২০০৪ সালকে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় বছরগুলোর একটি বলা যায়। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল তাদের ‘ইনভিন্সিবল’ মৌসুম পার করে, পোর্তো জিতে নেয় ঐ মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু সব ছাপিয়ে ঐ বছরের সব থেকে চমকপ্রদ ঘটনা হলো ২০০৪ সালে গ্রিসের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। ইউরোর ইতিহাসে সেরা অঘটনগুলোর একটি ধরা হয় এটিকে।
কীভাবে জিতলো গ্রিস ২০০৪ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ? ২০০৪ সালে গ্রিসের ইউরো জয়ের রহস্য বুঝতে হলে, তারও তিন বছর পেছন থেকে আমাদের শুরু করতে হবে।
২০০১ সালের কথা। বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের সবচেয়ে স্মরণীয় গোলটি দিয়েই এ গল্পের শুরু করতে হচ্ছে। ২০০২ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডের গ্রুপ নাইনের শেষ পর্বের ম্যাচ খেলছে ইংল্যান্ড ও গ্রিস। এই ম্যাচ যদি জিততে বা ড্র করতে না পারে ইংলিশরা, তাহলে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। একেবারে ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ বলে যাকে। খেলার নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হয়ে যায়; ইনজুরি টাইমের খেলা শুরু হয়। গ্রিসের মত পুঁচকে একটা দলের কাছে ম্যাচজুড়ে ব্যাপক নাকানিচোবানি খেয়েছে ইংলিশরা। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, আশার তরী ডুবল বলে। খেলায় তখন ৯২ মিনিট, ইংল্যান্ড ২-১ গোলে পিছিয়ে আছে।
এইরকম কঠিন সময়ে ডেভিড বেকহ্যাম ফ্রি-কিকে দারুণ এক গোল করেন। বেকহ্যামের ঐ গোলের সুবাদে ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়। ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। গ্রুপ নাইনের চ্যাম্পিয়নও হয় তারা। আর ডেভিড বেকহ্যাম হয়ে যান ইংল্যান্ডের ‘ন্যাশনাল হিরো’।
তবে এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, যদি বেকহ্যামের গোলটির জন্যই বিশ্বকাপ নিশ্চিত হয় ইংল্যান্ডের, তবে সেদিন যদি ইংল্যান্ড ম্যচটি হেরেও যেত, তবুও প্লে-অফ রাউন্ডের ম্যাচ খেলে বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল থ্রি লায়ন্সদের সামনে।
২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের মাত্র দু’টি ম্যাচ গ্রিস জিতেছিল। গ্রুপ নাইনে তাদের সঙ্গী ছিল ইংল্যান্ড, আলবেনিয়া, ফিনল্যান্ড, ও জার্মানি। ফিনল্যান্ড ও আলবেনিয়ার সাথে দুইটি ম্যাচ ন্যূনতম গোল ব্যবধানে জেতে গ্রিস। কেবল ইংল্যান্ডের সাথেই একটি ম্যাচ ড্র করে। বাকি পাঁচটি ম্যাচই হারতে হয় তাদের।
গ্রিসের ফুটবল ইতিহাস প্রায় শত বছরেরও বেশি পুরনো হলেও ফুটবলের ভিতটা এতটা শক্ত নয় তাদের, যে কারণে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির সঙ্গে এক কাতারে কোনোদিন তাদের নাম আসবে না। ইউরোপের বাকি দেশগুলোর মতো এতটা প্রগতিশীল নয় তাদের ফুটবল। যেই ২০০৪ ইউরো নিয়ে কথা বলছি আমরা, ঐ ইউরোর আগে গ্রিকরা তাদের ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র দুটো মেজর ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলেছে – ১৯৮০ সালের ইউরো এবং ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ। এই টুর্নামেন্টগুলোর যে ক’টি ম্যাচ তারা খেলেছে, একটি ম্যাচও জিততে পারেনি।
হয়তো ভাবছেন, তাহলে ইংল্যান্ডের সাথে কোয়ালিফায়ারের ম্যাচের প্রসঙ্গ আসছে কেন এখানে? যেটা আগেও বললাম, গ্রিস তাদের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের বেশিরভাগ ম্যাচ হেরেছিল। এমনকি তাদের পারফরম্যান্স এতই খারাপ ছিল যে কোচ ভাসিলিস ডানিলিকে চাকরিচ্যুত হতে হয়। এরপরই দায়িত্ব নেন জার্মান কোচ অটো রেহগাল। অটো রেহগালের সুখ্যাতি ছিল ধূর্ত বুদ্ধি এবং কঠিন নিয়মতান্ত্রিকতার জন্য। সবকিছুর আগে নিয়ম-শৃঙ্খলাই তার কাছে বেশি গুরুত্ব পেত।
