সংশয় ছিল প্রচণ্ড, প্রশ্নও ছিল অনেক৷ মহামারীর মধ্যে আইপিএল ফেরানো নিয়ে জল তো কম ঘোলা হয়নি! মাঠে খেলা গড়াতেই অবশ্য সব সংশয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, সমস্ত প্রশ্নকে দারুণ প্রাণবন্ত ক্রিকেট দিয়ে সীমানাদড়ির ওপারটায় উড়িয়ে দেবার দায়িত্বটা নিয়েছেন ক্রিকেটাররাই। মোটে পেরিয়েছে এক সপ্তাহ, তাতেই ‘ইতিহাসসেরা’র তকমাও আইপিএলের ১৩তম মৌসুমের তিলকে এঁকে দিতে চাইছেন কেউ কেউ। রোর বাংলাও পিছু ফিরে দেখতে চাইছে, কেমন ছিল আইপিএলের প্রথম সপ্তাহ।
এক নজরে প্রথম সপ্তাহ
-
গেল মৌসুমে রান পাননি, ২৩ গড়ে করেছিলেন মাত্র ২৮২ রান। ২০২০ মৌসুমে রান করবার জন্যে আম্বাতি রায়ুডু যেন তেঁতেই ছিলেন ভেতরে ভেতরে। মৌসুমের উদ্বোধনী ম্যাচেই ৭১ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে প্রমাণ করেছেন সেটাই।
-
১৯তম ওভার শেষে থাকা ১২৭ রানটাই ছয় বল পরে হয়ে গেল ১৫৭, পুরোটাই মার্কাস স্টইনিসের কল্যাণে। এই ১৫৭ রানকে পুঁজি করেই দিল্লি জিতেছিল মৌসুমের দ্বিতীয় ম্যাচ। অবশ্য তার আগে ঘাম ঝরেছিল বেশ। স্টইনিসের ঝোড়ো অর্ধশতক ম্লান হয়ে গিয়েছে মায়াঙ্ক আগারওয়ালের ৮৯ রানের এক কালজয়ী ইনিংসের কাছে। যদিও জয়ের হাসিটা শেষতক স্টইনিসই হেসেছিলেন, কিন্তু আগারওয়ালের দুর্দান্ত ইনিংসের সুবাদেই আইপিএল দেখেছে মৌসুমের প্রথম সুপার ওভার।
-
ব্যাটসম্যান পাওয়া নিয়ে ভারতের যে কোনোকালেই দুশ্চিন্তা করতে হবে না, তা বুঝিয়ে দিতে আইপিএলের মঞ্চে হাজির হলেন দেবদূত পাড়িকাল। মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে হাফসেঞ্চুরি করলেন সদ্যই কৈশোর পেরোনো এই ভারতীয়। বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদ ম্যাচে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়েছিলেন আরেকজনও, এবি ডি ভিলিয়ার্স নামটা নিশ্চয়ই আর বলতে হবে না! তাদের দু’জনের ব্যাটে চড়েই কোহলির দল তুলেছিল ১৬৩ রান, জনি বেয়ারেস্টোর অর্ধশতকের পরেও ২৪ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারিয়ে হায়দরাবাদ ম্যাচটা হেরেছিল ১০ রানে।
-
করোনার কারণে পাওয়া অনাহূত বিরতিতে হাজারবিশেক বল খেলেছিলেন সাঞ্জু স্যামসন। আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই ৩০ বলে ৭০ রানের এক ইনিংসে পেয়েছেন সেই পরিশ্রমের পুরষ্কার। তার দল রাজস্থান রয়্যালস ম্যাচটা ১৭ রানে জিতলেও আদতে চেন্নাই ম্যাচজয়ের দৌঁড়ে ছিল না কখনোই।
-
প্রথম ম্যাচে হারের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুম্বাই, কলকাতাকে হারিয়েছে ৪৯ রানে। রোহিত শর্মাও প্রথম ম্যাচে ব্যর্থতার শোধ তুলেছেন ব্যাট হাতে, খেলেছেন ৫৪ বলে ৮০ রানের ইনিংস।
-
রান তো অনেকেই করেন, কিন্তু লোকেশ রাহুলের মতো করে ক’জন ব্যাটসম্যান পারবেন! সেদিন রাহুলের করা ১৩২ রান আইপিএল ইতিহাসেরই সুন্দরতম ইনিংস কি না, তা নিয়ে তর্ক চলছে বেশ। তার এই ব্যাটিং-সৌন্দর্য্যের কল্যাণেই বেঙ্গালুরুকে ৯৭ রানে হারিয়ে মৌসুমের প্রথম জয় পেয়েছে পাঞ্জাব।
-
চেন্নাইয়ের আইপিএল সাফল্যের মূলসূত্র যে স্পিনাররা, সেই তারাই এবার এখন পর্যন্ত নিষ্প্রভ। রবীন্দ্র জাদেজা প্রথম সপ্তাহের তিন ম্যাচেই রান দিয়েছেন চল্লিশের বেশি, লেগ-স্পিনে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেননি পীযূষ চাওলাও। প্রথম ম্যাচে জয়ের পরে চেন্নাইও হেরেছে পরের দুই ম্যাচ, সপ্তাহের শেষ ম্যাচে দিল্লির কাছে হার ৪৪ রানে।
টস জিতে বল নিয়েছো, তো হেরেছো!
