মারাকানা নামের মন্দিরে আজ উপচে পড়া ভিড়।
সেটা না হওয়ারও কোনো কারণ নেই আসলে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে বাকি আর মাত্র এক ম্যাচ। উরুগুয়ের সাথে সেই ম্যাচটা জিতলে তো কথাই নেই, ড্র করলেও ব্রাজিলের ঘরে এসে যাবে প্রথম বিশ্বকাপ। গোটা দেশজুড়েই তাই তাই সাজ-সাজ রব। লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে স্টেডিয়ামের বাইরে। প্রায় দুই লক্ষ ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়ামে একটি সিট ফাঁকা থাকলেও আজ তা অস্বাভাবিক হতো।
খেলা শুরু হলো। অসাধারণ খেলতে থাকল স্বাগতিকেরা। তবে গোলের দেখা যেন পাওয়া যাচ্ছিলই না। প্রথমার্ধ শেষ হলো এভাবেই।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল। বিরতির পরে ততক্ষণে আড়মোড়াও ভাঙতে পারেননি দর্শক। তখনই গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দিলেন ফ্রিয়াকা!
বারুদে আগুন পড়লো যেন। আনন্দে বিস্ফোরিত হলো জনতা। বিশ্বজয়ের উৎসব শুরু হয়ে গেলো। কেউ না জানলে হয়তো ভেবেও নিতে পারতো, খেলা শেষ, জিতে গেছে ব্রাজিল। সেই সাথে জিতে গেছে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ। অথচ খেলা শেষ হতে তখনও বাকি প্রায় দ্বিতীয়ার্ধের পুরো সময়টুকু!
কিন্তু উরুগুয়েও যে একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! তারাও তো এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। তাই ঠিকই সমতায় ফিরে এলো তারা, ফেরালেন শিয়াফিনো। খেলার তখন ৬৬ মিনিট।
জনসমুদ্রের গর্জন তখন একটু কমেছে বটে; কিন্তু যা আছে, তা-ও নেহায়েত কম নয়। কারণ, বিশ্বকাপটা পেতে একটি ড্র-ই যথেষ্ট।
কিন্তু সর্বনাশ ঘটে গেল ৭৯ মিনিটে। বল পেয়ে গেলেন উরুগুয়ের উইঙ্গার অ্যালসিডেস ঘিগিয়া। শিয়াফিনোর গোলের উৎস তিনিই ছিলেন, আগেরবার ক্রস করেছিলেন একই জায়গা থেকে। এবারও ক্রস করবেন ভেবে নিজের জায়গা থেকে সরে গেলেন ব্রাজিলের গোলকিপার মোকির বারবোসা।
ভুল করলেন বারবোসা, এই ভুলের কারণে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আফসোস করে গেছেন এই গোলকিপার। কারণ ক্রস না করে সরাসরি শট নিলেন ঘিগিয়া। গোল!
থেমে গেল মারাকানার গর্জন। ঘিগিয়ার বল শুধু জালেই ঢুকল না, ঘিগিয়ার বল যেন গুলির রূপ নিয়ে ঢুকলো ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে। উরুগুয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে গেল।
ম্যাচের পরে এই হারের জন্য বারবোসাকে দায়ী করে গোটা ব্রাজিল। অথচ খেলায় এরকম ভুল হতেই পারে, কারণ খেলায় তাৎক্ষণিকভাবে সব সিদ্ধান্তই যে সঠিক হবে, তা তো নয়। আর তিনি তো ছিলেন গোলকিপার, ডিফেন্ডাররা কেন ঘিগিয়াকে ঠেকাতে পারেননি, এ প্রশ্ন মাথায় আসেনি কারো। অথবা এসেছিল হয়তো। কিন্তু মানুষ সবসময়ই ব্যর্থতার দায় চাপাতে চায় কারো কাঁধে, এক্ষেত্রে বারবোসার চেয়ে উপযুক্ত বলির পাঁঠা আর কেউই ছিল না। ২০০০ সালে তিনি যখন মারা যান, তখন পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করেনি ব্রাজিলিয়ানরা। যে কারণে বারবোসা একবার বলেছিলেন,
‘ব্রাজিলের আইনে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর। কিন্তু আমার জন্য তা হয়ে গেছে ৫০ বছর।’
৫০ বছর ধরে গোল না ঠেকানোর মতো এক ‘অপরাধ’ বয়ে বেড়িয়েছেন বারবোসা, তারপর ঘুমিয়ে গেছেন চিরনিদ্রায়।
*****
বারবোসার গল্প পাঠকরা রোর বাংলায় পড়েছেন। পড়ার পর তার দুঃখে দুঃখিতও হয়েছেন অনেকে। তবে আজ কেন তাকে নিয়ে আবার লেখা?