ইংল্যান্ড-গ্রিসের কোয়ালিফায়ারের ম্যাচটা ছিল অটো রেহগালের দ্বিতীয় ম্যাচ। অটো রেহগালের প্রথম ম্যাচ ছিল ফিনল্যান্ডের সাথে, যেখানে ৫-১ গোলে তারা হারে হেলসিংকিতে। দুটো ম্যাচ কোচিং করিয়েই ড্রেসিংরুমের পরিবেশ আর খেলার ধরন আমূল কেউ বদলে দিতে পারেন না। তবে এই ম্যাচেই ইংল্যান্ডের সাথে যে খেলা দেখিয়েছিল গ্রিস, যেভাবে ২-১ গোলে লিড নিয়ে এগিয়ে ছিল, যেভাবে খেলা নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরো সময়, তাতে করে গ্রিসের বদলে যাওয়ার আভাস টের পাচ্ছিল সবাই।
তিন বছরের ব্যবধানে এই গ্রিস সত্যি সত্যিই পালটে গেল। দলের খেলোয়াড়দের ভেতর এত অসাধারণ বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। তবে এর পেছনে কারণও ছিল।
এক সাক্ষাৎকারে গ্রিসের ইউরোজয়ী লেফটব্যাক তাকিস ফিসাস বলেছিলেন, দলের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম যেদিন অটো রেহগাল খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, সেদিনই বলে দিয়েছিলেন, সব কিছুর আগে জাতীয় দল; অন্য কোনো বাজে চিন্তা মাথায় থাকলে তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে।
গ্রিক লিগের সেরা তিন ক্লাব প্যানাথিনাইকোস, এইকে এথেন্স, এবং অলিম্পিয়াকোস। এই তিন ক্লাব লিগে একে অপরের রাইভাল। দলে এই তিন ক্লাবের খেলোয়াড়দেরই আধিক্য ছিল। যেহেতু রাইভাল ক্লাবের হয়ে খেলেন, সারা বছর একে অপরের প্রতিপক্ষ, সেই রাইভালরির আঁচটা জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমেও চলে আসত প্রায়ই। কিছুতেই একে অপরের সাথে মন খুলে মিশতে পারতেন না তারা। রেহগাল এসেই সমস্যাটা ধরে ফেলেন। এর কার্যকরী সমাধানও তিনি বের করেন। “সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতীয় দল” – এই মন্ত্রে দীক্ষিত করেন শিষ্যদের, দেশের খাতিরে একসাথে খেলতে উজ্জীবিত করে তোলেন। জাতীয় দলকে পরিবারের মতো ভাবতে শেখান।
রেহগাল খুবই সাহসী এবং স্মার্ট ছিলেন। জনপ্রিয় কিন্তু দাম্ভিক খেলোয়াড়দের বাদ দিতে বুক কাঁপত না তার। আত্মকেন্দ্রিক খেলোয়াড়দের বাইরে রেখেই দল সাজাতেন। গ্রিক পত্রিকায় তার সমালোচনাও করা হয়; তবে তাতে তার বয়েই গেছে, ড্রেসিংরুমটা নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিলেন ততদিনে।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে যেমন মেধাবী খেলোয়াড়ের অভাব নেই, তেমনটা গ্রিসের ক্ষেত্রে দাবি করা যাচ্ছে না। অন্য দেশের কোচ দল গড়তে চাইলে মধুর সমস্যাতেই পড়েন খেলোয়াড় বাছাইয়ে, অন্তত ৫৫-৬০ জন খেলোয়াড়ের তালিকা থাকে তাদের হাতে; সেখান থেকে বেছে বেছে ২৩-২৬ জন নিয়ে দল গড়তে পারেন তারা। যারা জাতীয় দলের হয়ে সত্যিকার অর্থেই খেলোয়াড় যোগ্যতা রাখেন, এরকম খেলোয়াড়ের সংখ্যা রেহগালের হাতে ছিল বড়জোর ২০-২৫ জন। মাঝে মাঝে তিনি প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের খোঁজ পেলে তাদের ক্যাম্পে ডেকে পাঠাতেন, বাজিয়ে দেখতেন তাদের ফুটবল স্কিল। এদের নিয়েই দল নির্বাচন করেন রেহগাল।
এই দলটির ছিল না কোনো তারকা খেলোয়াড় বা বড় নাম। যেমনটা ফিসাস বলেন,
“আমাদের তারকা খেলোয়াড় ছিল না। কিন্তু আমরা কঠিন পরিশ্রমী ছিলাম, আত্মত্যাগী মনোভাব ছিল, আর ছিল টিম স্পিরিট। দলকে পরিবার হিসেবে ভাবতাম আমরা। আজকের যুগের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ যেরকম খেলে।”
তবে তারকা না হলেও যারা খেলতেন, সবাই খুব স্কিলফুল খেলোয়াড় ছিলেন। শুধু তখনও কোনো কোচ এই খেলোয়াড়দের ব্যবহার করতে পারেননি ঠিকমতো। রেহগাল সবার শক্তিমত্তার সবল-দুর্বল দিকগুলো নিয়ে জেনেছেন, কার স্কিল কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, সেসব নিয়ে ভেবেচিন্তে তিনি ছক কষছিলেন দলটির জন্য। অসম্ভব গোল-ওরিয়েন্টেড এবং কঠোর কোচ ছিলেন তিনি, আর ছিলেন দলের প্রতি আন্তরিক। এরই ফল দেখা গিয়েছিল ইউরোতে।
