Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সম্ভাবনার সমীকরণ বদলে দেওয়া সেই ওয়ানডে সিরিজের গল্প

কিছুদিন আগেশতাব্দীর সেরা ওয়ানডে সিরিজ  শিরোনামে আমরা একটা ফিচার করেছিলাম, যেখানে ২০০৪ সালের ভারত-পাকিস্তান ওয়ানডে সিরিজকে শতাব্দীর সেরা সিরিজ হিসেবে বিবেচনা করে সেই সিরিজ নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছিলো। সেই ফিচারে অনেকেই অন্য আরেকটি সিরিজ নিয়ে বিস্তারিত লেখার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। সেটি হচ্ছে ২০০৬ সালের অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। ২০০৪ সালের ভারত-পাকিস্তান ওয়ানডে সিরিজের মতো ২০০৬ সালের অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটাও বেশ কিছু কারণে মাহাত্ম্যপূর্ণ। আজকের ফিচারে আমরা সেই ঐতিহাসিক সিরিজ নিয়েই জানবো, কেন সেই সিরিজটি শতাব্দীর অন্যতম সেরা সিরিজ সেটা নিয়েও আলোচনা করবো। 

প্রথম ওয়ানডে

২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ সফরে দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় অস্ট্রেলিয়া। সেসময়ের অস্ট্রেলিয়া দল ছিল ভীষণ প্রতাপশালী, আগের দুই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া তখন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তাদের কাছে সিরিজ জয়টা খুবই সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিলো। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা দলটা অস্ট্রেলিয়া দলের মতো অমন দাপুটে না হলেও গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বাধীন সেই দল বেশ ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। তাছাড়া খেলাটা প্রোটিয়াদের ঘরের মাঠেই অনুষ্ঠিত হবে। তাই বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা সহজে ছাড় পাবে না এটা শুরু থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিলো। 

২৬ ফেব্রুয়ারি সেঞ্চুরিয়নে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। তবে মাত্র ২৫ রানের মধ্যে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে শুরুতেই বেশ চাপে পড়ে যায় অজিরা। মাইকেল ক্লার্ক ও মাইকেল হাসির ১০০ রানের জুটিতে বেশ ভালোভাবেই খেলায় ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে ক্লার্ক ও হাসি দুজনই সাজঘরে ফিরে গেলে আবারো কোণঠাসা হয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। শেষদিকে লোয়ার অর্ডারে ব্রেট লি ২৮ বলে ৩৮ রান করায় নির্ধারিত ৪৭ ওভার শেষে ৮ উইকেটে ২২৯ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় অস্ট্রেলিয়া। প্রোটিয়া পেসার শন পোলক ১০ ওভার বল করে মাত্র ২৩ রান খরচায় ৩টি উইকেট তুলে নেন।

প্রথম ওয়ানদেতে অনবদ্য সেঞ্চুরির পর স্মিথ; Image Source : Gettyimages

ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে দক্ষিণ আফ্রিকার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ ওভারে ২৩৩ রান ঠিক হয়। সেই লক্ষ্যে খেলতে নেমে মাত্র ২৮ রানের মাঝে ডিপেনার ও গিবস সাজঘরে ফিরে গেলে কিছুটা চাপের মুখে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের সাথে তরুণ এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৮৩ রানের জুটিতে খেলার নিয়ন্ত্রণ প্রোটিয়াদের কাছে চলে আসে। মাত্র ৩০ বলে ৪৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ডি ভিলিয়ার্স ফিরে গেলেও স্মিথ ধীরে-সুস্থে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।

স্মিথ যখন সেঞ্চুরি পূরণ করেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ১৭৬/৪। সেসময়ে আবারো বৃষ্টি আঘাত হানলে খেলা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে, খেলা আবার শুরু হলে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৪১ ওভারে ২০৪ রান। কেম্প আর স্মিথের ৭৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ৬ উইকেট হাতে রেখেই সেই লক্ষ্যমাত্রায় সহজেই পৌঁছে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১২৪ বলে ১১৯ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলায় গ্রায়েম স্মিথকেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।  

দ্বিতীয় ওয়ানডে

৩রা মার্চ কেপটাউনে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। এ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো ব্যাটসম্যান বড় ইনিংস না খেলতে পারলেও ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম সাতজন ব্যাটসম্যানই মোটামুটি অবদান রাখায় ২৮৯ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এদের মধ্যে হার্শেল গিবস ৬৬ রান ও জাস্টিন কেম্প মাত্র ৪১ বলে ৫১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন।   

মাখায়া এনটিনির বোলিং তোপে তছনছ হয়ে যায় অজিদের ব্যাটিং লাইনআপ; Image Source : Gettyimages

জবাব দিতে নেমে প্রোটিয়া পেসার মাখায় এনটিনির বোলিং তোপে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় অজিদের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। মাত্র ৩৩ রানের মধ্যে টপ অর্ডারের প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানকে হারায় অস্ট্রেলিয়া। আর এই পাঁচটি উইকেটই নিয়েছিলেন এনটিনি। সেই ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া, মাত্র ৮৯ রানেই গুটিয়ে যায় অজিদের ইনিংস। ২২ রানে ৬ উইকেটের অসাধারণ এক স্পেলের কারণে ম্যাচসেরার পুরস্কার এনটিনির হাতেই ওঠে। আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৬ রানের বিশাল এই জয়ে পাঁচ ম্যাচ সিরিজে ২-০ তে এগিয়ে যায় প্রোটিয়ারা।  

তৃতীয় ওয়ানডে

যে দুরন্ত অস্ট্রেলিয়াকে একম্যাচে হারানোটাই সেসময়ের অন্যতম দুঃসাধ্য কাজ ছিল, তাদের বিপক্ষে ১৯৬ রানের বিশাল জয় দিয়ে সিরিজে ২-০ তে এগিয়ে যাওয়ায় প্রোটিয়ারা আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় উঠে গিয়েছিলো। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার তখন বাঁচা-মরা অবস্থা, সিরিজ জিততে গেলে বাকি তিন ম্যাচই জিততে হবে। যেকোনো দলের জন্যই এটা বেশ দুরূহ কাজ ছিল। তবে আগের দুই ম্যাচ মিস করা অধিনায়ক রিকি পন্টিং এ ম্যাচে ফেরায় অজিরা কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। পোর্ট এলিজাবেথে টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নামে অস্ট্রেলিয়া। রিকি পন্টিং ও ডেমিয়েন মার্টিনের ফিফটিতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ২৫৪ রানের মাঝারি মানের সংগ্রহ দাঁড় করায় অস্ট্রেলিয়া।  

ব্রেট লির দুর্দান্ত বোলিং অজিদের সিরিজে টিকিয়ে রাখে; Image Source : Gettyimages

জবাব দিতে নেমে মাত্র ৬৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে ষষ্ঠ উইকেটে এবি ডি ভিলিয়ার্স ও শন পোলকের ১২০ রানের জুটিতে জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু মাত্র ৪ রানের ব্যবধানে পোলক ও ডি ভিলিয়ার্স দুজনই আউট হয়ে গেলে আবারো পথ হারায় প্রোটিয়ারা। শেষপর্যন্ত ১৬ বল বাকি থাকতেই ২৩০ রানে গুটিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ৪ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার এই ২৪ রানের জয়ে বড় অবদান রাখায় ম্যাচসেরা হিসেবে ব্রেট লি নির্বাচিত হন। 

চতুর্থ ওয়ানডে

ডারবানে চতুর্থ ওয়ানডেতে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। তবে নাথান ব্র্যাকেনের বোলিং তোপে মাত্র ৯ রানের মধ্যে স্মিথ ও গিবস আউট হয়ে গেলে শুরুতেই কিছুটা বিপাকে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ডি ভিলিয়ার্সের সাথে বোয়েটা ডিপেনারের ৭২ রানের জুটিতে প্রাথমিক ধাক্কাটা মোটামুটি সামলে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে এই জুটি ভাঙার পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অন্যপ্রান্তে নিজের কাজে অবিচল থাকেন বোয়েটা ডিপেনার। তার সেঞ্চুরিতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ২৪৬ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। 

জবাব দিতে নেমে গিলক্রিস্ট-ক্যাটিচের ৮৭ রানের জুটিতে উড়ন্ত সূচনা পায় অস্ট্রেলিয়া। তখন মনে হচ্ছিলো হেসেখেলেই ম্যাচটা জিতে যাবে অজিরা। কিন্তু এই জুটি ভাঙার পর ছোটখাটো একটা মড়কের ফলে ১০১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন অ্যান্ড্রু সায়মন্ডস। তবে অন্য কোনো ব্যাটসম্যান সেদিন সায়মন্ডসকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারছিলেন না। ৭১ বলে ৭৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে যখন সায়মন্ডস সাজঘরে ফিরে যান তখন অজিদের সংগ্রহ ৪৩ ওভারে ২১৮/৭। 

শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের পর উল্লসিত মাইক লুইস ও স্টুয়ার্ট ক্লার্ক; Image Source : Gettyimages

কিন্তু এর পরের বলেই এনটিনির বলে কট বিহাইন্ড হয়ে ব্রেট লি ফিরে গেলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রোটিয়াদের কাছে চলে যায়। ৪১ বলে মাত্র ২৯ রান লাগলেও উইকেটের অভাবে অজিদের হারই তখন সম্ভাব্য ফল হিসেবে মনে হচ্ছিলো। তবে স্টুয়ার্ট ক্লার্কের ক্যামিওতে জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অজিরা যখন জয় থেকে মাত্র ৬ রান দূরে, তখন অ্যান্ড্রু হলের দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে সাজঘরে ফিরে যান ব্র্যাকেন। ম্যাচে তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, অজিদের দরকার মাত্র ৬ রান আর প্রোটিয়াদের দরকার একটিমাত্র উইকেট। তবে সেই একটি উইকেটের দেখা দক্ষিণ আফ্রিকা আর পায়নি, চূড়ান্ত নাটকীয় এই ম্যাচ ১ উইকেটে জিতে সিরিজে ২-২ এ সমতা ফেরায় অস্ট্রেলিয়া। তবে দল হারলেও ডিপেনার ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন। 

৫ম ওয়ানডে: ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ

১২ মার্চ জোহানেসবার্গে সিরিজের পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডেতে মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। এ ম্যাচ যারা জিতবে তারাই জিতে নিবে সিরিজ। তাই স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচটি নিয়ে ভক্তদের আগ্রহের কমতি ছিল না। সিরিজ নির্ধারণী এই ম্যাচ বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এমনটা সবাই প্রত্যাশা করছিলো। কিন্তু জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম ক্রিকেট ভক্তদের জন্য ঠিক কতটা চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিলো তা হয়তো কেউই ম্যাচ শুরুর আগে অনুমান করতে পারেনি।

জোহানেসবার্গের ব্যাটিং স্বর্গে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং। দুই ওপেনার গিলক্রিস্ট ও ক্যাটিচের ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে ভর করে উড়ন্ত সূচনা পায় অস্ট্রেলিয়া। মাত্র ১৫.২ ওভারে ৯৭ রানের জুটি গড়ে ব্যক্তিগত ৫৫ রানে যখন গিলক্রিস্ট সাজঘরে ফিরে যান তখন ক্রিজে আসেন অধিনায়ক রিকি পন্টিং। এই ওয়ান্ডারার্সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে ১৪০ রানের দানবীয় এক ইনিংস খেলেছিলেন পন্টিং, তিন বছর আগের সেই স্মৃতি আবারো এ ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন পন্টিং। মাত্র ৭১ বলে সেঞ্চুরি পূরণ করেন অজি অধিনায়ক। 

রিকি পন্টিংয়ের দানবীয় ইনিংসে ভর করে প্রথম দল হিসেবে ওয়ানডেতে ৪০০ রান করার রেকর্ড গড়ে অজিরা; Image Source : ICC

সেঞ্চুরি করার পর আরো আগ্রাসী হয়ে যান পন্টিং, শেষপর্যন্ত ১০৫ বলে ১৬৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে আউট হন পন্টিং। পন্টিংয়ের এই ইনিংসের সাথে মাইক হাসির ৫১ বলে ৮১ রানের ঝড় ইনিংস ও সায়মন্ডসের ১৩ বলে ২৭ রানের ক্যামিওতে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৪৩৪ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড় করায় অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম চার শতাধিক রান সংগ্রহের রেকর্ড। এ ম্যাচের শেষ দশ ওভারে রীতিমত তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিলো অজিরা, সেই তাণ্ডবে প্রোটিয়া বোলারদের বড্ড বেশি অসহায় লাগছিলো।

অস্ট্রেলিয়া যখন ৪৩৫ রানের প্রায় অসম্ভব লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দেয় তখন দক্ষিণ আফ্রিকার বড় হার ছাড়া অন্য কোনো ফলাফল খুব দর্শকই ভাবতে পেরেছিলো। কিন্তু একজন মানুষ ইনিংস বিরতির সময়ে এই রান তাড়ার ব্যাপারে আশার কথা শুনিয়েছিলেন। তিনি হলেন প্রোটিয়া অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস। ৪৩৫ রান তাড়ার চিন্তায় প্রোটিয়া সাজঘরে যখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা তখন ক্যালিস বলে ওঠেন, “আমার মনে হয় আমাদের বোলাররা তাদের কাজটা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছে! পিচ দেখে মনে হয়েছে এটা ৪৫০ রানের পিচ, সেই হিসেবে আমরা অজিদের ১৫ রান কমে আটকে দিতে পেরেছি। এখন সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের ব্যাটসম্যানদের উপরেই।”

