১৯৭৫ সাল। অক্টোবর মাস। ইংল্যান্ডে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। এমন এক দিনে গ্লস্টারশায়ারের স্ট্রাউড এলাকার ১২ বছর বয়সী এক কিশোর ঠিক করলো, বাইরে রাত কাটাবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। ঘরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল জঙ্গলে রাত কাটাতে। উদ্দেশ্য একটাই, সেনাবাহিনীর সৈনিকরা কীভাবে এমন পরিবেশে টিকে থাকেন, সেই অভিজ্ঞতা অর্জন। কারণ, সেই কিশোরও সৈনিক হতে চায় মনেপ্রাণে। ঘরে তোলপাড়, ছেলে হারিয়ে গেছে। ছেলের খোঁজে নামলেন বাবা। নির্দয় শীতে সারা রাত একাই খুঁজলেন। দেখা পেলেন অবশেষে। এরপর ছেলের কপালে বকুনি-পিটুনি জুটেছিল কি না, জানা নেই। তবে জঙ্গলে কনকনে ঠাণ্ডায় রাত কাটিয়ে সেই ছোট্ট কিশোরের মাথা থেকে সৈনিক হওয়ার ভূত নেমে গেল।
উপরের দুই অনুচ্ছেদে আপনারা পড়ছিলেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার রবার্ট চার্লস রাসেল ও তার বাবার ঘটনা। যদিও জ্যাক রাসেল নামেই সুপরিচিত সাবেক এই ইংলিশ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন সৈনিক হবেন। সেই স্বপ্ন মিইয়ে গেছে শীতের কাঁপুনিতে। তবে সৈনিকদের সাহস, অনুপ্রেরণা বুকে ধারণ করে হয়েছেন ক্রিকেটার।
রাসেলের জবানিতে,
‘সৈনিক হতে পারিনি বলে আক্ষেপ নেই। এটা মারাত্মক একটা কাজ। আমার অন্তত কাউকে গুলি করতে হচ্ছে না, বা আমার গায়েও গুলি এসে লাগছে না। তবে সৈনিকদের সাহসিকতা সবসময়ই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ওভালে খেলা হলে ম্যাচের আগের দিন আমি ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামে যাবোই। গোটা বিকেলটা সেখানে কাটাব।’
রাইফেলের পরিবর্তে হাতে নিয়েছেন ব্যাট। হাতে গ্লাভস গলিয়ে সীমান্ত রক্ষার পরিবর্তে সামলেছেন উইকেট তিনটে। সেই কাজেই বেশি পটু ছিলেন, ছিলেন শৈল্পিক; ঘাড় অবধি নেমে আসা চুল, গোঁফ, চোখে সানগ্লাস, মাথায় সাদা ফ্লপি হ্যাট, হাতে গ্লাভস, টেপ প্যাঁচানো কিপিং প্যাড। তড়িৎ গতির একটা স্ট্যাম্পিং, কিংবা অনায়াসে লেগ স্টাম্পের বাইরের একটা ডেলিভারিকে আটকে ফেলা। ৯০ দশকে উইকেটের পেছনে এমন ‘কুলনেস’ নিয়েই ইংল্যান্ডের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন রাসেল।
‘আমিও এমন করতে চাই’
ক্রিকেটের শুরু নিজের স্কুলে আর স্ট্রাউড ক্রিকেট ক্লাবে। স্কুলে বন্ধুদের সাথে খেললেও ক্লাব ক্রিকেটে তার বাবা জনও খেলতেন। ‘বয়েজ টিমের’ অধিনায়ক ছিলেন রাসেল নিজেই। কাজেই, সবার আগে ব্যাটিং-বোলিংটাও করে নিতেন অধিনায়কের জোর খাটিয়ে। কিন্তু ১৪তম জন্মদিনের দুইদিন আগে রাসেলের নিজের জীবন, ক্রিকেটীয় জীবনে একটা বড়সড় পরিবর্তন আসে।
১৯৭৭ সাল। চলছে অস্ট্রেলিয়ার ইংল্যান্ড সফর। সিরিজের চতুর্থ টেস্ট, হেডিংলিতে। বাবার সঙ্গে টিভিতে দেখছিলেন রাসেল। টেস্টের চতুর্থ ইনিংস গড়িয়েছে চতুর্থ দিনেই। টনি গ্রেগের বলে অজি ওপেনার রিক ম্যাককসকার ক্যাচ দিলেন উইকেটরক্ষক অ্যালান নটের হাতে। মাটি ছুঁই ছুঁই বলটা দারুণ রিফ্লেক্স আর ক্ষিপ্রতায় এক হাতে জমান নট। সেই একটা ডিসমিসাল দেখেই রাসেল তার বাবাকে বলে বসেন,
‘আমিও এমন করতে চাই।’
সত্তর দশক কাঁপানো ইংলিশ উইকেটকিপার নটের সেই ক্যাচ দেখেই গ্লাভসজোড়া হাতে গলানোর অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন রাসেল,
