এবারের দশকটি বোলারদের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। গত দশ বছরে ক্রিকেটে যত পরিবর্তন এসেছে, তার প্রায় সবগুলো বোলারদের কাজ আরো কঠিন করে দিয়েছে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের কথাই ধরা যাক, ২০১১ সালে নিয়ম করা হলো দুই প্রান্তে দুইটি নতুন বল নিয়ে প্রতিটি ম্যাচ শুরু হবে। আর এই একটি পরিবর্তনের ফলে ওয়ানডে থেকে রিভার্স সুইংয়ের ব্যাপারটাই এক প্রকার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া রানের ফোয়ারা ছোটানোর জন্য প্রায় সব জায়গার পিচই আগের তুলনায় অনেক বেশি ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
এসব প্রতিকূল অবস্থার মাঝেই বোলাররা নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছেন, উপহার দিয়েছেন অনেকগুলো স্মরণীয় স্পেল। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন উইজডেন তিনটি ফরম্যাটে সেরা বোলিং স্পেলগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন বোলারের কীর্তি সেই তালিকায় জায়গা পেল।
টেস্ট
ক্যারিয়ায়ের বড় একটা সময় জেমস অ্যান্ডারসনের ছায়ায় পার দিচ্ছেন স্টুয়ার্ট ব্রড, এ ব্যাপারে ব্রডের তেমন আক্ষেপ নেই। অবশ্য অ্যান্ডারসনের অনুপস্থিতিতে ইংলিশ বোলিং লাইনআপকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে বেশ কয়েকবার অনবদ্য সব পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালের অ্যাশেজেও এমন একটি উপলক্ষ্য এসেছিল। সিরিজে তখন ২-১ এ এগিয়ে ইংল্যান্ড, ট্রেন্টব্রিজের সেই টেস্ট জিতলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার। এমন গুরুত্বপূর্ণ টেস্টে নিজেদের সেরা বোলার জেমস অ্যান্ডারসনকে না পাওয়া ইংলিশদের জন্য বড় একটি ধাক্কা ছিল।
তবে স্টুয়ার্ট ব্রড সেদিন এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন যে, অ্যান্ডারসনের অভাব লেশমাত্র টের পাওয়ার সুযোগ পেল না ইংল্যান্ড। টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া প্রথম ছয় ওভারে হারিয়ে ফেলেছিল ছয় উইকেট, যার পাঁচটিই নিয়েছিলেন ব্রড! শেষ পর্যন্ত ১৮.৩ ওভারে মাত্র ৬০ রানে গুটিয়ে গেছিল অজিরা, ৯.৩ ওভারের টানা স্পেলে মাত্র ১৫ রানে ৮ উইকেট নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার গড়েছিলেন ব্রড। মূলত ব্রডের এই অনবদ্য বোলিং পারফরম্যান্স সেই অ্যাশেজের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। ব্রডের এই স্পেলকে এই দশকের সেরা বোলিং পারফরম্যান্স হিসেবে বেছে নিয়েছে উইজডেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের পিচগুলো সাধারণত দুই ধরনের হয়: ফ্ল্যাট পিচ হলে সেখানে ব্যাটসম্যানদের একক দাপট থাকবে, আর স্পিনিং ট্র্যাক হলে স্পিনাররা ছড়ি ঘোরাবে। অবশ্য ফ্ল্যাট পিচ হলেও শেষ দুই দিনে স্পিনাররা পিচ থেকে বেশ ভালো পরিমাণে সহায়তা পেয়ে থাকেন। এখানে পেসারদের দায়িত্ব থাকে প্রথম দশ ওভার বোলিং করে বলের উজ্জ্বলতা নষ্ট করা, যাতে স্পিনারদের টার্ন পেতে সুবিধা হয়। এখন আবার অনেক স্পিনার নতুন বলে বোলিংয়ের ব্যাপারেও বেশ দক্ষ, ফলে পেসারবিহীন একাদশ নামানোর সাহসও অনেকে দেখাচ্ছে। এই দশকের একদম শুরুতে, অর্থাৎ ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমনই এক প্রথাগত উপমহাদেশীয় পিচে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