এই আর্টিকেলে লেখা বারবোসার অংশটুকু শুধুই ভূমিকা হিসেবে। ভিলেন বলুন, কিংবা ট্র্যাজিক হিরো, বারবোসা তা হয়েছিলেন নিজের দোষে। কিন্তু লিওনিদাস ডা সিলভা ট্র্যাজিক হিরো হয়েছিলেন সম্পূর্ণ অন্যের দোষে।
ঘটনাটা বারবোসারও ১২ বছর আগের, ১৯৩৮ ফুটবল বিশ্বকাপের। সেই হিসেবে লিওনিদাসকে ব্রাজিল ফুটবলের প্রথম ট্র্যাজিক হিরো বললেও ভুল হবে না।
*****
১৯১৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর রিও ডি জেনিরোতে জন্ম লিওনিদাসের, পরবর্তীতে সেখানেই বেড়ে ওঠেন তিনি। দেখতে ছিলেন ছোটখাটো, সেই সাথে গায়ের রঙ ছিল কালো। ব্রাজিল থেকে দাসপ্রথা ১৮৮৮ সালেই নির্মূল হয় বটে, কিন্তু মানুষের মননে যদি বর্ণবাদ গেঁড়ে বসে থাকে, তবে তার শেকড় উপড়ে ফেলা সহজ হয় না কখনোই।
লিওনিদাসের ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। তিনি যখন ফুটবল খেলছেন, তখন খেলাটা বন্দী হয়ে আছে সাদা চামড়া আর অভিজাত লোকদের পায়ে। পরিবর্তনটা এলো উরুগুয়ের মাধ্যমে, ১৯১৬ সালের কোপা আমেরিকায় তারাই প্রথম কোন কালো ফুটবলারকে দলে রেখে চমকে দিলো সবাইকে। তবে ব্রাজিলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজ হলো না এত। কালো কোন ফুটবলারকে প্রথম তারা দলে নিলো ১৬ বছর পরে, ১৯৩২ সালে। সেই কালো ফুটবলারের নাম? লিওনিদাস ডা সিলভা।
লিওনিদাস প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন বনসাকসেসো নামের এক ক্লাবের হয়ে ৩৯ ম্যাচে ২৩ গোল করার পরে। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ইনসাইড রাইট হিসেবে; এতই দুর্দান্ত খেলেছিলেন যে, তার নাম হয়ে যায় ‘ম্যাজিয়া নেগ্রা’, যার মানে ‘দ্য ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান’। তার বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। এরপর ব্রাজিলিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের প্লে-অফে সাও পাওলোর বিপক্ষে ডাক পড়ে তার; রিও সেই ম্যাচ জেতে ৩-০’তে, আর লিওনিদাস করেন জোড়া গোল।
বনসাকসেসোতে থাকার সময়ই প্রথমবারের মতো বাইসাইকেল কিকে গোল করেন তিনি। ঘটনাটা ১৯৩২ সালের, ক্যারিওকা’র সাথে খেলার সময়। এই ঘটনার পর লিওনিদাস আর বাইসাইকেল কিক শব্দগুলো হয়ে যায় সমার্থক। সে সময় দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে এই কিক প্রচলিত থাকলেও ব্রাজিলের মাটিতে সেটাই প্রথম, যে কারণে অনেকেই বাইসাইকেল কিকের আবিষ্কারক হিসেবে লিওনিদাসকে মনে করে থাকেন। কথাটা ভুল অবশ্যই। তবে বাইসাইকেল কিক ব্রাজিলে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব কার, এই প্রশ্নের উত্তরও একটাই – লিওনিদাস ডা সিলভা।
ম্যাজিয়া নেগ্রার পাশাপাশি আরও একটি নাম ছিল তার। আকারে ছোটখাটো ছিলেন, সেই সাথে বল পায়ে ছুটতেন দুরন্তগতিতে। ফাউল করে, লাথি মেরে, পেছন থেকে টেনে ধরে, কোনোভাবেই যেন থামানো যেতো না তাকে। শরীরে যেন হাড় অথবা মাংসের অস্তিত্ব ছিল না, গোটা শরীরটাই ছিল কালো চামড়ায় মোড়ানো রাবার। এরকম খেলার কারণে তার নাম হয়ে যায় ‘দ্য রাবার ম্যান’।