‘একদম নিচু, এক হাতে ধরা, প্রায় প্রথম স্লিপে চলে গেছিল। দুর্দান্ত। মনে মনে ভাবছিলাম, আমারও এমন করার সক্ষমতা আছে। সেখানেই সব শুরু হয়েছিল। ক্রিকেটার কিংবা উইকেটরক্ষক হওয়ার অনুপ্রেরণা তখনই পেয়েছিলাম।’
স্ট্রাউড ক্রিকেট ক্লাবের ‘বয়েজ টিম’ থেকে ‘মেনস টিম’ ততদিনে রাসেলের ঠিকানা। সেই দলে তার বাবাও খেলতেন। সেই মেনস টিমে চার বছরে খেলার পর নিজের কাউন্টির দলে ডাক পান তিনি। নতুন পরিচয় গ্লস্টারশায়ারের উইকেটরক্ষক। এই কাউন্টির হয়ে খেলার সময়ই নজরে পড়েন ডার্বিশায়ার ও ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক বব টেলরের। টেলর তার সর্বস্ব দিয়ে রাসেলকে সাহায্য করেন। তুলে আনেন গ্লস্টারশায়ার কাউন্টির স্ট্রাউড ক্রিকেট ক্লাবের ‘বয়েজ টিম’ অধিনায়ক রাসেলকে।
ততদিনে টেলরের মাধ্যমে ‘আইডল’ অ্যালান নটের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছেন রাসেল। কৈশোরের নায়ক, পরামর্শক, বন্ধু; সবই ছিলেন। ব্যাটিং কিংবা কিপিং, চারদিন-পাঁচদিনের ম্যাচে কীভাবে খেলতে হয়, চিন্তাভাবনা কেমন হতে হয়, রাসেলকে তা ক্রমশ শিখিয়ে ফেলছেন নট। ৯৫ টেস্টে ২৬৯টি ডিসমিসাল নিয়ে ইংল্যান্ডের বাকি সব উইকেটকিপারকে ছাপিয়ে গেছেন নট। তার আশেপাশে থাকলেও কেউই তাকে ছুঁতে পারেননি। দুই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাট প্রায়র ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট। নটের মতো এই দু’জনও ইংলিশ ক্রিকেটে এখন সাবেক।
নট কাউন্টি খেলতেন কেন্টের হয়ে। রাসেল খেলতেন গ্লুচেস্টারশায়ারে। তবে কেন্টের ড্রেসিংরুমে তার আনাগোনা ছিল বেশ। ড্রেসিংরুমের দরজায় নক করতেন রাসেল, ডাকতেন নটকে। ওদিকে নট ছিলেন বেশ আলসে। ম্যাচ শেষ হয়ে গেলেও, অনেক সময় অবধি ড্রেসিংরুমে থাকতেন তিনি। সেই দেরি করাটা অবশ্য রাসেলের জন্য ভালোই ছিল। চুটিয়ে আড্ডা মারতেন দুজন। সেই আড্ডাতেই অল্প কথায় উঠে আসতো ক্রিকেটের নানান দিক।
ক্রিকইনফোর কাছে রাসেলের স্মৃতিচারণ,
‘আমাদের সময় কোচের এত ছড়াছড়ি ছিল না। এভাবেই শিখতাম আমরা। দরকারে নিজেই খুঁজে নিতাম। গ্রেট ক্রিকেটারদের সাথে সুযোগ পেলেই কথা বলা উচিত।’
উত্থান
কাউন্টিতে আলো ছড়িয়ে ডাক পান ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। যদিও, টেস্টের আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে পা রেখেছেন রাসেল। অভিষেক হয়েছে ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে। সুযোগ পেয়েছিলেন দুই বল খেলার। দুই বলে দুই রানে অপরাজিত থাকেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। সেদিন দুটো ক্যাচও নিয়েছিলেন তিনি। কেমন ছিল তার অনুভূতি? রাসেল ফিরে গেলেন ৮৭ সালের পেশোয়ারে,
‘থ্রি লায়ন্সকে বুকে নিয়ে মাঠে নামা প্রথমবারের মতো। সারাজীবনের চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যাওয়ার মতো ছিল ব্যাপারটা। সেটা যদি আমার খেলা একমাত্র ম্যাচ হতো, তাও আফসোস থাকতো না।’
ওয়ানডে ক্যারিয়ার বেশি লম্বা হয়নি। ১১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৪০ ওয়ানডে। ১৯৮৭-১৯৯৮ টাইম স্প্যানে ৪০ ওয়ানডে খেলে ৪৭ ডিসমিসালের মালিক হয়েছেন । ৪১ ক্যাচ, ছয় স্টাম্পিং। সাত নম্বর পজিশনের ব্যাটিং রেকর্ডটাও একেবারে সাদামাটা। ৪০ ম্যাচের ৩১ ইনিংসে ব্যাট করে ৪২৩ রান একটি মাত্র হাফ সেঞ্চুরি।
