টস সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। তবে তাদের মধ্যে ডব্লিউ জি গ্রেসের উক্তিটা পেয়ে গেছে ক্রিকেট ইতিহাসের ক্লাসিকের মর্যাদা। উক্তিটা হচ্ছে,
‘টসে জিতলে ব্যাটিং করো। যদি তোমার সন্দেহ থাকে, তবে একটু চিন্তা করো, তারপরে ব্যাটিং করো। যদি খুব বেশি সন্দেহ থাকে তবে তোমার সতীর্থের সাথে আলোচনা করো, তারপরে ব্যাটিং করো।’
টস সম্পর্কে ভিক রিচার্ডসনেরও দারুণ এক উক্তি আছে। সম্পর্কে তিনি গ্রেগ চ্যাপেলের মাতামহ। ভদ্রলোক নিজেও ক্রিকেট খেলতেন; অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন উনিশ টেস্ট। তার উক্তিটা ছিল এরকম,
‘দশবার টসে জিতলে নয়বার ব্যাটিং করো। দশমবার অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চিন্তা করো, তারপরে ব্যাটিং করো।’
মাতামহের এই উপদেশের পরও টসে জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। যে টেস্টের কথা বলা হচ্ছে, তা ১৯৮২ সালের অ্যাশেজের ৪র্থ টেস্ট, বক্সিং ডে টেস্ট। অবশ্য গ্রেগকে দোষারোপ করা যাবে না কোনভাবেই। পিচ ছিল একেবারে ভেজা, যাকে বলে ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি। সেই সিরিজে অধিনায়ক ছিলেন গ্রেগ। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কেরা এমনিতেই কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়, এবং সে সময়ে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এগিয়ে আছে ২-০’তে। হাতে আছে আর মাত্র দুই টেস্ট, সেই দুই টেস্টের এক টেস্টে ড্র করতে পারলেই ছাইদানী অস্ট্রেলিয়ার। এই অবস্থায় পিচের মতিগতি দেখে কেউ যদি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তাকে খুব বেশি দায় দেয়া যায় না।
টসে জিতে বোলিং বেছে নিলো অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিং করতে নেমে ক্রিস ট্যাভার আর অ্যালান ল্যাম্ব ছাড়া সুবিধা করতে পারলেন না ইংল্যান্ডের আর কেউ। ট্যাভার করলেন ৮৯, আর ল্যাম্ব করলেন ৮৩। এই দুজনের যুগলবন্দীতে ৪র্থ উইকেট জুটিতে এলো ১৬১ রান, ফলে মোটামুটি একটা সংগ্রহ দাঁড় করাতে সমর্থ হলো ইংল্যান্ড। ৪টি করে উইকেট নিলেন অস্ট্রেলিয়ার রডনি হগ আর ব্রুস ইয়ার্ডলি।
ব্যাটিংয়ে নেমে ৮৯ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলল অস্ট্রেলিয়া। তবে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন কিম হিউজ আর ডেভিড হুকস, ৯১ রানের জুটি গড়ে দলকে নিয়ে গেলেন ১৮০ পর্যন্ত। এরপর হুকস আউট হয়ে গেলেও ক্রিজে এলেন রডনি মার্শ, হিউজের সাথে ৮১ রানের আরেকটা বড় জুটি গড়লেন। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর তখন ২৬১। একটা বড় লিড যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনই আঘাত হানলেন ইংলিশ পেসার বব উইলিস। কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনি তুলে নিলেন হিউজ আর মার্শকে। স্কোর তখন ২৭৬/৭। এরপর রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’ হয়ে উঠলেন জিওফ মিলার, অস্ট্রেলিয়ার বাকি তিন উইকেট পকেটে পুরে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করলেন ২৮৭ রানে। লিড পেল বটে অস্ট্রেলিয়া, তবে তার পরিমাণ মাত্র ৩ রান।
ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ১১ জন খেললেও রান করেছিলেন আসলে দু’জন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে সবাই-ই কমবেশি ভূমিকা রাখলেন। আগের ইনিংসের হাফ সেঞ্চুরিয়ান ট্যাভার এবার ফিরে গেলেন কোন রান না করেই; ওপেনার গ্রায়েম ফাউলারের ৬৫, বোথামের ৪৬, প্রিঙ্গলের ৪২ আর বব টেলরের ৩৭ রানের সাথে যুক্ত হলো ল্যাম্ব আর কুকের দু’টো ২৬। সবকিছু মিলিয়ে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ হলো ২৯৪; প্রথম ইনিংসে ৩ রানের লিডের কারণে অস্ট্রেলিয়ার সামনে টার্গেট দাঁড়াল ২৯২ রানের।