২০০৪ ইউরো কোয়ালিফিকেশন
২০০৪ ইউরো কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড শুরু হয়ে গিয়েছে। অটো রেহগালের ফুটবলীয় দর্শন, দলীয় সংহতিবাদ – ততদিনে গ্রিসের খেলোয়াড়দের মস্তিষ্কে-রক্তে মিশে গিয়েছে। ইউরো কোয়ালিফিকেশনের প্রথম দুইটা ম্যাচ হারার পর, খুব ইম্প্রেসিভ পারফরম্যান্স করতে থাকে গ্রিস। এমনকি কোয়ালিফাইং রাউন্ডের একটা ম্যাচে স্পেনকেও হারিয়েও দেয় তারা।
অটো রেহগালকে অনেকে বলেন ‘দ্য ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস’। স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের সীমাবদ্ধতা তিনি বুঝতেন। তিনি একেকজন খেলোয়াড়কে তার শক্তিমত্তা অনুযায়ী খেলার পরিকল্পনা সাজানোর সময় দায়িত্ব দিতেন। প্রত্যেকটা ম্যাচে প্রতিপক্ষ দল কারা,তাদের শক্তি-দুর্বলতার দিকগুলো মাথায় রাখতেন, তাদের কীভাবে আটকাতে হবে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতেন। তাই একেক ম্যাচে একেকজনের দায়িত্ব একেকরকম থাকত। তবে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপার সবসময়ই মেইনটেইন করতেন অবশ্য সব ম্যাচেই। সেগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
টিম ট্যাকটিক্স
পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে দেখা গেছে গ্রিসকে। ডিপ মিডফিল্ডে ডেস্ট্রয়ার রোলে খেলতেন কস্তাস কাটসোরানিস। অ্যাঞ্জেলোস বাসিনাস এবং থিওডরোস জাগোরাকিস খেলতেন মিডফিল্ডের দুই প্রান্তে। জর্জিওস কারাগুনিস এবং অ্যাঞ্জেলোস ক্যারিসটিয়াস ছিলেন ওয়াইড মিডফিল্ডের প্লেয়ার। তাদের সামনে ছিলেন স্টেলিও জিয়ান্নাকোপোলাস।
ডিফেন্ডিংই ছিল তাদের মূলনীতি। কঠিনভাবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ম্যান-মার্ক করে খেলত গ্রিস, এবং প্রয়োজনে জোনাল মার্কিংও। দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের আলাদা আলাদা ভূমিকা ছিল পরিকল্পনায়। একেকজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের একেকজন খেলোয়াড়কে পুরো ম্যাচজুড়ে মার্ক করে খেলতেন। তবে গ্রিস শুধু প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পিছেই ছুটে বেড়িয়েছে বললেও বলায় খাদ রয়ে যায়।
তাকিস ফিসাস এবং জর্জিওস সেইতারিদিস প্রতিপক্ষের উইংগারদের মার্ক করে খেলতেন এবং তাদের কৌশলে গোলবার থেকে অনেকখানি দূরে সরিয়েও নিয়ে যেতেন। এরপর মিডে থাকা কাটসোরানিস ঐ প্লেয়ারকে মার্ক করার দায়িত্ব নিতেন, আর ফিসাস-জর্সিওস দ্রুত ডিফেন্সে নেমে আসতেন যাতে ডিফেন্সিভ লাইনের ভারসাম্য বা আকার নষ্ট না হয় বা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকরা আক্রমণের জায়গা না পায়।
গ্রিসের ওয়াইড মিডফিল্ডারদের দায়িত্ব ছিল প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের আটকে দেওয়া। মিডফিল্ডাররা ডিফেন্সিভ মাইন্ডের ছিলেন, প্রায়ই নিচের দিকে নেমে আসতেন, তখন ফর্মেশন ৪-৩-৩ কম, ৪-৫-১ বেশি মনে হতো। গোলকিপার ছিলেন অ্যান্তোনিস নিকিপোলিডিস।
গ্রিসের ‘লোন উলফ’ একমাত্র স্ট্রাইকার ছিলেন জিসিস ভ্রিজাস। প্রতিপক্ষের ডেস্ট্রয়ার বা হোল্ডিং মিডফিল্ডারকে সামলানো ছিল তার দায়িত্ব। আরেকজন খেলোয়াড় ছিলেন যিনি ডিফেন্সে ফ্রি রোলে খেলতেন, নির্দিষ্ট কাউকে মার্ক করার দায়িত্ব তার ছিল না। একজন সুইপার, যিনি শেষ মুহূর্তে এসে ট্যাকল করে প্রতিপক্ষের গোল নষ্ট করে দেবেন। এই খেলোয়াড়টি ছিলেন ট্রায়ানোস ডেলাস।
এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছেন হয়তো এই দল অ্যাটাকের ওপর নির্ভরশীল নয়। ট্রাঞ্জিশনের ওপরেই বেশি নির্ভরশীল ছিল। ওয়াইড এরিয়ায় প্রেসার দিয়ে খেলে কাউন্টার অ্যাটাক বিল্ড আপ করা এবং হেডে গোল করা – এই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
