লা মাসিয়া থেকে বার্সেলোনার মূল দলে জায়গা করে নিতে পেরেছে এমন সর্বশেষ খেলোয়াড় হলেন সার্জি রবার্তো। সার্জি রবার্তোর সাথে এবং তার পরে অনেক নতুন মুখ বার্সেলোনাতে দেখা গেলে থিতু কেউ হতে পারেনি। বর্তমানে কার্লোস আলেনা, ওরিওল বুসকেটস বা রিকি পুইগ প্রতিভা ছড়ালেও তাদেরকে বার্সেলোনা এখনও মূল দলে জায়গা করে দেয়নি।
প্রথমে সার্জি রবার্তোর বার্সেলোনাতে থিতু হবার গল্পটি জানা যাক। পেপ গার্দিওলার আমলে লিগের ছোট দলের বিপক্ষে মাঝেমধ্যে তাকে দেখা গেলেও নিয়মিত মূল দলে তাকে সুযোগ করে দেন লুইস এনরিকে। এনরিকে তার ক্যারিয়ারজুড়ে রবার্তোকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। কখনও মাঝমাঠে, কখনও উইং পজিশনে অথবা রাইট-ব্যাকে সার্জি রবার্তোকে ব্যবহার করতেন তিনি। হয়তো রবার্তোর বহুমুখী প্রতিভা ছিলো, সেজন্য প্রতি পজিশনে তিনি দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিতেন। যদিও লা মাসিয়াতে সার্জি রবার্তো বেড়ে উঠেছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মিডফিল্ডার হয়ে।
অনেকগুলো পজিশনের মাঝে সার্জি রবার্তো সবথেকে বেশি খেলেছেন রাইট-ব্যাক পজিশনে। কারণ দানি আলভেজের কোনো বদলি খেলোয়াড় বার্সেলোনাতে ছিলো না। মূল দলে আরেক লা মাসিয়ান মার্টিন মন্তয়া তেমন কার্যকারী না হবার কারণে “অলরাউন্ডার” খ্যাত সার্জি রবার্তোই দানি আলভেজের পরিবর্তে সবসময় মাঠে নামতেন। কিন্তু আলভেজের বার্সেলোনা ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিলো। তিনি যখন বার্সেলোনা ছেড়ে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান বার্সেলোনার রাইট-ব্যাকে খেলার মতো খেলোয়াড়ের সংখ্যা তখন শূন্য। অ্যালেক্স ভিদাল ছিলেন, তবে তিনি মূলত উইঙ্গার হলেও কাজ চালানোর মতো রাইট-ব্যাকে কিছুটা খেলতে পারেন। সেই বার্সেলোনা সময় হুট করে নতুন রাইট-ব্যাক কেনার অবস্থাতেও ছিলো না। কারণ দলটি একবার ট্রান্সফার নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলো না। তাই সার্জি রবার্তোকে রাইট-ব্যাকে বাধ্য হয়ে খেলাতে শুরু করলেন বার্সেলোনা কোচ। একই সময়ে নতুনভাবে শুরু হলো একজন মিডফিল্ডারকে জোর করে ডিফেন্ডার বানানোর অপচেষ্টা।
সার্জি রবার্তো রক্ষণে খুবই দুর্বল। তার পাস ভালো, পজিশন সেন্স ভালো, ট্যাকল ও মার্কিং মোটামুটি পর্যায়ের। তাই কোনোমতে চলছিলো বার্সেলোনার ডান অংশ। সার্জি রবার্তো আক্রমণাত্মক মনোভাবের কারণে প্রায় সময় তিনি তার পজিশন ছেড়ে উপরে উঠে যেতেন। তাই তার ছেড়ে যাওয়া অংশ পাহারা দিতে হতো ইভান রাকিটিচকে। দানি আলভেজের বিদায়ের পর তাই অনেকদিন ইভান রাকিটিচ বার্সেলোনায় তেমন কার্যকারী ছিলেন না। বার্সেলোনার ডান অংশও ঝিমিয়ে গিয়েছিলো। দুর্বলতা ঢাকতে এমনকি মেসিকেও নিচে নেমে খেলতে হতো অধিকাংশ সময়ে।
বয়সের সাথে সাথে আর একই পজিশনে খেলে বর্তমানে সার্জি রবার্তো বেশ খানিকটা উন্নতি করেছেন। পরিণত না হলেও এখন রাইট-ব্যাকে তার উপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু মাঝেমাঝে কোচ তাকে মিডফিল্ডে ব্যবহার করলে বোঝা যায়, এখনও একজন সঠিক আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডার সত্তা তার ভেতর লুকিয়ে আছে। মধ্যমাঠে আসলে তিনি যেন একদমই বদলে যান। কিন্তু এতকিছুর পরে সার্জি রবার্তো কি আসলেই একজন পূর্নাঙ্গ রাইট-ব্যাকে পরিণত হয়েছেন?
