১.
বিগ ব্যাশের ২০১৬-১৭ মৌসুমের ১২তম ম্যাচ। মেলবোর্ন ডার্বিতে মুখোমুখি হয় রেনেগেডস এবং স্টার্স। নতুন বছরের প্রথম দিনে মেলবোর্ন শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করে মাঠে নামে দুই দল। টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করার আমন্ত্রণ পায় রেনেগেডস। ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়ে সবাইকে চমকে দেয় ফিঞ্চের রেনেগেডস। নিয়মিত ওপেনার মার্কাস হ্যারিসের সাথে ক্রিজে না এসে আগে কখনও টি-টোয়েন্টিতে ওপেনিংয়ে না নামা সুনীল নারাইনকে নিয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন ফিঞ্চ।
স্টার্সের স্পিনার মাইকেল বিয়ার তখন প্রতি ম্যাচেই শুরুতে এসে মিতব্যয়ী বোলিং করে যাচ্ছিলেন। তখনই রেনেগেডস ম্যানেজমেন্ট তার বিপক্ষে পিঞ্চ-হিটার হিসাবে নামিয়ে দেয় নারাইনকে। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ওপেন করতে নেমে ১৩ বলে ২১ রানের কার্যকরী ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। নারাইনকে ওপেনার হিসাবে খেলানোর গেইম প্ল্যান ভালোভাবেই কাজে দিয়েছে রেনেগেডসের জন্য। এইরকম প্ল্যান পরবর্তী পাঁচ ম্যাচে আরও দুইবার করেছিল তারা।
২.
বিগ ব্যাশের তিন মাস পর অনুষ্ঠিত হয় আইপিএল। আসর শুরু হওয়ার আগেই বড় ধাক্কা খায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। ওয়াডার গাইড লাইন না মানার কারণে এক বছরের জন্য সবধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আন্দ্রে রাসেল। এদিকে কলকাতার ঘরের মাঠ ধীরে ধীরে ব্যাটিং স্বর্গে পরিনত হয়ে যাচ্ছিলো। তাই আন্দ্রে রাসেলের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের ব্যাকআপ হিসাবে পাওয়ার-প্লেতে দ্রুতগতিতে রান তোলার জন্য ক্রিস লিনকে দলে নেয় কলকাতা।
কলকাতাকে হতাশ করেননি ক্রিস লিন। গুজরাট লায়ন্সের বিপক্ষে ৪১ বলে অপরাজিত ৯৩ রানের ইনিংস দিয়ে আসর শুরু করেন। মাত্র দুই ম্যাচ খেলেই লিন ইনজুরিতে পড়লে সুনীল নারাইনকে ওপেনার হিসাবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতা। ওপেনার হিসাবে কলকাতার হয়ে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত করেন তিনি। মাত্র ১৮ বলে ৩৭ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে দলের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন।
২০১৭ সালে পুরো আসর জুড়েই কলকাতাকে উড়ন্ত সব সূচনা এনে দিয়েছিলেন নারাইন। আসরে ১৮৯.৮৯ স্ট্রাইকরেটে ৩৫৭ রান করেছিলেন। যার ফলে পাওয়ারপ্লেতে দ্রুতগতিতে রান তুলেছিল কলকাতা। আইপিএলের প্রথম ১২ আসরের মধ্যে এক আসরে প্রথম ছয় ওভারে সবচেয়ে বেশি রান রেটে রান তুলেছে কলকাতা। ২০১৭ সালে কলকাতার প্রথম ছয় ওভারে রান রেট ছিল ৯.৪০।
সুনীল ২০১৭ সালের আসরে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি নিজের মূল কাজ বোলিংয়েও দলকে সার্ভিস দিয়ে গেছিলেন। ৩৫৭ রানের পাশাপাশি ১৭ উইকেট তুলে নিয়ে মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।
৩.