সাধারণত আইপিএলটা যখন হয়, ভারতে তখন চলে গ্রীষ্মকাল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবারের আইপিএলটা হচ্ছে আমিরাতের শীতকালে। রাত্তিরে শিশির পড়বে এই সমীকরণ কষে টস জিতে ফিল্ডিং নেবার কথাই ভেবেছিল দলগুলো। কেননা, শিশির পড়লে বলটা পিছলে গিয়ে ব্যাটে আসে ভালো, বোলারদের বলটা গ্রিপ করতেও সমস্যা হয় তখন। ইতিহাসও তো অধিনায়কদের বলছিল টস জিতে বোলিং নেবার জন্যে। ২০১৪ সাল থেকে হিসেব করলে আইপিএলের প্রথম সপ্তাহে পরে ব্যাট করেই জয় পেয়েছে বেশিরভাগ দল। এমনকি ২০১৪ সালে শেষ যেবার আমিরাতে বসেছিল আইপিএলের আসর, সেবারেও সাতবারের ছয়দানেই জিতেছিল ম্যাচের দ্বিতীয়ভাগে ব্যাট করা দল।
এবারে খেলা মাঠে গড়াতে দেখা যাচ্ছে, এসব সম্ভাবনা-সমীকরণ কাজে দেয় ম্যাচের আগ অব্দিই। শুরুর সাত ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন সব অধিনায়কই, তাতে সাফল্যের মুখ দেখেছেন একমাত্র এমএস ধোনিই। বাকি ছয় দানেই টসজয়ী অধিনায়ক হোটেলে ফিরেছিলেন ম্যাচজয়ের দুঃখ মুখে লেপে। এবারের আসরে প্রথম ইনিংসে গড় রানও এসেছে আগের চাইতে বেশি। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করা দলগুলো এবারে রান তুলেছে ১৮২ গড়ে, ১৭৫ গড় নিয়ে যার কাছাকাছি রান ২০১৫ মৌসুমে।
পেসার বনাম স্পিনার
পিএসএল কিংবা আমিরাতের মাটিতে পাকিস্তানের খেলা টি-টোয়েন্টি সিরিজগুলো দেখে দলগুলো খুব সম্ভবত ধারণা পেয়েছিল, এবারের আইপিএলে পেসাররাই রাজ করবেন, আর স্পিনাররা দলে রইবেন রান আটকে রাখার দায়িত্বে। কিন্তু আইপিএল শুরুর পর জারি হয়েছে স্পিনারদের শাসনতন্ত্র। উইকেট, বোলিং গড় কিংবা ইকোনমি, প্রথম সপ্তাহে স্পিনাররা এগিয়ে আছেন সবখানেই। শুরুর সাতদিনে স্পিনাররা বল করেছেন ঠিক ১০০ ওভার, যার ৮৩টাই মিডল-ওভার সময়কালে। সময়টা যে লেগ স্পিনারদের, তা বুঝিয়ে স্পিনাররা এগিয়ে আছেন এবারের আইপিএলেও। ওভারপ্রতি ৭.৬০ রান খরচায় তারা উইকেট তুলেছেন ২২টি, বিপরীতে অফস্পিনারদের শিকার মাত্র দশ উইকেট, ইকোনমিও ০.০৬ বেশি।
পেসাররা অবশ্য দাবি করবেন, ইনিংস শুরুর পাওয়ারপ্লে কিংবা শেষের স্লগ ওভারে, তাদের হাতে বল তুলে দেয়া হয় তখনই। এখন অব্দি শেষের ওভারগুলোতে বল হাতে তাদের পারফরম্যান্সকে এক কথায় বলা চলে ‘যাচ্ছেতাই’। ১৬-২০ ওভারগুলোতে যে কয় ওভার বল করেছেন তারা, তাতে যদিও তুলেছেন ত্রিশ উইকেট, কিন্তু ওভারপ্রতি রান খরচা করেছেন তো এগারোর বেশি।