খেলোয়াড়দের দারুণ টেকনিকাল এবিলিটি ছিল। বিশেষ করে ভাসিলিওস সিয়ারতাস, যিনি বেশিরভাগ সময় সাবস্টিটিউট হিসেবে খেলতেন। টুর্নামেন্টের বাকিদলগুলোর সাথে ম্যান টু ম্যান তুলনা করলে নিঃসন্দেহে পিছিয়ে ছিল গ্রিস। তবুও এই ট্যাকটিক্সের সাথে দলের খেলোয়াড়দের সাথে মানিয়ে গিয়েছিল।
উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ – ২০০৪
গ্রুপপর্ব
২০০৪ সালে ইউরো জেতার জন্য সবচেয়ে ফেভারিট দলগুলোর যে তালিকা করা হয়েছিল, সেই তালিকার ১৬টি দলের ভেতর ১৫ নম্বরে ছিল গ্রিস। অর্থাৎ গ্রিস যে ইউরো জিততে পারে, এরকমটা দূরতম দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারেননি।
গ্রিসের একমাত্র লক্ষ্য কী ছিল জানেন? কেবল কোনোমতে একটা ম্যাচ জেতা। স্রেফ একটা। আগে অংশগ্রহণ করা দুই টুর্নামেন্টের মত কোনো ম্যাচ না জিতে মুখচুন করে দেশে ফিরতে চায়নি তারা।
ভাগ্য তাদের প্রথমেই ফেলে দেয় কঠিন পরীক্ষায়। স্পেন, পর্তুগাল এবং রাশিয়ার সাথে একই গ্রুপে পড়ে যায় গ্রিস। এটিকে বলা হচ্ছিল ‘গ্রুপ অফ ডেথ’। এও যেন যথেষ্ট ছিল না। টুর্নামেন্টের একেবারে প্রথম ম্যাচেই পর্তুগালের বিপক্ষে খেলা পড়ে গ্রিসের। ইউরোর উদ্বোধনী ম্যাচ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আগ্রহ থাকে। সুতরাং বাড়তি একটা চাপও ছিল তাদের ওপর। পর্তুগাল স্বাগতিক দেশ, দলে অভিজ্ঞ-তরুণ মিলিয়ে চমৎকার কিছু খেলোয়াড় আছেন। এদিকে গ্রিস আজ পর্যন্ত কোনো টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। বলতে গেলে পরিস্থিতি পর্তুগিজদের অনুকূলেই ছিল।
তবে ম্যাচে দেখা গেল পুরো উলটো চিত্র। পর্তুগালই ২-১ গোলে হেরে বসল গ্রিসের কাছে। এবং সেটাই ইতিহাস হয়ে গেল। ইউরো টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই অঘটন দিয়ে সূচনা হল। এদিকে গ্রিস প্রথম ম্যাচ জয়ের আনন্দে উদ্বেল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ঘাড় থেকে যেন বোঝা নেমে গেছে অনেকখানি। একটি ম্যাচ জেতার যে আকাঙ্খা ছিল, প্রথম ম্যাচ জিতেই তা পূরণ হয়ে গেছে। এবারে যদি বাকি সব ম্যাচ হেরেও যায় গ্রিস, তবুও মনে দুঃখ নিয়ে তো বাড়ি ফিরতে হচ্ছে না!
সেই ঐতিহাসিক জয়ের পরে খেলোয়াড়-কোচ-কোচিং স্টাফ কেউ ঘুমোতে পারেননি সারারাত। আনন্দের আতিশয্যে ছটফট করেছেন, উদযাপন করেছেন। সারারাত ধরে গ্রিসের জাতীয় রেডিও চ্যানেলে ম্যাচ রিপোর্ট এবং মানুষের প্রতিক্রিয়া শুনেছেন তারা।
এ ছিল কেবল শুরু। চাপমুক্ত, নির্ভার গ্রিস এরপর আরো চমক দেখাতে শুরু করলো। টুর্নামেন্ট জয়ের অন্যতম ফেভারিট দল স্পেনকে আটকে দেয় গ্রিস। এক গোলে পিছিয়ে থাকার পরও তারা সমতায় ফেরে। স্পেন-গ্রিস চার পয়েন্ট পেয়ে যায়, পর্তুগাল তিন। পরের ম্যাচ রাশিয়ার সাথে, রাশিয়াকে হারাতে পারলেই হেসেখেলে কোয়ার্টারে উঠে যেতে পারে গ্রিস।
কিন্তু ভাগ্য এখানে বাদ সাধল। খেলার প্রথম ১৭ মিনিটেই দুটো গোল খেয়ে যায় গ্রিস। প্রথমার্ধের শেষে জিসিস ভ্রিজাস এক গোল করলে গোল ব্যবধানটা শুধু কমে আসে। এরপর গ্রিস চেষ্টা করেও সমতায় ফিরতে পারেনি।
ম্যাচ হারার ফলে এবার গ্রিসকে তাকাতে হয় পর্তুগাল-স্পেনের ম্যাচের দিকে। ফলে সমীকরণটা দাঁড়ায় এরকম – স্পেন এবং পর্তুগালের ম্যাচ ড্র হলে বা স্পেন জিতলে গ্রিস বাদ পড়ে যাচ্ছে। জিউস যেন আশীর্বাদ করেছিলেন গ্রিকদের। আর তাতেই বোধহয় পর্তুগাল রাশিয়ার সাথে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়, আর সেই সুবাদে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় গ্রিকরা। স্বস্তির বাতাস বয়ে যায় গ্রিক শিবিরে। ভাগ্যদেবতা যেন আড়াল থেকে মিটিমিটি হাসছিলেন, “কেমন মজা দেখালাম?”