নাগপুরের নিষ্প্রাণ সেই উইকেটে রানের উৎসব করে ৬ উইকেটে ৫৫৮ রানে ইনিংস ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। একই পিচে শেবাগ, গম্ভীর, শচীন, ধোনিরা এমন আরেকটি রানোৎসব উপহার দেবেন – স্বাগতিক ভক্তদের এই প্রত্যাশা করাটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে প্রত্যাশার সব সমীকরণ একাই ওলটপালট করে দেন ডেল স্টেইন। ক্রমাগত ১৪০ কিলোমিটার বেগে বোলিং সাথে রিভার্স সুইংয়ের বিষাক্ত বাণ – দুইয়ের সংমিশ্রণে সেদিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি।
নতুন বলে নিয়েছিলেন বিজয় ও শচীনের উইকেট, আসল জাদুটা দেখান পুরনো বলে। তিন ওভারের স্পেলে মাত্র তিন রানে তিনি তুলে নেন পাঁচ উইকেট। তার এই রুদ্রমূর্তির কাছে তছনছ হয়ে যায় ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ, মাত্র ১২ রানের ব্যবধানে তাদের শেষ ৬ উইকেটের পতন ঘটে। মূলত স্টেইনের এই পারফরম্যান্সের কারণেই ইনিংস ব্যবধানে নাগপুর টেস্ট জিতে নেয় প্রোটিয়ারা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার এই দুর্দান্ত স্পেলটিকে এই দশকের দ্বিতীয় সেরা স্পেল হিসেবে বেছে নিয়েছে উইজডেন।
আগের তিনটি অ্যাশেজ হারায় ২০১৩-১৪ সালের অ্যাশেজ ছিল অজিদের জন্য অনেকটা বাঁচা-মরার লড়াই। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টে মুখোমুখি হয় দু’দল, অজিদের বোলিং তাণ্ডবে সেই ম্যাচে ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা পাত্তাই পায়নি। পরের টেস্টের ভেন্যু অ্যাডিলেড ব্যাটিংয়ের জন্য সহজতর – এমনটি ভেবেই হয়তো নিজেদের সাহস দিচ্ছিল ইংল্যান্ড।
কিন্তু অ্যাডিলেডের ফ্ল্যাট পিচে মিচেল জনসন ঠিক কোন মাত্রার তাণ্ডব চালাতে পারেন, তা হয়তো অনেকেই চিন্তা করতে পারেননি। ১৭.২ ওভারের স্পেলে মাত্র ৪০ রানে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপকে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার এই স্পেলটিকে তালিকার তৃতীয় স্থানে রেখেছে উইজডেন।
ওয়ানডে
২০১৫ বিশ্বকাপের অধিকাংশ ম্যাচেই ব্যাটসম্যানদের দাপট দেখা গিয়েছিল। তবে অল্প কিছু ম্যাচে বোলারদের একক দাপটও লক্ষ্য করা গেছে। তেমনই একটি ম্যাচ ছিল গ্রুপপর্বে ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটি। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক ইয়োন মরগ্যান। সাউদির জোড়া আঘাতে ৩৬ রানে দুই ওপেনারকে হারায় ইংলিশরা।
গ্যারি ব্যালান্সও দ্রুত আউট হওয়ার পর রুটকে সাথে নিয়ে হাল ধরার চেষ্টা করেন অধিনায়ক মরগ্যান। কিন্তু দলীয় ১০৪ রানে মরগ্যান সাজঘরে যাওয়ার পর ইংলিশদের ইনিংসে রীতিমতো মড়ক লাগে, যার নেপথ্য নায়ক ছিলেন টিম সাউদি। পরের স্পেলে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে ইংলিশদের মাত্র ১২৩ রানে অলআউট করার পিছনে বড় অবদান রাখেন তিনি। সাউদির এই ৩৩ রানে ৭ উইকেটের স্পেলটিকে এই দশকের সেরা বোলিং স্পেল হিসেবে বেছে নিয়েছে উইজডেন।
২০১৫ বিশ্বকাপে ২২ উইকেট নিয়ে ট্রেন্ট বোল্টের সাথে যৌথভাবে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হয়েছিলেন মিচেল স্টার্ক। এই ২২ উইকেটের মাঝে ১৬টি উইকেটই এসেছিল অজিদের জয় পাওয়া ম্যাচে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, হেরে যাওয়া ম্যাচের ছয় উইকেট নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল! অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে আগে ব্যাট করতে নেমে বোল্টের দুর্দান্ত বোলিংয়ে মাত্র ১৫১ রানে গুটিয়ে গেছিল অস্ট্রেলিয়া।
