১.
মিডিয়ার মতে, ম্যাচটা ছিল ফাইনালের ড্রেস রিহার্সেল। অথচ তখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে নকআউট স্টেজই শুরু হয় নি। গ্রুপপর্ব শেষে সেটা ছিল সুপার সিক্সের দ্বিতীয় ম্যাচ। তবে এরপরও ‘ফাইনালের ড্রেস রিহার্সেল’ তকমা দেবার পর কারো তরফ থেকে কথাটার প্রতিবাদ না ওঠার পেছনে মূল কারণ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ওয়াহ ব্রাদার্স, পন্টিং, গিলক্রিস্ট, বেভান, ম্যাকগ্রা, ওয়ার্নদের সমন্বয়ে দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে বিশ্বকাপে এসেও নিজেদের চেনা রূপে আসতে পারছিল না তারা। স্কটল্যান্ডের সাথে জিতলেও পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ডের সাথে হেরে গিয়ে চলে গিয়েছিল খাঁদের কিনারে। সেখান থেকে ফিরে এসে সুপার সিক্সে জায়গা করে নিলেও চ্যাম্পিয়ন হতে হলে তাদের সমীকরণ ছিল পরের কোনো ম্যাচ না হারা। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকা গ্রুপে একটি করে ম্যাচ হারলেও সেগুলো অঘটনের তালিকাতেই পড়েছিল। সুপার সিক্স নিশ্চিত হবার পর নির্ভার হয়ে খেলতে গিয়ে জিম্বাবুয়ের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার, কিংবা বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের পরাজয় তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। বাকি দলগুলোও খুব বেশি ভালো অবস্থানে না থাকায় টুর্নামেন্টের ফর্মে থাকা দুই দলের লড়াইটার দিকে সবার চোখ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।
সৌভাগ্যবশত, হতাশ হননি সেই ম্যাচের দর্শকরা।
২.
টস জিতে পাকিস্তান ব্যাটিংয়ে নামলো। এটা অবশ্য অনুমিতই ছিল। শুরু থেকে সাঈদ আনোয়ার এবং ওয়াজাতুল্লাহ ওয়াস্তি বেশ সতর্কতার সাথে ব্যাটিং করতে থাকলেন। তবে এরপরও ১৪তম ওভারে সাঈদ আনোয়ার যখন আউট হলেন, তখন দলের সংগ্রহ ৪১ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সাঈদ আনোয়ার খুব দুর্দান্ত একজন ব্যাটসম্যান হলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি পুরোপুরিই ব্যর্থ ছিলেন। এই ইনিংসের আগ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯টি ইনিংসে সাঈদ আনোয়ারের রান ছিল মাত্র ২৮৩, সেটাও মাত্র ১৫.৭২ গড় আর ৬১.৯৩ স্ট্রাইকরেটে। এই ইনিংসে করতে পারলেন মাত্র ২৩ রান। আফ্রিকার বিপক্ষে পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারেই সাঈদ আনোয়ারের কোনো অর্ধশত রানের ইনিংসও নেই, বিষয়টা বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট।
আনোয়ার আউট হবার পর নামলেন সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের চমক অলরাউন্ডার আবদুর রাজ্জাক। ওয়াস্তিকে নিয়ে আবদুর রাজ্জাক খুবই সাবধানে খেলতে থাকলেন। মাঝে ওয়াস্তি আউট হলে জুটি গড়লেন ইজাজ আহমেদের সাথে। দলীয় ১০০ রান করতে পকিস্তানকে ৩০তম ওভার পর্যন্ত খেলতে হলেও কেউ অবাক হলো না। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের স্ট্র্যাজেডিই ছিল এমন, শুরুতে উইকেট হাতে রেখে শেষের দিকে আক্রমণ করে লড়াইযোগ্য রান তুলে নেওয়া। এরপর শক্তিশালী বোলিং দিয়ে সেটাকে ডিফেন্ড করা। তবে প্রতিদিন পরিকল্পনা সফল হয় না। ৩৬তম ওভারে দলীয় ১১৮ রানেই ইনজামাম-উল হকও আউট হয়ে যাবার পর মনে হলো, আজ হচ্ছে তেমনই একটা দিন। পাকিস্তান পুরো ওভার টিকতে পারবে কি না, সেটাই তখন ভাবনার বিষয় ছিল।
তবে ধীরে ধীরে খেললেও পাকিস্তান একটা পর্যায়ে ম্যাচে ফেরত আসলো। ৪৬তম ওভারশেষে পাকিস্তানের রান ছিল মাত্র ১৭২, উইকেটে সেট ব্যাটসম্যান ছিলেন একমাত্র মঈন খান। ৪৭তম ওভারে এলো ১৭ রান, ৪৮তম ওভারে ১৩। মাঝের একটা ওভারে ৬ রান উঠলেও শেষ ওভারে মঈন খান তুলে নিলেন ১৪ রান। শেষ পর্যন্ত যে পুরো ওভার খেলে পাকিস্তান ২২০ রানের একটা স্কোর দাঁড় করাতে পারলো, তার জন্য একমাত্র অবদান ছিল উইকেটকিপার মঈন খানের ৫৬ বলে ৬৩ রানের একটা অসাধারণ ইনিংস।
৩.
