সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবাল দুজনেই রোববার বিকেল থেকে স্রেফ টেলিভিশনের সামনে দর্শক হয়ে ছিলেন। মুশফিকুর রহিমের পাঁজরের ব্যাথা, মাশরাফি বিন মুর্তজার আঙ্গুলের চোট শতভাগ সেরে ওঠেনি এখনও। তারপরও খেলতে হয়েছে। উপরি পাওনা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হঠাৎ পাঁজরের চোট।
এমন অবস্থায় ৮ মাস পর ঘরের মাঠে খেলতে নেমে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কেমন করবে বাংলাদেশ? প্রতিপক্ষ যা-ই হোক, একরকম ‘প্যারালাইজড’ বাংলাদেশের সামনে জিম্বাবুয়েকেই ফেবারিট ভাবা হচ্ছিলো। কিন্তু কীসের কী! মাঠে যেন পাত্তায় পেল না আফ্রিকার দলটি। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সেই উল্লাস, সেই আলো আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের কাঁধে চড়ে স্রেফ উড়ে গেলেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা-ব্রেন্ডন টেইলররা। কিংবা বলা যায়, উড়িয়ে দিলেন ইমরুল কায়েস। যিনি কিনা বারবার ভালো করেও, টিম ম্যানেজমেন্টের সুনজরে আসেননি। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, ইমরুলকে কেন দলে নেওয়া হয়নি – তার উত্তর নেই নির্বাচকদের কাছেও। সেই ইমরুল বাঁচিয়েছেন এশিয়া কাপে, বাঁচালেন মিরপুরেও। খেললেন ১৪৪ রানের ঝড় তোলা ইনিংস। যে ঝড়ে মাতলো পুরো দেশের কোটি সমর্থকরা। আর ইমরুল? সেঞ্চুরিটা উপহার দিলেন নবজাতক পুত্রসন্তানকে।
আবার একেবারে ‘উড়ে গেল’ বললেও ভুল হবে। কারণ, পুরো ৫০ ওভার খেলেছে জিম্বাবুয়ে। ৯ উইকেট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের দেওয়া ২৭২ রানের লক্ষ্য জয় করতে নেমে তুলেছে ২৪৩ রান, অর্থাৎ ২৮ রানে জিতেছে লাল-সবুজ জার্সিধারী বাংলাদেশ। ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শুরুটা ভালো হওয়ায় ১-০ তে এগিয়ে রইলো স্বাগতিকরা।
১.
মাত্রই এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে আসা বাংলাদেশ খানিক বিশ্রামের পর জিম্বাবুয়ে সিরিজের মুখোমুখি। দলের সবাই মোটামুটি পারফর্ম করায় ড্রেসিংরুমে আত্মবিশ্বাস ছিলই। তাছাড়া প্রতিপক্ষ যখন র্যাংকিংয়ের বেশ নিচে, তখন মানসিকভাবে একটু তো এগিয়ে থাকাই যায়। কিন্তু দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা সেই এগিয়ে থাকা থেকে নিজেদের রুখে দিয়েছিলেন। তিনি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, অন্য যে কোন দলের চেয়ে এই জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশিবার খেলেছে। এই দলটির বিপক্ষে বাংলাদেশ অনেকবার হেরেছেও। অর্থাৎ, সহজভাবে নেওয়ার কোন সুযোগই নেই।
শেরে বাংলায় যখন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বসলেন মাশরাফি তখনই বলেছিলেন,
‘এমন নয় যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমরা কখনো হারিনি বা হারতে পারব না। ওদের যে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে, ওদের সামর্থ্য আছে ভালো করার। এখানে একজন প্লেয়ার যদি সেঞ্চুরি করে, সেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১০০ হিসেবেই গণ্য হবে। কেউ যদি পাঁচ উইকেট পায়, তাহলে পাঁচ উইকেটই গণ্য করা হবে। যে প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই খেলি না কেন, এমন পারফরম্যান্স করা কিন্তু কঠিন।’
সব মিলিয়েই ফেবারিট ছিল জিম্বাবুয়ে। সিরিজেও, প্রথম ম্যাচের আগেও। তাছাড়া দীর্ঘ আট মাস পর ঘরের মাঠে খেলতে নামা বাংলাদেশও যে খানিকটা অপ্রস্তুত, তা মাসাদাদজা-টেইলরের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের পাখির চোখ ঠিকই বুঝে নিয়েছিলো। সেভাবেই এঁটেছিলো রণপরিকল্পনা। দিনশেষে যদিও সেসব পরিকল্পনা কোনো কাজেই আসেনি।