সবচেয়ে বড় ঝড়টা অবশ্য বয়ে গিয়েছে শেষ ওভারে যারা বল করতে এসেছেন, সেই পেসারদের ওপর দিয়ে। মৌসুমের দ্বিতীয় ম্যাচেই ক্রিস জর্ডানের শেষ ওভারে ৩০ রান তুলে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মার্কাস স্টইনিস, দু’দিন বাদে লুঙ্গি এনগিডির ওভারেও একই সংখ্যার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন জোফরা আর্চার। ইনিংসের শেষ ওভারে রান তোলার হার এমনিতেই বাড়ছিল মৌসুমে মৌসুমে, কিন্তু এবারে তা ছাড়িয়ে গিয়েছে সব হিসেবনিকেশ। এবার প্রথম সাত ম্যাচে ২০তম ওভারে রান হয়েছে ১৭.৭১ করে, যা কি না গত মৌসুমের চাইতে ৩.৫৯ রান বেশি।
শেষের এই করুণ পরিণতিতে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে পেসারদের শুরুর ওভারের সাফল্য। এবারের আইপিএলের পাওয়ারপ্লেতে এখন অব্দি পেসাররা বল করেছেন ৭৬ ওভার, তাতে ইকোনমিটা মাত্র ৭.০৫। প্রথম ইনিংসের চাইতে দ্বিতীয় ইনিংসে নতুন বলে পেসাররা সাফল্য পাচ্ছেন বেশি। পেসাররা দ্বিতীয় ইনিংসে পাওয়ারপ্লেতে বল করেছেন, এমন ওভারগুলোতে ব্যাটসম্যানরা রান তুলতে পেরেছেন মাত্র ৬.২৮ করে, ২৫.১১ গড়ে বোলাররা উইকেট তুলেছেন প্রতি ২০ বলে একবার।
এমনকি আগের আসরে যে দলগুলো পিছিয়ে পড়েছিল নতুন বলে উইকেট না তুলতে পারার কারণে, তারাও এবার কাটিয়ে উঠেছে এই সমস্যা। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব যেমন গেলবারের গোটা মৌসুমে শুরুর ছয় ওভারে উইকেট তুলেছিল ১২টি, এবারে মোহাম্মদ শামির সঙ্গে শেলডন কটরেলের জুটি গড়িয়ে দিয়ে প্রথম দুই ম্যাচেই তারা শিকার করেছে পাঁচ উইকেট। ট্রেন্ট বোল্ট আর জেমস প্যাটিনসনের কল্যাণে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বল হাতে শুরুটাও হচ্ছে বেশ ভালো, নতুন বলে তারা মিলে তুলেছেন চার উইকেট, ইকোনমি ছয়েরও নিচে।
এবারের আইপিএলের ম্যাচগুলো শুরু হচ্ছে আমিরাতের ঠিক সন্ধ্যে নামার ক্ষণে, টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নামা দল তাই নতুন বল পুরোটাই পাচ্ছে কৃত্রিম আলোর নিচে। কন্ডিশন আর বলটার যথাযথ ব্যবহার তারা করতে পারছেন বলেই রানতাড়ায় টসজেতা দলগুলো পড়ছে পিছিয়ে, এমনকি ইনিংসের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই প্রয়োজনীয় রানরেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে দশের কোটা।
চর্বিলাগানো হাত
