ম্যারাডোনা মানেই ফুটবলের জাদু; তাছাড়া ম্যারাডোনা যেখানে, সেখানে গল্পকথার পাশাপাশি জমে থাকে খানিকটা বিতর্কও। জাদুর ফুটবল, রূপকথার আখ্যান, বিতর্ক- সবকিছু মিলিয়েই যেন ম্যারাডোনা নামের পূর্ণতা পায়। ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে এসেছিলেন রাজকুমারের মতো, এরপর শিরোপা জিতেছেন রাজার মতো, আবার আসর থেকে বিদায়ও নিয়েছেন রাজ্যহীন রাজার মতো। সব মিলিয়ে আজও ম্যারাডোনা উপাখ্যানের জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি।
আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ও শেষ বিশ্বকাপ এসেছে এই কিংবদন্তির জাদুকরী পায়ের ছোঁয়াতেই। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেলেও ম্যারাডোনা ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপেই খেলেছেন। চার বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা গোল করেছেন ৮টি, হলুদ কার্ড ৪টি এবং লাল কার্ড ১টি। গোল কিংবা কার্ডের বিবেচনায় বিশ্বকাপের ম্যারাডোনাকে কতটুকু আর বিচার করা যায়!
যা-ই হোক, তাঁর অনবদ্য কৃতিত্বের সুবাদেই মেক্সিকো ‘৮৬ বিশ্বকাপের পর ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপেও টানা দুটি ফাইনাল খেলে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা বলেই কি না, প্রতিটি বিশ্বকাপেই তিনি জন্ম দিয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনার, তা লাথি মেরে লাল কার্ডই হোক কিংবা হ্যান্ড অব গড, শতাব্দীর সেরা গোল অথবা নিষিদ্ধ ড্রাগ নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়াই হোক!
ফিফার অনুরোধে ম্যারাডোনা তাঁর ঘটনাবহুল বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের নানা ঘটনা থেকে তুলে এনেছিলেন স্মরণীয় পাঁচটি মুহূর্ত, যেগুলোর প্রতিটি মুহূর্তে মিশে আছে বিশ্বকাপের অসাধারণ সব ঘটনা। ম্যারাডোনাকে নিয়ে ভক্তদের অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে, কিন্তু আপনি হয়তো সবসময়ই চেয়েছেন ম্যারাডোনার নিজের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর কথা জানতে। তাই আজকের আয়োজন বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত নিয়ে।
আর্জেন্টিনা ৪-১ হাঙ্গেরি: বিশ্বকাপে প্রথম গোল; ১৮ জুন, ১৯৮২
আর কিছুই না, আমি শুধু চাচ্ছিলাম বলটা জালে জড়াক। প্রথম ম্যাচে আমরা বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে গিয়েছিলাম, ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিলাম আমরা।
অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপেও গোল করেছিলাম, কিন্তু মূল বিশ্বকাপের গোল করার অনুভূতির সাথে আপনি তা তুলনা করতে পারবেন না। অনুভূতিটা এমন যে, আপনি বিছানায় এবং আপনার মা এসে সকালের নাস্তা দিয়ে গেল। মাকে চুমু খাওয়ার মতো নিখাদ সুখানুভূতি এটি। মাথায় তখন এরকম অনেক কিছু চলছে।
আর্জেন্টিনা ১-৩ ব্রাজিল: বাতিস্তাকে লাথি দেওয়ার জন্য লাল কার্ড; ২ জুলাই, ১৯৮২
বছরখানেক পরে আমি ব্যাপারটি নিয়ে বাতিস্তার সাথে কথা বলেছিলাম, ফ্যালকাওয়ের সাথেও। ফলাফল যখন ৩-১, তারা আমাদের নিয়ে মজা করতে শুরু করেছিল। হারতে আমি একটুও পছন্দ করি না। সে আমাকে বলেছিলো, “না, দিয়েগো। এটা শুধুই ফুটবল, যা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি।”
কিন্তু আপনি জানেন কি? আমি যদি ৩ গোলে এগিয়ে থাকি এবং বল পায়ে “অলে! অলে! অলে!” গাইতে থাকি, তখন আপনিও রাগে অন্ধ হয়ে যাবেন। আপনার শিরায় যদি বিন্দুমাত্র রক্ত থাকে, তাহলে প্রচণ্ড রাগে আপনার গা জ্বালা করবে। কিন্তু হ্যাঁ, আমি ভুল খেলোয়াড়কে লাথি মেরেছিলাম। অবিশ্বাস্য!
