লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একটা তৈরি করা ছবি খুব জনপ্রিয় হয়েছে- দুজনে কাঁধে হাত রেখে মাঠ ছেড়ে বের হচ্ছেন।
ছবিটা সত্যি না, কিন্তু প্রতীকটা সত্যি। সম্ভবত, বিশ্বকাপ না জিতেই ফুটবল থেকে বের হয়ে যেতে হবে এই দুই মহানায়ককে। যদিও বয়স বলে জোর করে আরেকটা বিশ্বকাপ হয়তো খেলতে পারেন দুজনই। কিন্তু এটা খুব কঠিন স্বপ্ন যে, পরের বিশ্বকাপে মেসি বা রোনালদো কারো স্বপ্নপূরণ হবে।
তাহলে কি তাদের নামও লেখা থাকবে বিশ্বকাপ না জেতা গ্রেটদের তালিকায়?
সময় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বিশ্বকাপ না জেতা ১০ মহাতারকাকে ফিরে দেখা যাক।
লেভ ইয়াসিন
গোলরক্ষক হিসেবে অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা এই সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলোয়াড়। আপাদমস্তক কালো পোশাক পরে মাঠে নামতেন। চিতার মতো ক্ষিপ্র আর মাকড়শার মতো ধূর্ত ছিলেন। তাই ডাক নাম ছিলো ব্ল্যাক স্পাইডান বা ব্ল্যাক প্যান্থার। তার সময়ে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো গোলরক্ষক এই বিশ্বে ছিল না।
ক্লাব দল ডায়নামো মস্কোর হয়ে অত্যন্ত সফল ক্যারিয়ার ছিলো তার। ৫ বার লিগ শিরোপা ও ৩ বার কাপ শিরোপা জিতেছেন। ৯ বার ইউরোপের বর্ষসেরা গোলরক্ষক হয়েছেন। জাতীয় দলের হয়েও ব্যর্থ ছিলেন, তা নয়। ইউরো জিতেছেন, অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জিতেছেন। কিন্তু জেতা হয়নি বিশ্বকাপটাই। ১৯৬৬ সালে সর্বোচ্চ সেমিফাইনাল অবধি গিয়েছিলেন। ওটাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিলো।
পাওলো মালদিনি
পাওলো মালদিনি বিশ্বকাপ জেতেননি, এটা বিশ্বাস করতে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। মালদিনের আগেও ইতালি বিশ্বকাপ জিতেছে, পরেও জিতেছে। মাঝের যে সময়টাতে মালদিনি ছিলেন ইতালির রক্ষণের দুর্গ, বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার; সেই সময়টাতেই কেবল তারা বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। মালদিনি ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি জাতীয় দলে খেলেছেন। ইতালি এর আগে ১৯৮২ সালে ও পরে ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছে। তার সময়কালে ১৯৯০ বিশ্বকাপে ইতালি তৃতীয় হয়েছিলো, ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে পেনাল্টি শুট আউটে গিয়ে হেরেছিলো! আর ১৯৯৮ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে ও ২০০২ সালে শেষ ষোলোতে বাদ পড়েছিলো তারা।
খেলোয়াড় হিসেবে মালদিনি কতটা কিংবদন্তী ছিলেন, সেটা তার ক্যারিয়ারই সাক্ষ্য দেবে। এসি মিলানের হয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি দাপটের সাথে খেলে গেছেন। ৫ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন!
জর্জ বেস্ট
জর্জ বেস্টের সামনে অবশ্য বিশ্বকাপ জয়ের কোনো সুযোগ ছিলো না। কারণ, তার দল আয়ারল্যান্ড তার খেলোয়াড়ী জীবনে তিনটি বিশ্বকাপে বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি। তবে বেস্ট ছিলেন সেই সময়ের অবিসংবাদিত সেরা ফুটবলারদের একজন। খেলোয়াড় হিসেবে যতটা আলোচিত ছিলেন, তার চেয়েও বেশি আলোচিত ছিলেন মাঠের বাইরের কর্মকান্ডের জন্য। নিজেই বলেছেন, জীবনটা আরেকটু সংযত হলে পেলে-ম্যারাডোনার নাম কেউ মনে রাখতো না!
