“ নারী মাত্রই দুর্বল। পুরুষের তুলনায় স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন। দাবা খেলাটি তাদের জন্য নয়…”
ওপরের উক্তিটি করেছিলেন একসময়ের বিশ্বসেরা এবং অনেকের মতেই ইতিহাসের সেরা দাবাড়ু– ববি ফিশার। কিন্তু এই উক্তিটিই তার দিকে একদিন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে এক বিস্ময় বালিকা জুডিথ পোলগারের কল্যাণে।
১৯৯১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে জুডিথ তৎকালীন সময়ের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হবার নতুন রেকর্ড গড়েন। এই রেকর্ড গড়ার জন্য তাকে পেছনে ফেলতে হয় প্রায় ২৩ বছর ধরে সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের রেকর্ড নিজের দখলে রাখা ববি ফিশারকে! সেদিনের সেই প্রত্যয়ী কিশোরী জুডিথ পরবর্তীতে দাবার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী দাবাড়ু হিসেবে।
আসলে শুধুমাত্র ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ শব্দটি দ্বারা এককথায় জুডিতের কৃতিত্বকে বোঝানো অসম্ভব। অর্জনের দিক দিয়ে যে কোন নারী দাবাড়ুর থেকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে। নিজের সেরা সময়ে তিনি ছিলেন ছেলে বা মেয়ে, উভয়ের মধ্যেই অন্যতম সেরা।
ইতিহাসের একমাত্র নারী দাবাড়ু হিসেবে জুডিথ কোয়ালিফাই করেছিলেন ‘বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে’। একমাত্র নারী হিসেবে তিনি পৃথিবীর সেরা ১০০ জন দাবাড়ুদের র্যাংকিং-এ স্থান করে নিয়েছিলেন এবং একসময়ে পৌঁছে যান শীর্ষ দশে। দশ জনের অধিক পুরুষ বিশ্বসেরা দাবাড়ুর সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার কৃতিত্বও রয়েছে জুডিতের ঝুলিতে।
জুডিথ পোলগারের বাবা লাজলো পোলগার ছিলেন একজন গণিতের শিক্ষক। তার অবসর সময় কাটতো বই পড়ে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা ব্যক্তিদের জীবনী নিয়ে লেখা বইগুলো ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। প্রায় একশ’র বেশি এই ধরনের বইয়ের সংগ্রহ ছিল তার।
বিশ্বসেরা ব্যক্তিদের জীবনী পড়তে পড়তে একসময় তিনি নিজেই সফলতার একটি মৌলিক রাস্তা খুঁজে পান, আর তা হলো কোনো একটি বিষয়ের ওপর একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড দক্ষতা গড়ে তোলা। তা করতে পারলে বিশ্বসেরা হওয়া কঠিন কিছু না।
সাফল্যের সূত্র তো লাজলো পেলেন, কিন্তু এই সূত্র প্রয়োগ করতে হলে প্রয়োজন একেবারেই কম বয়সী শিশুর। তা তিনি পাবেন কোথায়? তাই সব কিছু ভেবে-চিন্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করার।
লাজলো বিভিন্ন নারীর সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। তাদেরকে নিজের চিন্তা-ভাবনার কথা জানালেন এবং ভবিষ্যতে কোন একটি ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা হবে- এমন একজন সন্তানের জন্ম দেওয়ার ব্যাপারের তাদের মতামত জানতে চাইলেন।
অনেক নারীই ব্যাপারটিকে হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু ক্লারা নামের একজন ইউক্রেনিয়ান স্কুল শিক্ষিকার কাছে বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়। তিনি লাজলোর পোলগারের প্রস্তাবে রাজি হন। পরবর্তীতে লাজলো এবং ক্লারা বিয়ে করেন এবং তাদের ঘর আলো করে আসে তিনটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান – সুজান, সোফিয়া এবং জুডিথ পোলগার।
তার মেয়েরা কোন ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা হবে, তা নিয়ে প্রথম দিকে কোন মাথাব্যথা ছিল না লাজলো-ক্লারা দম্পতির। তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে বরং বাড়িতেই শিক্ষিত করে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ক্লারা তার মেয়েদেরকে ইংরেজি, রাশান, জার্মান এবং এস্পেরান্তো ভাষা শেখানো শুরু করেন এবং তাদেরকে উচ্চতর গণিত শেখানোর দায়িত্ব নেন লাজলো।
