ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির কোচ হিসেবে সময়টা খারাপ গেলেও দ্বিতীয় মৌসুমেই অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন পেপ গার্দিওলা, ওল্ড ট্রাফোর্ডে লীগের তলানিতে থাকা ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিওনের কাছে ১-০ গোলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হারে পাঁচ ম্যাচ বাকি রেখেই লিগ জয় নিশ্চিত ম্যানচেস্টার সিটির। ২০১৩-১৪ মৌসুমের পর আবারো লিগ শিরোপা গেলো সিটিজেনদের ঘরে, সব মিলিয়ে এটা ম্যানচেস্টার সিটির পঞ্চম লিগ জয় আর প্রিমিয়ার লিগের যুগ হিসাব করলে এটা সিটিজেনদের তৃতীয় শিরোপা। আজ আমরা ম্যানচেস্টার সিটির এবারের লিগজয়ের আদ্যোপান্ত নিয়েই জানবো আর ভবিষ্যতেও সিটির এই জয়রথ অব্যাহত থাকবে কিনা সেটাও বিশ্লেষণ করা হবে।
ম্যানচেস্টার সিটির রোড টু সাকসেস
ম্যানচেস্টার সিটি লিগের প্রথম ম্যাচ খেলে ব্রাইটনের মাঠে গিয়ে, ২-০ গোলের জয়ে শুরুটা ভালোই হয় সিটির। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই হোঁচট খায় সিটি! ঘরের মাঠ ইতিহাদ স্টেডিয়ামে এভারটনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে তারা।
ব্যাস, এরপর থেকেই সিটি এক স্বপ্নের জয়যাত্রা শুরু করে। টানা ১৮ ম্যাচ জিতে প্রিমিয়ার লিগে টানা জয়ের নতুন রেকর্ড গড়ে ম্যানচেস্টার সিটি। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্টামফোর্ড ব্রিজে গিয়ে এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন চেলসিকে ১-০ গোলে হারিয়ে আসাটা। পেপ এর মতে এই জয়ের ফলে দলের আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে তখন মনে হচ্ছিলো যেকোনো দলকে হারানোর ক্ষমতাই তাদের আছে।
আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য যদি স্টামফোর্ড ব্রিজের জয়টা ভূমিকা রাখে তবে লিগ জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডে গিয়ে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারানো। এডারসনের অতিমানবীয় কিছু সেভে ওই ম্যাচ ২-১ গোলে জিতে নেয় ম্যানসিটি আর এই জয়ের ফলে দুই দলের পয়েন্ট ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ১১ তে! এত বিশাল পয়েন্ট ব্যবধানের পর লিগ জয়ের ব্যাপারে মনোবলটাই হারিয়ে ফেলে হোসে মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
সিটির জয়রথ থামে ২১তম রাউন্ডে ক্রিস্টাল প্যালেসের মাঠে ড্র করে। জয়রথ থামলেও আর্সেনালের ইনভিন্সিবল থাকার রেকর্ডটা ছোঁয়ার সুযোগ তখনো সিটির সামনে ছিল। কিন্তু লিগের ২৩তম রাউন্ডে অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের কাছে ৪-৩ গোলে হারায় অপরাজিত থেকে লিগজয়ের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় ম্যানসিটির। এরপর বার্নলির সাথে ড্র করা বাদে ৩২ রাউন্ড পর্যন্ত বাকি সবগুলো ম্যাচে সিটি জেতার ফলে ৩৩ তম রাউন্ডে এসে সমীকরণ দাঁড়ায় ইতিহাদে ইউনাইটেডকে হারালেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যাবে সিটির। কিন্তু হায়, ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও ঘরের মাঠে ইউনাইটেডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় ম্যানসিটি!