প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই ২২০ রান পাকিস্তানের জয়ের জন্য পর্যাপ্ত কি না।
এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়া এর আগের ১৩টি ম্যাচেই পাকিস্তান পরাজিত হলেও সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় এককভাবে কাউকে ফেভারিট বলা যাচ্ছিল না। বিশেষ করে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শোয়েব আখতারের উত্থানের পর থেকে পাকিস্তান আগে ব্যাটিং করে হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচে। বিশ্বকাপেও অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর নিউ জিল্যান্ড হেরেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে রান তাড়া করতে গিয়েই।
যেমনটা অনুমান করা হয়েছিল, ম্যাচের শুরুটা হলো ঠিক তেমনই। ওয়াসিম আকরামের প্রথম ওভারে ৭ রান আসলেও দ্বিতীয় ওভারেই আঘাত পেল দক্ষিণ আফ্রিকা। শোয়েব আখতারের চতুর্থ বলেই ইজাজ আহমেদের হাতে ধরা পড়লেন হার্শেল গিবস। শোয়েবের প্রথম ওভার থেকে কোনো রান এলো না। দক্ষিণ আফ্রিকান শিবিরে শোয়েব আবারও আঘাত হানলেন নিজস্ব তৃতীয় ওভারে, এবারের শিকার অধিনায়ক হ্যানসি ক্রনিয়ে।
৬ ওভারের মাঝেই দু’টো গুরুত্বপূর্ণ উইকেট পড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা কিছুটা সতর্ক হলো। এরপরও পাকিস্তানীদের তোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলো না। ২০তম ওভারের মাঝেই ৫ উইকেট পড়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকার, সেটাও মাত্র ৫৮ রানে। ১৮০ বলে ১৬৩ রানের প্রয়োজনটা খুব বেশি না হলেও বাকি ৫ উইকেট নিয়ে সেই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে বাজি ধরার মানুষ ছিল না বললেই চলে।
দলের বিপর্যয়ের সেই মুহূর্তে কোনো একজনের হাল ধরাটা খুবই প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনীয় সেই কাজটা করার জন্য এগিয়ে এলেন জ্যাক ক্যালিস। অলরাউন্ডার শন পোলককে নিয়ে গড়লেন ৭৭ রানের একটা জুটি। ৩৭তম ওভারের প্রথম বলে ৩০ রান করে শন পোলক আউট হয়ে যাবার পর মাঠে নামলেন ল্যান্স ক্লুজনার। জিততে হলে দক্ষিণ আফ্রিকার তখন প্রয়োজন ৮৩ বলে ৮৬ রান, পাকিস্তানের প্রয়োজন ৪ উইকেট।
৪.