কোয়ার্টার ফাইনাল – ফ্রান্স
গ্রিস যে এতদূর এসে পৌছেছে, খেলোয়াড়দের নিজেদেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না কারো। তবে খুশি মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না,যখন তারা জানতে পারেন কোয়ার্টারে প্রতিপক্ষ এবারে ফরাসিরা! ফ্রান্স তখন ইউরোর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। জিনেদিন জিদান,অঁরি,লিজারাজু,মাকেলেলের মত খেলোয়াড় নিয়ে দল গড়েছে ফ্রান্স। ধরেই নিয়েছিলেন সবাই, মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, গ্রিসের দৌড়ও এই অব্দিই থাকবে।
সেই ফ্রান্সকেও থামিয়ে দেয় গ্রিসরা। সেইতারিদিসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় থিয়েরি অরিকে পুরোটা সময় মার্ক করে খেলার। অরিকে আটকে দেওয়ার এই বুদ্ধি খুবই কাজে দিয়েছিল। ৬৫ মিনিটের মাথায় ক্যারিসটিয়াসের পা থেকে গ্রিসের একমাত্র ও জয়সূচক গোলটি আসে।
সেমিফাইনাল – চেক প্রজাতন্ত্র
এই পর্যায়ে এসে বলাই যায়, মন জয় করা ফুটবল বলতে যা বোঝায়, তার ধারেকাছেও কিছু খেলেনি গ্রিস। তবে তাতে গ্রিকরা তাতে থোড়াই কেয়ার করেন! বিপক্ষ দলের সমর্থকরা খুশি নন, নিরপেক্ষ দর্শকরা খুশি নন, শুধু গ্রিসের অধিবাসী, ভক্ত-সমর্থকরা ছাড়া। গ্রিসের খেলার ধরনকে সবাই বলছিলেন নেতিবাচক, রক্ষণাত্মক ফুটবল। যে খেলা দেখে অসন্তুষ্টি সরাসরিভাবে প্রকাশ করছিলেন মিডিয়া ও ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। যেমন, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা গ্রিসের এক ম্যাচ রিপোর্টে তো লিখেই বসে,
“ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র আন্ডারডগ দল এই গ্রিস, সবাই যে দলটিকে হারতে দেখতে চায় এখন।”
সেমিফাইনালে গ্রিসের খেলা পড়ে চেক প্রজাতন্ত্রের সাথে। চেক প্রজাতন্ত্র সেবার ইউরোতে খেলার ধরন ছিল গ্রিসের একেবারে উলটো। চেক প্রজাতন্ত্র সবচেয়ে ইতিবাচক ধরন ও মানসিকতার ফুটবল খেলেছিল টুর্নামেন্টে। সেই দলে ছিলেন পাভেল নেদভেদ, মিলান বারোস, ইয়ান কোলার। মিলান বারোস ছিলেন ইউরোর সেই আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা, পাঁচটি গোল করেছিলেন তিনি। গ্রুপপর্বে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্ককে টপকে সেমিতে পৌঁছে চেক। ম্যাচ হারলেও প্রতিপক্ষের সমর্থকরা চেকের খেলার ধরনের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। চেক সবার চোখের মণি, আর গ্রিস সকলের চোখের বালি। ম্যাচটা হয়ে দাঁড়ায় অ্যাটাক বনাম ডিফেন্সের লড়াই।
এই ম্যাচ নিয়ে গোলকিপার অ্যান্তোনিস নিকোলোপাডিস পরে বলেন,
‘চেক রিপাবলিক ছিল ইউরোর সবচেয়ে ইনফর্ম দল। টুর্নামেন্টের একমাত্র দল হিসেবে চারটি ম্যাচই জিতেছিল তারা। আমাদের মূল শক্তির জায়গা ডিফেন্স এবং সেটপিসে গোল করা। আর চেক সেটপিসে একটি গোলও খায়নি। আমরা আক্রমণে যদি না যাই, আর সেটপিসে গোল করার সুযোগ যদি না পাই, তাহলে কীভাবে জিতব, এই দুশ্চিন্তাটা ছিলই।’
এরপর আগানোর আগে, এইখানে আমাদের গোল্ডেন গোল রুল ও সিলভার গোল রুল সম্পর্কে একটু জানতে হচ্ছে। এখন যেমন নকআউট পর্বের ম্যাচে ৯০ মিনিটের খেলার পরও যদি জয়ী দল না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ১৫ মিনিট করে দু’বারে আরো আধাঘন্টা খেলা হয়, যাকে আমরা এক্সট্রা টাইম বা অতিরিক্ত সময় বলি। এরপরও যদি ফল না আসে, ম্যাচ পেনাল্টি শ্যুটআউটে গড়ায়। এ তো আমরা জানিই।
তবে, নব্বইয়ের দশকে ফিফা ‘গোল্ডেন গোল’ রুলের প্রচলন ঘটায়। এই রুল অনুযায়ী, ৯০ মিনিটের ভেতর ফল না আসলে, যথারীতি অতিরিক্ত সময়ের খেলা হবে। এই সময়ের ভেতর যে মুহূর্তে কোনো দল গোল দিলেই সাথে সাথে রেফারি বাঁশি বাজিয়ে খেলা শেষ ঘোষণা করবেন এবং ঐ গোল দেওয়া দলটি জয়ী বিবেচিত হবে।
