উত্তর মেরুর প্রায় সবখানেই চলছে শীতের রাজত্ব, তীব্র শীত আর বড়দিনের ছুটির আমেজ ইউরোপের ফুটবলেও প্রভাব ফেলেছে। বড়দিনের ছুটিতে প্রায় প্রতিটি লিগই দুই সপ্তাহের বিরতিতে গেছে। তবে এই ছুটি শুরুর আগেই দারুণ সব ম্যাচ উপহার দিয়ে গেছেন তারা। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া সব ম্যাচ বিশ্লেষণ করে আমরা বেছে নিয়েছি সেরা খেলোয়াড়দের। দেখে নেওয়া যাক সেসব খেলোয়াড়দের তালিকা।
প্রিমিয়ার লিগ – কেভিন ডি ব্রুইন (ম্যানচেস্টার সিটি)
সব লিগ বড়দিনের ছুটিতে গেলেও ব্যতিক্রম শুধুমাত্র ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। শ্রমজীবী মানুষদের ছুটি আরো উপভোগ্য করে তোলার জন্য এই ছুটিতে ইংলিশ লিগে বরং অতিরিক্ত এক গেমউইক খেলা হয়। টানা ম্যাচের কারণে খেলোয়াড়দের খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। খেলোয়াড়েরা যাতে টানা খেলে ইনজুরিতে না পড়ে এজন্য কোচদের খুব বুঝে-শুনে একাদশ নির্বাচন করতে হয়। এই অসম্ভব টাইট শিডিউলেও কিছু খেলোয়াড় দারুণ ধারাবাহিক পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন।
এদের মধ্যে কেভিন ডি ব্রুইনের কথা সবার আগে উল্লেখ করতে হয়। ডিসেম্বরে ইংলিশ লিগে ম্যানসিটির ছয়টি ম্যাচেই শুরু থেকে ছিলেন এই বেলজিয়ান প্লেমেকার, তিন গোল ও তিন অ্যাসিস্টে সিটিজেনদের তিন জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষ করে আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচটির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়। এমিরেটস স্টেডিয়ামে সিটিজেনদের করা তিন গোলের প্রতিটিতে প্রত্যক্ষ অবদান রেখে গানারদের একাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ডিসেম্বরে লিভারপুলের রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডও স্বমহিমায় উজ্বল ছিলেন। এই মাসে অলরেডদের ম্যাচ ছিল পাঁচটি, যার মধ্যে চারটিতেই ক্লিনশিট রেখেছিল তারা। আর্নল্ড আসল জাদুটা দেখিয়েছেন অন্যখানে, এক গোল ও তিন অ্যাসিস্ট করে দলের প্রায় প্রতিটি আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন এই ফুলব্যাক।
এছাড়া পাঁচ গোল করে সেরা খেলোয়াড়ের দৌড়ে আরেকজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ড্যানি ইংস। তার এই অনবদ্য পারফরম্যান্সের কারণেই পয়েন্ট টেবিলের তলানি থেকে বারো নাম্বারে উঠে এসেছে সাউদাম্পটন। এই তিনজনের মাঝে একজনকে বেছে নেওয়া বেশ কঠিন কাজ ছিল, তবুও সবকিছু বিবেচনা করে কেভিন ডি ব্রুইনকেই ডিসেম্বর মাসে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নেওয়া হলো।
লা লিগা – লুইস সুয়ারেজ (বার্সেলোনা)
ধারে রিয়াল সোসিয়েদাদে খেলতে আসার পর থেকেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন মার্টিন ওডেগার্ড। ডিসেম্বরে তিন ম্যাচ খেলে করেছেন এক গোল ও এক অ্যাসিস্ট। গোল-অ্যাসিস্টের চেয়েও তার খেলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বেশি প্রশংসিত হচ্ছে, বিশেষ করে শক্তিশালী বার্সার বিপক্ষে পুরো ম্যাচেই ছিলেন দারুণ ছন্দে। এদিকে বরাবরের মতো এই মাসেও লা লিগায় দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন লিওনেল মেসি। পাঁচ ম্যাচে পাঁচ গোল ও সাথে এক অ্যাসিস্ট করে বার্সার শীর্ষস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন তিনি।
