারো লীগ বঞ্চিত করতে রিয়ালকে সাহায্য করেন। ততদিনে রিয়ালে তাঁর একটা নামডাক এসে যায়, টানা দুটি লীগ জিততে সাহায্য করেছেন, কম তো নয়! সমস্যাটা বাঁধে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে!
২০০৭ এর দিকে রিয়াল প্রেসিডেন্ট ক্যালদেরন ঘোষণা দেন রিয়াল রোনালদোকে কিনতে চায়। রবিনহো আর রোনালদোর পজিশন আবার একই! বহু চেষ্টা করেও রিয়াল সেবার রোনালদোকে সাইন করাতে পারেনি, বদলে রবিনহোকেই চুক্তি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রোনালদোকে এভাবে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করাটা রবিনহোর ভালো লাগেনি, প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। শুরু করেন বের হয়ে যাওয়ার তোড়জোড়, ক্লাবকর্তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। শেষাবধি ক্লাব রাজি হয় তাঁকে বিক্রি করতে। চেলসি আগে থেকেই তাঁর দিকে আগ্রহী, কোচ তখন ব্রাজিলিয়ান স্কলারি। সব রেডি, ঠিক সেই সময়ই রবিনহো তাঁর ক্যারিয়ারঘাতী সিদ্ধান্তটি নেন। চেলসিতে না গিয়ে বেশী টাকার প্রলোভনে পড়ে রেকর্ড ফি-তে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেন তিনি!
পতনপর্ব
ম্যানসিটি তখন কেবল অর্থ বিনিয়োগ শুরু করেছে, এখনের অবস্থা ছিল না। রবিনহোই সেরা প্লেয়ার। শুরুটা হলো দারুণ, স্বপ্নের মতো। হ্যাটট্রিক সহ বেশ ভালোই খেলছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক গড়নের ইংলিশ লীগে তাঁর মতো হালকা গড়নের প্লেয়ার সংগ্রাম করতে লাগলেন, সাথে ভালো কমপ্লিমেন্ট দেয়ার মতো কেউ নেই, পড়লেন ইনজুরিতে। যখন ফিরলেন, ততদিনে কোচ মানচিনি আর তাঁকে খেলানোর অবস্থায় নেই। সান্তোসের ‘ওয়ান্ডারকিড’ লোনে আবার সান্তোসেই ফিরে গেলেন একটু ফর্ম ফিরে পাওয়ার আশায়।
ততদিনে সেই অভ্যাসটা স্থায়ী হয়ে গেছে, অধারাবাহিকতা। ব্রাজিলিয়ান কাপ জেতালেও সেই আগের রোগ থেকেই যায়, দেখা যেত আচমকা তাঁর একটা স্কিল পুরো স্টেডিয়ামকে উত্তাল করে দেয়, আবার সহজ মিস তাঁর সেইসব কেড়ে নেয়। লোন শেষে যোগ দেন এসি মিলানে। প্রথম মৌসুমে ইব্রাহিমোভিচ ও পাতোর সমান সংখ্যক ১৪ গোল করে এসি মিলানকে পাঁচ বছরের ইন্টার মিলান আধিপত্য ভেঙে লীগ জয় করতে সাহায্য করেন। শুধু গোল না, খেলায়ও আগের একটা ধাঁচ ফিরে আসছিল। তবে হলো না, পরের মৌসুমেই ইনজুরি। ইব্রা চলে যাওয়ার পর স্ট্রাইকারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে, সুযোগ ছিল একে লুফে নেয়ার। উল্টো চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোয়ালিফাইং ম্যাচে এত সহজ সহজ মিস করলেন যে রেগেমেগে কোচ আবারো বেঞ্চ করে দিলেন। এসি মিলানের বাকি দিনগুলোও মনে রাখার মতো কিছু ছিল না। এরপর আবার সান্তোস, চায়না ক্লাব এভারগ্রান্দে হয়ে এখন আছেন এথলেটিকো মিনেইরোতে। ততদিনে পেলের ব্যর্থ ভবিষ্যৎবাণীর পাল্লাটা আরো ভারী করে দিলেন রবিনহো।
জাতীয় দলের হয়ে রবিনহো
তবে একটা জায়গায় তিনি ছিলেন ভাস্বর, তা হলো ব্রাজিলের জার্সি গায়ে। ২০০২ এর পর অভিষেক হলেও রোনালদো, কাকা, রোনালদিনহো, আদ্রিয়ানোদের ভিড়ে স্থায়ী হতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে ২০০৫ এর কনফেডারেশন কাপ জিতে নেন। ২০০৬ বিশ্বকাপের পর যখন একে একে ব্রাজিলের প্রায় সব তারকা পতন হয়, ব্রাজিলে যখন প্রতিভার অভাব, তখন সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা রবিনহো। ২০০৭ এ আনকোরা, কম কোয়ালিটিসম্পন্ন এক ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন একাই, সে টুর্নামেন্টের রবিনহো ছিলেন ঠিক সেই প্লেয়ার যেটা সবাই ভেবেছিল তাঁর ভবিষ্যৎ হিসেবে। কাকা, ফ্যাবিয়ানোকে নিয়ে খর্বশক্তির এক ব্রাজিলকে লাতিন বাছাইপর্বের শীর্ষস্থান পাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০০৯ কনফেডারেশন কাপে সেই ত্রয়ী ব্রাজিলকে করে চ্যাম্পিয়ন। ২০১০ বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের জার্সিতে উজ্জ্বল ছিলেন। হল্যান্ডের সাথে তাঁর সেই গোলটি অফসাইডে বাতিল না হলে ব্রাজিল হয়তো বাদ পড়তো না কোয়ার্টার ফাইনালে। ২০১০ এর পর যখন আবার ব্রাজিল দলে ব্যাপক ছাটাই চলে, তখনো সেই রবিনহো ছিলেন এর বাইরে। কিন্তু ক্লাবে তাঁর অধারাবাহিকতা আর ইনজুরি, সাথে অস্কার, উইলিয়ান, নেইমার, গানসোদের উত্থানে ব্রাজিল দলে তিনি হয়ে উঠেন অনিয়মিত।
পতনের শেষ ধাপ
মিলানের একটি নাইটক্লাবে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এক নারীকে যৌন হেনস্তা করার দায়ে এক আদালত তাঁকে ৯ বছরের সাজা প্রদান করে, ইতালিতে গেলে যে সাজা কার্যকর হবে। ‘পরবর্তী পেলে’ যখন জেলের আলেখ্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, তখন সান্তোসের এক যুব কোচের গলায় একরাশ আফসোস। নেইমার আর রবিনহো, দুজনকেই কাছ থেকে দেখা এই কোচের কাছে রবিনহোর হারিয়ে যাওয়াটা তাঁর কাছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের জন্য অভাবনীয় এক ক্ষতি। কী ছিলনা তাঁর পায়ে? এককথায় সব। নেইমারের চেয়েও উজ্জ্বল তাঁর আগমন আর নীরবেই ধ্বংস হলো তাঁর ক্যারিয়ার। খুব সুন্দর এক শিক্ষা তাঁর ক্যারিয়ারটা আমাদের দেয়। স্কিল বা ট্যালেন্ট যা-ই থাকুক, আসল জিনিস হলো পরিশ্রম আর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যে দুটোর অভাবে অভাবনীয় প্রতিভার আসল ছটা দেখলো না ফুটবল বিশ্ব।