গোল্ডেন রুল নিয়ে নানারকম বিতর্ক উঠলে এরপর ‘সিলভার গোল’ রুল প্রচলন করা হয়। এই সিলভার গোল রুল অনুযায়ী, অতিরিক্ত সময়ের প্রথম অর্ধে তথা প্রথম ১৫ মিনিটে কোনো দল যদি গোল করেও, তবুও সাথে সাথে খেলা শেষ করে দেওয়া হবে না, পুরো ১৫ মিনিটের সময়ের কোটা পূরণ করেই ম্যাচ শেষ হবে। অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া দলের হাতে তখনও গোল শোধ করার জন্য অল্প কিছু সময় থাকবে। তবে যা করার ঐ অর্ধের মধ্যেই করতে হবে। পিছিয়ে পড়া দলটি যদি গোল শোধ করতে না পারে প্রথম অর্ধে, ব্যস, খেলা শেষ, দ্বিতীয় অর্ধের খেলা আর হবে না। গোল করা দলটিই যথারীতি বিজয়ী ঘোষিত হবে। আর যদি ভাগ্যগুণে গোল শোধ করতে পারে প্রথম অর্ধে, তবেই খেলা দ্বিতীয় অর্ধে যাবে।
এই সিলভার গোল রুলই ব্যবহার করা হয়েছিল ২০০৪ ইউরোর সেমিফাইনালে। চেক রিপাবলিক বনাম গ্রিস ম্যাচে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের খেলা শুরু হয়; সাড়ে ১৪ মিনিট শেষ হয়ে যায় প্রথমার্ধের, ঠিক সেই সময়ে, একেবারে অন্তিম মুহূর্তে গোল করেন গ্রিসের ট্রায়ানাস ডালাস। কর্নার থেকে গোল করার সুযোগ পেয়ে যায় তারা। সিয়ারতাস শট নেন, হেড করে জালে বল ঢোকান ডালাস। এদিকে ঘড়ির কাঁটাও থেমে নেই। ম্যাচের আর দু-তিন সেকেন্ড বাকি। দু-তিন সেকেন্ডের ভেতর চেককে গোল পরিশোধ করতে হবে, যদি খেলা দ্বিতীয় অর্ধে নিতে চায় তারা। কিন্তু দু-তিন সেকেন্ডে কি আর কোনো গোল পরিশোধ করা সম্ভব? না, কোনো জাদুর ছড়ি ঘুরিয়েও সম্ভব ছিল না আর তাদের পক্ষে গোল করা। এইভাবেই সিলভার গোল রুলের কল্যাণে শেষ মুহূর্তের গোলে নাটকীয়ভাবে জয় পায় গ্রিস। আর চেক প্রজাতন্ত্র চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় নেয়।
এরপরই সিলভার রুল নিয়ে এরপর তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। প্রথম অর্ধে একটি দল গোল দিলে তাদের প্রতিপক্ষকে সেই অর্ধেই গোল পরিশোধ করতে হবে, নইলে দ্বিতীয় অর্ধে খেলা গড়াবে না – এরকম উদ্ভট নিয়ম নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা উঠলে, বাধ্য হয়ে গোল্ডেন গোল রুল ও সিলভার গোল রুল বাতিল করে আইএফএবি (ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড)। এই ইউরোর পর রুল দু’টি আর ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি।
ফাইনাল – পর্তুগাল
ইউরোর ট্রফি এবং গ্রিসের মধ্যে তখন আর মাত্র এক ম্যাচের ব্যবধান। পর্তুগালকে হারাতে হবে আরেকবার। এই একটিই কাজ বাকি। ঘরের মাঠে, ঘরের দর্শকদের সামনে পর্তুগাল দল। ফুটবল খেলা যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে, ইউরোর ঢেউ লেগেছে জনজীবনের সর্বত্র।
কাকতালীয় ব্যাপারই বলতে হবে। গ্রুপপর্বে একই গ্রুপে ছিল দল দু’টি, ইউরোর উদ্বোধনী ম্যাচও খেলেছে তারা। এবারে ফাইনালেও দল দু’টি একে অপরের প্রতিপক্ষ। ১৯৮০ সালের পর কোনো আয়োজক দেশ তাদের প্রথম ম্যাচ হারেনি। কিন্তু গ্রিসের কাছে হেরেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছে পর্তুগিজরা। এই ফাইনাল ম্যাচ জিতলে পারলে তাই পর্তুগালের সামনে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুবর্ণ সুযোগ – প্রথমত, গ্রুপপর্বের ম্যাচ হারের প্রতিশোধ নেওয়া, দ্বিতীয়ত ইউরোর শিরোপা জেতা।
গ্রিসকে নিয়ে কথা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেবারের পর্তুগাল দলটিকেও কিন্তু কম চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়নি। এই পর্তুগালের গল্পটাও চমৎকার। আন্ডারডগদের কাছে ম্যাচ হারা এবং তারপরও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া; এরপর ইংল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মকে হারিয়ে, শক্তিশালী নেদারল্যান্ডসকে টপকে ফাইনালে এসে পৌঁছেছে তারা।
