তার আবির্ভাবের আগে রাঁচি নামের ছোট্ট শহরটার নাম ক’জন শুনেছে গোটা বিশ্বে, সেটা বোধহয় গুনে ফেলতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। আর তার নামটাই এত বড় একটা সাইনবোর্ড যে তাকে নিয়ে অল্পবিস্তর শোনেননি, এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভারতের মতো একটা দেশে এতগুলো বছর অধিনায়কত্ব করে গেছেন, অথচ বিতর্ক ছুঁতে পারেনি পুরো ক্যারিয়ারে, এমন হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেও তিনি চলে আসবেন খুব সম্ভবত সবার আগে। আর এই ছোট্ট ভূমিকাটুকুর পুরোটা পড়ার আগেই যে একটা মানুষের চেহারা আপনার সামনে ভেসে উঠছে, সেটাও বলাই বাহুল্য। ঠিক ধরেছেন, বলা হচ্ছে মহেন্দ্র সিং ধোনির কথা।
রাঁচি’তে পুরো শহরের বাণিজ্য মোটামুটি বলা যায় ‘মেইন রোড’-এর দুই দিক ঘিরেই গড়ে উঠেছে; আর এসব দোকানেই কেটেছে মাহীর অলস বিকেলগুলো। এমনই এক দোকান ছিল পরমজিত সিংয়ের, কিংবা ‘ছোটু ভাইয়া’র। ‘প্রাইম স্পোর্টস’ নামের ছোট্ট একটা লোকাল স্পোর্টস কীটের দোকান তার। মাথায় শিখ পাগড়ি, মুখভর্তি দাড়ি – পরমজিত রীতিমতো আমাদের কল্পনায় দেখা আদর্শ শিখ দর্শনধারী। এলাকায় কে কোন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলছে, কে তাতে কেমন পারফর্ম করছে, সব একেবারে তার নখদর্পনে। তারই নজরে প্রথম পড়েছিলেন মাহী, তার বড় এক পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন ছোটু ভাইয়া।
তবে শুরুটা কিন্তু ঠিক ক্রিকেট থেকে হয়নি। ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন – খেলেছেন সবই। ভারতের আর দশটা ছেলের মতো “ক্রিকেট খাই ক্রিকেট পরি ক্রিকেট ঘুমাই” গোছের কিছু কোনোদিনও ছিলেন না। ফুটবলে গোলরক্ষণের কাজটা ভালোই সামলাতেন, নামটামও ছড়িয়েছিল অল্পবিস্তর। তবে তার দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় বা ওই গোছের কোনো একটা কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, যেটার জন্য একটা ক্রীড়াবৃত্তি জুটে যাওয়া ছিল খুব দরকার। ঠিক এমনই সময় স্কুলের ক্রিকেট কোচ কেশব রঞ্জন ব্যানার্জি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ক্রিকেট খেলবি? চার মাস বাদে ক্রিকেট মৌসুম শুরু। আমার একটা কিপার লাগবে।”
সেই ঘটনার পর প্রায় মাসচারেক কেটে গেছে। ব্যানার্জি বাবুও সে ঘটনা বেমালুম ভুলে গেছেন, এমনকি মাহী কী উত্তর দিয়েছিলেন সেটাও আর মনে নেই। হঠাৎ এসে হাজির মাহী, সে প্র্যাকটিস করতে চায়।
এরপর? শুনলে রূপকথার মতোই মনে হবে। মাঠে নেমে দারুণ পারফর্ম করে সেন্ট্রাল কোলফিল্ডস লিমিটেড থেকে প্রথম ক্রীড়াবৃত্তি পেলেন, দুলীপ ট্রফিতে ২০০১ মৌসুমে ইস্ট জোনের হয়ে মাঠে নামারও সুযোগ মিলে গেল। এই টুর্নামেন্টে শচীন টেন্ডুলকারেরও খেলার কথা ছিল, সে কারণে রীতিমতো আনন্দে টগবগ করছিলেন অত্যুৎসাহে। হা হতোস্মি, কেউ জানতেই পারল না যে সুযোগ হয়ে গেছিল মাহীর। বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে যে সেই চিঠি পৌঁছায়ইনি মাহী অবধি। ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত, বলা কঠিন। তবে সিলেকশনের কথাটা মাহী জানতে পারলেন সেদিন রাতে, এক বন্ধু পত্রিকা মারফত জেনে যখন তাকে ফোন করে জানালেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সেদিনের শেষ গাড়িটাও রাঁচি ছেড়ে গেছে। ভাগ্যকে দুষেই হয়তো সে যাত্রা পার করে দিতেন মাহী।
কিন্তু ভাগ্যের কাছে হার মানতে রাজি হলেন না ছোটু ভাইয়া। বললেন,
“ধুর ছাই, উচ্ছন্নে যাক বাকি সব। চল বেরিয়ে পড়ি।”
ধর্না দিলেন বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে, একটা গাড়ি যদি মিলে যায়। ফিরিয়ে দিল তারা, মিলবে না কিচ্ছু। দমলেন না ছোটু ভাইয়া, তার কয়েকজন বন্ধুপ্রতিম মানুষের থেকে টুকটাক ধারকর্জ করে একটা ট্যাক্সির জোগাড় করে ফেললেন; উদ্দেশ্য – কলকাতা। বিধি বাম, মাঝ রাস্তায় বিকল হলো গাড়ি। ধোনিও মিস করে ফেললেন ফ্লাইট। প্রথম ম্যাচটা মিস করে ফেললেন, আগরতলার সেই ম্যাচে খেললেন দীপ দাশগুপ্ত। দ্বিতীয় ম্যাচটা হলো পুনেতে, সেটাতেও দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেন শচীন কীভাবে ওয়েস্ট জোনকে ম্যাচ জেতালেন।
এরপর আর রূপকথা নয়, কঠোর পরিশ্রমের গল্প। ধাপে ধাপে উঠলেন উপরের দিকে, প্রতিটি ধাপে নিজেকে চেনালেন আলাদা করে। একদিন সৌরভ গাঙ্গুলী টিম মিটিংয়ে বললেন, ‘লেটস ট্রাই মাহী।’ ব্যস! সাফল্য এল ঝাঁক বেঁধে; কখনো উইকেটের সামনে, কখনো উইকেটের পিছনে, কখনো অধিনায়কত্বের ব্যাজ পরে, আবার কখনো ভারতীয় ক্রিকেটের গতিবিধি বদলে দিয়ে।
কিন্তু ধোনি কীভাবে পেলেন এই উত্তুঙ্গ সাফল্য? সেটা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে, ধোনি কীভাবে অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে গ্রেগ চ্যাপেল বরাবরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, একদম প্রথাগত পরিবেশের বাইরে থেকে ‘আউটসাইডার’ হয়ে উঠে এসেছেন বলেই ধোনি সবার থেকে আলাদা; তার ডিসিশন মেকিং আর স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা, কোনো কোচিং ম্যানুয়ালে ওসবের খোঁজ পাওয়া যাবে না। এমনকি নিজের বইতেও তাকে নিয়ে প্রশংসা বৈ কিছু নেই। তার ভাষ্যটা ছিল অনেকটা এমন,
“ভারতীয় ক্রিকেটে সত্যিকারের আশার আলো হয়ে এসেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি; আমি যেসব তরুণের সাথে কাজ করেছি জীবনে, খুব সম্ভবত সবচেয়ে ইমপ্রেসিভ ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন। সে স্মার্ট, খেলাটা দারুণ পড়তে পারে, স্বভাবতই দুর্দান্ত নেতৃত্বগুণ। ব্রেকের সময়টায় মাঠে কী চলছে বোঝার জন্য নির্দ্বিধায় ওর কাছেই চলে যেতাম সবার আগে।”