পরবর্তীকালে অনেক ভেবেচিন্তে লাজলো-ক্লারা দম্পতি তাদের তিন মেয়েকে বিশ্বসেরা দাবাড়ু হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে মনস্থির করেন। দাবার বিশ্বজনীন আবেদন, ইন্টারন্যাশনাল র্যাংকিং সিস্টেম এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ- এই তিনটি দিকই তাদেরকে নিজ কন্যাদের জন্য দাবাকে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
পোলগার বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুজান সর্বপ্রথম জনসম্মুখে নিজের প্রতিভা দেখাতে সক্ষম হন। মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি অনূর্ধ্ব-১১ বুদাপেস্ট নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন এবং ১৪ বছর বয়সে মেয়েদের র্যাংকিং-এ শীর্ষস্থান অধিকার করেন। সুজানের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট সোফিয়া মাত্র এগারো বছর বয়সেই অনূর্ধ্ব-১৪ বিশ্ব নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ড মেডেল লাভ করেন এবং ১৪ বছর বয়সে একই টুর্নামেন্টে তিনজন গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারিয়ে চারদিকে তাক লাগিয়ে দেন।
পোলগার পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য জুডিথ পোলগারের জন্ম হয় ১৯৭৬ সালে। তার শৈশব আর দশটা সাধারণ শিশুর মত ছিল না। বাবা-মায়ের নিবিড় পরিচর্যা এবং প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে তার জীবন। আশেপাশের অনেকেই জুডিতের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো এবং তার স্কুলে না যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের কটু কথা বলতো।
কিন্তু জুডিথ ওসবে কখনোই কান দেননি। বরং বড় দুই বোনের কাছ থেকে দাবার খুঁটিনাটি বিষয় শিখে নেয়ার প্রতিই ছিল তার যত আগ্রহ। একসময় দাবা হয়ে ওঠে পোলগার পরিবারের সার্বক্ষণিক সঙ্গী, যা তাদেরকে বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা করে রেখেছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবারের সবাই মগ্ন থাকত দাবা খেলায়। এজন্য অবশ্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ‘অসামাজিক’ তকমা জুটে গিয়েছিল তাদের।
পোলগার বোনদের যখন উত্থান হচ্ছিল, সেসময় দাবার দুনিয়ায় ছিল পুরুষদের একচ্ছত্র রাজত্ব। মেয়েদের দাবা খেলায় সাফল্য পাবার ব্যাপারে অনেকেই ছিল সন্দিহান। মেয়েরা দাবার মত একটি মানসিক খেলায় বিশ্বব্যাপী সাফল্য পাওয়ার মতো ‘স্মার্ট’ নয়– এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল সবার মধ্যে। অবশ্য সেসময় আন্তর্জাতিক দাবায় মেয়েদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম, যা এই ধরনের চিন্তার বিস্তার লাভে সাহায্য করেছিল।
তবে লাজলো পোলাগার এসব ধারণায় কখনোই বিশ্বাস করতেন না। তার মতে, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবই মেয়েদের দাবা খেলায় পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মেয়েরাও দাবা খেলায় ছেলেদের সমপর্যায়ে যেতে পারবে। জুডিথ এবং তার বোনেরা লাজলোর বিশ্বাসকে বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছেন।
জুডিথ প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা দাবা খেলে কাটাতেন। তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখনই তিনি তার বাবাকে দাবায় হারাতে পারতেন! একবার হাঙ্গেরির একটি শহরে একই সাথে পনেরো জনের বিরুদ্ধে লড়ে সবাইকেই হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি!