সাও পাওলো’র বিপক্ষে এই পারফরম্যান্স তাকে টেনে নিল বাৎসরিক রিও ব্রাঙ্কো টুর্নামেন্টের ব্রাজিল দলে। প্রথম বছর দলে রিজার্ভ হিসেবে থাকলেন, পরের বছর সুযোগ এলো মূল দলে। আর মূল দলে সুযোগ পেয়েই করলেন জোড়া গোল, উরুগুয়ের সাথে দল জিতল ২-১ ব্যবধানে।
তার এই পারফরম্যান্স দেখে ১৯৩৩ সালে তাকে কিনে নিল পেনারোল। পেনারোল উরুগুয়ের সেরা দুই ক্লাবের একটি, আরেকটির নাম ইন্টারন্যাশিওনাল। সেখানে এক বছর কাটানোর পরে আবার ফিরে এলেন ব্রাজিলে, এবারে তার দলের নাম ভাস্কো ডা গামা। সেখান থেকে যান বোটাফেগোতে, এবং ১৯৩৬ সালে যোগ দেন ফ্ল্যামেঙ্গোতে। ফ্ল্যামেঙ্গো একদম প্রথম দিকে যেসব কালো ফুটবলারকে সই করিয়েছিল, লিওনিদাস ছিলেন তাদের একজন। এই ক্লাবের হয়ে তার পরিসংখ্যান রীতিমতো অতিমানবীয়, ৮৮ ম্যাচে ৮৯ গোল। ১৯৪২ সালে ফ্ল্যামেঙ্গো ছেড়ে সাও পাওলো’তে পাড়ি জমান তিনি, ১৯৫০ সালে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
*****
১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল স্কোয়াডে ডাক পান লিওনিদাস। সেই বিশ্বকাপটা জঘন্য কাটল ব্রাজিলের, স্পেনের কাছে ৩-১’এ হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় তারা। একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় খেলতে এসেছিল দলটা, খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনো বোঝাপড়াই ছিল না। সেখান থেকেই এই বিপর্যয়। তবে বলাই বাহুল্য, ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন লিওনিদাসই!
তবে ম্যাজিকের পুরোটাই লিওনিদাস জমিয়ে রেখেছিলেন পরের বিশ্বকাপের জন্য। ১৯৩৮ বিশ্বকাপের আসর বসল ফ্রান্সে। গোটা ইউরোপজুড়েই তখন থমথমে এক পরিস্থিতি, অস্ট্রিয়াকে নিজেদের কবজায় নিয়ে নিয়েছে জার্মানি। যেকোনো মুহূর্তে বেজে উঠবে যুদ্ধের দামামা।
এত সবের মধ্যে ফ্রান্সের মাঠে জাদু দেখাতে শুরু করলেন দ্য ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান। ১৬ দল নিয়ে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপ ছিল নকআউট ফরম্যাটের, যার মানে হারলেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়।
পোল্যান্ডের সাথে প্রথম ম্যাচেই লিওনিদাসের হ্যাটট্রিক। নির্ধারিত সময়ের খেলা ৪-৪ গোলে শেষ হলো, প্রয়োজন পড়লো অতিরিক্ত সময়ের। অতিরিক্ত সময়ে ২ গোল করে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করলেন লিওনিদাস, সেই সাথে ব্রাজিল পোল্যান্ডকে হারাল ৬-৫ ব্যবধানে। পোল্যান্ডের উইলিমোস্কির চার গোল বৃথাই গেল শুধু।