ক্রিকেটের রাজসিক ফরম্যাট টেস্টে তার অভিষেক হয় ১৯৮৮ সালে, লর্ডসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ইংল্যান্ডের বোর্ড চাচ্ছিল কিছু নতুন মুখ তুলে আনতে। সেই সিরিজেই ফিল নিউপোর্ট, কিম বার্নেটের সঙ্গে অভিষেক হয় তার। ছয় রানের জন্য সেদিন লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠেনি রাসেলের। ৯৪ রানে আউট হয়ে যান তিনি। অবশ্য ১৯৯৪ সালে ভারতের বিপক্ষে লর্ডসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে অনার্স বোর্ডে নাম তুলে নেন।
পরের টেস্ট খেলতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় বছরখানেক। সেই এক টেস্টের অভিজ্ঞতাই ছিল তার। ব্যাটসম্যান হিসেবেও ওয়ানডেতে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। ব্যাটিং সামর্থ্য সীমিত হলেও উইকেটকিপিংয়ে ছিলেন দুর্দান্ত। একই কারণে থিতু হতে পারছিলেন না টেস্ট দলেও। কিন্তু সুযোগ পেয়ে সীমিত ব্যাটিং শক্তি ও চোখ ধাঁধানো উইকেটকিপিং দিয়ে ঠিকই আলোচনায় ছিলেন রাসেল। সেবার বছর শেষে তিনিই ছিলেন একমাত্র ইংলিশ ক্রিকেটার, যিনি সে বছরের যে কারো গড়া বিশ্ব একাদশে জায়গা পেয়ে যাবেন।
অ্যাশেজে ‘দ্য ঘোস্ট অব এইটটি নাইন’
১৯৮৯ সালের অ্যাশেজ। সেবার যেন ভূত ভর করেছিল ইংল্যান্ডের ওপর। ভরাডুবি হয়েছিল ইংল্যান্ডের। ৪-০তে হেরে অ্যাশেজ খুইয়েছিল থ্রি লায়ন্সরা। সেই অ্যাশেজে ইংল্যান্ড দলে ডাক পান রাসেল। ঘরের মাঠে ভরাডুবির সেই অ্যাশেজে ইংল্যান্ড খাবি খেলেও, থেকে থেকে তাদের আলো হয়ে জ্বলছিলেন রাসেল। সিরিজের ছয় টেস্টে এক সেঞ্চুরি, এক হাফ সেঞ্চুরিতে ৩১৪ রান। দলের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান, সাথে ১৮ ডিসমিসাল। উইকেটের সামনে-পেছনে অবদান রেখে সেবার ‘উইজডেন’-এর সেরা ক্রিকেটারদের একজন হয়েছিলেন।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ম্যানচেস্টার। অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ২৬০। জবাবে অজিদের ১৮৭ রানের লিড। লিড টপকাতে গিয়ে পা হড়কায় ইংলিশদের। দুর্দশা চলমান, ৩৮ রানে নেই পাঁচ উইকেট। উইকেটে গেলেন রাসেল। ইনিংস ব্যবধানে হারের চোখ রাঙানি। মঞ্চটাও যেন তৈরি ছিল তার জন্য নিজের সেরাটা ঢেলে দেয়ার। ডেভিড গাওয়ারকে সাথে নিয়ে ছোট্ট এক জুটি গড়লেও সেটা টিকে থাকেনি বেশিক্ষণ। তবে জন এমবুরের সাথে বেশ জমে যায় রাসেলের। ১৪২ রানের মান বাঁচানো জুটি গড়েন দু’জন। দিনশেষে তেমন কোনো প্রভাব না ফেললেও রাসেল খেলেন সাহসী এক ইনিংস। দেখা পান প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির, তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার।
মাটিতে পড়তে থাকা ইংল্যান্ডের ভার একাই বয়েছেন সেদিন রাসেল। প্রায় ছয় ঘন্টা, ২৯৩টি ডেলিভারি পর্যন্ত অজিদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। অন্য প্রান্তে কেউ সেভাবে থিতু হতে পারেননি। লোন সারভাইভার হয়ে একাই টিকে ছিলেন রাসেল। মাঠ ছেড়েছিলেন ১২৮* রানে।