তবে শিরোপা জয় নিশ্চিতের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা সিটিকে করতে হয়নি। ৩৪তম রাউন্ডে ওয়েম্বলিতে স্পার্সকে ৩-১ গোলে হারায় ম্যানসিটি। এরপর ঘরের মাঠে তলানির দল ওয়েস্ট ব্রমের কাছে ১-০ গোলে ইউনাইটেডের হারে দুই দলের পয়েন্ট ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ১৬-তে। ফলে পাঁচ ম্যাচ বাকি থাকতেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত হয় গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির। এখন পর্যন্ত ৩৩ ম্যাচে ২৮ জয়, ৩ ড্র ২ হারে সিটির সংগ্রহ ৮৭ পয়েন্ট। বাকি পাঁচ ম্যাচে নয় পয়েন্ট পেলেই ২০০৪-০৫ মৌসুমে চেলসির ৯৫ পয়েন্টের রেকর্ডকে টপকে যাবে সিটি। আর ১৩ পয়েন্ট পেলে প্রিমিয়ার লিগে প্রথম ক্লাব হিসেবে পয়েন্টের সেঞ্চুরি করবে ম্যানসিটি। সামনে যা ফিক্সচার তাতে সেঞ্চুরিটা খুব করেই সম্ভব গার্দিওলার দলের জন্য।
এমন দাপুটে লিগজয়ের পিছনে রহস্য কি?
পেপ গার্দিওলা ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নেন ২০১৬-১৭ মৌসুমে। সিটির দায়িত্ব নেওয়ার আগে গার্দিওলা সিনিয়র টিমের কোচ হিসেবে সাত সিজন ছিলেন। এর মধ্যে বার্সেলোনায় কাটিয়েছেন চার মৌসুম আর বাকি তিন মৌসুম কাটিয়েছেন বায়ার্নের কোচ হিসেবে। এই সাত মৌসুমের মধ্যে মাত্র একবারই লিগ জিততে পারেনি গার্দিওলার দল, বাকি ছয়বারই লিগ জেতার ক্ষেত্রে সফল গার্দিওলা (২০১১-১২ মৌসুমে মরিনহোর মাদ্রিদের কাছে লিগ খোয়ায় গার্দিওলার বার্সা)। অথচ সেই গার্দিওলাই সিটির কোচ হিসেবে প্রথম সিজনে দলকে চ্যাম্পিয়ন করা দূরে থাক, রানার্স আপও করতে পারেননি!
২০১৬-১৭ প্রিমিয়ার লিগে ৩৮ ম্যাচে ম্যানচেস্টার সিটির সংগ্রহ ছিল ৭৮ পয়েন্ট যা সেবারের লিগজয়ী চেলসির চেয়ে পনেরো ও রানার্স আপ স্পার্সের চেয়ে আট পয়েন্ট কম। প্রথম মৌসুমে গার্দিওলার এমন ব্যর্থতার পর অনেকেই ইংলিশ লিগে গার্দিওলার পাসিং নির্ভর ফুটবল কতটা সফল সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলো। অনেকে তো বলেই দিয়েছিলো, টিকিটাকা নাকি গতিময় প্রিমিয়ার লিগে ধোপে টিকবে না!
কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে সিটির কোচ হিসেবে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমেই স্বরূপে ফিরলেন গার্দিওলা। পাঁচ ম্যাচ হাতে রেখেই লিগ জিতে প্রমাণ করে দিয়েছেন গতিময় প্রিমিয়ার লিগেও টিকিটাকা দিয়ে সাফল্য পাওয়া সম্ভব। তবে যতটা সহজে বলা হচ্ছে গার্দিওলার সাফল্য পাওয়া ততটা সহজ ছিল না, এজন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে গার্দিওলাকে। সবচেয়ে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে দল সাজানোর ব্যাপারে।
কোচ হিসেবে প্রথম মৌসুমে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে এভারটন থেকে জন স্টোন্সকে নিয়ে এসেছিলেন গার্দিওলা। কিন্তু সিটির দুই উইংব্যাক গার্দিওলার ট্যাকটিসের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় সে সিজনে ডিফেন্স নিয়ে বেশ ভুগতে হয় তাকে। অবস্থা একপর্যায়ে এতটাই খারাপ হয়েছিলো যে দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফার্নান্দিনহোকেও কিছু ম্যাচে উইংব্যাক হিসেবে খেলিয়েছিলেন গার্দিওলা! শুধু উইংব্যাক না, গোলকিপিং পজিশন নিয়েও ঝামেলায় পড়তে হয় গার্দিওলাকে, সিটির দীর্ঘদিনের গোলকিপার জো হার্টের বল প্লেয়িং অ্যাবিলিটি খারাপ হওয়ায় সেই সিজনে বার্সা থেকে ক্লদিও ব্রাভোকে নিয়ে আসেন গার্দিওলা। কিন্তু সিটিতে ব্রাভো এতটাই জঘন্য পারফর্ম করেন যে শেষদিকে রিজার্ভ গোলকিপার উইলি কাবায়োকে খেলাতে হয়েছিলো গার্দিওলার।
এ কারণে এই ২০১৭-১৮ মৌসুম শুরু হওয়ার আগে সামার ট্রান্সফারে গোলকিপার ও উইংব্যাক কেনার ব্যাপারে উঠেপড়ে লাগেন গার্দিওলা। ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডে বেনফিকার এডারসনকে কিনে নেয় সিটি। এরপর ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ডে স্পার্সের রাইটব্যাক কাইল ওয়াকারকে দলে নিয়ে আসেন গার্দিওলা, দলের পাইপলাইন মজবুত করার জন্য বিকল্প রাইটব্যাক দানিলোকে কিনতেও গার্দিওলার সিটি খরচ করে প্রায় ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড! এ তো গেলো শুধু রাইটব্যাক, লেফটব্যাকও সিটি কিনেছিলো বেশ চড়াদামেই, ৫২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে মোনাকো থেকে বেঞ্জামিন মেন্ডিকে দলে ভিড়িয়েছিলো ম্যানচেস্টার সিটি। এছাড়া শীতকালীন দলবদলে অ্যাথলেটিক বিলবাও থেকে আইমারিক লাপোর্টকে দলে ভেড়ায় সিটি।
শুধু ডিফেন্স না, অ্যাটাকিং লাইনআপেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন গার্দিওলা। পেপ যখন সিটিতে আসেন তখন সিটিতে নইলিতো, হেসাস নাভাস, কেলেচি ইহানেচোরা ছিল; কিন্তু এদের একজনও পেপকে মুগ্ধ করতে না পারায় সবাইকেই একে একে ছেড়ে দেয় সিটি। ২০১৬-১৭ গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ডর্টমুন্ড থেকে ইকেই গুন্ডোগান এবং উলফসবার্গ থেকে নিয়ে আসেন লিরোয় সানেকে আর শীতকালীন দলবদলেই সিটি দলে ভেড়ায় ব্রাজিলের অন্যতম সেরা উঠতি তরুণ গ্যাব্রিয়েল জেসাসকে। এই মৌসুমে ২০১৭-১৮ গ্রীষ্মকালীন দলবদলে মোনাকো থেকে বার্নার্ডো সিলভাকে দলে নেয় সিটিজেনরা। দলবদল শেষ হওয়ার পর দেখা যায় যে, প্রায় প্রতিটি প্লেয়িং পজিশনেই সিটির দুইজন করে খেলোয়াড় আছে। নিচের তালিকাটা দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
- গোলকিপার – এডারসন, ক্লদিও ব্রাভো
- রাইটব্যাক – কাইল ওয়াকার, দানিলো
- সেন্টারব্যাক – ওটামেন্ডি, স্টোন্স, কোম্পানি, মাঙ্গালা/লাপোর্ট