ম্যাককালামের ঝড়ো ফিফটিতে মাত্র ৭.৩ ওভারে দুই উইকেট হারিয়ে ৭৮ রান তুলে ফেলেছিল নিউ জিল্যান্ড, তখন ম্যাচের একপেশে ফলাফলকেই অবশ্যসম্ভাবী হিসেবে মনে হচ্ছিল। তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব স্টার্কের, টানা দুই বলে টেইলর ও এলিয়টের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে অজিদের ম্যাচে ফেরান তিনি। তবে উইলিয়ামসন ও অ্যান্ডারসনের জুটিতে আবার ম্যাচের সমীকরণ সহজ করে ফেলে নিউ জিল্যান্ড, পাঁচ উইকেট হাতে রেখে তাদের দরকার ছিল মাত্র ১৩ রান। ম্যাক্সওয়েলের বলে অ্যান্ডারসন সাজঘরে ফিরলে ভাঙে সেই জুটি।
এরপর আবারও স্টার্কের তাণ্ডব। টানা দুই বলে মিলনে ও সাউদিকে বোল্ড আউট করে অজিদের জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছিলেন তিনি। তবে শেষরক্ষা হয়নি, স্টার্ক নিজের দশম ওভার করার আগেই ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করে দেন উইলিয়ামসন। ম্যাচ হারলেও স্টার্কের এই পারফরম্যান্সের মাহাত্ম্য কমে যায়নি, উইজডেনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই স্পেলটি।
আফগানিস্তানের দ্রুত উত্থানে বড় অবদান রেখে যাচ্ছেন রশিদ খান, ক্যারিবিয়ানদের মাটিতে মাত্র ১৮ রানে ৭ উইকেট নেওয়া তার স্পেলটি রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে।
টি-টোয়েন্টি
‘ডু-অর-ডাই’ ম্যাচে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা ও নিউ জিল্যান্ড। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১১৯ রানেই যখন গুটিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা, তখন গ্রুপপর্ব থেকেই লঙ্কানদের বিদায়কে আসন্ন ফল বলে মনে হচ্ছিল। দলের এমন ক্রান্তিলগ্নে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন আগের দুই ম্যাচ সাইডবেঞ্চে থাকা রঙ্গনা হেরাথ। ৩.৩ ওভারে মাত্র ৩ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে একাই গুঁড়িয়ে দেন তিনি। নিশ্চিত হারা ম্যাচ এভাবে জিতে যাওয়ায় লঙ্কানদের আত্মবিশ্বাসের পারদটাও অনেক উঁচুতে উঠে যায়, শেষ পর্যন্ত ওই আসরের শিরোপা জিতে টানা ফাইনাল হারার গেরো কাটায় তারা। তাই সব কিছু মিলিয়েই হেরাথের স্পেলটির মাহাত্ম্য অনেক উঁচুতে, উইজডেনের তালিকার শীর্ষস্থানটাও পেয়েছে এই স্পেল।
২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে স্যামুয়েলসের অনবদ্য ইনিংসে ভর করে ১৩৭ রানের পুঁজি পায় উইন্ডিজ। পিচ কিছুটা ধীরগতির হলেও বোলাররা দারুণ কিছু না করলে স্বল্প পুঁজি নিয়ে জেতা সম্ভব ছিল না। আর বড় মঞ্চে সেই দারুণ কিছু করার দায়িত্বটা পালন করেন সুনিল নারাইন। নিজের দ্বিতীয় ওভারে লঙ্কানদের সেরা ব্যাটসম্যান ও তাদের কাপ্তান মাহেলা জয়াবর্ধনেকে আউট করে ক্যারিবিয়ানদের জয়ের পথ অনেকটা মসৃণ করে ফেলেন তিনি।
তবে মাত্র ১৩ বলে ২৬ রান করে উইন্ডিজদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নুয়ান কুলাসেকারা, নিজের তৃতীয় ওভারে তাকে আউট করে ভয় দূর করেন নারাইন। আর নিজের শেষ ওভারে মালিঙ্গাকে আউট করে নিশ্চিত করেন ক্যারিবিয়ানদের শিরোপাজয়। ৩.৪ ওভারে মাত্র ৯ রানে নেওয়া তার তিন উইকেটের স্পেলটিকে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে উইজডেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে উমর গুলের ৬ রানে ৫ উইকেট নেওয়া স্পেলটি রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে।