
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এশিয়ার দলগুলো সফরে যাবে এবং গো-হারা হেরে দেশে ফিরবে এটা যেন অলিখিত সংবিধান। ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা নিজেদের শেষ কিউই সফরে ওডিআই এবং টেস্ট দুটি সিরিজই হেরেছিলো। পাকিস্তান তো গত মাসেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শোচনীয়ভাবে দুটি টেস্ট হেরেছিলো। শ্রীলঙ্কা এবং ভারতেরও একই অবস্থা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েলিংটন টেস্টের সাদামাটা বোলার কলিন ডা গ্রান্ডহোম কিছুদিন আগে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দিয়ে জিতে নিয়েছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
বাংলাদেশ শুধুমাত্র গ্রান্ডহোমকে না, প্রথম ইনিংসে কিউইদের প্রত্যেকটা বোলারকে ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছিলেন। সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়, পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। এটা যেমন প্রতিদিন একই নিয়মে চলছে, ঠিক তেমনি নিউজিল্যান্ড সফরে এশিয়ান দলগুলো বেহাল অবস্থা প্রতিবারই ঘটছে।
সে হিসাবে এশিয়ার পরাশক্তিদের চেয়ে কিউইদের মাটিতে বাংলাদেশের পারফরমেন্স তুলনামূলক ভাবে অনেক ভালো। সফরের প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই চালকের আসন থেকে ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ। অভিজ্ঞতা এবং ভাগ্য সহায় থাকলে দৃশ্যপট ভিন্ন হতে পারতো।
সদ্য শেষ হওয়া ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম চারদিন চালকের আসনে থেকেও ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ভাগ্যকেও দোষ দেওয়া যায়।
সফরের প্রথম ওডিআই দিয়ে শুরু, ঐদিন ভাগ্যের সহায়তা পেলে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে অধরা জয়ের দেখা পাওয়াটা সময়ের ব্যাপার ছিলো বাংলাদেশের কাছে। ঐ ম্যাচে লাথাম এবং মুনরোর অসাধারণ ব্যাটিংয়ে কিউইরা বাংলাদেশের সামনে ৩৪২ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিলেও ম্যাচ বাংলাদেশের নাগালের বাহিরে যায়নি। এই মাঠেই বাংলাদেশের ৩২২ রান করেছিলো পরে ব্যাট করে, প্রেরণা হিসাবে ঐ ম্যাচটিও ছিল।
মাত্র ৩০ ওভারে ১৬৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের রান সংখ্যা তখনো দ্রুত বাড়তে থাকে। মুশফিকুর রাহিম হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরি নিয়ে যখন মাঠ ছাড়েন তখন বাংলাদেশের রান ছিলো ৩৮.৩ ওভারে ২১৯।
বাংলাদেশের ইনিংসের ৩৭.২ ওভারের সময় মিচেল স্যান্টনারের বল মিড-অনে ঠেলে দিয়ে দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গিয়েই পুরানো ইনজুরিতে নতুন করে ব্যথা পান মুশফিকুর রহিম, এক ওভার পরেই মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন মুশফিক। এরপর আর মাঠে নামা হয়নি ৪৮ বলে ৪২ রান করে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়া মুশফিকের, শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ৪২ রানে রিটায়ার্ড নট আউট থাকেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক।
ঐ সময় ভাগ্যের সহায়তা পেলে ফলাফল হয়তো নিজেদের অনুকূলে আনতে পারতো বাংলাদেশ। ইনজুরির দরুন পুরো ওডিআই সিরিজের পাশাপাশি টি-টুয়েন্টি সিরিজেও দলের বাহিরে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। মুশফিক থাকলে হয়ত পুরো সফরে মিডল অর্ডারে একজন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসবে এমন ব্যাটসম্যানের জন্য আক্ষেপ করতে হত না। গত কয়েক বছর মুশফিক এই দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন।