ইনজুরিতে পরে মাঠের বাইরে চলে যাবার আগে রবার্তোকে রাইট-ব্যাকে রেখে ভালভার্দে স্কোয়াড সাজিয়েছেন ৯ ম্যাচে। এই ৯ ম্যাচের ভেতর বার্সেলোনা ক্লিনশিট রেখেছে মাত্র ৩টিতে, গোল হজম করেছে ১২টি। এবং টানা গোল হজম করার পেছনে রবার্তো কতটুকু দায়ী, তা দেখা যাক।
এ মৌসুমে হুয়েস্কাকে বার্সেলোনা ৮-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়েছিলো। কিন্তু দুর্বল এ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বার্সেলোনা ২ গোল খেয়ে ক্লিনশিট হারিয়েছে। হুয়েস্কার হয়ে প্রথম গোলটি করেন কুকো হার্নান্দেজ। কুকোকে যে বলটি তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি হলেন স্যামুয়েল লংগো। মাঠের ডানপাশে তিনি ছিলেন একদমই ফাঁকা অবস্থায়, যেখানে তাকে মার্ক করার কথা ছিলো সার্জি রবার্তোর। দ্বিতীয় গোলের কিছু মুহুর্ত আগে বল যখন বার্সেলোনার ডি-বক্সে বাতাসে ভাসছিলো, তখন একমাত্র রবার্তোই লক্ষ্য করেছিলেন যে, হুয়েস্কা খেলোয়াড় অ্যালেক্স গ্যালার সম্পূর্ণ আনমার্কড অবস্থায়। কিন্তু তার এগিয়ে না যাওয়ার কারণে অগাধ জায়গা পেয়ে মুই গোমেজকে দারুণভাবে ক্রস করেন গ্যালার। দুজনের মাঝমাঝি স্থানে থেকে গ্যালারের করা বুদ্ধিদীপ্ত ক্রস ঠেকানোর কোনো উপায় ছিলো না রবার্তোর।
লা লিগার পরের ম্যাচ লেগানেসের সাথে, যেখানে লেগানেসের বিপক্ষে হেরে তিন পয়েন্ট হারিয়েছিলো বার্সেলোনা। এই লজ্জাজনক হারের পেছনে অঘোষিত দায়ী রবার্তো। তার জঘন্য পারফর্মেন্সের কারণে লেগানেস ২ গোল করার সামর্থ্য পেয়েছিলো। প্রথম গোলের আক্রমণ শুরু হয় মাঠের ডানপাশ থেকে। জোনাথন সিলভাকে কোনোরকম আটকানোর চেষ্টা না করে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সোজা ক্রস করার সুযোগ করে দেন রবার্তো। এই গোলে বার্সেলোনার ডিফেন্ডার টমাস ভারমায়লেনের দোষও আছে। কিন্তু রবার্তো সিলভাকে এই ক্রস করার সুযোগ না দিলে ডি-বক্সে থাকা নাবিল এল জাহার কখনোই বল পেতেন না। দ্বিতীয় গোলের আক্রমণ শুরু হয়েছিলো রবার্তোর অংশ থেকেই। যদিও এ গোলটির পেছনে জেরার্ড পিকের হাত বেশি কিন্তু অস্কার রদ্রিগুয়েজ যখন বল নিয়ে ছুটছিলেন, সার্জি রবার্তো তার পজিশনেই তখন ছিলেন না।
রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে ম্যাচ। বার্সেলোনার প্রথম গোলে লিড নেবার পরও হোসে পজোর গোলে সমতায় ফেরে রায়ো ভায়োকানো। বার্সেলোনার ডি-বক্সে যখন পজো শট নিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, সার্জি রবার্তো তখন পজিশন হারালেও পজোকে আটকানোর কোনো ইচ্ছা তার ভেতর ছিলো না। একজন রাইট-ব্যাকের কাছ থেকে এমন অলসতা কখনই কাম্য নয়। দ্বিতীয় গোলের কারণ সম্পূর্ণ সার্জি রবার্তোর না হলেও তার ভুল লক্ষ্যণীয়। এ ম্যাচে প্রথম থেকে তিনি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় কে কোথায় আছে বা ভায়োকানোর ট্যাকটিস কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা ধরতে পারেননি। এই ফর্মহীনতার ফল দ্বিতীয় গোল।