এর ১১ মাস আগেই টেস্টে অভিষেক হয়েছিল, লর্ডসে। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে গিয়েছিলেন উইকেটে। ৯৪ রানে আউট হয়ে যান। শ্রীলঙ্কার সেই দলটার বোলিং অ্যাটাকের ধার, ইংল্যান্ডের কোনো একটা কাউন্টির ধারেকাছেও ছিল না যদিও।
রাসেল ভেবেছিলেন, এই না পাওয়ার অনল তাকে সারাজীবন পোড়াবে। কিন্তু ১১ মাসের ব্যবধানে ক্রিকেট তাকে আরো বড় মঞ্চে আরো বড় সুযোগ করে দিল। আবারও এনে দাঁড় করিয়ে দিল নার্ভাস নাইন্টি ফোরে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে যখন ৯৪ রানে ব্যাট করছিলেন, তখন রাসেলের মনে হচ্ছিল, বাকি ছয়টা রান যেন ছয় ঘন্টার রাস্তা। সেই ইনিংসের রোমাঞ্চ এখনো ছুঁয়ে যায় তাকে,
‘আমার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস? অজিদের বিপক্ষে অ্যাশেজে আমার সেঞ্চুরি। এটাকে পেছনে ফেলার কোনো উপায়ই নেই। এর আগে লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে ৬৪* করেছিলাম। এরপরেও বাদ পড়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। কারণ, প্রথম টেস্টে রান পাইনি। ‘ডু অর ডাই’ ইনিংস ছিল সেটা।’
অ্যালেক স্টুয়ার্ট: বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি
একই পজিশনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট। স্টুয়ার্টের আগমনের পরই বদলে যায় চিত্রনাট্য। রাসেলের চেয়ে ঢের ভালো ব্যাটসম্যান স্টুয়ার্ট। ওদিকে উইকেটকিপিংয়ে স্টুয়ার্টের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে রাসেল। ব্যাটিংয়ে এগিয়ে থাকার কারণে নির্বাচকদের সুনজর বেশিরভাগ সময় স্টুয়ার্টের দিকেই গেছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের বোলিংয়ের সামনে প্রায়ই তাসের ঘরের মতো থুবড়ে পড়তো ইংল্যান্ড।
সেদিক থেকে চিন্তা করলে ব্যাটিং অর্ডারের নিচের দিকে স্টুয়ার্টের কার্যকারিতা রাসেল থেকে বেশিই ছিল। এর সাথে রঙিন পোশাকে সাদামাটা ব্যাটিংটাই রাসেলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারটাকে এগোতে দেয়নি। দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। তবে সেই সীমিত ব্যাটিং প্রতিভা আর দারুণ উইকেটকিপিং দিয়ে স্টুয়ার্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ঠিকই। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই দু’হাতে লুফে নিয়েছেন। উইকেটকিপার হিসেবে এতটাই ভালো ছিলেন যে, টিম ম্যানেজমেন্ট বাধ্য হয়েছে একাদশে দু’জন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান রাখতে। একসাথে ৩৬ টেস্ট, ও ২৬ ওয়ানডে খেলেছেন রাসেল-স্টুয়ার্ট।
সঙ্গী হোয়াইট ফ্লপি হ্যাট
অ্যালান নটের মতো সাদা ফ্লপি হ্যাট, টেপ প্যাঁচানো প্যাড পরেই উইকেট সামলাতেন রাসেল। এই সাদা ফ্লপি হ্যাট নিয়ে বিশাল সিরিয়াস ছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচ ছাড়া, বাকি সব ম্যাচেই একই ফ্লপি হ্যাট পরে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন এই ইংলিশ ক্রিকেটার। প্রিয় ফ্লপিকে প্রতি সিজনে দুইবার করে ধুয়ে দিতেন রাসেল। নিজের জীবনীতে লেখেছেন ধোয়ার পর শুকানোর প্রক্রিয়া। ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দ্রুত শুকানোর জন্য ওভেনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ফলাফল, ভস্মপ্রায় ফ্লপি!
