অ্যালেক্স হেস নামের এক বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক দ্রগবার সাক্ষাৎকার নিতে চাইছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। হঠাৎ একদিন ফোন এলো, ওপাশ থেকে দরাজ গলায় একজন বললেন,
“হ্যালো, আমি দিদিয়ের বলছি। আবিদজানে চলে এসো, হতাশ হবে না নিশ্চিত, বরং লেখার আরো অনেক খোরাক পাবে।”
অ্যালেক্স দোনামনা করেও শেষ অবধি চলেই যান আবিদজানে। সেই সফরটা অ্যালেক্সের অনেক চিন্তাধারাই বদলে দেয়। তার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফুটবলারের স্থানটা হয়ে যায় দিদিয়ের দ্রগবার। কেন? সেই সাক্ষাৎকারে দ্রগবার একটি কথা উল্লেখ করেই পুরো ঘটনায় যাওয়া যাক। তিনি বলেছিলেন,
“আমি অনেক ট্রফি জিতেছি, অ্যালেক্স। কিন্তু এদের কোনোটিই আমাকে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি মর্যাদা ও আনন্দ দেয়নি!”
২০০৫ সাল, আফ্রিকান দেশগুলোর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা চলছে। সুদানকে হারিয়ে সেবার প্রথমবারের মতো আইভরিকোস্ট বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। পুরো দেশ তখন আনন্দে উদ্বেলিত। কেনই বা হবে না? পাঁচ বছর ধরে দেশটি প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পীড়িত। চারিদিকে ক্ষুধা, হত্যা, অত্যাচার আর রক্ত। এদিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার আনন্দে স্বভাবতই মত্ত খেলোয়াড়রা। ড্রেসিংরুমে চলছিল উল্লাস। এরই মধ্যে দ্রগবা সবাইকে উল্লাস থামাতে বলেন। ডেকে আনা হয় মিডিয়াকে, পুরো আইভরিকোস্ট তখন টিভির সামনে সরাসরি সম্প্রচারে। মাইক্রোফোন হাতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দ্রগবা বিবাদমান দু’পক্ষের কাছে অনুরোধ জানালেন, এ রক্তক্ষয় বন্ধ করতে, দেশকে নবনির্মাণ করতে। রূপকথার গল্প ভাববেন না পাঠক, সত্যিই গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! সেই থেকে আইভরিকোস্টে দ্রগবা যেন এক ডেমিগড।
৫ বছর বয়সে দ্রগবা তার চাচার সাথে ফ্রান্সে চলে এলেও, গৃহকাতরতার জন্য বেশিদিন টিকতে পারেননি। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে পারিবারিক কারণে আইভরিকোস্ট থেকে আবার ফ্রান্সে চলে আসেন। এক সাদাসিধে ছেলে, মনের আনন্দে রাস্তায় ফুটবল খেলেন, এমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই যে প্রফেশনাল ফুটবলার হতেই হবে। কিন্তু রক্তে যে আছে ফুটবল! স্কুল ও স্থানীয় ফুটবল ধরে ধরে লে মান্স নামের দ্বিতীয় সারির ক্লাবে চলে আসেন তিনি। কিন্তু অগ্রগতি প্রচণ্ড ধীরগতির। প্রথম চার বছরেও অনুশীলনে নিয়মিত হতে পারেননি। শারীরিক, মানসিক অজুহাতে প্রায়ই অনুশীলন বাদ দিতেন। ২১ বছর বয়সে তার যুবদলে অভিষেক হয়! অথচ এই বয়সে অনেকের তারকাখ্যাতি এসে যায়। যেবার মূল দলে জায়গা পেলেন, সে বছর তার কপালে কোনো গোলই জোটেনি। এরপরের বছর ইনজুরিতে পড়েন। ফিরে এসেও দেখালেন সেই গড়পড়তা খেলা, ১৬ ম্যাচে মাত্র ৩ গোল। তাকে প্রথম বিভাগের শেষ সারির দল গুইনগাম্প কিনে নেয় মৌসুমের মধ্যপথে। তেমন কোনো পরিবর্তন এলো না তার খেলায়। তবুও পরের মৌসুমের জন্য কোচিং স্টাফরা তার উপর ভরসা রাখলেন। আর সেখান থেকে তার উত্থানপর্ব শুরু। ৩৪ ম্যাচে ১৭ গোল করে গুইনগাম্পকে ৭ম স্থানে এনে দেন। ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট মার্সেই এর নজরে পড়ে গেলেন দ্রগবা। যোগ দিলেন মার্সেই এ। সেই ফর্ম চলতেই থাকলো। সে মৌসুমে ২৪ গোল করে চলে এলেন চেলসির রাডারে।