গ্রেগ চ্যাপেল থামেননি সেখানেই। আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, গাঙ্গুলীর সমস্যাটা ছিল অনেকটা চিরাচরিত ভারতীয় বাবা-মা’য়ের মতো, সন্তানের ভালো চেয়ে সবকিছু নিজেরাই ঠিক করে দেবেন। সেটা হয়তো কোনোরকমে অনেক উঁচু কোনো অবস্থানে পৌঁছে দেবে, তবে টেস্ট ক্রিকেটের মতো বিশাল অঙ্গনে এসে উদোম হয়ে দাঁড়ালে নিজের সামর্থ্য ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। আর ঠিক এ কারণেই একটা নির্দিষ্ট জায়গা অব্দি পৌঁছানোর পরও যথার্থ নেতৃত্বহীনতায় পরের ধাপটায় যেতে পারছিল না ভারত। আর ঠিক এখানেই চলে এলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, আর এসেই ইতিহাস-পরিসংখ্যান-ভক্তমন সব উলটপালট করে দিলেন। কীভাবে বদলে দিয়েছিলেন ধোনি, কোথায় এসেছিল পরিবর্তনটা? অধিনায়কত্বের শুরুর সময়টাতে খুব কাছ থেকে দেখেছেন গ্রেগ চ্যাপেল; তার ভাষ্যমতে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের সবচেয়ে সমস্যার জায়গাটাই বদলে দিয়েছিলেন ধোনি।
“আমি তরুণ খেলোয়াড়দের সাথে আলাদা করে কথা বলতে গেলেই দেখতে পেতাম, তাদের কাছে দারুণ সব আইডিয়া আছে। অথচ টিম মিটিং আসলেই সবাই চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইয়ংস্টাররা বলতো, আমি অমুকের সামনে বলতে পারব না, তাহলে আমার আর রক্ষা নেই। কেউ কেউ তো ভয়ে মুখ খুলতেই রাজি হতো না। ধরা যাক শচীন কিছু বললো, সেটা মনে হতো বেদবাক্য। অথচ ধোনি নেতৃত্বে আসার পর এই ব্যাপারটাই বদলে গেল, এইসব শিকল সে ভেঙে ফেলল একদম শুরুতেই।”
শুরুর দিনগুলোতে ধোনি ছিলেন ‘পালোয়ান’ রোলে, ঠিক বীরেন্দর শেবাগের মতো। তার কাছে কেউ ৫০ বলে ৩০ চায় না, তার কাছে চায় আসুরিক শক্তিতে বিগ হিট। আর উইকেটের পিছনে অসম্ভব রকমের সপ্রতিভ হওয়ার কারণে খুব সহজেই ‘টারজান’ উপাধিও পেয়ে গেলেন। ঝাকড়া চুলের ধোনির নাম তখন সবার মুখে মুখে।
কিন্তু ‘টারজান’ নয়, তিনি সন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। সেটা রাতারাতি এলো না। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের খেলার ধরনটা বদলে দিতে হলো, খেলার মাঠে দলটাকে রীতিমতো যোদ্ধায় পরিপূর্ণ করে তুলতে হলো, গোটা দলকে শেখাতে হলো চাপের মুখে নিস্পৃহ থাকার শিল্পটা। এই পরিবর্তনটা কীভাবে এলো, সেটা একটা বর্ণনা পাওয়া যায় সাংবাদিক ভারত সুন্দরসেনের লেখা ‘দ্য ধোনি টাচ’ বইয়ে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৬০ রানের একটা রান তাড়া করছিল ভারত। সেটা ধোনির অধিনায়কত্বে মোটে ১৫তম ওয়ানডে। যখন ম্যাচটা জিততে ১০ রান বাকি আর, ক্রিজে তখন তৎকালীন ইয়ংস্টার রোহিত শর্মা আর ধোনি নিজে। ধোনি অনেকটা অহেতুকই ওই সময়টাতে গ্লাভস চেয়ে পাঠালেন। সচরাচর যেটা হয়, গ্লাভস আনার পথে ড্রেসিংরুম থেকে বার্তা আসে। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা হলো ঠিক উল্টো – ধোনি বলে পাঠালেন, ম্যাচটা জেতার পর ব্যালকনিতে কেউ যেন উদযাপন না করে।
এ আবার কেমন বার্তা!