ল্যান্স ক্লুজনারকে তখন পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপে কোনো বোলারই আউট করতে পারেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার জয় পাওয়া আগের দুই ম্যাচেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ক্লুজনারই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যে ম্যাচটাতে হেরেছিল, সেটাতেও ৫৮ বলে অপরাজিত ৫২ রানের একটা ইনিংস খেলে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে এরপরও শোয়েব, সাকলাইন, আকরাম আর আজহার মাহমুদের আগুনঝরানো বোলিং এর বিপক্ষে একইরকম খেলবেন ক্লুজনার, সেটা ভাবার জন্য কিছুটা সাহসের প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের বিপক্ষে জেতা দূরে থাক, টিকে থাকার কথাই তো ভাবা মুশকিল।
সৌভাগ্যের কথা হচ্ছে, ক্লুজনার টিকে গেলেন। আক্রমণের পরিবর্তে পরিস্থিতি অনুযায়ী মাঝে মাঝে যে রক্ষণাত্মকও খেলা প্রয়োজন, সেটা হয়তো তার মাথায় ততক্ষণে ঢুকে গিয়েছে। এজন্যই মুখোমুখি হওয়া প্রথম ৮ বলে তিনি রান করতে পারলেন মাত্র ২। অপরপ্রান্তে খুব সাবধানে খেলে ক্যালিস করলেন ৮৯ বলে ব্যক্তিগত অর্ধশত রান। কিছুটা ধীরগতির হলেও পরিস্থিতির বিবেচনায় সেটা ছিল খুবই কার্যকরী এবং প্রয়োজনীয় একটা ইনিংস।
শেষ ৩৬ বলে ৪৬ রানের লক্ষ্যমাত্রা খুব কঠিন নয়। তবে হুট করেই এটাকে কঠিন মনে করিয়ে দিলেন সাকলায়েন মুশতাক, ক্যালিসকে আউট করে পাকিস্তানকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন তিনি। সাকলায়েনের সেই ওভারে মাত্র ২ রান আসায় শেষ ৩০ বলে জেতার জন্য আফ্রিকার প্রয়োজন হলো ৪৪ রান।
৪৬তম ওভারটাই সম্ভবত ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওভার ছিল। ক্লুজনারের বিপক্ষে বল করতে এলেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা শোয়েব আখতার। প্রথম বলে কোনো রান হলো না, দ্বিতীয় বলে ১ রান নেওয়ার পরের বলে বাউচারও ১ রান নিতে পারলেন। চতুর্থ বলটি হলো নো বল। পরের বলটাতে শোয়েব বাউন্সার দিলেন। ক্লুজনার হুক করলেও ঠিকমতো ব্যাটে বলে না হওয়ায় বলটা উপরে উঠে গেলো। কিন্তু থার্ডম্যান থেকে দৌড়ে আজহার মাহমুদ বলটা আয়ত্ত্বে আনতে পারলেন না, বরং তার হাত গলে বলটা বাউন্ডারির দিকে ছুটে গেলো। পরের বলে পুল করে ক্লুজনার আরেকটা ছক্কা মেরে ম্যাচটাকে মোটামুটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেন। ওভারের শেষ বলটাতে লেগ বাই’তে চার রান হওয়ায় শেষ ২৪ বলে আফ্রিকার প্রয়োজন হলো ২৭ রানের।
৫.
এর চাইতে কঠিন পরিস্থিতিতেও পাকিস্তান আগে ম্যাচ জিতেছে। মাঝে সাকলাইনের ১ ওভারে ৯ রান উঠার পর শেষ ১৮ বলে ১৮ রান প্রয়োজন থাকলেও পাকিস্তানি সমর্থকদের ভরসা ছিল ওয়াসিম আকরামের উপর। ৪৮তম ওভারের প্রথম ৫ বলে ওয়াসিমের ওভার থেকে এলো মাত্র ৩ রান। কিন্তু ওভারের শেষ বলে বিশাল একটা ছক্কা মেরে ক্লুজনার বুঝিয়ে দিলেন যে, দিনটা আসলে তারই। পরের ওভারের প্রথম বলেই বাউচার আরেকটা ছক্কা মেরে টার্গেট নামিয়ে নিয়ে এলেন ৩ রানে। পঞ্চম বলে ১ রান এলে সাকলাইনের ওভারের শেষ বলে স্ট্রাইক পেলেন ক্লুজনার। জিততে হলে আফ্রিকার প্রয়োজন ৭ বলে ২ রান, কিন্তু ব্যক্তিগত অর্ধশত পূরণ করার জন্য ক্লুজনারের প্রয়োজন ৬ রানের।
সেটা মাথায় রেখেই কি না কে জানে, সাকলায়েনকে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন ক্লুজনার। কিন্তু সাঈদ আনোয়ার ক্যাচটা ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় ২ রান নিয়ে ম্যাচটা জিতে গেলো আফ্রিকা। ক্যাচটা ধরতে পারলে শেষ ওভারে ২ উইকেট নিয়ে আফ্রিকার জানার উপায় নেই। তবে ম্যাচে ৪১ বলে ৪৬ রানের ছোট্ট, কিন্তু কার্যকরী ইনিংস খেলার জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেলেন ল্যান্স ক্লুজনার। নাটকীয় এই ম্যাচটাতে বারবার জয়ের পাল্লা দুই দিকেই হেলতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আফ্রিকাই সেটা ছিনিয়ে নেয়।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাদ না পড়লে ফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি হতো দক্ষিণ আফ্রিকাই। হয়তো বা বিশ্ব তখন নতুন আরেকটা চ্যাম্পিয়ন দেশকেই দেখতে পেত। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিপক্ষ তো কেবল শক্তিশালী দেশগুলোই নয়! ভাগ্যবিধাতা স্বয়ং যখন তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান, তখন সাধ্য কী জয় ছিনিয়ে আনার!