১৯২৮ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের দেয়া ৩৩২ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছিলো অস্ট্রেলিয়া। সাথে ২৯৭ এবং ২৯৫ রান তাড়া করার রেকর্ডটা বিবেচনায় রাখলে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যটা অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করার জন্য এই টেস্টকেই বেছে নিলেন নরমান কাওয়ান্স, ফলে অসম্ভব হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার জয় । শুরুটা করলেন কেপলার ওয়েসেলসকে দিয়ে, এরপরে তুলে নিলেন গ্রেগ চ্যাপেলকেও। ৭১ রানে জন ডাইসন আউট হওয়ার পর হিউজ আর হুকসের মিলে ১০০ রানের জুটি গড়ে ম্যাচ যখন বের করে নিয়ে যাচ্ছেন প্রায়, তখনই হিউজ আউট হলেন মিলারের বলে। প্রায় সাথে সাথেই আবার আঘাত হানলেন কাওয়ান্স, ডেভিড হুকসকে আউট করলেন, কিছু সময়ের ব্যবধানে ফেরালেন মার্শকেও। স্কোরের সাথে এক রানও যোগ না করে সাজঘরে ফিরলেন ব্রুস ইয়ার্ডলি। ১৭১/৩ থেকে স্কোর হয়ে গেল ১৯০/৭। জিততে তখনও লাগে ১০২ রান, জয়ের সূর্য অস্তাচলে প্রায়।
তবে ক্রিজে তখনও এবি আছেন। ‘এবি’ মানে অ্যালান বোর্ডার। এজন্যই ‘প্রায়’ বলা হচ্ছে, নয়তো জয়ের দেখা পাওয়া যে একেবারেই অসম্ভব, তা তখনই বলে দেয়া যেত। কিন্তু সেই সিরিজটা তখন পর্যন্ত জঘন্য কাটছিল এবি’র, আগের ৩ টেস্টের ৫ ইনিংস মিলিয়ে রান করেছিলেন মাত্র ৮১। কিম হিউজ আউট হওয়ার পর পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসেন, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কাওয়ান্সের সেই ধ্বংসযজ্ঞ। তাই এবি কতটুকু কী করতে পারবেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না কেউই। এর মধ্যেই সাজঘরে ফিরে গেলেন জিওফ লসন আর রডনি হগ। এর মধ্যে হগ আবারও কাওয়ান্সের শিকার, সেই ইনিংসে কাওয়ান্স ৭৭ রানে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ২১৮ রানে হগ ফেরার পর শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে এলেন জেফ থমসন।
থমসন যখন ক্রিজে এলেন, তার উপর কোনো প্রত্যাশাই ছিল না তখন। একজন বোলারের কাছে আর কী-ই বা প্রত্যাশা থাকে? তবে তিনি একটা কাজ করলেন, তাতিয়ে দিলেন বোর্ডারকে। এমনিতে বোর্ডার আর থমসনের বেশ বন্ধুত্ব ছিল, জাতীয় পর্যায়ে তো সতীর্থ ছিলেনই, সতীর্থ ছিলেন কুইন্সল্যান্ডের দলেও। থমসনের কথা যে তাকে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা গেল, যখন বোর্ডার কাওয়ান্সকে কভার দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠালেন।
সেই অ্যাশেজে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ছিলেন বব উইলিস, অধিনায়ক হিসেবে খুব একটা জাতের ছিলেন না তিনি। ৯ম উইকেট পড়ার পর প্রতিপক্ষকে যেখানে আরও চেপে ধরার কথা, তিনি উল্টোটা করলেন। বোর্ডারকে বাদ দিয়ে থমসনকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর নির্দেশ দিলেন বোলারদের। এদিকে তাকে কেউ আক্রমণ করছে না দেখে হাত খুলে খেলতে শুরু করলেন বোর্ডার। হাত খোলা মানে কিন্তু চার-ছয়ের ফুলঝুরি নয়, হাত খোলা মানে এক রানকে দুই রানে পরিণত করা, দুইকে তিনে। থমসনকে স্ট্রাইক থেকে দূরে রেখে নিজে খেলতে লাগলেন, ওভারের শেষ বলে রান নিয়ে নিজে পরের ওভার মোকাবেলা করলেন। আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগলো তার, তা সংক্রমিত হলো থমসনের মধ্যেও।