ইন্টার মিলানের মাঠ থেকে জয় ছিনিয়ে আনা অসম্ভব ছিলো বার্সেলোনার জন্য। তাই কাতালানদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো সম্পূর্ণ ৩টি পয়েন্ট না হারিয়ে ফিরে আসার। কিন্তু ৮৩ মিনিটে ম্যালকমের দুর্দান্ত গোলের পর মনে হচ্ছিল বার্সেলোনা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলবে। তবে শেষ মুহুর্তে সার্জি রবার্তো সব গুবলেট পাকিয়ে ফেলেন। মাউরো ইকার্দির সামনে রবার্তো বল হারিয়েছেন। ইকার্দি বল দুবার স্পর্শ করেন, সময় নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন, রবার্তোকে বোকা বানিয়ে টার স্টেগানকে পরাজিত করে ইন্টারকে ঘরের মাঠে হারা থেকে বাঁচিয়েছেন। আর রবার্তো হেরে গেছেন ইকার্দির গতি আর বুদ্ধির কাছে।
২০১৮/১৯ মৌসুমে লিগে বার্সেলোনার আরেকটি লজ্জাজনক হার। ঘরের মাঠে তারা রিয়াল বেটিসের কাছে ৪ গোল হজম করার লজ্জাজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। বেটিসের প্রথম গোলের দায়ভার সম্পূর্ণ রবার্তোর। নিজের ভুলে জুনিয়র ফির্পোকে শট নেবার জন্য প্রচুর জায়গা দিয়ে ফেলেছিলেন রবার্তো। দ্বিতীয় গোলেও তার ভুল লক্ষ্যণীয়। তিনি দলের খেলোয়াড় না দেখেই অদ্ভুত এক ক্রস দিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও পাশাপাশি মধ্যমাঠ ও আলবার ভুলে ক্রিশ্চিয়ান তেয়ো গোল করান হোয়াকিনকে দিয়ে। চতুর্থ গোলও সম্পূর্ণ তার ভুল। এ সময় তিনি ম্যানমার্কিংয়ে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তার ধারণাই ছিলো না বেটিস উইঙ্গার জুনিয়র ফির্পো কোথায়। টালমাটাল অবস্থা থেকে ফিরে মাঠের পরিস্থিতি যখন বুঝেছেন, ততক্ষণে অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছেন ফির্পো। তার দুর্দান্ত ক্রস ঠেকাতে পারেননি বার্সার দুই সেন্টার-ব্যাকও। ফলে সেখান থেকে সহজ গোল করে বেটিসকে ৪ গোলে এগিয়ে নেন সার্জিও ক্যানালেস।
নতুন মৌসুমের এই অল্প কয়েকটি ম্যাচের ফলাফল বলে দেয়, সার্জি রবার্তো একজন “অলরাউন্ডার” খেলোয়াড় হলেও প্রতিষ্ঠিত কোনো ডিফেন্ডার নন। আর বার্সেলোনা ৪-৩-৩ পজিশন ও ভালভার্দের যে ট্যাকটিসে খেলে, সেখানে রক্ষণের দুপাশের খেলোয়াড়দের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়। যেমনটা একসময়ে দানি আলভেজ করেছেন ও বর্তমানে জর্ডি আলবা করে যাচ্ছেন। বার্সেলোনার লেফট-ব্যাক বা রাইট-ব্যাকদের সাথে আক্রমণের সম্পর্ক কতটা মধুর ও কার্যকর, তার শক্ত প্রমাণ আলবা ও মেসি জুটি।