দিবা-রাত্রির ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুটা তাদের মোটেও মনে রাখার মতো হয়নি। গ্যালারি ভরা দর্শক আর মাঠে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের নিয়মিত আসা-যাওয়ার বিরতি চোখে আঙুল দিয়ে অশনিসংকেত দিচ্ছিলো।
পরীক্ষিত ওপেনার তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে লিটন দাসের সঙ্গে ইমরুল কায়েস। কিংবা উল্টো করে যদি বলা যায়, ইমরুল কায়েসের সঙ্গে লিটন কুমার দাস, তাতেও ক্ষতি নেই। রানের চাকা শুরুতে একরকম বেঁধে রেখেছিল জিম্বাবুয়ের বোলাররা। তাতেই খানিকটা অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন এশিয়া কাপ ফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান লিটন। বিপত্তি বাঁধতে সময় লাগেনি। ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলেই চাতারার বলে ক্যাচ তুলে দিলেন, দলীয় রান তখন কেবল ১৬। ওভারের শেষ বলে আরো একটি উইকেট তুলে নেয় জিম্বাবুয়ে। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নামা ফজলে রাব্বি ব্যাট করতে নামলেন ঠিকই, কিন্তু ৪ বল মোকাবেলা করেও রানের খাতা খোলার আগেই ফিরলেন সাজঘরে। সাকিব আল হাসানের ইনজুরিতে জাতীয় দলে জায়গা হয় ৩০ বছর বয়সী রাব্বির। যার শূণ্যস্থান পূরণে নেমেছিলেন, সেখানে কোন সুবিধাই করতে পারলেন না এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার। শূন্য রানে আউট হওয়ার মধ্যে দিয়ে নাম লেখালেন বিব্রতকর রেকর্ডের পাশে। এ নিয়ে তিনি ১৩তম বাংলাদেশি ক্রিকেটার যিনি কিনা আন্তর্জাতিক অভিষেক ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়েছেন।
পরের উইকেটে মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গে নিয়ে ভালোই এগিয়েছেন ওপেনার ইমরুল কায়েস। ৪৯ রানের জুটি গড়ার পর ব্যক্তিগত ১৫ রানে আউট হয়েছেন মুশফিক। ততক্ষণে দলীয় রান ৬৬। সেখান থেকে মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে ২৮তম ওভারে ১৩৭ রান পর্যন্ত গেলেন ইমরুল।
শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন এই অবস্থানে, তখন আবার ঝড়। মাত্র ২ রানের ব্যবধানে মিঠুনসহ সাজঘরে মোট ৩ জন ব্যাটসম্যান। মিডল অর্ডারের ‘ত্রাণকর্তা’ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মেহেদী হাসান মিরাজ, দু’জনেই আউট! হুট করেই বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ১৩৯ রান।
এমন অবস্থা থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়ার অন্যতম এই পরাশক্তি যে প্রতিনিয়ত বড় দলে পরিণত হচ্ছে, তারই প্রমাণ মিলেছে রবিবারের ম্যাচে। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, যিনি কিনা উদীয়মান একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার, তাকে নিয়ে ওপেনার ইমরুল কায়েস গড়েছেন ১২৭ রানের জুটি। এর মধ্যেই ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরিটি তুলে নিলেন ইমরুল কায়েস।
উদযাপনটাও ছিল চোখে পড়ার মতোই। মিরপুরে ফুটবলার বেবেতো যেন ফিরে এলেন ক্রিকেটার ইমরুল কায়েসের মধ্যে। প্রথম সন্তানের বাবা হয়েছেন ক’দিন আগেই, সেঞ্চুরিটি ছেলেকে উৎসর্গ করলেন বেবেতোর মতো ছেলে কোলে নেওয়ার ইশারা দেখিয়ে।
শেষ পর্যন্ত ইমরুল কায়েস ১৪৪ রানের ইনিংস খেলেছেন, খরচ করেছেন ১৪০ বল। ইনিংসজুড়ে ছিল ১৩টি চার ও ছয়টি ছক্কার মার। কাইল জারভিসের বলে আউট হয়ে যখন সাজঘরে ফিরছেন তামিমের অভাব বুঝতে না দেওয়া এই ওপেনার, বাংলাদেশ তখন ৭ উইকেট হারিয়ে ২৬৬ রান তুলেছে। তারপরই ফিরেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি তুলে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ থেমেছে ২৭১ রানে।
২.
ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ২৭২ রানের লক্ষ্য জয় করতে নেমে জিম্বাবুয়ের শুরুটা হয়েছিল দারুণ মারকুটে। ওপেনার ঝুয়াওয়ে যখন মুস্তাফিজুর রহমানের বলটি বুঝে ওঠার আগেই বোল্ড হলেন, জিম্বাবুয়ের দলীয় রান তখন ৪৮। সেখান থেকে ৫২ রানের ব্যবধানে আরও চারটি উইকেট হারিয়েছে সফরকারীরা।
এরপর শন উইলিয়ামস ও পিটার মুর প্রতিরোধের দেয়াল তুললেও সেটা টিকেছে ৪৫ রান পর্যন্ত। শেষদিকেও খানিকটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলো জিম্বাবুয়ে, কিন্তু তা কেবল বিরক্তিকরভাবে ম্যাচই টেনেছে, কমিয়েছে ম্যাচের আমেজ। কারণ জিম্বাবুয়ের হার নিশ্চিত হয়েছে তাদের ৮ম উইকেটেই।
শেষ পর্যন্ত ৯ উইকেটে ২৩৬ রানে থেমেছেন মাসাকাদজা-ঝুয়াওয়েরা, যেখানে বল হাতে বাংলাদেশের ডানহাতি স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নিয়েছেন। এছাড়া আরেক স্পিনার নাজমুল অপু নিয়েছেন দুই উইকেট, মুস্তাফিজ নিয়েছেন একটি।
৩.
ম্যাচ শেষে পুরো আলোটুকু কেড়েছেন ইমরুল কায়েস। ১৪৪ রানের বদৌলতে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা লিখেছেন নিজের নামের পাশে। তবে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলার পরও এটাকে নিজের সেরা ইনিংস বলতে নারাজ ইমরুল। তার চেয়েও বেশি মাত্র শেষ হওয়া এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাওয়া ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংসকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কায়েস বলেছেন,
‘এটা আমার ক্যারিয়ারের ভালো একটা ইনিংস হিসেবে রাখবো। তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইনিংস অনেক দরকার ছিল। আল্টিমেটলি নিজে ভালো খেললে দলের কাজ হয়ে যায়। আজকের ইনিংসটির জন্য বাংলাদেশ দল সেভ হয়ে গেছে। এটার জন্য আলহামদুলিল্লাহ।’
দলে তামিম নেই। সেক্ষেত্রে তামিমের সেই চাপটা এসে পড়েছিল ইমরুলের উপর। অভিজ্ঞতা আর ম্যাচে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সেই চাপ কাটিয়ে সেঞ্চুরি পাওয়াটা ইমরুলের জন্য বাড়তি অনুপ্রেরণার যোগান দিয়েছে। বলেছেন,
‘আসলে আজকের ইনিংসটিতে শুরুতে একটু নার্ভাস লাগছিল। একটু চাপ নিলে ঘাম হয় প্রচুর। ঘামলে ক্র্যাম্প হওয়ার শঙ্কা থাকে। একটা সময় যখন ভালো বোধ করতে শুরু করলাম, তার পর আর ঘাম হয়নি বেশি। একটি গ্লাভস পরেই ইনিংস শেষ করেছি, বদলাতে হয়নি। চাপটা পরে আর অনুভব করিনি।’
আপাতত মিরপুরের মিশন শেষ। সিরিজ এবার চট্টগ্রামের সাগরিকায়। আজ ইমরুল, কাল লিটন কিংবা পরশু আরেকজন; এভাবেই একটা ‘দল’ হয়ে ম্যাচ জয় থেকেই হয়তো সিরিজ জয়ের হাসিটাও হাসবে বাংলাদেশ।