বছর দুয়েক পরের কথা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ। আয়োজক (ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা) কমিটি থেকে নোটিশ পেলেন রাসেল। ইংল্যান্ডের নীল জার্সির সাথে মিলিয়ে ক্যাপ বা হ্যাট পরতে হবে। কিন্তু রাসেল তার জায়গায় অনড়। সাদা ফ্লপি হ্যাট পরেই খেলবেন তিনি। কলকাতা-লন্ডনে উত্তেজনা ছড়াল। দুই শহরের মধ্যে ফ্যাক্স চালাচালি হলো, ‘জ্যাক রাসেল হ্যাট ক্রাইসিস’। সমাধান এলো, বিশ্বকাপের টেকনিক্যাল কমিটি অনুমোদন দিলেন রাসেল ও তার সাদা ফ্লপি হ্যাটকে।
১৯৯৮ সালের ঘটনা। ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। তৎকালীন ইসিবি প্রধান, ইয়ান ম্যাকলরিন দলের সব ক্রিকেটারকে বললেন, সিরিজের সব ম্যাচে নীল ক্যাপ পরতে। সবাই রাজি হলেও গোঁ ধরে বসে ছিলেন রাসেল। কয়েক দফা বৈঠক হলো। সিদ্ধান্ত এলো, নীল ক্যাপটা নিজের মতো করে কেটে নিয়ে ব্যবহার করবেন রাসেল। সেই সফরেই ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে খেলেছিলেন তিনি। শেষ ওয়ানডেতে করে বসলেন আরেক মজার কাণ্ড। নীল ক্যাপ কেটে নিয়ে, পুরনো ফ্লপি হ্যাটে সেলাই করে সেই ম্যাচ খেলেছিলেন। ফ্লপি হ্যাট নিয়ে এতটাই সিরিয়াস ছিলেন তিনি!