ক্যালিসের এই কথার পর দক্ষিণ আফ্রিকা শিবির কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। কিন্তু অসম্ভব এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দলীয় ৩ রানের সময়ে সাজঘরে ফিরে যান আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান বোয়েটা ডিপেনার। তবে কিছুটা ধীরগতির ব্যাটসম্যান ডিপেনারের এই আউট হওয়াটা প্রোটিয়াদের জন্য শাপে বর হয়ে আসে। তিন নাম্বারে খেলতে নামা মারকুটে ব্যাটসম্যান হার্শেল গিবস অধিনায়ক স্মিথের সাথে নিয়ে ধুন্ধুমার মেজাজে ব্যাট করা শুরু করেন। এই জুটির তাণ্ডবে প্রথম দশ ওভারে ৮০ রান তুলে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা।

ওয়ান্ডারার্সের ছোট বাউন্ডারির সুবিধা কাজে লাগিয়ে পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পরেও দ্রুত গতিতে রান তুলে যাচ্ছিলো স্মিথ-গিবস জুটি। মাত্র ১২৭ বলে ১৮৭ রানের জুটি গড়ে এই বিশাল রানচেজের শক্ত ভিতটা গড়ে দেন এ দুজন। ৫৫ বলে ৯০ রানের টর্নেডো ইনিংস খেলে মাইকেল ক্লার্কের বলে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ দিয়ে আউট হন গ্রায়েম স্মিথ। অধিনায়ক চলে গেলেও অপরপ্রান্তে গিবস ছিলেন অবিচল। ডি ভিলিয়ার্সের সাথে গিবসের ৯৪ রানের জুটিতে ডি ভিলিয়ার্সের অবদান ছিল মাত্র ১৪ রান! ২১টি চার আর সাত ছক্কায় ১১১ বলে ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে যখন গিবস আউট হন তখন প্রোটিয়াদের সংগ্রহ ৩১.৫ ওভারে ২৯৯/৪। মজার ব্যাপার হচ্ছে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকার কারণে গিবসের এ ম্যাচ খেলারই কথা ছিল না! 

গিবসের অনবদ্য ইনিংসে ভর করেই অসম্ভব সেই লক্ষ্যমাত্রার পেছনে ছুটতে থাকে প্রোটিয়ারা; Image Source : cricket.com.au

গিবস আউট হলেও অসম্ভব সেই লক্ষ্যপূরণের পথটা ততক্ষণে বেশ মসৃণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকায় সেই মসৃণ পথটাও একসময়ে বন্ধুর হয়ে যায়। এ সময়ে দলের হাল ধরেন অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক মার্ক বাউচার, একপ্রান্ত আগলে রেখে আস্তে আস্তে দলকে জয়ের দিকে এগিয়ে নিতে থাকেন। বাউচারকে যোগ্য সঙ্গ দেন ভ্যান ডার ওয়াথ। শেষ আট ওভারে চার উইকেট হাতে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল ৮০ রান। অর্থাৎ প্রতি ওভারে দশ রান। ভ্যান ডার ওয়াথের ১৮ বলে ৩৫ রানের ক্যামিও দক্ষিণ আফ্রিকাকে খেলায় ধরে রাখে।

এরপর রজার টেলামাচুসের সাথে বাউচারের ১১ বলে ২৪ রানের জুটি ম্যাচটাকে দক্ষিণ আফ্রিকার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। টেলামাচুস যখন আউট হন, তখন প্রোটিয়াদের জয়ের জন্য দরকার ১০ বলে ১২ রান, হাতে আছে ২ উইকেট। শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ছিল ৭ রান। প্রথম বলে সিঙ্গেল নেন বাউচার। পরের বলে অ্যান্ড্রু হল যখন চার মারেন, তখন প্রোটিয়াদের এই অসম্ভব জয়টাকেই খুব বেশি সম্ভব মনে হচ্ছিলো। কিন্তু চূড়ান্ত এই নাটকীয় ম্যাচে আবারো নাটকীয় মোড়, ব্রেট লির পরের বলে ক্লার্কের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট অ্যান্ড্রু হল! জয়ের জন্য অজিদের দরকার আর মাত্র ১ উইকেট আর প্রোটিয়াদের মাত্র ২ রান! তারচেয়েও বড় কথা, ক্রিজে আসছেন মাখায়া এনটিনির মতো পুরোদস্তুর এক বোলার।