- লেফটব্যাক – মেন্ডি, ডেলফ
- হোল্ডিং মিডফিল্ডার – ফার্নান্দিনহো, ইয়াইয়া তোরে
- অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার – ডেভিড সিলভা, কেভিন ডি ব্রুইন, গুন্ডোগান
- উইঙ্গার – সানে, স্টার্লিং, বার্নার্ডো সিলভা
- স্ট্রাইকার – আগুয়েরো, গ্যাব্রিয়েল জেসাস
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এই তালিকায় যাদের নাম আছে তারা প্রত্যেকেই সহজেই কোনো প্রথম সারির ক্লাবে মূল একাদশে খেলতে পারে। প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোকে লিগের সাথে সাথে ক্যারাবাও কাপ ও এফএ কাপেও খেলতে হয়। আর প্রথম সারির দল হলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ/ইউরোপা লিগ তো সাথে আছেই। এতগুলো টুর্নামেন্ট খেলার কারণে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দলগুলোর দুটি করে ম্যাচ থাকে। ফলে স্কোয়াড রোটেট করে খেলানোটা এখানে খুব বেশি জরুরী। নইলে লিগের মাঝামাঝি পর্যায়ে ইনজুরি/অতিরিক্ত খেলার চাপে খেলোয়াড়েরা ফর্ম হারিয়ে ফেলে।
এবারের প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই স্কোয়াড ডেপথ থাকার গুরুত্ব আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।
এবার লিগের শুরুর দিকে দুই নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যে শীর্ষস্থান দখলের লড়াইটা কিন্তু সমানে সমানই চলছিলো। সপ্তম রাউন্ড পর্যন্ত দুই দলের মধ্যে পার্থক্য ছিল শুধুমাত্র গোল ব্যবধানে! কিন্তু সময় যত গিয়েছে ততই ম্যাচের সংখ্যা বেড়েছে বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ আর ক্যারাবাও কাপ শুরু হওয়ার পর ইউনাইটেড আর সিটি দুই দলেরই প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দুটি করে ম্যাচ খেলা শুরু হলো। সিটির শক্তিশালী স্কোয়াড থাকায় তারা তাদের মূল প্লেয়ারদের বেশ কিছু ম্যাচে বিশ্রাম দিয়েও ঠিকই সবগুলো ম্যাচ জিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ইউনাইটেডের বেঞ্চ সিটির মত শক্তিশালী না, তাই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ আর প্রিমিয়ার লিগে প্রায় একই একাদশ নিয়েই নামতে হচ্ছিলো।
একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হবে। ইউনাইটেডের হয়ে স্ট্রাইকার রোমেলো লুকাকু সিজনটা শুরু করেছিলেন দুর্দান্তভাবে, শুরুর দিকে প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল পাচ্ছিলেন লুকাকু। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরু হওয়ার পর ভালো কোনো বিকল্প স্ট্রাইকার দলে না থাকায় প্রতি সপ্তাহেই দুটো করে ম্যাচ খেলতে হয়েছে লুকাকুকে। অতিরিক্ত খেলার চাপে সময় যত গিয়েছে লুকাকু ততই বিবর্ণ হয়েছেন। অন্যদিকে সিটিজেনদের স্ট্রাইকার হিসেবে দলে ছিল সার্জিও আগুয়েরো ও গ্যাব্রিয়েল জেসাস, দুজনই যেকোনো প্রথম সারির দলে খেলার যোগ্য। ফলে গার্দিওলা তার সুবিধামত রোটেশন পলিসি ব্যবহার করে এই দুজনকে খেলাতে পেরেছেন। এক সপ্তাহে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে যদি আগুয়েরো খেলতেন, তাহলে সেই সপ্তাহের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আগুয়েরোকে বিশ্রাম দিয়ে জেসাসকে খেলানো হতো। এরকমভাবে প্রায় প্রতি পজিশনেই সিটি রোটেশন পলিসি ব্যবহার করেছে। তাই সিটির কোনো খেলোয়াড়কেই অতিরিক্ত খেলার চাপ নিতে হয়নি।
শুধু রোটেশন পলিসির জন্যই না, আরো একটা কারণে শক্তিশালী বিকল্প দল থাকাটা দরকার। মূল দলের কোনো খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়লেও শক্তিশালী বিকল্প থাকলে সেই পরিস্থিতি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। স্টোনস, আগুয়েরো, জেসাস, সানে, স্টার্লিং সিজনের বিভিন্ন সময়ে ইনজুরড ছিলেন। ডেভিড সিলভা পারিবারিক কারণে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেননি। কোম্পানি, লাপোর্তে, বার্নার্ডো সিলভা, গুন্ডোগানদের মত তারকা রিজার্ভ বেঞ্চে থাকায় এসবের কোনোকিছুই সিটিজেনদের পারফর্মেন্সে প্রভাব ফেলতে পারে নি।
তবে শুধুমাত্র শক্তিশালী বিকল্প দল থাকার কারণেই সিটির এমন সাফল্য এসেছে এটা বললে গার্দিওলার অবদানকে খাটো করা হবে। যেমন ধরা যাক বেঞ্জামিন মেন্ডির কথা, চড়াদামে কেনা এই লেফটব্যাকের সেরকম কোনো বিকল্প সিটিতে ছিল না। সিজনের শুরুতেই মেন্ডি যখন প্রায় আট মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলো তখন সবাই ভেবেছিলো পেপ বুঝি এবার রাইটব্যাক দানিলোকেই লেফটব্যাক হিসেবে খেলাবেন। কিন্তু পেপ তা না করে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফ্যাবিয়ান ডেলফকে লেফটব্যাক হিসেবে খেলানোর ঝুঁকি নেন। আর পুরো সিজন জুড়ে ডেলফ এতটাই অসাধারণ পারফর্ম করেন যে মেন্ডির অভাব সেরকমভাবে সিটি অনুভবই করেনি। তাছাড়া যে স্টার্লিং সিটিতে আসার পর নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারছিলেন না, সেই স্টার্লিং এই সিজনে গার্দিওলার অধীনে নিজের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যান!
সানে, জেসাসদের মত তরুণ তুর্কিদের এত অল্প বয়সেই প্রিমিয়ার লিগে মানিয়ে নেওয়াটাও সম্ভব হয়েছে গার্দিওলার জন্যই। দীর্ঘদিন ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকা ইকেই গুন্ডোগানকেও আস্তে আস্তে দলের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন গার্দিওলা। কাড়ি কাড়ি পাউন্ড দিয়ে ডিফেন্ডার কেনার জন্য অনেকেই গার্দিওলার সমালোচনা করেন। কিন্তু বর্তমান বাজারের তুলনায় অনেক কম মূল্যে সানে, জেসাস, বার্নার্ডো সিলভাকে কেনার ব্যাপারটা অনেক সমালোচকের চোখই এড়িয়ে যায়!
ট্যাকটিস ও টপ পারফর্মার
ট্যাকটিসের কথা বললে লিগের শুরুদিকে ৫-৩-২ এ খেলালেও অধিকাংশ সময়জুড়েই দলকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলিয়েছেন পেপ গার্দিওলা। পাসিং ফুটবল দিয়ে প্রতিম্যাচেই প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে ম্যানসিটি। বল পজিশনে এগিয়ে থাকাটা সিটির জন্য প্রতিম্যাচের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
গোলকিপার পজিশনে গত মৌসুমে ব্রাভোকে নিয়ে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হলেও এই সিজনে এডারসন বেশ ভালোভাবেই গোলবার সামলিয়েছেন। এডারসনের অসাধারণ বল প্লেয়িং অ্যাবিলিটি সিটিকে পাসিং ফুটবল খেলতে অনেকাংশে সাহায্য করেছে। ডিফেন্ডারদের মধ্যে ওটামেন্ডি আর ওয়াকার ছিলেন নিয়মিত, স্টোনস শুরুর দিকে নিয়মিত হলেও ইনজুরিতে পড়ে ফর্ম হারানোয় তার জায়গায় কোম্পানি আর লাপোর্টকে রোটেট করিয়ে খেলাতে থাকেন গার্দিওলা। আর মেন্ডির অনুপস্থিতিতে লেফটব্যাকে ডেলফের পারফর্মেন্স তো উপরেই বলা হয়েছে।
হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে এই মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন ফার্নান্দিনহো। তার অসাধারণ পারফর্মেন্সের ফলে বাকি দুই মিডফিল্ডার ডি ব্রুইন ও ডেভিড সিলভা স্বাধীনভাবে আক্রমণে যেতে পেরেছেন। কেভিন ডি ব্রুইন এই সিজনে লিগের সেরা মিডফিল্ডার। ৭ গোল ও ১৫ অ্যাসিস্টে সিটির লিগজয়ে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তারই। ওদিকে পারিবারিক সমস্যার কারণে বেশ কিছু ম্যাচ মিস করলেও ডেভিড সিলভাও বেশ উজ্জ্বল ছিলেন। লিগে ডেভিড সিলভার গোলসংখ্যা ৮ আর অ্যাসিস্ট ১১।
অ্যাটাকিং ফোর্সে বরাবরের মতন এবারো সবচেয়ে উজ্জ্বল সার্জিও আগুয়েরো। ২১ গোল করে সিটিজেনদের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই এছাড়াও সাথে রয়েছে ৬টি অ্যাসিস্ট। ১০ গোল ও ৩ অ্যাসিস্ট করে আগুয়েরোর অনুপস্থিতিতে দায়িত্বটা ভালোভাবেই সামলিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল জেসাস। আর দুই উইংয়ে স্টার্লিং ও সানে ছিলেন অনবদ্য। স্টার্লিং ১৭ গোলের সাথে করেছেন ৮ অ্যাসিস্ট আর সানে ১২ অ্যাসিস্টের সাথে করেছেন ৯ গোল।
সিটিজেনদের এই সাফল্য কি সামনেও অব্যাহত থাকবে?
ম্যানসিটির স্কোয়াড দেখলেই খেয়াল করা যায়, অধিকাংশ খেলোয়াড়ই তরুণ, সময় যত যাবে এদের পারফর্মেন্স গ্রাফ আরো উঁচুতে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। গার্দিওলা দল সাজাচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়, তাই সিটির ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বলই বলা যায়। আর প্রিমিয়ার লিগের অন্য দলগুলোর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, ম্যানসিটির যে স্কোয়াড গভীরতা এর আশেপাশে এখন কোনো দলই নেই। তাই আগামী মৌসুমেও সিটির এই দাপট অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাকি ইংলিশ দলগুলো এই সিজনের দলবদলে ঠিকমতো ঘর না গোছালে আগামী সিজনেও আরেকটা একপেশে লিগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে ম্যানসিটি সামনের সিজনে শুধুমাত্র ঘরোয়া লিগের শিরোপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইবে না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের জন্য সামনের সিজনে গার্দিওলা যে উঠেপড়ে লাগবেন এটা চোখ বন্ধ রেখেই বলা যায়। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের চিন্তা করলে শুধু ভালো দল সাজালেই চলবে না, গার্দিওলাকে ট্যাকটিকালি সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে হবে।
পুরো সিজনে দুর্দান্ত খেলা স্টার্লিংকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে লিভারপুলের বিপক্ষে সাইডবেঞ্চে রাখা কিংবা ৪-৩-৩ ফরমেশনে সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও সেটা থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। তাছাড়া ২০১০-১১ তে বার্সেলোনাকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর একবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেনি গার্দিওলার দল। তাই পরের সিজনে নিজের সব ভুলত্রুটি শুধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের জন্য ম্যানসিটিকে নিয়ে গার্দিওলা যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে।
আগামী মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে সিটির এই সাফল্য অব্যাহত থাকে কিনা এবং সেই সাথে গার্দিওলা তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খরা কাটিয়ে ম্যানসিটির হয়ে নতুন ইতিহাস গড়তে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।