সাদা ফ্লপি হ্যাট মাথায় চাপিয়ে, চোখে সানগ্লাস, আর শার্টের কলার দাঁড় করিয়ে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ৫৪ টেস্ট খেলেছেন। নামের পাশে আছে ১৬৫ ডিসমিসাল। ১৫৩ ক্যাচ, ১২ স্টাম্পিং। সেই ১২ স্টাম্পিংয়ের বেশিরভাগই একদম সেকেন্ড, মিলি সেকেন্ডের হিসেবে করা।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই। গোটা সফরেই ব্যাট হাতে বিবর্ণ ছিলেন তিনি। পাঁচ টেস্টে ৯০ রান করেন। যদিও ১২ ক্যাচের সাথে একটা স্টাম্পিং ছিল তার দখলে। তবে তা দিয়ে মোটেই আর দলে থাকা যাচ্ছিল না। বিদায়ঘন্টা বেজে গেল নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণার পর। ইংল্যান্ডের দায়িত্ব পেলেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট। এর ছয় মাসের মধ্যেই রাসেল চলে গেলেন সাইডলাইনে। রিজার্ভ উইকেটকিপার হিসেবে উঠে আসলেন ওয়ারেন হেগ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা থেমে গেলেও ২০০৪ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কাউন্টি ক্রিকেট। আটকে ছিলেন নিজের কাউন্টি গ্লস্টারশায়ারের সাথে। ১৯৯৫ সালে পান কাউন্টির অধিনায়কের দায়িত্ব। ছয়টা ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালে তুলেছেন দলকে। যার মধ্যে পাঁচটাতেই গ্লস্টারশায়ারকে জিতিয়েছেন শিরোপা। টানা এই সাফল্য তাকে বানিয়েছে ‘মেম্বার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’। ১৯৯৬ সালে রাণী এলিজাবেথের জন্মদিনে তাকে এই উপাধি দেয়া হয় ব্রিটিশ রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে।
সবাইকে থামতে হয়। সবকিছুরই শেষ আছে। জ্যাক রাসেলও থেমেছেন। ২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে পিঠের ইনজুরি দেখা দেয়। আর পেরে উঠছিলেন না। বয়সের ঘোড়াও ততদিনে ৪০-এর ঘরে দৌড়াচ্ছে। ব্যাট-প্যাডের সাথে গ্লাভসজোড়াও তুলে রাখতে হলো তাকে। মাঠের ক্রিকেটকে বিদায় বললেও ক্রিকেট থেকে দূরে সরেননি রাসেল। কোচিং করিয়েছেন গ্লস্টারশায়ারকে। ছিলেন দলটির পরামর্শকও। জেরাইন্ট জোন্সকে নিয়ে আলাদা করে কাজ করেছেন ২০০৮ সালে, যেমনটা অ্যালান নট তাকে নিয়ে করেছিলেন।
‘রেইন স্টপড প্লে’
শৈশবে হতে চেয়েছিলেন সৈনিক। জীবনের লক্ষ্য বদলে যায় একটা ক্যাচ দেখে। ক্রিকেটে ভালো-মন্দের মিশেলে সময় কাটিয়ে থিতু হয়েছিলেন কোচিংয়ে। তবে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে জ্যাক রাসেল মন দিয়েছেন ছবি আঁকাতে। দারুণ এক চিত্রকর তিনি। নিজের জীবনী তো লিখেছেনই, গোটা তিনেক বই লিখেছেন ছবি আঁকার ওপরেও। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ক্রিকেট মাঠেই। কিন্তু যখনই সময় পেয়েছেন, যখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছেন, তখন হাতে তুলে নিয়েছেন একট স্কেচবুক, পেন্সিল আর ক্যামেরা। হোক সেটা সেভার্ন নদীর কিনার কিংবা মুম্বাইয়ের মতো ব্যস্ত একটা শহর, পেশোয়ারের বাজার, অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো এক সমুদ্র সৈকতে বসে।
রাসেলের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটাও বেশ মজার। স্কেচবুকে, পেন্সিল-রংতুলির আচঁড় তখনও দেননি তিনি। তাকে সেদিকে এগিয়ে দিল বৃষ্টি। হ্যাঁ, বৃষ্টি। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। মাঠের বড় স্ক্রিনে, টিভির স্ক্রলে ভেসে ওঠে ‘রেইন স্টপড প্লে’। সেই সময়টায়, না চাইলেও মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয় ক্রিকেটারদের। কেউ আড্ডা দেন, কেউ তাস পিটান, কেউ বা আবার দু-পাতা সাহিত্য উল্টান। রাসেল অবশ্য ওসবের কোনোটাই করতেন না। সেই অঘোষিত অবসর কাজে লাগানোর জন্য তিনি বেছে নিলেন ছবি আঁকাকে। বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া কোনো একটা তিন দিনের ম্যাচের সেই অবসরেই রাসেলের শিল্পী হিসেবে হাতেখড়ি। এখন সেই শিল্পের মাস্টার তিনি রীতিমতো।