৭৪ রান লাগে, এমন অবস্থায় ক্রিজে এসেছিলেন থমসন। বোর্ডারের সাথে মিলে যোগ করলেন ৩৭ রান, স্কোর দাঁড়াল ২৫৫/৯। জয়ের জন্য প্রয়োজন আরও ৩৭ রান। এই অবস্থায় সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো চতুর্থ দিনের খেলা।
স্ট্যাম্পস, ডে ফোর।
পরের দিন সকালে এক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হতে মাঠে এলো প্রায় দশ হাজার দর্শক। আগের দিন খেলা যখন শেষ হয়, তখন বোর্ডারের রান ছিল ৪৪, থমসনের ৮। আগেই রণকৌশলেই অটল থাকলেন উইলিস, বোর্ডারের দিকে মনোযোগ না দিয়ে থমসনকে আউট করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলো তার বোলাররা। এদিকে বিশ হাজারের কোটা ছুঁয়ে ফেললো দর্শক সংখ্যা। নতুন বল নেয়া হলো, কিন্তু বোর্ডার একমনে খেলতে লাগলেন, আগের দিনের তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাস সঙ্গে নিয়ে নামার পর তার সাথে যোগ দিলেন থমসনও। বিন্দু বিন্দু বালুকণার মতো সিঙ্গেলস-ডাবলস-বাউন্ডারিতে ২৫৫/৯ থেকে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল ২৮৬/৯ তে।
জয়ের জন্য আর দরকার মাত্র ৬ রান!
সেই ম্যাচে বেশ অসুস্থ ছিলেন বব উইলিস, প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট নিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে কোন উইকেট পাননি তিনি। তবে নিজের সেরা ওভারটা করলেন বড় মোক্ষম সময়ে, চেষ্টা করেও ২ রানের বেশি নিতে পারলেন না বোর্ডার। এবং সবচেয়ে বিপদের কথা হলো, ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিতে ব্যর্থ হলেন তিনি। যার মানে, থমসনকে মোকাবেলা করতে হবে পরের ওভারটা।
জিততে হলে দরকার আর মাত্র ৪ রান!
এই সময়ে বোলিংয়ে আসলেন বোথাম। প্রথম স্লিপে ছিলেন মিলার, দ্বিতীয় স্লিপে ট্যাভার। পিচের অবস্থা খেয়াল করে কিছুটা সামনে এগিয়ে এলেন তারা। অন্য দিকে থমসনের মাথায় চলছিল অন্য চিন্তা। আর মাত্র একটা বাউন্ডারি দরকার, তাহলেই তো খেলা শেষ!
বোথামের করা বলটি অনুমানের চাইতে বেশী লাফাল। দ্বিধায় ভুগলেন থমসন। ‘খেলব, নাকি খেলব না?’ চিন্তা করতে করতেই ব্যাটের কানা ছুঁয়ে গেল বল, জমার চেষ্টা করলেন সেকেন্ড স্লিপে থাকা ট্যাভার। সুবিধা করতে পারলেন না ট্যাভার, হাত ফসকে উপরে উঠে গেল বলটি। দৌড়ে গিয়ে লুফে নিলেন ফার্স্ট স্লিপের মিলার।
অস্ট্রেলিয়া ২৮৮ রানে অল আউট! স্নায়ুক্ষয়ী এই ম্যাচ ইংল্যান্ড জিতল মাত্র ৩ রানে!
এই প্রসঙ্গে পরে থমসন বলেছিলেন, ট্যাভারের ক্যাচ নেয়ার মুহূর্তটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে মুহূর্তগুলোর একটি।
তীরে এসেও তরী ডোবার ক্ষোভে কিটব্যাগে ঝেড়ে লাথি মারলেন রডনি মার্শ। আর এদিকে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ইংল্যান্ড দলকে সিডনিতে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে এলেন থমসন।
সিডনিতে অবশ্য জিততে পারল না অস্ট্রেলিয়া। ড্র হয় সেই টেস্ট, ফলে ২-১’এ সিরিজ জিতে নেয় চ্যাপেলবাহিনী।
আর অ্যালান বোর্ডার?
এই ম্যাচে ৬২ রানে অপরাজিত ছিলেন, ম্যাচটা কীভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল, দেখেছিলেন অপর প্রান্ত থেকে। তার দুঃখ ভুলতেই হয়তো পরের টেস্টের দুই ইনিংসেই জ্বলে উঠলেন, খেললেন ৮৯ আর ৮৩ রানের দু’টো ইনিংস। তাতে কি মেলবোর্নের হারের দুঃখে প্রলেপ পড়েছিল কিছুটা হলেও?
হয়তো। হয়তো না। কে জানে!