তবে ওডেগার্ড ও মেসিকে ছাড়িয়ে গত মাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন লুইস সুয়ারেজ। কিছুটা মুটিয়ে যাওয়া, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অ্যাওয়ে ম্যাচে গোল না পাওয়া– সবকিছু মিলিয়ে মৌসুমের শুরু থেকেই কিছুটা সমালোচনার মুখে ছিলেন তিনি। কঠিন সময়ের সব বাঁধা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পাঁচ ম্যাচে তিন গোল ও ছয় অ্যাসিস্টে দারুণভাবে ফিরে এসেছেন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার। এমন অনবদ্য পারফরম্যান্স তার আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে বড় ভূমিকা রাখবে তা বলাই বাহুল্য।
বুন্দেসলিগা – টিমো ভার্নার (আরবি লাইপজিগ)
বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে এখন পর্যন্ত বুন্দেসলিগার পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে অবস্থান করছে আরবি লাইপজিগ। আর তাদের এই সাফল্যে সবচেয়ে বড় অবদান দলটির সেরা তারকা টিমো ভার্নারের। মৌসুমের শুরু থেকেই দারুণ ধারাবাহিক পারফর্মেন্স উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে ডিসেম্বরে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত, চার ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল, সাথে এক অ্যাসিস্ট। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ম্যাচটির কথা। জোড়া গোল করে দলকে অ্যাওয়ে ম্যাচে ড্র এনে দেওয়ার মূল নায়ক ছিলেন তিনি।
এদিকে বায়ার্ন মিউনিখ পয়েন্ট টেবিলে পিছিয়ে থাকলেও তাদের স্ট্রাইকার রবার্ট লেভান্ডস্কি মৌসুমের শুরু থেকেই রয়েছেন দুর্দান্ত ফর্মে। এই মাসেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন এই পোলিশ তারকা, চার ম্যাচে করেছেন তিন গোল, সাথে এক অ্যাসিস্ট। লেভান্ডস্কির সতীর্থ ফিলিপ কৌতিনহো ওয়ের্ডার ব্রেমেনের বিপক্ষে এক ম্যাচে তিন গোল ও দুই অ্যাসিস্ট করে নিজের স্বরূপে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের পুরনো রোগ অধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারেননি এই ব্রাজিলিয়ান তারকা, পরের দুই ম্যাচে কোনো গোলেই তার অবদান ছিল না। তাই সবকিছু মিলিয়ে টিমো ভার্নারকেই ডিসেম্বর মাসে বুন্দেসলিগার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নেওয়া হলো।
সিরি এ – ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (জুভেন্টাস)
গত মৌসুমের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে সবাইকে চমকে দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। নিজের এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রত্যয়কেই সামনে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নেওয়ার পর এই নতুন চ্যালেঞ্জের কথা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক হাসি-তামাশা হয়েছিল। এই মৌসুমের শুরুতে সিরি এ-তেও যখন খারাপ সময় পার করছিলেন, তখন তাকে নিয়ে এই ট্রলের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেছিল।
অবশ্য সমালোচকদের এসব কথায় তো কখনোই দমে যাননি রোনালদো, সবকিছু উপেক্ষা করে ঠিকই স্বরূপে ফিরে এসেছেন। ডিসেম্বরেও ঠিক তা-ই হয়েছে, চার ম্যাচে পাঁচ গোল করে আবারো ফর্মে ফিরে এসেছেন এই পর্তুগিজ তারকা। বিশেষ করে সাম্পদোরিয়ার বিপক্ষে সুপারম্যানের মতো শূন্যে ভেসে থেকে যেভাবে হেডে গোল করেছেন, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সিরি এ-তে গত মাসে অন্য কোনো খেলোয়াড়ই সেভাবে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে পারেননি। তাই সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বেছে নিতে খুব একটা চিন্তা করতে হয়নি।
লিগ ওয়ান – নেইমার (পিএসজি)