রাসেলের ছবি আঁকার ‘সাবজেক্ট’-এর পরিধিটাও বিশাল। ল্যান্ডস্কেপ, ওয়াইল্ডলাইফ, মিলিটারি, খেলার জগত, পছন্দের ক্রিকেট ভেন্যু। তার আঁকা ছবিগুলো ছড়িয়ে আছে সারা দুনিয়াতেই। ব্যাপ্তিটাও লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ থেকে অস্ট্রেলিয়ার বোরালে ‘দ্য ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম’। এঁকেছেন ‘ডিউক অব এডিনবরা’, ‘ডিউক অব কেন্ট’ এর ছবি। মিলিটারি, সৈনিকদের প্রতি তার ভালোবাসা ফুটে উঠছে পেন্সিল-তুলির ছোঁয়াতেও। এঁকেছেন ব্রিটিশ আর্মির দশজন ফিল্ড মার্শালের ছবিও। এই তালিকায় আছেন স্যার ববি চার্লটন, ডিকি বার্ড, ফিল টেলর। আছেন তার আইডল অ্যালান নটও।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে ছবি আঁকছেন রাসেল। ক্রিকেট মাঠের বেশ কিছু ছবিও এঁকেছেন। তার আঁকা অনেকগুলো ছবির মধ্যে দুটো ছবি আছে, যেগুলো ‘নট ফর সেল’। ছবির নাম তিনি দিয়েছেন ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’। ১৯৯৫ সালে ওয়ান্ডারার্স টেস্টে মাইকেল আথারটন ও রাসেল মিলে দারুণ এক জুটিতে ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন। সেই জুটির এক পর্যায়ে বল গিয়ে লাগে আথারটনের হেলমেটে। ব্যাটে ভর দিয়ে পিচে বসে যান তিনি। তখন কথা বলার জন্য এগিয়ে যান রাসেল। সেই পুরনো মুহূর্তটাই রংতুলিতে তুলে ধরেছেন রাসেল।
দ্বিতীয় ছবিটি হচ্ছে ২০০৫ অ্যাশেজের ঐতিহাসিক এজবাস্টন টেস্ট। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ছুটে গিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ব্রেট লি’কে। ‘স্পিরিট অফ দ্য গেম’, নাম দিয়েছেন ছবিটার। এই দুটো ছবির কোনো দাম হয় না রাসেলের কাছে।
ব্রিস্টল থেকে ১২ মাইল দূরে, সাউথ গ্লস্টারশায়ারের চিপিং সদবারি এলাকায় আছে রাসেলের আর্ট গ্যালারি। ‘দ্য বেল ইন’ নামে তৈরি হয়েছিল ভবনটি, ১৫৬০ সালে। যার বর্তমান মালিক সাবেক ইংলিশ এই ক্রিকেটার। ১৯৯৪ সালে কিনে নিয়ে, দান করেছেন নতুন চেহারা, দিয়েছেন শৈল্পিক রুপ। কেউ যদি ঘুরতে যান সেখানে, ক্রিকেটার ও শিল্পী রাসেলের দেখা পেয়ে যাবেন একেবারে। তার আঁকা ছবিগুলো আপনাকে নিয়ে হেঁটে বেড়াবে স্মৃতির করিডোর ধরে।
বলা চলে, শখে আর বিরক্তি দূর করতেই আঁকাআকি শুরু করেছিলেন। সেই শখ আর বিরক্তি দূর করার জিনিসটাই হয়ে উঠেছে তার দ্বিতীয় পেশা, একই সাথে নেশাও। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে, ক্যাচ ধরে, স্টাম্পিং করে, রান আউট করে উল্লাসে মেতে ম্যাচের ছবি এঁকেছেন, বদলে দিয়েছেন ম্যাচের গতিপথ, চিত্র, নকশা।
গ্লাভস হাতে ক্রিকেট মাঠে আঁকা সেই ছবিগুলো বদলে গেছে। ওভারকাস্ট ইংলিশ কন্ডিশনে সতীর্থ পেসারদের সুইং করানো বলগুলো জমা পড়তো তার গ্লাভসে। সেই গ্লাভসের জায়গা নিয়েছে রংতুলি। ওভারকাস্ট, স্যাঁতস্যাঁতে কন্ডিশনের পরিবর্তে রাসেল এখন স্বপ্ন আঁকেন ইংলিশ সামারের বৃষ্টিভেজা বিকেলগুলোতে। হাত-পা-শরীর নাচতো বলের গতিপথে, সেসব এখন নেচে যায় রংতুলি আর স্কেচবুকের সাথে। মাথায় আর ফ্লপি হ্যাট নেই, মাথার ভেতরে আছে অসংখ্য ছবির ক্যানভাস।