২টি টেস্ট এবং ৩টি টি-টুয়েন্টিতে দলের বাইরে থাকার পর বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক ওয়েলিংটন টেস্ট দিয়ে দলে ফিরে আসেন। টেস্টের প্রথম দিনে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় দিনে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে স্বপ্নের মতো একটি দিন অতিবাহিত করেন। দুজনে মিলে ৫ম উইকেট জুটিতে যোগ করেন রেকর্ড ৩৫৯ রান। এর মধ্যে মুশফিকুর রহিম করেন ১৫৯ রান, যা টেস্ট ক্রিকেটে তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস।
মুশফিকের দুর্দান্ত দিনটি ঠিক অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেনি ব্যাট করার সময় আঙুলে বল আঘাত হানলে। আঙুলে চোট পাওয়ার কারণে ফিল্ডিংয়ে দেখা যায় নি বাংলাদেশের অধিনায়ককে। হঠাৎ করে দলের অবস্থা বেগতিক দেখে ব্যাট হাতে দলকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নেমে যান দ্বিতীয় ইনিংসে।
নিউজিল্যান্ডের পেসাররা তখন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের শরীর বরাবর একের পর এক প্রাণঘাতী বাউন্সার দিয়ে যাচ্ছিলো। মুশফিক ব্যাট হাতে নেমে ৫২ টি বল দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন। কিন্তু টিম সাউদির এক বাউন্সারে শেষ পর্যন্ত কুপোকাত হন মুশফিক। প্রাণঘাতী এই বাউন্সার তার হেলমেটে আঘাত হানে এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুশফিক। অ্যাম্বুলেন্সে তড়িঘড়ি করে হসপিটালে নেওয়া হয় তাকে, ডাক্তাররা আশঙ্কা মুক্ত বললেও কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ মাঠের কাছ ঘেষতে নিষেধ করেছেন।
তার মানে আবারো রিটায়ার্ড নট আউট, আবারো বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ। প্রথম ওডিআইতে হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরির পর সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরে একবার আঙুলে এবং আরেকবার মাথায় চোট পেলেন। টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসাবে মুশফিকুর রাহিম রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেছেন।
এর আগে ২০০৮ সালে আফতাব আহমেদ সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে জ্যাক ক্যালিসের বলে মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
মুশফিকুর রহিম শুধুমাত্র টেস্ট এবং ওডিআইতে নয়, টি-টুয়েন্টিতেও ইনজুরির কারণে রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। গত বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪ ম্যাচ টি-টুয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে টসে জিতে ব্যাট করছিলো বাংলাদেশ, প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচেও সে পথেই এগুচ্ছিল।
সৌম্য, সাব্বির এবং মুশফিকের ব্যাটে চড়ে ১৬ ওভারে ৩ উইকেটে ১২৮ রান সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ, ঠিক ঐ সময়েই মুশফিক হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। এবং শেষ পর্যন্ত ২৪ রান করে রিটায়ার্ড নট আউট থেকে যান।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিম একমাত্র ক্রিকেটার হিসাবে তিন ফরম্যাটেই রিটায়ার্ড নট আউটের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ১০৬ জন, ওডিআইতে ৬৭ জন এবং টি-টুয়েন্টিতে ৮ জন ক্রিকেটার রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন। এর মধ্যে একমাত্র মুশফিকুর রহিমই তিন ফরম্যাটে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রিটায়ার্ড নট আউটের শিকার হন।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে করে মাঠের বাহিরে যাওয়া মুশফিকুর রহিমকে দেখতে চায় না কেউই। তার ব্যাট উঁচিয়ে হাসতে হাসতে মাঠের বাইরে যাওয়াটাই নিশ্চয়ই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।
‘রিটায়ার্ড নট আউট’ এবং ‘রিটায়ার্ড আউট’ এ দুইয়ের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। আম্পায়ারের অনুমতি ব্যাতীত স্বেচ্ছায় মাঠ ত্যাগ করলে ব্যাটসম্যানকে রিটায়ার্ড আউট দেওয়া হয়। আর আম্পায়ারের অনুমতি নিয়ে আউট না হয়ে মাঠ ত্যাগ করলে ব্যাটসম্যানের ঐ ইনিংসটিকে অপরাজিত হিসাবে ধরে রিটায়ার্ড নট আউট দেওয়া হয়।
ব্যাটসম্যান যদি শারীরিকভাবে ইনজুরি কিংবা অনিবার্য কারণে ব্যাট করতে অক্ষম হন তাহলে আম্পায়ারের অনুমতি নিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন এবং পুনরায় ব্যাট করতে না আসতে পারেন তাহলে ব্যাটসম্যানের ঐ ইনিংসটি রিটায়ার্ড নট আউট হিসাবে ধরা হবে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র দুইজন ব্যাটসম্যান রিটায়ার্ড আউট হয়েছেন। ২০০১ সালে কলোম্বো টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান মারভান আতাপাত্তু ২০১ রান এবং মাহেলা জয়াবর্ধনে ১৫০ রান করে অধিনায়ক সনাৎ জয়াসুরিয়ার নির্দেশে মাঠ ছেড়ে চলে আসেন। উক্ত ঘটনা নিয়ে প্রেস-কনফারেন্সে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিলো জয়াসুরিয়াকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিটায়ার্ড নট আউট হওয়া ব্যাটসম্যানদের তালিকা বেশ লম্বা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচেই রিটায়ার্ড নট আউটের ঘটনা ঘটে, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান চার্লস ব্যানারম্যান প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করে।
ঐ ইনিংসে চার্লস ব্যানারম্যান ২৮৫ মিনিট ক্রিজে থেকে ১৬৫ রান করেন, দলের ২৪৫ রানের মধ্যে ব্যানারম্যানের একাই করেন অপরাজিত ১৬৫ রান।
এরপর টেস্ট ক্রিকেটে আরো ১২১ বার ১০৫ জন ক্রিকেটার রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন।
সবচেয়ে বেশি রাহুল দ্রাবিড়, দিলিপ ভেংশঙ্কর এবং নাসের হুসাইন রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ছেড়েছেন, তারা তিনজনই তিনবার চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিম প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে রিটায়ার্ড নট আউটের শিকার হলেও বিশ্ব একদিনের ক্রিকেটে এটি ৮২ তম রিটায়ার্ড নট আউট হওয়ার ঘটনা।
১৯৭১ সালে একদিনের ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালে শ্রীলংকান দুলিপ মেন্ডিস অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যাট করার সময় ব্যক্তিগত ৩২ রানে ইনজুরিতে পড়ে রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন, একই ম্যাচে ২য় ব্যাটসম্যান হিসাবে শ্রীলংকান সুনীল উইটেমুনি ৫৩ রান করে রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন শ্রীলঙ্কার আরেক ব্যাটসম্যান রোশান মাহানামা। তিনি তার ক্যারিয়ারে ৪ বার রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে মাঠ ছাড়েন। এছাড়া ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা এবং সনাৎ জয়াসুরিয়া তিনবার রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছেড়ে শেষপর্যন্ত রিটায়ার্ড নট আউট হয়ে ইনিংস শেষ করেন।
টেস্ট এবং ওডিআই’র অনেক পরে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয়। স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই ক্রিকেট ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা খুব বেশি একটা ঘটে নি। এখন পর্যন্ত ৮ জন ব্যাটসম্যান রিটায়ার্ড নট আউট থেকে নিজেদের ইনিংস শেষ করেছেন।
টেস্ট খেলুড়ে দেশের তুলনায় সহযোগী দেশের ক্রিকেটারদের ফিটনেসের ঘাটতি থাকে। ৮ জন ক্রিকেটারদের মধ্যে ৪ জনই সহযোগী দেশের ক্রিকেটার এবং রস টেইলর একাই দুবার রিটায়ার্ড নট আউট থেকেছেন। এছাড়া মুশফিক একবার এবং জিম্বাবুয়ের মুতুম্বামি একবার রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে নট আউট থেকেছেন।