ফাইনালের দু’দিন আগে গ্রিসের খেলোয়াড়দের জরুরি টিম মিটিংয়ে ডাকেন রেহগাল। একটি পরিবারের সদস্যদের ভেতর যেমন নানা রকম ঝামেলা থাকে, এই দলের ভেতরেও ছিল। বিশেষ করে গোলকিপার অ্যান্তোনিস নিকোপোলিডিস এবং কনস্তান্তিনোসের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিলই না। মিডফিল্ডার অ্যাঞ্জেলোস বাসিনাসের গ্রিক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে বোনাসের টাকা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। অটো রেহগালের কিছু কিছু খেলোয়াড়ের সাথে শীতল লড়াই চলছিল, যেমন মিকালিস কাপসিস। আবার সিয়ারতাসকে গ্রুপপর্বের ম্যাচে শুরুর একাদশে নেওয়া হয়নি বলে তিনিও খুব হতাশ ছিলেন।
সেদিন বিকেলে সবাই সব তিক্ততা ভুলে গিয়েছিল। সবাই খেলা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, চাইলে যে শিরোপা জয় অসম্ভব কিছু নয়, তারা বুঝতে পারছিলেন। উত্তেজনা যেন শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল। ফুটবলারদের সাধারণত দেশের হয়ে কিছু করে দেখানোর সুযোগ সবসময় আসে না। তারা বুঝেছিলেন যে সুযোগ তাদের সামনে আছে, এই সুযোগ একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে কোনোদিন পাওয়া যাবে না। তারা প্রতিজ্ঞা করেন, সেরাটাই দিতে হবে মাঠে।
এরপর এল সেই প্রতীক্ষিত ৪ জুলাই। পর্তুগালের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম, বেনফিকার হোম গ্রাউন্ড এস্তাদিও দ্য লুইজে শুরু হল ফাইনাল।
পর্তুগালের ফ্রন্ট ফোর – ফিগো, রোনালদো, ডেকো, পাউলেতা শুরুর মিনিট থেকেই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেকোনো মুহূর্তে গ্রিসের পাথর-কঠিন রক্ষণভাগ ভেঙে পড়ল বলে। গ্রিসের ডিফেন্ডারদের কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে তখন পর্তুগিজরা।
খেলায় ৫৭ মিনিট তখন। হঠাৎ কর্নার পেয়ে গেল গ্রিস। কর্নার নেওয়া হলো, লাফিয়ে উঠলেন অ্যাঞ্জেলো ক্যারিস্তিয়াস। বল গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে ঢুকে জড়িয়ে পড়ল জালে… এবং গোল! পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে এই একই স্টাইলে গোল করে গিয়েছে গ্রিকরা। ক্যারিস্তিয়াস ৬ ফুটের ওপর লম্বা, তার লাফ দিয়ে হেডে গোল করার স্কিলই গ্রিসকে ম্যাচ জিতে দিয়েছিল।
এরপর পাগলের মতো আক্রমণ চালিয়েও গ্রিসের ডিফেন্স ভাঙতে পারেননি রোনালদো-ফিগোরা। অ্যাঞ্জেলোর একমাত্র গোলে ইউরোর শিরোপা জিতে নেয় গ্রিস। ফুলটাইমের বাঁশি বাজালেন যখন রেফারি, পর্তুগালে তখন নেমে এসেছে শোকের ছায়া। চোখের পানিতে ভাসছেন ক্রিস্টিয়ানো-ফিগো। আর টিভিপর্দায় খেলা দেখে আনন্দে ফেটে পড়েছে পুরো গ্রিস।
ইউরো জয়ের পর প্রতিক্রিয়া
ইউরোতে গ্রিসের এত বড় একটা অঘটন ঘটানোর পর গণমাধ্যম এবং ফুটবল পণ্ডিতেরা ঠিক হজম করতে পারেননি ব্যাপারটা। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষই বোধহয় মন থেকে খুশি হয়েছিলেন একটি আন্ডারডগ দল শিরোপা জেতায়। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের প্রিয় দল বা জনপ্রিয় দলগুলো টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে গেলে মানুষ কোনো টুর্নামেন্ট উপভোগ করতে পারেন না। তবে ফুটবল ভক্তদের ভেতর যেসব প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তার অনেকগুলোর মধ্যে একটি প্রবণতা হলো আন্ডারডগ বা তুলনামূলক কম শক্তিশালী কোনো দল বড় কোনো দলকে হারিয়ে দিলে বা টুর্নামেন্ট জিতলে মানুষ তা খুবই উপভোগ করেন।
কিন্তু এই ইউরো যেন ব্যতিক্রম ছিল। গ্রিসের নেতিবাচক, রক্ষণাত্মক, গা বাঁচানো ধরনের ফুটবল খেলার ধরনের জন্যই মানুষ খেলা দেখতে গিয়ে খুবই একঘেয়েমিতে ভুগতেন। তাই মন থেকে খেলাটা উপভোগ করতে পারেননি অনেকেই। এই সময়গুলোতে সুন্দর ফুটবলের গুণগ্রাহীরা নিজেদের কিছুটা প্রতারিত মনে করতে থাকেন। তাই গ্রিস ইউরো জেতার পর মুখ গোঁজ করে বসে ছিলেন বেশিরভাগই, যেন মারাত্মকরকম ঠকিয়ে দিয়েছেন কেউ তাদের। টেলিগ্রাফ পত্রিকার পরেরদিনেই একটি শিরোনামই দেখা যাক,
“A tear flowed down the face of the beautiful game.”