শুধু সেখানেই থামলেন না ধোনি; রোহিত শর্মাকে বুঝিয়ে বললেন, ম্যাচটা জেতার পর অজিদের সাথে হাতটা মেলাতে হবে খুব ভেবেচিন্তে। খুব উৎফুল্ল হয়ে মিলাতে যাবে না, স্রেফ মেলানোর জন্য মেলানো গোছের একটা ভাব রাখবে। আর ওদের চোখের দিকে তাকাবে একটা শূন্য দৃষ্টি দিয়ে, কোনো রকম উত্তেজনা যেন চোখে ধরা না পড়ে! ম্যাচটা জয়ের পর ভাবটা থাকবে এমন, “এ আর এমন কী!”
কেন করলেন ধোনি এমনটা? সেটা পরে জানিয়েছিলেন দলে থাকা আরেকজন ক্রিকেটার,
“আমরা যদি পাগলাটে উদযাপন করতাম, অজিদের কাছে মনে হতো একটা অঘটন ঘটিয়ে সেটার জন্য উল্লাস করছি। আমরা এই বার্তাটা দিতে চেয়েছিলাম, অঘটন নয়, এটাই এখন থেকে প্রতিনিয়ত হবে, বারবার হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর অজিরা এইটা কিছুতেই হজম করতে পারেনি, টলমল করে উঠেছিল তাদের পায়ের নিচের মাটি।”
সময়টা এমন ছিল, যখন অস্ট্রেলিয়া ছিল অজেয়। রিকি পন্টিংয়ের দলটার কাছে তখন অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো পরাজয়ই ‘অঘটন’, অন্য দলগুলোর জন্য তো বটেই। আর এমনই এক পরিস্থিতিতে মহেন্দ্র সিং ধোনি এমন গুরুতর একটা বার্তা পৌঁছে দিলেন, অজিদের আত্মা কেঁপে উঠল। আর তিনি? শান্ত-সৌম্য চেহারায় ছোট্ট একটা হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন সৌজন্যের খাতিরে।
একজন অধিনায়ক আর একজন দূরদর্শী নেতার মধ্যে তফাৎ বোঝা যায় এমন কিছু ছোটখাটো গল্প থেকেই।
অধিনায়কত্বের মাধ্যমে কীভাবে বদলটা এনেছিলেন, সে গল্প বলা শুরু করলে থামা মুশকিল। তবে মহেন্দ্র সিং ধোনির আরেকটা গুণও তাকে গোটা বিশ্বে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল – তার ফিনিশিং। আর এই গুণটাও একদিনে রপ্ত করেননি তিনি। শোনা যাক ধোনির নিজের মুখ থেকেই:
তখন আমি চার-ছক্কা মারতে খুব ভালোবাসি। যুবরাজ সিং এসে একদিন জিজ্ঞেস করলো, ‘তা ভায়া কেমন চলছে?’ আমি বললাম, ‘বল দেখছি আর মারার চেষ্টা করছি।’ যুবরাজ বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। একটু সময় যেতে দাও, কাঁধে চাপটা আরেকটু বাড়ুক, তখন বুঝতে পারবে, ছক্কার চেয়ে ম্যাচ জেতানোতেই মজা বেশি।’
এরপর সময় গেছে, ধোনিও ছক্কা মারার চাইতে ম্যাচ জেতানোতেই মন দিয়েছেন। নিজেকে তুলে নিয়েছেন এমন উচ্চতায় যে এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ‘ফিনিশার’ রোলে তাকে মনে করা হয় পথিকৃৎ, এতগুলো বছর পেরিয়েও তিনিই আজও ফিনিশিংয়ের শেষ কথা। কীভাবে সেই সময়টাতে চিন্তা করেন, ধোনি কথা বলেছেন সেটা নিয়েও,
“ফিনিশারদেরকে নিয়ে গণ্ডগোলটা হচ্ছে, তেমন কিছু পাওয়ার মতো নেই। বিগ শটই যে সেরা শট হবে, এমন কোনো কথা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি কখনো তাড়াহুড়ো করি না। আমার লক্ষ্যটা পরিষ্কার: যতক্ষণ অব্দি আমি আর বোলার সমান পরিমাণ চাপে না পড়ছি, ততক্ষণ অব্দি শান্ত থাকব। এরপর দেখি কে বেশি ভালো চাপ সামলাতে পারে – আমি, নাকি বোলার। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পা মাটিতেই রাখা। কিচ্ছু আগে থেকে ভেবে রেখে লাভ নেই। প্রতিটা দিন আলাদা। আমি সবসময় দলকে বলি, আজকে কেউ না কেউ হিরো হবে। তোমার সামনে যদি সেই সুযোগ আসে, সেটাই নিতে হবে।”