সার্জি রবার্তোর জন্য বা বার্সেলোনার জন্য হোক, রবার্তোকে রাইট-ব্যাক থেকে সরিয়ে আনা উচিত। কারণ তিনি মাঝে মাঝে যেসব শিশুতোষ ভুল করেন, একজন পূর্ণাঙ্গ রাইট-ব্যাক কখনও সে ভুলগুলো করবে না। আর ম্যাচে ছোটখাট ভুলের কারণে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। যখন বার্সেলোনা লিগে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বা রিয়াল মাদ্রিদ অথবা ভ্যালেন্সিয়া বা সেভিয়ার মতো দলের সাথে বা তাদের মাঠে খেলতে যায়, রক্ষণে এসব ভুল বড্ড বেশি বাঁধার কারণ হয়ে ওঠে।
সার্জি রবার্তো যে মধ্যমাঠে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি, তা-ও নয়। তিনি লা মাসিয়াতে গড়ে উঠেছিলেন একজন মিডফিল্ডার হিসেবে। এমনকি বার্সেলোনার মূল দলে এসেছিলেনও মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হয়ে। দলে অভিষেক হবার পর প্রথমদিকে বেঞ্চ থেকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমে তিনি দলকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তিনি যে আক্রমণেও বেশ ভালো, ২০১৫/১৬ মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে মেসির পরিবর্তে নেমে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তার মধ্যমাঠের পারফর্মেন্সগুলোও তাক লাগানোর মতো। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দুই ম্যাচ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজির বিপক্ষে ও গত মৌসুমে চেলসির বিপক্ষে মিডফিল্ডার হিসেবে নেমে রবার্তো প্রশংসিত হয়েছেন।
মেঘে মেঘে কিন্তু বেলা অনেক হয়েছে। রবার্তো এখন আর সেই কাতালানদের প্রতিভাবান তরুণ নেই। তার বয়সে বা তার থেকে কম বয়সে অনেক খেলোয়াড় দলের সেরা খেলোয়াড়ের পরিণত হয়েছেন। কিন্তু রবার্তো বার্সেলোনা কোচদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছুরি-কাঁচির নিচে পড়ে আছেন একমাত্র কাতালানদের রক্ত ধমনী বহন করছে বলে। সার্জি রবার্তো মিডফিল্ডার হিসেবে জন্ম নিয়েছেন, আক্রমণ ঠেকাতে নয়। হয়তো বর্তমান বার্সেলোনা স্কোয়াডে রাইট-ব্যাক ছাড়া প্রথম একাদশে তার সুযোগ পাওয়া কষ্টকর। তবে বেঞ্চ হোক আর শুরুর একাদশ হোক, তাকে মানায় মধ্যমাঠে, একজন মধ্যমমানের রাইট-ব্যাক হিসেবে নয়।
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়ুন-
১) The Manager: Inside the Minds of Football’s Leaders
২) The Football Book