আর্জেন্টিনা ২-১ ইংল্যান্ড: শতাব্দীর সেরা গোল; ২২ জুন, ১৯৮৬
এরকম গোল আমি আর কখনোই করিনি। কিছু গোল করেছি যেগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা কঠিন, কিন্তু এই গোলটি ছিল বিশ্বকাপে। সব শিশুই এরকম একটি গোল করার স্বপ্ন দেখে। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি যে ড্রিবলিং করে তাদের অনেককে পিছনে ফেলে যাচ্ছি, (পিটার) শিলটনকেও। এখনও বুঝি না সে আসলে কী করেছিল। আমি জানি না আসলে কী হয়েছিল। মনে হয় তাকে কোনো ভূত বা ইউএফও নিচে নেমে এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পুরো গোলবার সে আমার জন্য একেবারে খুলে রেখেছিল। আমি তাকে শুধু পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম এবং এরকমই ছিল ব্যাপারটি।
যখনই টিভিতে মাকে আমার গোলগুলো উপভোগ করতে দেখেছি, তখনই মা বলতো, “এগুলো দেখতে কখনোই ক্লান্ত লাগে না আমার।” “মা, আবার একই গোলগুলো দেখছো!”
মা বলতো, ছেলেকে গোল করতে দেখলে ভীষণ হালকা লাগে নিজেকে। “তুমি যেতে চাইলে যাও। আমি তোমার গোলগুলো দেখতে থাকবো।”
ইতালি ১-১ আর্জেন্টিনা (টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে আর্জেন্টিনার জয়): পেনাল্টিতে জিঙ্গাকে পরাস্ত করা
বেশ অবাক করা ব্যাপার, কারণ আমরা পেনাল্টিতে গিয়েছিলাম। মাঠে ইতালিয়ানরা আমাকে বলছিল, ম্যাচটি তাদের জেতা উচিত ছিল। দে আগোস্তিনি এবং ওয়াল্টার জিঙ্গা আমাকে বলেছিল, ড্র ন্যায্য ফলাফল নয়। এমন ম্যাচে উপযুক্ত ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না, তাই না? তারা তাদের মতো করে দেখেছে, আমি আমার মতো।
যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে আমি একটি পেনাল্টি মিস করেছিলাম। তাই আমার পেনাল্টি নেওয়ার জন্য মাঝমাঠ থেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, আর নিজেকে বলছিলাম, “তুমি যদি এটা মিস কর, তাহলে তুমি নির্বোধ। যদি মিস কর, কাপুরুষ তুমি, নিকৃষ্ট। মা, বাবা, ভাই, আর্জেন্টিনার জনগণ- ভালোবাসার মানুষদের সাথে প্রতারণা করতে পারো না তুমি।” কিন্তু জিঙ্গাকে আমি পরাজিত করেছিলাম এবং ফাইনালে পা রেখেছিলাম। আমিই ইতালিয়ানদের পরাজিত করেছি।
আর্জেন্টিনা ১-০ ব্রাজিল: ক্লদিও কানিসিয়ার জন্য জাদুকরী অ্যাসিস্ট; ২৪ জুন ১৯৯০
গোলটির জন্য ব্রাজিলিয়ানরা আলেমাওকে দোষারোপ করে, কিন্তু আমি তাকে খুব দ্রুতই পার করে গিয়েছিলাম। একজন ছিল, যার বিপক্ষে আমাকে সত্যিই প্রতিরোধ করতে হয়েছিল এবং আমাকে আটকানোর জন্য তার প্রচেষ্টা থামাতে কনুই ব্যবহার করতে হয়েছিল, সে হলো দুঙ্গা। তাই এটা আলেমাও নয়, দুঙ্গার দোষ ছিল। আমার তাকেই পরাস্ত করে যেতে হয়েছিল।
কানি (ক্লদিও কানিসিয়া) যখন গোল করলো, আমি ঈশ্বর, আমার মা এবং সকল সন্তদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। সে তেমন একটা উদযাপন করেনি, শুধু মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলেছিল। উফ! যেন তেমন কিছুই হয়নি। কিছু সময় পর তাঁর সাথে দেখা হলে তাকে বললাম, “শোনো, পরিষ্কার দিনের এই আলোতে ঠিক এখানে, জানো আজকে তুমি কী করেছ?” সে বলল, “হ্যাঁ, গোল করেছি।” “না, তা নয়! তুমি গোটা স্টেডিয়ামকে নিশ্চুপ করে দিয়েছ!”
ব্রাজিলিয়ানদের প্রতি সম্মান থেকে, ড্রেসিং রুমে ফিরে যাওয়ার পথে আমি ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দিয়েছিলাম। জার্সিটি কারেয়াকার, সে আমার বন্ধু। কিন্তু মনে হচ্ছিলো যেন… আসলে তা-ও নয়, আমরা ব্রাজিলের কাছ থেকে জয়টা ছিনিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আর্জেন্টিনার পরিবর্তে তারাই পরবর্তী পর্বে যাওয়ার যোগ্য ছিল। গোটা ম্যাচে আমাদের উপর তাদের আধিপত্য বজায় থাকলেও আমরাই জিতেছিলাম। এজন্যই, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলা ফুটবল।
ফিচার ইমেজ- minutouno.com