১৯৮৮ সালে অনূর্ধ্ব-১২ বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন জুডিথ। ১৫ বছর বয়সে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই তৎকালীন সময়ের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হবার কৃতিত্ব লাভ করেন তিনি।
শুরুর দিকে জুডিথ শুধুমাত্র মেয়েদের টুর্নামেন্টগুলোয় অংশ নিতেন। কিন্তু তার কাছে সেসব ছিল ডালভাত। কোন মেয়েই তার সামনে দাঁড়াতেই পারতো না। বাবার সাথে আলোচনা করে তাই তিনি ছেলেদের টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অবশ্য জুডিতের আগে প্রথমবারে মত বিশ্ব পুরুষ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কোয়ালিফাই করতে সক্ষম হন তার বড় বোন সুজান। জুডিথও তার বোনকে অনুসরণ করে একসময় অংশ নেন বিশ্ব পুরুষ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে।
দাবার আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ জুডিথ পোলগারের দ্রুত উত্থান ভালোভাবে নিতে পারেননি তৎকালীন বিশ্বসেরা অনেক দাবাড়ু। তারা বিভিন্ন জায়গায় জুডিতের নামে কটু কথা বলে বেড়াতেন। তৎকালীন বিশ্বসেরা দাবাড়ু গ্যারি ক্যাসপারোভ একবার বলেছিলেন,
“জুডিথ মেধাবী। কিন্তু খুব বেশি মেধা তার নেই। আসলে মেয়েরা তো প্রকৃতিগত ভাবেই দাবা খেলায় দুর্বল”।
১৯৯৪ সালে ক্যাসপারোভের কথার জবাব দেয়ার একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান জুডিথ। ঐ বছর একটি ম্যাচে মুখোমুখি হন ক্যাসপারোভ আর জুডিথ। অবশ্য ম্যাচটি ছিল যথেষ্ট বিতর্কিত। ম্যাচের এক পর্যায়ে ক্যাসপারোভ ঘোড়া দিয়ে একটি চাল দেন, কিন্তু পরক্ষণেই কী ভেবে তা ফিরিয়ে আনেন আগের জায়গায়।
নিয়মানুযায়ী একটি চাল দেয়া হয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু রেফারি ক্যাসপারোভের এই চালটি হিসাবের মধ্যে ধরলেন না এবং ম্যাচ শেষে ক্যাসপারোভই বিজয়ীর হাসি হাসেন।
ক্যাসপারোভের সাথে এই হারটি ছিল জুডিতের জন্য অত্যন্ত বেদনার। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ঐ বছরই বিশ্ব দাবাড়ুদের র্যাংকিং – এ শীর্ষ দশে জায়গা করে নেন জুডিথ।
পরবর্তী বছরগুলোয় একের পর এক পেশাদার ম্যাচ খেলে যান জুডিথ। ২০০৫ সালে বিশ্ব র্যাংকিং-এ শীর্ষ আটে প্রবেশ করেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে ইতিহাসের সেরা বেশ কয়েকজন পুরুষ গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারাতে সক্ষম হন জুডিথ। তাদের মধ্যে আনাতোলি কারপোভ, বিশ্বনাথ আনন্দ এবং গ্যারি ক্যাসপারোভ অন্যতম।
২০০৬ সালের দিকে সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে তিনি দাবা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। পরের কয়েক বছর নিজের মেয়ের দেখাশোনা, বই লেখা এবং বিভিন্ন দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে সময় কাটান জুডিথ। দাবাবিহীন এই সময়গুলো তাকে জীবনকে নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে বলে জানান জুডিথ। অবশ্য একসময় আবার তিনি প্রতিযোগিতামূলক দাবায় ফিরে আসেন এবং ২০১৪ সালের দিকে অবসর গ্রহণ করেন।
জুডিথ পোলগার যখন তার দাবা ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখনো আন্তর্জাতিক দাবায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। কিন্তু ধীরে ধীরে সে চিত্র বদলেছে। দাবা খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ এখন চোখে পড়ার মত। অবস্থার এই পরিবর্তনের পেছনে যে ক’জনের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে জুডিথ পোলগার অন্যতম। তিনি এখন আর শীর্ষ র্যাংক-ধারী কোন দাবাড়ু নন। কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে সর্বদা তিনি বিবেচিত হবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী দাবাড়ু হিসেবেই।
Outliers: The Story of Success বইটিতে লেখক ম্যালকম গ্লাডওয়েল ‘10,000 Hour Rule’ নামে একটি হাইপোথিসিসের সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দেন। তার মতে, কোনো ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতনভাবে দশ হাজার ঘণ্টা পরিশ্রম করলে তার পক্ষে ঐ বিষয়ে বিশ্বসেরা হওয়া খুবই সম্ভব। ম্যালকমের এই থিওরি সম্পর্কে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু পোলগার বোনদের জীবন, বিশেষ করে জুডিতের জীবনের গল্প যেন ম্যালকমের থিওরিকেই সমর্থন করে যে, চ্যাম্পিয়ন হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং চ্যাম্পিয়ন তৈরি করতে হয়।