তখন তার বয়স ২৫ পেরিয়েছে। জোসে মরিনহো চেলসিতে এসেছেন নতুন। মরিনহো নিজেও প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী, চেলসিও তাই। টাকা খরচ করতে রাজি, কিন্তু সাফল্য চাই-ই। মরিনহো ২৫.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে যখন ২৫ বছর বয়সী তুলনামূলক অখ্যাত, অপরীক্ষিত দ্রগবাকে নিয়ে এলেন, ইংল্যান্ডে তখন অনেকেই সন্দিহান। সবাই চাইছিলেন প্রতিষ্ঠিত কোনো স্ট্রাইকারকে। চিরকালীন অ্যারোগেন্ট মরিনহো বলে দিলেন, আমার এই সিদ্ধান্তকে বিচার করবেন আরো বছর কয়েক পরে। সত্যিই তাই। প্রথম মৌসুমে এসেই জোড়া ইনজুরির ধাক্কা। ফিট হয়ে ফিরে সাহায্য করলেন দলের ৫০ বছর পর প্রথম লিগ ট্রফি জয়ে। সেবার করলেন ১৬ গোল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, সেই চেলসি দলকে বলা হতো ‘দ্য ১-০ টিম’! আর দ্রগবার গোলগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যেত, কেন তার এত মাহাত্ম্য। দ্রগবার সেসব গোল এ যুগে চোখ ছানাবড়া না করলেও তার অধিকাংশ গোলই ছিল মোক্ষম সময়ে। পরাজয় ঠেকানো, সমতায় ফেরানো বা জয়সূচক টাইপ গোলই তার ছিল বেশি। অভিষেক মৌসুমেই কারলিং কাপ ফাইনালে তারই দেওয়া গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলকে ১-০ তে হারায় চেলসি। ইনজুরি বিধ্বস্ত মৌসুমেও তার অবদান ছিল বলার মতো। সেই থেকে শুরু। এরপরে চেলসির আক্রমণের আসল কাণ্ডারী তিনি। পরের মৌসুমের শুরুতে তারই গোলে আর্সেনালকে কমিউনিটি শিল্ডের ফাইনালে হারায় চেলসি। দেখা যেতে থাকে অন্য এক দ্রগবাকে। কেবল গোল করা নয়, গোল করানোর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যেতে থাকে তাকে। সেবার আবার লিগ জিতে নেয় চেলসি, যার মূল ভিত্তি ছিল ল্যাম্পার্ড-দ্রগবা পার্টনারশিপ।
এর পরের মৌসুমটা দ্রগবার জন্য হয়ে আসে তার চেলসি ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম। ৩৩ গোল করে দলকে জেতান কারলিং কাপ ও এফএ কাপ। দ্রগবার বহুল জনপ্রিয়তার একটা অন্যতম কারণ ছিল চেলসিতে তার সাফল্যের সম্মুখ নায়কই তিনি। তার দেওয়া জোড়া গোলেই ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালকে হারায় চেলসি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে এফএ কাপ ফাইনালের নায়কও তিনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতও আসতে থাকে তার ক্যারিয়ারে। মরিনহো চেলসি ছাড়ার পর তার ফর্মে বেশ ধাক্কা লাগে। মরিনহো যখন তাকে জানান যে, তিনি ক্লাব ছাড়ছেন। দ্রগবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অন্তর্বর্তী কোচ আভ্রাম গ্রান্টের অধীনে দেরিতে হলেও ফর্ম ফিরে পান তিনি, সেই সাথে চেলসি। তারই গোলে সেমিফাইনালে লিভারপুলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠে যায় চেলসি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে সেই ফাইনালে সমতায় থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত সময়ে তার দারুণ একটি শট বারে লেগে আসে, ভাগ্য আর সেদিন পক্ষে ছিল না। হতাশ দ্রগবা লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়েন। ধারাভাষ্যকাররা তখন বলছিলেন, এটাই হয়তো তার শেষ ম্যাচ। কিন্তু বিধাতার মর্জি যে ছিল অন্যরকম; তার বিদায় হয় এমনই এক ম্যাচে, অন্যভাবে।
এরপরের মৌসুমে স্কলারির অধীনে ধুঁকতে থাকেন দ্রগবা, স্কলারি বরখাস্ত হলে হিডিঙ্ক এসে তাকে জাগিয়ে তোলেন, ওঠেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিতে। কিন্তু বিতর্কিত সেকেন্ড লেগের এক ম্যাচে চেলসি বার্সেলোনার কাছে তাদের এক প্রাপ্য জয় বঞ্চিত হয়। তবে মৌসুমে খালি হাতে ফিরতে হয়নি চেলসিকে। তারই গোলে লিগ কাপের ফাইনালে এভারটনকে হারায় চেলসি। পরের মৌসুমে কার্লো আঞ্চেলত্তি আসেন। দ্রগবাও ফেরেন তার চিরচেনা ফর্মে, তখন বিশ্বে দ্রগবা কেবল সেরা স্ট্রাইকার না, সেরা খেলোয়াড়দেরই একজন। দলকে জেতালেন লিগ । আর কাপ ফাইনালে তারই গোলে জিতে যায় চেলসি। কী দেখলেন? যখনই দরকারী মুহূর্ত, তখনই তার সেরাটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু ক্লাবের মালিক আব্রাহামোভিচের আক্ষেপ একটাই, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। বারবার কাছে গিয়েও ব্যর্থ চেলসি।