ম্যাচে তখন টানটান উত্তেজনা, এনটিনি কি পারবেন একটা সিঙ্গেল নিয়ে বাউচারকে ক্রিজে আনতে? নাকি সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মতো আবারো প্রোটিয়ারা তীরে এসে তরী ডুবিয়ে নিজেদের আরেকবার চোকার্স হিসেবে প্রমাণ করবে? বল করলেন ব্রেট লি, সেই বল কোনোমতে থার্ডম্যান অঞ্চলে পাঠিয়ে সিঙ্গেল নিলেন এনটিনি। দুই দলের স্কোরই তখন সমান, জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার আর একটি মাত্র রান। বাকি কাজটুকু ঠাণ্ডা মাথায় সারলেন বাউচার, মিড অফের উপর দিয়ে চার মেরে অসম্ভব সেই জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় দলকে পৌঁছে দেন বাউচার। এই ম্যাচ জয়ের সাথে ৩-২ ব্যবধানে প্রোটিয়াদের সিরিজ জয়টাও নিশ্চিত হয়ে যায়। 

মহাকাব্যিক সেই জয়ের পর উল্লসিত এনটিনি ও বাউচার; Image Source : cricketcountry.com

স্টেডিয়ামের স্বাগতিক দর্শকরা আনন্দে মাতোয়ারা, কিছু দর্শক তখনো হয়তো নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। ৪৩৪ রান তাড়া করে সিরিজ জয়- এও কি সম্ভব! তখন দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়েরা চোকার্স বদনাম ঘোচানোর আনন্দে মাতোয়ারা। প্রোটিয়া খেলোয়াড়দের এমন আনন্দের বিপরীতে ১ উইকেটের এই হারে অজিদের চোখে-মুখে তখন রাজ্যের হতাশা। বিশেষ করে অধিনায়ক রিকি পন্টিং যেন কিছুতেই এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে ম্যাচ হারলেও এই ম্যাচকে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ হিসেবেই বর্ণনা করেছিলেন অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং।  

মহাকাব্যিক এ ম্যাচে ম্যাচসেরা হিসেবে একজন নয়, দুজনকে নির্বাচিত করা হয়। রিকি পন্টিং ও হার্শেল গিবসকে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর পুরো সিরিজে অসাধারণ বোলিংয়ের সাথে ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সিরিজসেরার পুরস্কারটি পান শন পোলক।

বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে সিরিজ জেতার পর আনন্দে মাতোয়ারা প্রোটিয়ারা; Image Source : Getty Images

সবমিলিয়ে এই সিরিজের মাহাত্ম্য অন্যরকম, দ্বিতীয় ম্যাচে বাজেভাবে হেরে ২-০ তে পিছিয়ে যাওয়ার পরেও অজিরা যেভাবে ফিরে এসেছিলো সেটা সত্যিই অনন্য। বিশেষ করে চতুর্থ ম্যাচে অজিদের ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের ম্যাচটা সিরিজের মান আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে জোহানেসবার্গের মহাকাব্যিক সেই ম্যাচ, এক একটি ম্যাচই সিরিজের ওজন অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আধুনিক ক্রিকেটে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়, যেকোনো লক্ষ্যমাত্রাই অতিক্রম করা সম্ভব – এই বার্তাটা জোহানেসবার্গের সেই ম্যাচ বেশ ভালোভাবেই দিয়েছিলো। অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মতে, জোহানেসবার্গের এই ঐতিহাসিক ম্যাচটিই সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ম্যাচ। 

সর্বকালের সেরা ম্যাচ কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আধুনিক ক্রিকেটের সম্ভাবনার সমীকরণ ঐ একটা ম্যাচের কারণে অনেকখানি বদলে গেছে এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অন্যান্য সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচগুলো অনেক নাটকই জন্ম দিয়েছে, তবে জোহানেসবার্গের এই মহাকাব্য সব নাটককে অনেক বড় ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছে।

সেই ম্যাচের পর এক যুগ কেটে গিয়েছে, আধুনিক ক্রিকেটে ৪০০ রান করাটাও সহজলভ্য হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ৪৩৪ রান তাড়ার রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। ভবিষ্যতে কেউ এই রেকর্ড ভাঙলেও প্রোটিয়াদের এই কীর্তি সবার উপরেই হয়তো রয়ে যাবে, কারণ শুরুর ইতিহাস রচয়িতাদের মহিমাটাই যে আলাদা।  

ফিচার ইমেজ : cricketcountry.com

Related Articles