২০১৭ সালে কলকাতার হয়ে ওপেনিংয়ে নামার পর পরবর্তী ৪২ ইনিংসের মধ্যে ৩৬ ইনিংসেই কলকাতার হয়ে ওপেনিংয়ে নেমেছেন তিনি। সব ধরনের টি-টোয়েন্টিতে ২০১৭ সালে ৬২% ইনিংসে, ২০১৮ তে ৭১% ইনিংসে, ২০১৯ সালে ৮৫% ইনিংসে এবং ২০২০ সালে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে মিডল-অর্ডারে নামার আগে শতভাগ ইনিংসে ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করেছেন নারাইন।
টি-টোয়েন্টিতে পিঞ্চ-হিটার শব্দের ব্যবহার খুব একটা হয় না, কারণ এই ফরম্যাটে সব ব্যাটসম্যানই আক্রমণাত্মক খেলে থাকেন। তবে নারাইনকে কলকাতা যেভাবে ব্যবহার করেছে, তার নামের পাশে পিঞ্চ-হিটার শব্দটি মানায়। ওপেনিংয়ে নেমে গড়ে প্রতি ইনিংসে ১১ বল খেললেও তার সময়ে ওপেনারদের মধ্যে দ্রুত রান তোলার দিক থেকে তিনি চতুর্থ স্থানে আছেন। ব্যাট হাতে ক্রিজে আসো, ব্যাট চালাও, দ্রুত রান তোলো, কাজ শেষ। এটাই ছিল নারাইনের ওপেনিংয়ের জীবনচক্র।
ওপেনিংয়ে তার সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে স্পিন ভালো খেলতে পারা। শেষ চার মৌসুমে স্পিনারদের বিপক্ষে তিনি ওভারপ্রতি ১৩ রান করেছেন। স্ট্রাইকরেট রীতিমতো চক্ষু চড়কগাছ করে দেওয়ার মতো, ২২০! এই সময়ে তার চেয়ে দ্রুত স্পিনারদের বিপক্ষে রান তুলতে পারেননি আর কেউ।
৪.
স্পিনারদের বিপক্ষে রান তুলতে কোনো সমস্যা না হলেও দ্রুতগতির বলে টেল-এন্ডারদের মতোই ব্যাটিং করেন নারাইন। দ্রুতগতির পেসারদের বিপক্ষে ওভারপ্রতি মাত্র ৬ গড়ে রান করেছেন তিনি। এতদিন এতে কলকাতার কোনো সমস্যা হয়নি। নারাইনের সাথে ওপেনিংয়ে আসতেন ক্রিস লিন। লিন পেসারদের বিপক্ষে দুর্দান্ত, স্পিনারদের বিপক্ষে খুব একটা সাবলীল নন। তাকে আটকানোর জন্য স্পিনার আক্রমণে আনলে নারাইন তুলোধুনো করতেন, পেসার বল করলে লিন নিজেই। যাতে করে তাদের জুটির রসায়ন বেশ ভালোভাবে জমেছিল।
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ক্রিস লিন দ্রুতগতির পেসারদের বিপক্ষে ওভারপ্রতি ৯.৩ গড়ে এবং স্পিনারদের বিপক্ষে ৬.৮ গড়ে রান করেছেন। অন্যদিকে সুনীল নারাইন ঠিক তার উল্টো, স্পিনারদের বিপক্ষে ওভারপ্রতি ৯.৪ রান করলেও দ্রুতগতির পেসারদের বিপক্ষে মাত্র ৬.২ গড়ে রান করেছেন।
এইবছর ক্রিস লিন কলকাতা ছেড়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, যার ফলে নারাইনের সাথে ইনিংস উদ্বোধন করছেন শুভমান গিল। গিলের ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই; স্পিনারদের বিপক্ষে তার ব্যাটিং গড় ৬০-এর উপরে, পেসারদের বিপক্ষে ৩০ ছুঁইছুঁই। শুভমান গিল এবং সুনীল নারাইন ইনিংস উদ্বোধন করতে নামলে প্রতিপক্ষ দ্রুতগতির পেসার দিয়েই বোলিং আক্রমণ শুরু করে।
সুনীল নারাইন চলতি আসরে চার ম্যাচে ওপেনিংয়ে ব্যাট করেছেন, আর এই চার ম্যাচে যথাক্রমে ৯, ০, ১৫ এবং ৩ রান করেছেন। চার ম্যাচের এক ম্যাচেও তার বিপক্ষে স্পিনার আনেনি প্রতিপক্ষ। আইপিএলের গত আসরে যেখানে তিনি ৩৯% বল খেলেছেন স্পিনারদের, এই আসরে তা শূন্য।
৫.
ক্রিস লিন এবং সুনীল নারাইন একে অপরের দুর্বল দিকগুলো ঢাকা দিয়েছেন একসাথে। ক্রিস লিনের সাথে সুনীল নারাইন ২৫ বার ইনিংস উদ্বোধন করেছেন। এই ২৫ ইনিংসে তিনি ১৯০.১১ স্ট্রাইকরেটে এবং ২২.২৮ ব্যাটিং গড়ে ৫৫৭ রান করেছেন। অন্যদিকে, লিনকে ছাড়া আইপিএলে ১২ ইনিংসে ওপেনিংয়ে নেমে ১৬৭ রান করেছেন। স্ট্রাইকরেট এবং ব্যাটিং গড়েও আকাশ-পাতাল তফাৎ।
লিনের সাথে সুনীল নারাইন যে ২৫ ইনিংসে ব্যাটিং করেছেন, এর মধ্যে ২৪.৬% বল খেলেছেন স্পিনারদের। প্রতি চার বলে একটি স্পিনারদের। কিন্তু শুভমান গিল এবং গৌতম গম্ভীরের সাথে ব্যাটিংয়ে নেমে নয় বলের মধ্যে একটি খেলেছেন স্পিনারদের। এই মৌসুমে তো ওপেনিংয়ে স্পিনারদের মোকাবেলা করার সুযোগই পাননি।
৬.