ধোনি নিজে সেটা নিয়েছেন, বারবার নিয়েছেন। আর সবচেয়ে ভালোভাবে নিয়েছেন সবচেয়ে বড় মঞ্চেই, ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে। নিজের স্বাভাবিক ছয় নম্বরে না নেমে সেদিন তিনি নেমেছিলেন পাঁচ নম্বরে। পুরো বিশ্বকাপটা স্বপ্নের মতো কাটানো যুবরাজ সিংকে বসিয়ে রেখে তিনিই হুট করে সেদিন নেমে যাওয়ার কারণটা কী ছিল?
“সেদিন আমার মন বলছিল, আমার পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নামা উচিত। আমি যখন আমার ব্যাটিং শ্যু পরছিলাম, গ্যারি কারস্টেন এসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নামবো আমি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় তোমার নামা উচিত।’ আইপিএলে মুরালির সাথে চেন্নাইতে প্রচুর খেলেছি আমি, মনে হচ্ছিল ওকে পড়তে পারব ভালো। আর যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তাহলে অন্যরাও যথেষ্ট শান্ত থাকতে পারবে। এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে সেদিন জুয়া খেলেছিলাম কি না, অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার বিশ্বাস, ঠিক সিদ্ধান্ত কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত ছাড়িয়ে এটা ছিল একটা অকপট এবং গভীর চিন্তা থেকে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। আমার মন থেকে বিশ্বাস ছিল এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত, আর দলও আমার উপরে ভরসা করেছিল।”
সে বিশ্বাসের প্রতিদানটা যে ধোনি কেমনভাবে দিয়েছেন, সেটা এরপর গোটা বিশ্ব দেখেছে।
সেদিনের ‘মাহী’ এখন আর রাঁচিতে ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারেন না। যদি ঘুরতেই হয়, মাথায় একটা হেলমেট চাপিয়ে কাঁধে ঝুলানো একটা ব্যাগে লাইসেন্সড গান নিয়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ঘুরতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক যেই মানুষটা, এতটুকু খ্যাতির বিড়ম্বনা যে তাকে পোহাতেই হবে!
তবু মহেন্দ্র সিং ধোনির মুখে হাসি সরে না। তিনি নিজের জীবনযুদ্ধে জিতেছেন, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, গোটা ভারতকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন, পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর রাস্তাটাও দেখিয়ে দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন,
“মানুষ ভুলে যাবে তুমি কী বলেছিলে। মানুষ ভুলে যাবে তুমি কী করেছিলে। কিন্তু মানুষ এটা কোনোদিনও ভুলবে না, কী অনুভূতিটা উপহার দিয়েছিলে একদিন তাদেরকে।”
এভাবেই ছোট্ট শহর রাঁচির মাহী হয়ে উঠেছেন প্রকট বটবৃক্ষ, হয়ে উঠেছেন ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’। তার গল্পটা বলে শেষ করবে, এমন সাধ্য এই সামান্য লেখকের আছে নাকি!