বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কে? জার্মানি। আরেকটু বাড়ালে বলা যায় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ধারাবাহিক দলও এই জার্মানিই। টানা ছয়টা সেমিফাইনাল খেলেছে তারা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের। এই যাত্রার শুরু হয়েছিল দারুণ এক লজ্জা থেকে। হ্যাঁ, ইউরো ২০০০ এর লজ্জা। সেবার জার্মানি গ্রুপ পর্বের তলানীতে থেকে প্রথম রাঊন্ডেই বিদায় নেয়। পুরো গ্রুপ পর্বের খেলায় মাত্র এক গোল করতে পেরেছিলো তারা, তাও রোমানিয়ার সাথে এবং তাতে লাভ হয়নি, ম্যাচটি ড্র হয়েছিল। এটা যদি হয় সবল ফিনিক্সের ছাই হয়ে যাওয়া, তবে তার পরের এক যুগ ভস্ম থেকে পুনরুত্থানের।
নব্বইয়ের দশকে কোচ ভেরতি ভগস প্রায়ই বলতেন জার্মানির নতুন ট্যালেন্ট ফ্লো কমে আসছে, কেউ তেমন গা করতেন না। এই ভেরতি ভগস ‘৯৬ এ জার্মানিকে ইউরো জেতান। দেশ যখন আনন্দে ভাসছে, তখনও তিনি বললেন একাডেমি বাড়ানো বা ট্যালেন্ট তুলে আনার কথা। ফেডারেশন আবারও গা করলো না, সদ্য ইউরো সেরা বলে কথা। তবে ফলতেও বেশী সময় লাগলো না। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে কোয়ার্টারে ক্রোয়েশিয়ার সাথে ৩-০ তে হেরে যায় জার্মানি, আসল বিপদ আসে নি তখনো। ২০০০ ইউরোতে কোনো ম্যাচ না জিতে তলানিতে থেকে গ্রুপ থেকেই বাদ পরে তারা। এবার আসলেই টনক নড়লো, হাতে নিলো বিশাল প্রকল্প পুরো স্ট্রাকচার ঢেলে সাজানোর।
জার্মান ফুটবল এসোসিয়েশন একটা কথা প্রায়ই বলে যেটা পুরো বর্তমানকে ব্যাখ্যা করে দেয়,
“কোনো স্কিলফুল বা ট্যালেন্ট প্লেয়ার যদি আল্পসের পাদদেশেও জন্মায়, আমাদের সিস্টেম তাকে ঠিকই বার্লিনে নিয়ে আসবে!”
কিভাবে? জার্মানিতে বর্তমানে আঞ্চলিক ফুটবল একাডেমি ৩৬৬টি।
একটু সংখ্যার মাহাত্ম্যে আসি। জার্মানির আয়তন বাংলাদেশের ২.৫ গুণ। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার হিসেবে ওখানে জেলা ধরি ৬৪*২.৫=১৬০টি। তাদের আঞ্চলিক একাডেমি ৩৬৬টি। অর্থাৎ আপনি যে জেলায় বসে আছেন, ধরা যায় এতটুকু এলাকার জন্য জার্মানিতে প্রায় দুইটি করে একাডেমি আছে। এই ৩৬৬টি একাডেমিতে ফিফা লাইসেন্সধারী কোচ আছে ১৩০০ জন। অর্থাৎ আপনার জেলার মতো জার্মানির এই সমান জায়গায় ফিফার লাইসেন্সড কোচ আছে চারজন যারা কেবল ট্যালেন্ট তুলে আনে। এখান থেকে মোস্ট স্কিলড প্লেয়ারগুলোকে নেক্সট হায়ার একাডেমিতে পাঠানো হয় যদি না কোনো ক্লাব এরই মধ্যে না নেয়। এমন হায়ার একাডেমি সংখ্যা ৫২টি! খোঁজ নিলে দেখা যাবে এমন কাছাকাছি তবে কম কার্যকর স্ট্রাকচার আরো কিছু দেশে আছে। তবে ফারাক কোথায়?