নেইমারকে নিয়ে তার ভক্তদের অনেক স্বপ্ন ছিল, মেসি-রোনালদো যুগের পর নেইমারের একক রাজত্ব দেখা যাবে– এমন আশা অনেকেই বুক বেঁধেছিল। কিন্তু ক্রমাগত ইনজুরির কারণে সেই আশার সিকিভাগও পূরণ হয়নি। সাথে যোগ হয়েছে মাঠের বাইরের নানা বিতর্ক, মৌসুমের শুরুতেই পিএসজি ছেড়ে নিজের পুরনো ক্লাব বার্সেলোনায় ফেরার জন্য নানা ধরনের চেষ্টা করেছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। তার সেই ইচ্ছার কারণে বেশ কিছু ম্যাচে তাকে একাদশে রাখেননি পিএসজি কোচ টমাস টুখেল।
নেইমারের সেই ইচ্ছা অবশ্য পূরণ হয়নি, সবকিছু ভুলে পিএসজিতেই নিজের সেরাটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আবারো ইনজুরির থাবায় চলে গিয়েছিলেন মাঠের বাইরে। এভাবে এতদিন মাঠের বাইরে থাকায় তার ভক্তরাও বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এবার ইনজুরি থেকে ফিরে অবশ্য স্বমহিমাতেই ফিরেছেন নেইমার। ডিসেম্বর মাসে লিগ ওয়ানের প্রতিটি ম্যাচে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন তিনি, চার ম্যাচে করেছেন চার গোল, সাথে চার অ্যাসিস্ট।
সত্যি বলতে ছন্দে থাকা নেইমারকে এসব গোল-অ্যাসিস্ট দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। কিছুটা নিচে নেমে এসে প্রতিটি ম্যাচ তিনি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন তা এককথায় দুর্দান্ত। আর এ কারণেই ছয় গোল ও এক অ্যাসিস্ট করা পিএসজিরই আরেক তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে না নিয়ে নেইমারকেই সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ – আরকাদিউসজ মিলিক (নাপোলি)
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের শেষ রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে ডিসেম্বরে, তাতে বেশ কিছু ম্যাচেই গোলবন্যা দেখা গেছে। ডিনামো জাগরেবের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে সিটিজেনদের বড় জয় এনে দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। গ্যালাতাসারের বিপক্ষে পিএসজি পেয়েছিল ৫-০ গোলের বড় জয়, যেখানে নেইমার ও এমবাপ্পে– উভয়ের ঝুলিতে ছিল এক গোল ও দুই অ্যাসিস্ট।
তবে সবাইকে পেছনে ফেলেছেন নাপোলির স্ট্রাইকার আরকাদিউসজ মিলিক। পরের রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকার জন্য ঘরের মাঠে গেঙ্কের বিপক্ষে ন্যূনতম ড্র দরকার ছিল নাপোলির। অবশ্য ড্রয়ের জন্য তাদের ভাবতে হয়নি, খেলার ৩৮ মিনিটের মাঝে হ্যাটট্রিক করে তাদের বড় জয় নিশ্চিত করেছেন মিলিক। তাই ম্যাচের গুরুত্ব বিবেচনা করে মিলিককেই বেছে নেওয়া হলো।
ইউরোপা লিগ – দিয়েগো জোতা (উলভারহ্যাম্পটন)
৫৬ মিনিটে বদলি হিসেবে নেমে ৬৮ মিনিটের মাঝে হ্যাটট্রিক পূরণ– পুরো ব্যাপারটি ভাবলে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এমন অবিশ্বাস্য কাজটিই করে দেখিয়েছেন উলভারহ্যাম্পটনের পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড দিয়েগো জোতা। বদলি হিসেবে তিনি যখন নামেন তখন গোলশূন্য ড্র নিয়ে খেলা এগিয়ে যাচ্ছিল। মাঠে নেমে মুহূর্তের মাঝে খেলার গতিপথ পাল্টে দেন তিনি। তার হ্যাটট্রিকে বেসিকতাসের বিপক্ষে ৪-০ গোলের বড় জয় নিয়েই পরের পর্বের জন্য নিজেদের আগমনী বার্তা জানিয়ে রাখে নেকড়েরা।
ইউরোপা লিগে এই মাসের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই ছিলেন বুকায়ো সাকা। স্টান্ডার্ড লিয়েগের বিপক্ষে গানাররা যখন ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিল, তখন সমীকরণের মারপ্যাঁচে তাদের গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখনই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন সাকা, এক গোল ও এক অ্যাসিস্ট করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গানারদের পরের রাউন্ড নিশ্চিত করেন তিনি। তবে অল্প কিছু ব্যবধানে সাকাকে টপকে জোতার অভাবনীয় হ্যাটট্রিকই এগিয়ে থাকবে।