সারকথাটা পরিষ্কার, ফুটবল নামের সুন্দর খেলাটির চোখ দিয়ে আজ যেন এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
তাদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। চোখ ধাঁধানো ফুটবল গ্রিস খেলেনি, খেলায় সেই চমক বা ধার বা গতি কোনোটাই ছিল না, যা দেখার জন্য বুভুক্ষের মতো ফুটবলপূজারীরা অপেক্ষা করে থাকেন মনের ক্ষুধা মেটাবেন বলে। নিরন্তর শুধু বল ঠেকিয়ে যাওয়া দেখতে কারই বা ভালো লাগে! এখন অবধি ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলগুলোর ভেতর সবচেয়ে কম গোল দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডটা তাদেরই দখলে।
আরো বড় আশংকা যেটা ছিল, গ্রিস যদি এভাবে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ট্রফি জিতে যায়, বাকি সব ফুটবল ক্লাবও এবার এই একই নীতিতে খেলতে যদি শুরু করে দেয় শিরোপা জেতার আশায়? তাহলে ফুটবল পুরোই ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে। যদিও পরবর্তী সময়ে এই ট্যাকটিক্সে বড় ক্লাবগুলো খেলেনি, যেটা স্বস্তির বিষয় ছিল।
এই ধরনের ফুটবল খেলে সাফল্য পাওয়া খুব কষ্টকর। তবুও গ্রিস পেরেছিল, কারণ এই গ্রিস দলটি আর দশটি দলের থেকে আলাদা ছিল। খেলোয়াড় এবং ম্যানেজারের ভেতর যে একাত্মবোধ ছিল, সেই উপাদানটি অনেক ভালো দলের ভেতর থাকে না।
মাইকেল কক্স তার বই জোনাল মার্কিংয়ে গ্রিসের ইউরো জয়কে “tactical achievement of the decade” বলে আখ্যা দেন। ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, সুইডেন, চেক প্রজাতন্ত্র – প্রত্যেকেই তাদের সোনালি প্রজন্মের খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়েছিল। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে গ্রিকরাই। খেলোয়াড়দের ভেতরকার বোঝাপড়া, অটো রেহগালের ধুরন্ধর ফুটবলীয় বুদ্ধি – এই দুইয়ের মিশেলে ইউরোর ইতিহাসে রচিত হয় এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়।
গ্রিস কেমন খেলে ইউরো জিতল বা কোন ট্যাকটিক্সে তিনি গ্রিসকে খেলিয়েছেন, সেসব নিয়ে নিন্দে করতেই পারেন। কিন্তু তাতে গ্রিসের গৌরব ম্লান হয় না। গ্রিস অটো রেহগালকে তাদের দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছে। ভালোবেসে গ্রিকরা তাকে ডাকেন ‘কিং অটো’ বলে। ইতিহাসে ঢুকে গিয়েছেন গ্রিসের সেই দলের সদস্যরাও, মানুষ তাদের বসিয়েছে দেবতার আসনে। ইউরোর জিতে ফেরার পথে গ্রিসের টিম বাসে লেখা ছিল স্লোগান – “প্রাচীন গ্রিসের দেবতা ছিলেন ১২ জন, আধুনিক গ্রিসের দেবতা ১১ জন।”
ইউরো ২০০৪ জয় গ্রিকদের ইতিহাসে গৌরবজনক এক অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। গ্রিসকে ইউরো জেতানোর জন্য অটো রেহগালের নামটাও ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইউরোর ইতিহাস, কিংবা বলা ভালো, ফুটবলের ইতিহাসেই তিনি ঢুকে গেছেন।