১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ অবধি ১১ বছরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ৩৬১টি ম্যাচ খেলেছেন। নিজেকে ইউনাইটেডের একজন কিংবদন্তীতে পরিণত করেছেন। এই সময়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় অসংখ্য অর্জন আছে তার। ইউনাইটেড ছাড়ার পর অনেকগুলো ছোট ছোট ক্লাবে খেলেছেন। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে শেষ অবধি ২০০৫ সালে মৃত্যুই বরণ করেছেন। এর আগে রেখে গেছেন অসংখ্য গল্প এবং বিশ্বকাপ স্পর্শ করতে না পারার হতাশা।
মিশেল প্লাতিনি
প্লাতিনি নিজে যেমন সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন, তার সময়ের ফ্রান্সকেও বলা হয় সোনালী প্রজন্মের দল। এই দলটির অর্জনও নিতান্ত কম নয়। ১৯৮৪ সালের ইউরো জিতেছে তারা। ৯ গোল করে সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন প্লাতিনি। কিন্তু এই ফ্রান্সেরই দুর্ভাগ্য, পরপর দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে গেছে তারা, ১৯৮২ ও ১৯৮৬।
প্লাতিনি ছিলেন এমন এক মিডফিল্ডার, গোল করাটাও যার কাছে সহজাত একটা ব্যাপার ছিলো। ক্লাবের হয়ে ৫৮০ ম্যাচে তার ৩১২টি গোল ছিলো। মিডফিল্ডারদের মধ্যে তাকে সেরা গোল স্কোরার বলে মনে করা হয়। ফ্রান্স জাতীয় দলে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ গোলের মালিক ছিলেন প্লাতিনি।
জিকো
এটা শুধু জিকোর একার দুর্ভাগ্য নয়, ব্রাজিলের একটা প্রজন্মের জন্য হতাশার ব্যাপার যে, তারা ওই সময়ে তিনটি বিশ্বকাপের একটিও জিততে পারেননি। অথচ ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলগুলোর একটা মনে করা হয় সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশকের শুরুতে খেলা দলটিকে। তারা ১৯৭৮, ১৯৮২ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ব্যর্থ হওয়াতে জিকোর মতো সর্বকালের সেরা একজন ফুটবলারকে বিশ্বকাপের স্পর্শ ছাড়াই অবসরে যেতে হয়েছে।
এর মধ্যে ১৯৮২ সালের ব্রাজিল দলটাকে বলা হয়, বিশ্বকাপ না জেতা সর্বকালের সেরা ফুটবল দল। যে দলটি সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে হেরে বিদায় নিয়েছিলো।
জিকো কেমন ছিলেন, সেটা বুঝতে তার ডাক নামটা জানাই যথেষ্ঠ। তাকে বলা হতো, ‘সাদা পেলে’। সত্তর ও আশির দশকের সেরা খেলোয়াড় মনে করা হতো তাকে; যদিও সেই সময় পৃথিবীতে ডিয়েগো ম্যারাডোনাও উপস্থিত ছিলেন।
ইউসেবিও
লুই ফিগো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্ম পর্তুগালে। তারপরও দেশটির লোকেরা বিশ্বাস করে, এই দেশে জন্মানো সেরা ফুটবলারের নাম ইউসেবিও।
ইউসেবিওর দুর্ভাগ্য, তার সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি বিশ্বকাপের দুটিতে দলকে বাছাইপর্বই পার করাতে পারেননি। তবে যে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেলেছেন, সেখানে নিজেকে চিনিয়ে এসেছিলেন। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বাদ পড়েছিলেন। তার আগে ৯ গোল করে নাম লিখে রেখে এসেছেন। সেমিফাইনালে পর্তুগালের সেই বাদ পড়াটা ছিলো একটা হতাশার ব্যাপার।
বেনফিকার হয়ে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন এই পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। মোজাম্বিকে জন্ম নেওয়া এই আফ্রিকান ফুটবলার পর্তুগালে পরিচিত ‘দ্য কিং’ নামে।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো
একটা বিশ্বকাপ খেলার জন্য মানুষ কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ডি স্টেফানো।
পেলে ও ইউসেবিওর মতে, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ফুটবলার ছিলেন আর্জেন্টিনায় জন্মানো এই খেলোয়াড়। তাকে পূর্ণাঙ্গ বলার একটা বড় কারণ হলো তার মাঠের যেকোনো জায়গায় খেলার সমান দক্ষতাকে। যদিও ফরোয়ার্ড ছিলেন, কিন্তু বল বিতরণের জন্য মাঝমাঠে, আবার রক্ষণের জন্য নিজেদের বক্সে তার উপস্থিতি ছিলো নিয়মিত।
আর্জেন্টিনার হয়ে যখন খেলেছেন, তখন ১৯৫০ ও ১৯৫৪ বিশ্বকাপ বর্জন করেছিলো আর্জেন্টিনা। এরপর স্পেনে চলে আসার পর তারা ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার হতে ব্যর্থ হয়। আর ১৯৬২ সালে সবই ঠিক ছিলো, স্পেনও খেলছিলো; কিন্তু ডি স্টেফানো ইনজুরিতে পড়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের এই কিংবদন্তীকে বিশ্বকাপ খেলার আফসোস নিয়েই থাকতে হয়েছে।
ফেরেঙ্ক পুসকাস
হাঙ্গেরির ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’ নামে পরিচিত সোনালী প্রজন্মের দলের অধিনায়ক ছিলেন পুসকাস। এই দলটি বিশ্বকাপ জিতবে না, এটা তখন বললে কেউ বিশ্বাস করতে পারতো না।
পুসকাসকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা একজন গোলস্কোরার। যদিও তিনি প্রচলিত অর্থে ‘আউট অ্যান্ড আউট স্ট্রাইকার’ ছিলেন না। রিয়াল মাদ্রিদে ডি স্টেফানোর সাথে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর এক জুটি। ‘ডিপ লাইং সেন্টার ফরোয়ার্ড’ বা ‘সেকেন্ড স্ট্রাইকার’ ব্যাপারটার জন্মদাতা মনে করা হয় এই পুসকাসকে।
হাঙ্গেরির হয়ে বিশ্বকাপ জেতার চেষ্টা করেন ১৯৫৪ সালে। প্রায় কাছেই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনালে শেষ অবধি পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে যেতে হয়। এরপর ১৯৬২ বিশ্বকাপে স্পেনের হয়ে গিয়েছিলেন খেলতে। সেবার গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেন।
ইয়োহান ক্রুইফ
আধুনিক আক্রমণাত্মক ফুটবলের একজন জনক। বিশেষ করে ডাচ টোটাল ফুটবল বলে যে ব্যাপারটা আজও নানা ফর্মে বিদ্যমান, সেটার সফল রূপকার ছিলেন তিনি। যদিও এই ফুটবলের জন্মদাতা ছিলেন ক্রুইফের কোচ রাইনাস মিশেল। তবে আয়াক্স থেকে বার্সেলোনায় এই ফুটবল আমদানি করেন ক্রুইফই। দুটি ক্লাবেই খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে অনেক অবদান তার। এমনকি স্পেনের টিকিটাকা ফুটবলের আদিরূপ তার হাতেই লা মেসিয়াতে শুরু হয়েছিলো বলে অনেকে দাবি করেন। কিন্তু তারও আফসোস, বিশ্বকাপ জেতা হয়নি।
১৯৭৪ বিশ্বকাপে টোটাল ফুটবলের দারুণ প্রদর্শনী দেখিয়েছিলো নেদারল্যান্ডস। কিন্তু ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে যেতে হয় তাদের।
অলিভার কান
আরেকজন সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক। জার্মানি জীবনে অনেক ট্রফি জিতেছে, অনেক বিশ্বকাপও জিতেছে। কিন্তু কানের দুর্ভাগ্য, তার সময়ে জেতা হয়নি কিছুই। অবশ্য একটা ইউরো জিতেছেন তিনি। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিলেন। কিন্তু হেরে যেতে হয়েছিলো সেই ফাইনালে। তবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন বল জিতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে রেখেছেন এই গোলরক্ষক।
জার্মানির ইতিহাসের সেরা এই গোলরক্ষক বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে জিতেছেন অনেক শিরোপা।