ফারাক হলো, জার্মান জাতীয় দলে কোচ স্ট্যাবিলিটি। বর্তমান কোচিং স্টাফ-সেট এর বেইজটা আসে ২০০৪ এ ক্লিন্সম্যান কোচ হওয়ার পর থেকেই। এর আগে জার্মানিকে সবাই মেশিন হিসেবেই বেশী জানত, খেলায় পাওয়ার থাকত বেশী, সৌন্দর্য কম। ক্লিন্সম্যান জার্মানির পুরো ধাচটাই বদলে দেন। জার্মানির আক্রমণাত্মক খেলা দেশে বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত হয়। ২০০৬ এ ক্লিন্সম্যান চলে গেলে সবাইকে অবাক করে ফেডারেশন নিয়োগ দেয় অখ্যাত তাঁর সহকারী বর্তমান বিশ্বকাপ জয়ী জোয়াকিম লো কে, যেন ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
জার্মান খেলা আগে অতিরিক্ত পাওয়ার, লং বল বেজড থাকায় খাটো, শারীরিকভাবে দুর্বল কিন্তু স্কিলফুল প্লেয়ারদের উঠে আসতে কষ্ট হতো। ক্লিন্সম্যান-লো এর খেলার ধরনে লং বল, পাওয়ার ফুটবলের চেয়ে স্কিল বেশী প্রাধান্য পাওয়ায় জাতীয় দলে ওজিল, গোতজে, লাম রা সহজেই চান্স পেতে থাকে। আর একাডেমিতে তরুণ খেলোয়াড়দের জাতীয় দলের আদলেই খেলানো হয়। যেহেতু ২০০৪ থেকে এখনো একই ফিলসফি জাতীয় দলে চলছে, তাই একাডেমিগুলোও সহজে জাতীয় দলের আদলে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান ফুটবলকে একটু মাথা খাটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, একজন মেসি রোনালদোর মতোই সমান গুরুত্ববহ একজন পিরলো, জাভি বা ক্রুস (যথাক্রমে ইতালি ২০০৬, স্পেন ২০১০ ও জার্মানি ২০১৪ বিশ্বকাপের নেপথ্য নায়ক) এর মতো সেন্টার মিডফিল্ডার। গত দশকে স্পেন ছাড়া জার্মানির মতো এত ক্লাসিক সেন্টার মিডফিল্ডার, প্লে-মেকার কেউ ডেভেলপ করেনি। জাতীয় দলের খেলাও পাসিং বেজড, একাডেমিতেও পাসিং বেজড খেলা প্রেফার করা হয়, আর উঠেও আসছে দারুণ সব প্লে-মেকার।
সব কি এত সহজ ছিল? না। জার্মানির ট্যালেন্ট তুলে আনার প্রক্রিয়া ২০০০ এর আগে এতটাই বাজে ছিল যে ২১ বছর বয়সেও বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশী গোলদাতা ক্লোসা ৫ম বিভাগে খেলত! ২০০০ এর সেই ধাক্কার পর সবাই যখন ইয়ং প্লেয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য সচেতন হয়, তখনই একটা শাপে বর হয়ে আসে টিভি ক্রাইসিস। কোনো এক ঝামেলায় টিভি বিজ্ঞাপন স্বত্ব নিয়ে ক্লাবগুলা বিপদে পড়ে যায়। বলা বাহুল্য টিভি স্বত্বের টাকা ক্লাবের বিশাল টাকার উৎস। এই ঝামেলার জন্য ক্লাবগুলোয় টাকার ফ্লো কমে গেল, বায়ার্ন বাদে আর কেউ টাকা দিয়ে প্লেয়ার কেনার অবস্থায় ছিল না। বাধ্য হয়ে নিজেদের স্থবির একাডেমি চালু করে ট্যালেন্ট তুলে আনায়। দ্বিতীয়ত কারণ ছিল জাত্যাভিমান। জার্মানির ক্লাবগুলো ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের মতো ব্যক্তি মালিকানাধীন নয়, সমর্থকদের টাকায় চালিত। ফলে ফ্যান বেইজড কালচার খুব শক্ত। স্পেন বা ইংল্যান্ডে প্রায়ই দেখা যায় জাতীয় দলের চেয়ে ক্লাবের টান বেশী। জার্মানিতে তাঁর উল্টো। একজন জার্মান এলাকার যে ওই এলাকার ক্লাবের সদস্য সে তাঁর ক্লাব ভালো করলে যতটা খুশি হয়, ঠিক ততটাই খুশি হয় তাদের একাডেমির একজন জাতীয় দলে ভালো করলে। সব মিলিয়ে ফ্যান বেজড কালচার, জাত্যাভিমান একটা বড় কারণ ছিল এবং আছে।
তৃতীয় এবং অবশ্যই নিয়ম। সব জার্মান ক্লাবকেই প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। ফেডারেশন প্রতিটা ক্লাবের ইয়ুথ একাডেমি থাকা এবং কিছু নিয়ম কানুন এমন শক্ত করে দিল যে ক্লাবগুলোও বাধ্য হলো। ফলে কাজটা ত্বরান্বিত হয়। এমন চেষ্টা ব্রাজিলে করেও ক্লাবগুলোর দ্বন্দে আর করা হয়নি। জার্মানিতে কিভাবে হলো? কর ও ব্যাঙ্ক ঋণ সংক্রান্ত এক ঝামেলার সময় বায়ার্ন তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দী বরুশিয়া ডরটমুন্ডকে ঋণখেলাপী হওয়া থেকে বাঁচায়- এমন কিছু আরো ছোট ঘটনার জন্য পারস্পরিক অবিশ্বাস অন্যান্য দেশের মতো নয়। বর্তমানে আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, বায়ার্নের একাধিপত্যে লীগ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বায়ার্নের লেভেল অন্যদের ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে অনেকাংশে। একটা দল যখন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় থাকে, সে পরীক্ষিত প্লেয়ারদের বেশী খেলায়, তরুণ খেলোয়াড় খেলানোর ঝুঁকি নেয় না। গত পাঁচ বছরে বায়ার্ন যে লেভেলে পৌছেছে, লীগে কম্পিটিশন কম, তাই ২, ৩, ৪, ৫ র্যাঙ্কের ক্লাবগুলোও যথেষ্ট তরুণ প্লেয়ার খেলাতে সুযোগ পায়। সহজ ইমিগ্রেশন পলিসির কারণে তুরস্ক, পোল্যান্ড বা আফ্রিকান অরিজিনের বেশ অনেক প্লেয়ার ইয়ুথ র্যাঙ্কে রয়েছে। ক্লোসা, পোদোলস্কি, ওজিল, বোটেং, গুন্দোগান, খেদিরা এদের মতো অনেক বিখ্যাত জার্মান জাতীয় দলের অরিজিন নন-জার্মান। অথচ পিওর ব্রাজিলীয় একজন প্লেয়ার যদি খুব তরুণ বয়সেই ইউরোপে খেলতে চলে আসে তাদের লীগ না খেলেই, তবে তাকে অতটা আপন করে অনেক সময়ই দেখা হয়না, এমন উদাহরণ অনেক আছে।
ফ্রেইবারগ ক্লাবটার একটা উদাহণ টানা যায়। ছোট ক্লাব, তলানির দিকেই থাকে। পুরো সিজন বাজেট ১৭ মিলিয়নের আশেপাশে, রিয়ালে এক রোনালদোর বেতনই ১৫ মিলিয়ন! এত প্লেয়ার বাইরে থেকে কেনা সম্ভবও না তাদের। উপরন্তু ভৌগোলিক অবস্থানও সীমান্তবর্তী। তাদের ২৩ জনের দলের ১৬ জনই জার্মান যার ১০ জন আবার তাদের একাডেমির। সিজনের লাস্ট ম্যাচটা জিতলে তারা ইউরোপা খেলতে পারত- এমন অবস্থায় জার্মানির জীবন্ত কিংবদন্তী কাইজার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তাদের সমর্থনে স্টেডিয়ামে যান, কেবল তাদের এই অল্প সামর্থ্যের মধ্যে একাডেমির মাধ্যমে উপরে উঠার প্রচেস্টাকে সমর্থন দেয়ার জন্য। যদিও তারা হেরে যায় ওই ম্যাচ, কিন্তু ফ্রেইবারগ এখন অনেকের কাছেই একটা উদাহরণ। ২০০০ সালের পর এমন অনেক ক্লাব উপরে উঠতে চেয়েছে কেবল টাকার জোরে নয়, নিজেদের একাডেমির গরজে, যেটা বদলে দিয়েছে জার্মান ফুটবল।
জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান প্রধান গ্রিন্ডেল যখন দায়িত্ব নেন এ বছর, তৃপ্তির চেয়ে চিন্তাই ছিল বেশী যে কিভাবে এই সিস্টেমের উন্নতি করবেন যেটা অলরেডি স্বয়ংসম্পূর্ণ! উনার ভাষায়,
“২০০০ সালে যদি এই চেয়ারে বসতাম, তবে চিন্তায় শেষ হয়ে যেতাম কিভাবে এত বড় পুনর্গঠন করব। এখন চিন্তায় আছি কিভাবে, আর কোন দিকটায় একটু উন্নতি করা যায়! আগে আমরা উপদেশের জন্য অনেক দেশের কাছে গিয়েছি, এখন তারাই আসে!”
এটাই জার্মানির পুনরুত্থানের সারমর্ম।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপ তাদের পরিকল্পনা, ধৈর্য, টানা সেমিফাইনাল হারার পরেও বিশ্বাস অটুট রেখে চলার ফসল। ছাই থেকে ফিনিক্সের নবরুপের আসল পরিণতিই এই বিশ্বকাপের মাধ্যমে এসেছে। এই সাফল্যের প্রতিটা প্রশংসার যোগ্য দাবিদার তারা তাদের এই পরিকল্পনার সফল রুপায়নের জন্য। আর বিশ্ব সবসময়ই বিজয়ীকেই কুর্নিশ করে, জার্মানি সে যোগ্য বিজয়ী।