এক টালমাটাল মৌসুমে ডি মাত্তেও দায়িত্ব নিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্বে নাপোলির সাথে চেলসির বাদ পড়া নিশ্চিত- এমন ম্যাচে কামব্যাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন দ্রগবা গোল করে। তারই গোলে সেমি ফাইনালের প্রথম লেগে বার্সেলোনার সাথে জয় পায় চেলসি। তারই তিন দিন আগে দারুণ এক গোলে চেলসিকে এফএ কাপের ফাইনালে তোলেন দ্রগবা, যেন ডালভাতের মতো ব্যাপার ফাইনালে তার গোল! এফএ কাপ ফাইনালে লিভারপুলের সাথে জয়সূচক গোলটি আসে সেই তারই পা থেকে। টালমাটাল মৌসুমে চেলসি পায় শিরোপার স্বাদ। এদিকে চেলসি তখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। দুর্বল দলটির সামনে নিজেদের মাঠে ফাইনালে প্রায় অদম্য মনে হওয়া বায়ার্ন। সারা ম্যাচে আক্রমণ বলতে গেলে করেইনি চেলসি, উল্টো ৮২ মিনিটে গোল খেয়ে যায় বায়ার্নের কাছে। ঘরের মাঠে সমর্থকরা যখন উদযাপনের অপেক্ষায়, তখন পুরো স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কর্নার থেকে ভেসে আসা বলে গোল দিয়ে সমতায় ফেরান চেলসিকে। এক্সট্রা টাইমে তারই করা ফাউলে পেনাল্টি পায় বায়ার্ন, সব হারানোর পথে দ্রগবা। এতদিনের ঋণ ফেরাতেই যেন চেলসি কিপার চেক ঠেকিয়ে দিলেন পেনাল্টি, মহানায়ককে ভিলেন হতে দিলেন না। টাইব্রেকারে শেষ শটটি তার, গোল হলে চ্যাম্পিয়ন। মাথায় রাজ্যের চাপ, এই দলটির এত উঠে আসার পেছনে তার অসম্ভব অবদান। পারবেন কি? পারলেন, বলটি জালে জড়াতেই যেন তার চেলসি অধ্যায় পূর্ণ হয়ে যায়। চেলসির ইতিহাস থেকে সমর্থক- সবার মনেই তার স্থান হয়ে যায় চিরস্থায়ী।
সেই সাংবাদিক অ্যালেক্স যখন আবিদজানের রাস্তায় ঘুরছেন, যেন বারবার অবাক হচ্ছিলেন। একটা দেশে এত জনপ্রিয়তা কীভাবে থাকে একজন মানুষের? কফি শপ থেকে জুতোর দোকান- সর্বত্রই তার ছবি। লোকজনের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়, তিনি ফুটবলারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু সেখানে। অ্যালেক্স জিজ্ঞাসা করলেন, “কখনো তো ইংল্যান্ডে বলেননি, আপনি এখানে এত জনপ্রিয়!” হেসে দ্রগবা জানান, তিনি প্রচারবিমুখতাই ভালবাসেন।
সেই যুদ্ধবিরতির দুই বছর পর আবার দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা, লড়াই শুরু হতে থাকে। আবার তিনি এগিয়ে এলেন, প্রেসিডেন্টকে বলে জাতীয় দলের একটি ম্যাচ রাজধানী থেকে বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সে ম্যাচে আইভরিকোস্টের জাতীয় সঙ্গীতের সময় দুই নেতাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যখন জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন, তখন দ্রগবার কাছে মনে হচ্ছিল, যেন এক নতুন আইভরিকোস্ট জন্ম নিচ্ছে।
আসলেই এক নতুন আইভরিকোস্টের অগ্রপথিক তিনি। আইভরিকোস্টের ফুটবলে নবজাগরণের আদর্শ তিনি। নিজেকে দেশের দুঃসময়ে দূরে রাখেননি। উল্লাস থামিয়ে হাঁটু গেড়ে দেশের মানুষের জন্য শান্তি ভিক্ষা করেছেন, সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও দেশের মানুষকে শান্তির ঘুম উপহার দিয়েছেন, দিয়েছেন রাস্তায় নেমে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার সুযোগ। আসলেই কি দিদিয়ের দ্রগবা কিংবদন্তীর চেয়েও একটু বেশি কিছু নন?