ছ’মাস-ন’মাস বাদে ক্রিকেটাররা মাঠে ফিরেছেন বলে শুরুর ম্যাচগুলোতে ফিল্ডিংটা বেশ বাজে হবে, এমন শঙ্কা ছিলই। কিন্তু মাঠে যা হচ্ছে, তা তো ছাড়িয়ে যাচ্ছে ধারণাকেও। জসপ্রীত বুমরাহ ফিল্ডিং মিস করে হার্দিক পান্ডিয়ার নাকানিচুবানি খাচ্ছেন, বলের বাঁক বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন ট্রেন্ট বোল্ট। তবে সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে ক্যাচ ধরতে গিয়ে, প্রথম সাত ম্যাচেই ক্রিকেটাররা ক্যাচ ফেলেছেন ১৭ বার, যা কি না ইতিহাস-সর্বোচ্চ৷ শ্রেয়স আইয়ার তো মায়াঙ্ক আগারওয়ালের ক্যাচ ফেলে ম্যাচই হারিয়ে দিয়েছিলেন দিল্লিকে (শেষমেশ সুপার ওভারে জয়টা পেয়েছিল বলে রক্ষা), কোহলি একই ম্যাচে লোকেশ রাহুলের ক্যাচ ফেলেছেন দু’বার।
ক্রিকেটারদের এই বিপুল পরিমাণ ক্যাচ মিসের রহস্যোদ্ঘাটনের চেষ্টাও তাই চলছে সমানে, ১৭ ক্যাচের ১৩টিই দুবাইতে পড়েছে বলে আতশকাঁচের তলায় বেশি আসছে এই নামটিই। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর নয়, বরং ফ্লাডলাইটগুলো বিস্তৃত পুরো মাঠজুড়েই। তাই যেকোনোদিকে ক্যাচ উঠলেই মুহূর্তের জন্যে বল হারিয়ে ফেলবার কথা ক্রিকেটারদের, আর ওই এক পলকেই সর্বনাশ হচ্ছে, ক্যাচ পড়ছে।
প্রথম সপ্তাহ তো এমনি করেই চললো, এখন সময় দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার। কেননা, এবারের আইপিএলে সবচেয়ে বেশি তো দুবাইতেই খেলতে হবে।
শারজা বনাম অন্যরা
প্রথম সপ্তাহে ছয় হয়েছে ৯০টি, যার ৩৩টিই এসেছে শারজায় হওয়া একমাত্র ম্যাচে। এমনকি দুবাইতে হওয়া চার ম্যাচ মিলেও ব্যাটসম্যানরা ছক্কা মারতে পারেননি অতগুলো। কারণটি তো খালি চোখেই বোঝা যায়। অন্য মাঠগুলোর ব্যাসার্ধ যেখানে ৮০-৮২ মিটার অব্দিও পৌঁছে, শারজার সীমানাদড়িকে উইকেট থেকে ৭০ মিটার দূরত্বে স্থান দেয়াও মুশকিল হয়ে যায়। বাকি দুই মাঠে তাই দৌঁড়েই রান নিতে হচ্ছে বেশি, যেখানে শারজা পিছিয়ে আছে চার-ছয়ের অনুপাতেও।
চোটের সঙ্গে চোটপাট
ছয় মাস বাদে ক্রিকেটে ফেরার কারণে ক্রিকেটারদের ইনজুরিতে পড়বার ঝুঁকিটা এমনিতেই ছিল। ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাড়তি উৎপাত হয়ে হাজির হয়েছে আমিরশাহীর গরম। প্রথম ম্যাচে ৭২ রানের ইনিংস খেলবার পরে আম্বাতি রায়ুডু আর নামতে পারেননি পরের দুই ম্যাচে, পড়েছেন হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে। নিজের বলে ফিল্ডিং করতে গিয়ে কাঁধের চোটে পড়েছেন রবিচন্দন অশ্বিনও। দীপক চাহারকেও হ্যামস্ট্রিং ধরে কসরত করতে দেখা গিয়েছিল কিছুক্ষণ, ছোটখাটো চোট-সমস্যায় ভুগেছেন রোহিত শর্মা আর সৌরভ তিওয়ারিও। সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তিটির নাম অবশ্য মিচেল মার্শ, গোড়ালির চোটে পড়ে মাত্র চার বল করেই ছিটকে গিয়েছেন টুর্নামেন্ট থেকে।
এ তো গেল মাত্র প্রথম সপ্তাহের খতিয়ান। সামনে এগুতে এগুতে এই তালিকা আরও কত লম্বা হয়, তা-ই এখন দেখার।