ওপেনার হিসাবে যাত্রা শুরু করার পর প্রথম দুয়েক বছরে কয়েক ইনিংস পরই একটি ম্যাচের মোড় ঘুরানোর মতো ইনিংস উপহার দিতেন নারাইন, যার দেখা পাওয়া গত মৌসুম থেকেই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তিনি ২০১৭-১৮ সালের আসরে ওপেনার হিসাবে ২৬ ইনিংসে ১৮৭.৭১ স্ট্রাইকরেটে এবং ২১.৭৩ ব্যাটিং গড়ে ৫৬৫ রান করেছেন। এরপর ১১ বার ওপেনিংয়ে নেমে মাত্র ১৫৯ রান করেছেন তিনি।
নারাইন যখন ওপেনার হিসাবে ব্যাট করা শুরু করেছেন, তখন প্রতিপক্ষ তাকে নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় পায়নি। সময়ের সাথে সাথে দুর্বল দিকগুলো সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। এতে করে ৪-৫ ইনিংস পরপরই একটি করে ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলা নারাইন এখন ৯-১০ ম্যাচ পর পাকেচক্রে একটি ব্যাটসম্যান-সুলভ ইনিংস খেলতে পারেন।
৭.
টি-টোয়েন্টিতে শুধুমাত্র বোলার হিসাবে সুনীল নারাইন এখনও বেশ কার্যকরী। তাই ওপেনিংয়ে না খেললেও এখনও সেরা একাদশে জায়গা পাওয়ার সামর্থ্য আছে তার। আইপিএলে ‘ওপেনার নারাইন’-এর ক্যারিয়ার প্রায় শেষ। তার বদলে ইনিংস উদ্বোধন করা রাহুল ত্রিপাঠি ইতঃমধ্যে একাধিক ম্যাচে রান পেয়েছেন। তাই শুভমান গিলের সাথে তাকেই কলকাতার পছন্দ।
ওপেনার নারাইনের ক্যারিয়ার শেষ হলেও ‘ব্যাটসম্যান নারাইন’ অবশ্য এখনও দলের সম্পদে পরিণত হতে পারেন। জোফরা আর্চার, প্যাটিনসনদের গতির সামনে ইনিংসের শুরুতে সুবিধা করতে না পারলেও স্পিনারদের বিপক্ষে এখনও ভয়ংকর তিনি। অনেক দল মিডল ওভারে স্পিনারদের দিয়ে বোলিং করায়। চলতি আইপিএলেও মিডল ওভারে স্পিনাররাই ৮০ শতাংশের কাছাকাছি বোলিং করেছে। মিডল-অর্ডারে নারাইনকে পাঠালে দল উপকৃত হবে। প্রতিপক্ষ যদি নারাইন ব্যাটিংয়ে আসলে পেসার আক্রমণে নিয়ে আসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শেষের ওভারগুলো স্পিনারদের দিয়ে করাতে হবে। তখন রাসেল-মরগানরা যে স্পিনারদের ছেড়ে কথা বলবেন না, সেটা অনুমেয়।
বিগত আসরগুলোতে সুনীল নারাইনকে ওপেনার হিসাবে ব্যাট করতে পাঠানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়নি। কলকাতার হয়ে বেশ কিছু ম্যাচের মোড় ঘুরানো ইনিংস খেলেছেন তিনি। তবে এখন কলকাতা ওপেনার নারাইনের কথা বাদ দিয়েই সামনে আগানোর পরিকল্পনা করছে। ইতঃমধ্যেই প্রতিপক্ষ তার দুর্বল জায়গা সনাক্ত করে ফেলেছে। তাছাড়া ওপেনার হিসাবে শুভমান গিল-রাহুল ত্রিপাঠিরা দলকে ভালো সূচনা এনে দিচ্ছেন। ইংলিশ ওপেনার টম ব্যান্টনও আছেন কলকাতার স্কোয়াডে। সুনীল নারাইন হয়তো ওপেনার হিসাবে কলকাতার হয়ে শেষ ইনিংস ইতঃমধ্যেই খেলে ফেলেছেন। ওপেনার নারাইনকে দেখা না গেলেও ব্যাটসম্যান নারাইন আর কত ম্যাচে ঝড় তুলতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।