ধুমধাড়াক্কা স্টাইলে ব্যাটিং করার কারণে পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদিকে অনেকে ‘বুম বুম আফ্রিদি’ হিসাবে চেনেন। ক্রিকেট পাড়ায় তার এই নাম বেশ বিখ্যাত। টপ-অর্ডার বলেন কিংবা মিডল-অর্ডার, লোয়ার-অর্ডার কিংবা ফিনিশার, যখন যে পজিশনেই ব্যাট করুক না কেন, তার ব্যাটিং স্টাইলে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। ক্রিজে আসো, সজোরে ব্যাট হাঁকাও; ব্যাটে-বলে হলে বল মাঠের বাইরে, আর না হলে আফ্রিদি মাঠের বাইরে। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের চিত্রটাই এমন। ওয়ানডে, টেস্ট অথবা টি-টোয়েন্টি, সব ধরনের ক্রিকেটেই তার এই রূপ দেখা যেতো। এই রকম ব্যাটিং স্টাইলের কারণে তার স্ট্রাইক রেট যে অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় বেশি হবে, সেটা অনুমেয়।
শহীদ আফ্রিদি ৩৯৮ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৩.৫৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ১১৭.০০ স্ট্রাইক রেটে ৮,০৬৪ রান করেছেন। ওয়ানডেতে স্ট্রাইক রেটের দিক থেকে তার উপরেও আছেন কয়েকজন ক্রিকেটার। তার মধ্যে একজন ইংল্যান্ডের জস বাটলার। বাটলার নিজের উইকেটের কদর করে ক্রিকেটীয় শট খেলে প্রতিপক্ষের বোলারদের তুলোধোনা করে আসছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। ওয়ানডেতে কমপক্ষে এক হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট তার। সবার উপরে আছেন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তিনি ৩২.৩১ ব্যাটিং গড়ে ১২১.৬৪ স্ট্রাইক রেইটে ২,৩২৭ রান করেছেন। ম্যাক্সওয়েলের পরই অবস্থান করা জস বাটলার এখন পর্যন্ত ১২৬ ম্যাচের ১০৪ ইনিংসে ব্যাট করে ৪১.০২ ব্যাটিং গড়ে ১১৯.০৩ স্ট্রাইক রেটে ৩,৩৬৪ রান সংগ্রহ করেছেন।
ওয়ানডেতে চল্লিশ কিংবা তার চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান তুলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বাটলারের পর সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট ভারতের কেদার যাদবের। তিনি ৪৩.৫৬ ব্যাটিং গড়ে এবং ১০৬.৮২ স্ট্রাইক রেটে ১,০০২ রান করেছেন। ওয়ানডেতে জস বাটলারের মতো ধারাবাহিকভাবে রান করে এমন স্ট্রাইক রেটে রান করা ব্যাটসম্যান আর দ্বিতীয়টি নেই। ভারতের ওপেনার বীরেন্দর শেবাগের নাম আসতে পারে এই তালিকায়। তিনি ওয়ানডেতে ৩৫.০৫ গড়ে এবং ১০৪.৩৩ স্ট্রাইক রেইটে ৮,২৭৩ রান করেছেন।
জস বাটলারের ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিলো ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দুবাইতে নিজের অভিষেক ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো রান না করেই সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ‘সকাল দেখেই বোঝা যায়, দিনটা কেমন যাবে’ কথাটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বাটলারের ক্ষেত্রে। অন্যান্য হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যানদের মতো এলোপাতাড়ি ব্যাট না চালিয়েও দ্রুতগতিতে রান তুলতে পারেন তিনি। নিজের ৭ম ওয়ানডে ইনিংসে এর হালকা ঝলক দেখান নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। নটিংহ্যামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ ইনিংসে মাত্র ১৬ বলে ছয়টি চার এবং তিনটি ছয়ের মারে অপরাজিত ৪৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর থেকে নিয়মিতই এইরকম ঝড়ো ইনিংস খেলে অনুমানের চেয়েও দলকে বাড়তি সংগ্রহ এনে দিতেন তিনি।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর ওয়ানডেতে নতুন এক ইংল্যান্ডকে দেখা যায়। অল আউট অ্যাটাকের এই দলের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য জস বাটলার। এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রতিপক্ষের বোলাররা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাপে থাকেন। রয়, বেয়ারস্টো, হেলস, মরগান, রুট, স্টোকস এবং বাটলারদের নিয়ে গড়া এই ব্যাটিং লাইনআপ নিজেদের দিনে যেকোনো দলকে উড়িয়ে দিতে পারে।
এই সময়ে জস বাটলারও ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৭ ইনিংসে ব্যাট করে ছয়টি শতক এবং ১১টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন বাটলার, ব্যাটিং গড় এবং স্ট্রাইক রেটও ঈর্ষণীয়। ৪৯.৬১ ব্যাটিং গড়ে এবং ১২৪.৩৪ স্ট্রাইক রেটে তিনি ২,০৮৪ রান সংগ্রহ করেছেন বিশ্বকাপের পর থেকে।
জস বাটলার ওয়ানডেতে এখন পর্যন্ত সাতটি শতক এবং ১৮টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। কিন্তু ওয়ানডেতে তিনি মাত্র একবার শতাধিক বল মোকাবেলা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৮ সালের ২৪শে জুন ম্যানচেস্টারে ১২২ বলে ১২টি চার এবং একটি ছয়ের মারে অপরাজিত ১১০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২০৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ড মাত্র ১১৪ রানে আট উইকেট হারিয়ে বসে। সেখান থেকে আদিল রশিদ এবং জ্যাক বলকে সাথে দলকে এক উইকেটের জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। দল বিপর্যয়ে না পড়লে এই ইনিংসেও হয়তো শতক হাঁকাতে শতাধিক বল খেলতেন না তিনি।
ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের হয়ে দ্রুততম শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় জস বাটলারের জয়জয়কার। ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে সবচেয়ে দ্রুততম শতকের মালিক তিনি। ২০১৫ সালের ২০শে নভেম্বর দুবাইতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫২ বলে দশটি চার এবং আটটি ছয়ের মারে অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংস খেলার পথে মাত্র ৪৬ বলে শতক পূর্ণ করেছিলেন তিনি। যে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডেতে খালি হাতে ফিরে গিয়েছিলেন, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বছর তিনেক পর রেকর্ড গড়ে শতক হাঁকিয়ে বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। এজন্যই হয়তো পরের ওয়ানডে ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৬ বলে ১১টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের মারে ১০৫ রানের ইনিংস খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। ঐ ইনিংসে তিনি শতক হাঁকিয়েছিলেন মাত্র ৭৩ বলে।
গতকাল (২৭শে ফেব্রুয়ারি) ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনি মাত্র ৬০ বলে শতক হাঁকান। ওয়ানডেতে এটি তার দ্বিতীয় দ্রুততম শতক হাঁকানোর রেকর্ড। সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার ৭৭ বলে ১৩টি চার এবং ১২টি ছয়ের মারে সাজানো ১৫০ রানের ইনিংসের উপর ভর করে ইংল্যান্ড পাঁচ উইকেটে ৪১৮ রান তুলেছিল। তার ঝড়ো ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি হেলস, মরগান এবং বেয়ারস্টোর দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ইংল্যান্ড এই ম্যাচে মোট ২৪টি ছয় হাঁকিয়েছিলো, যা ওয়ানডেতে যেকোনো দলের পক্ষে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানোর রেকর্ড।
জস বাটলার তার ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ ম্যাচে ছয় কিংবা সাত নাম্বারে ব্যাট করেছেন। গতকাল পাঁচ নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে দেড়শো’ রানের ইনিংস খেলেছেন। ওয়ানডেতে এই নিয়ে পাঁচ কিংবা এর নিচের ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করে দেড়শো’ রানের ইনিংস খেলার ঘটনা ঘটেছে মাত্র ছয়বার, যার মধ্যে দুইবার এই কীর্তি গড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। ইংল্যান্ডের হয়ে পাঁচ কিংবা এর নিচের পজিশনে ব্যাট করতে নেমে এর আগের সর্বোচ্চ ইনিংসটিও বাটলারই খেলেছিলেন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৬৬ বলে শতক হাঁকানোর পর ৭৭ বলে ১৩টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের মারে ১২৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
গতকাল জস বাটলার মাত্র ৭৬ বলে ১৫০ রান পূর্ণ করেছেন। ওয়ানডেতে দ্বিতীয় দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসাবে তিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। তার উপরে আছেন শুধুমাত্র এবি ডি ভিলিয়ার্স, তিনি ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৪ বলে ১৫০ রান পূর্ণ করেছিলেন।
বাটলার তার ১৫০ রানের ইনিংস খেলার পথে ১২টি ছয় হাঁকিয়েছেন, যা ইংল্যান্ডের কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছয় হাঁকানোর রেকর্ড। এর আগে কোনো ব্যাটসম্যান দশের বেশি ছয় হাঁকাতে পারেননি। সর্বোচ্চ আটটি ছয় হাঁকিয়েছিলেন তিনি নিজেই; পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪৬ বলে শতক হাঁকানোর দিনে আটটি ছয় হাঁকিয়েছিলেন।
ওয়ানডেতে এমন ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে ক্রিকেট বিশ্বের নজর কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের টেস্ট দল নির্ধারণ করা সদস্যদেরও সুনজরে এসেছেন তিনি। তার দুর্দান্ত সময়কে কাজে লাগানোর জন্য তাকে টেস্ট দলেও অন্তর্ভুক্তি করানো হয়। টেস্ট দলে জায়গা পেয়েও তার খেলার ধরনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান হিসাবে খেললেও তার ব্যাটিং পজিশন মিডল-অর্ডার এবং লোয়ার মিডল-অর্ডারেই। যেসব কন্ডিশনে দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা সুবিধে করতে পারেন না, সেখানে তিনি এসে টেল-এন্ডারদের সাথে নিয়ে দ্রুত কিছু রান যোগ করে দিয়ে যান, যা রানসংখ্যাতে খুব বেশি না হলেও কার্যকরী।
ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ইংল্যান্ড দলের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি। তিন ফরম্যাটে তিন রকম দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওয়ানডেতে মিডল-অর্ডার সামলানোর পাশাপাশি উইকেট-কিপিংয়ের দায়িত্বও পালন করেন। টি-টোয়েন্টিতে ইনিংস উদ্বোধন করে পাওয়ার-প্লে’র সদ্ব্যবহার করতে তার বিকল্প নেই। টেস্ট ক্রিকেটে উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্বভার বেয়ারস্টোর কাঁধে তুলে দিলেও ব্যাটিংটা করেন নিজের মতো করে, যেমনটা করে থাকেন স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে।
‘জোস’ বাটলার এভাবেই মুগ্ধতার ফেরিওয়ালা হয়ে যে আমাদেরকে মাতিয়ে রাখবেন আরো বেশ কয়েক বছর, সে বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ডের মানসিকতা খোলনলচে বদলে দেওয়া দলটাতে এই ক্রিকেটার অবিসংবাদিত এক অংশ। বিশ্বকাপেও যে তিনিই বাজির ঘোড়া হবেন ইংল্যান্ডের, সেটা বলাই বাহুল্য!