এরপর কোয়ার্টার ফাইনাল। চেকস্লোভাকিয়ার মুখোমুখি ব্রাজিল। ১-১ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হলো এই ম্যাচ, এর মধ্যেও টুর্নামেন্টে নিজের চতুর্থ গোলটা তুলে নিলেন লিওনিদাস। সেই টুর্নামেন্টের নিয়ম ছিল, কোনো ম্যাচ ড্র হলে তা আবার হবে; ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রিপ্লে’। দু’দিন পরের ম্যাচে লিওনিদাস আর রবার্তোর গোলে চেকস্লোভাকিয়াকে ২-১’এ হারিয়ে সেমিতে চলে গেল ব্রাজিল।
৩ ম্যাচে ৫ গোল করে তখন রীতিমতো উড়ছেন লিওনিদাস। বিশ্বকাপটা বোধহয় প্রথমবারের মতো এসেই যাবে ব্রাজিলের ঘরে, এমনটাই ভাবছেন সবাই। কিন্তু ব্রাজিলের কোচ আদেমার পিমেন্তার কী হলো, কে জানে। ফাইনালে যেন ‘ফ্রেশ’ লিওনিদাসকে পাওয়া যায়, সেই কারণে সেমিতে ইতালির সাথে তিনি রেস্ট দিলেন তার তুরুপের তাসকে!
পিমেন্তার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে গেল। ২-১ ব্যবধানে ইতালির কাছে হেরে গেল ব্রাজিল, হেরে বিদায় নিল বিশ্বকাপ থেকে। না, পুরোপুরি বিদায় নিল না; তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে খেলতে নামল তারা, ‘ফ্রেশ’ লিওনিদাসের জোড়া গোলে সুইডেনকে হারালো ৪-২ ব্যবধানে।
পিমেন্তা সেই ভুল সিদ্ধান্তটা না নিলে কী হতো? কী হতো, তা আসলে নিশ্চিতভাবে জানার কোনো উপায় নেই। অনুমানই করা যায় শুধু।
সেই বিশ্বকাপ ব্রাজিল জিতলে ১৯৫০ বিশ্বকাপে চাতকের পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকতে হয় না ব্রাজিলিয়ানদের। হ্যাঁ, ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিততে পারলে সেটা দারুণ কিছু হতো নিশ্চয়ই, কিন্তু উরুগুয়ের সাথে হৃদয়ভাঙার বেদনাটাও তখন এত বড় হয়ে দেখা দিত না ব্রাজিলিয়ানদের জন্য। ভুলের মাশুল সারা জীবন ধরে দিতে হতো না বারবোসাকেও। আর সবচেয়ে বড় কথা, দল তৃতীয় হলেও সেবারের আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা কিন্তু লিওনিদাসই ছিলেন। তাই বিশ্বকাপটা জিততে পারলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পেলেকে আমরা কী হিসেবে চিনতাম?
১৯৩৮ সালে লিওনিদাসের বয়স ছিল মাত্র ২৫। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এবার হলো না, আগামীবার নিশ্চয়ই হবে। সেই আগামীবার আর আসেনি কখনোই। জাতীয় দলের ক্যারিয়ার পুড়ে ছাই হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে। বছরের পর বছর গেছে। আর বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তার। বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯৪৬ সালে তো অবসরই নিয়ে ফেললেন। ১৯৫০-এর দলে ফিরতে পারতেন, কিন্তু সেই দলটা তখন দারুণ খেলছিল যে! সেই দলে তার মতো ৩৭ বছর বয়সীর জায়গা কোথায় হতো?
*****
সবাই বলে, ইতিহাস নাকি বিজয়ীদেরই মনে রাখে! কথাটা কী নিদারুণ ভুল!
মাত্র ৩০০ সৈন্য নিয়েও থার্মোপাইলের যুদ্ধে পার্সিদের মুখোমুখি হয়েছিলেন স্পার্টার রাজা লিওনিদাস। হেরে গেলেও ইতিহাস তাকে ঠিকই মনে রেখেছে। যেমনটা মনে রেখেছে ট্র্যাজিক হিরো লিওনিদাস ডা সিলভাকে!