আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগেই ক্রিকেট পাড়ায় উত্তাপ ছড়িয়েছেন মুম্বাইয়ের তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান পৃথ্বী শ’। অনেকেই তার মধ্যে কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকারের ছায়া দেখছেন। অনেকের মতেই, তিনি ক্রিকেট বিশ্বের ‘নেক্সট বিগ থিং’। ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা তার প্রথম টেস্ট ইনিংস দেখে বলছেন, শেবাগের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, কোহলির মতো ধারাবাহিক এবং টেন্ডুলকারের মতো ক্লাসিক ব্যাটসম্যান পৃথ্বী।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পৃথ্বীর জাতীয় দলে অভিষেক ঘটা ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলে ডাক পেলেও মূল একাদশে জায়গা হয়নি তার। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে তার অভিষেক হতে যাচ্ছে, তা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলো। রাজকোটে দিনের শুরুতে বিরাট কোহলি’র হাত থেকে টেস্ট ক্যাপ গ্রহণ করার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে।
ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তারকা পৃথ্বী তার প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ খেলছেন মাত্র ১৮ বছর ৩২৯ দিন বয়সে। ব্যাটসম্যান হিসাবে বর্তমান ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া কতটা কঠিন, তা মায়াঙ্ক আগারওয়াল কিংবা হানুমা বিহারিদের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে। তাই একাদশে সুযোগ পেলে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই হবে। পৃথ্বীও তাই করলেন, নিজের অভিষেক টেস্ট ইনিংসেই শতক হাঁকালেন তিনি। দেবেন্দ্র বিশুর নির্দোষ সাধারণ একটি ডেলিভারিতে আউট হওয়ার আগে খেলেছেন অসাধারণ ইনিংস। দুর্দান্ত সব শটের সাহায্যে মাত্র ৯৯ বলে শতক হাঁকানোর পর ১৫৪ বলে ১৯টি চারের মারে ১৩৪ রানে থেমেছেন তিনি।
উইকেটে যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ মনোমুগ্ধকর সব ক্রিকেটীয় শটের পসরা সাজিয়েছেন পৃথ্বী। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদেরকে ‘স্কুল ক্রিকেটের বোলার’ বানানো পৃথ্বী প্রথম শিরোনামে এসেছিলেন স্কুল ক্রিকেটে ৫৪৬ রানের ইনিংস খেলে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ‘রিজভী স্প্রিংফিল্ড’-এর হয়ে ছয় ঘন্টা সাত মিনিট ব্যাটিং করে ৮৫টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের সাহায্যে ৫৪৬ রানের বিশাল ইনিংস খেলে জাতীয় রেকর্ড গড়ে শিরোনামে এসেছিলেন।
এরপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৪ মৌসুম কাটিয়েছেন শচীনপুত্র অর্জুনের সাথে ইংল্যান্ডে। দুইজন একই সঙ্গে অনুশীলনও করতেন। খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকা পৃথ্বীর রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটে ২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি। নিজের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচটিও খেলেছেন রাজকোটেই, অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসেই শতক হাঁকিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন। এরপর দুলীপ ট্রফিতেও নিজের অভিষেক ম্যাচে শতক হাঁকিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের পাশে নাম লিখিয়েছেন। শচীনও রঞ্জি এবং দুলীপ ট্রফিতে নিজের অভিষেক ম্যাচে শতক হাঁকিয়েছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন পৃথ্বী। কোনোরকম নার্ভাসনেসে না ভুগে অসাধারণ এক ইনিংস খেলে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন – তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছেনা একদমই, বরং নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকুই পাচ্ছেন তিনি।
পৃথ্বী শ’ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে ভারতকে শিরোপা জেতান। এরপর আইপিএলে দিল্লী ডেয়ারডেভিলস তাকে ১.২ কোটি রুপিতে দলে ভেড়ান। সেখানেও তিনি সবার নজর কেড়েছেন, নিজের অভিষেক আইপিএল ম্যাচে ১০ বলে ২২ রান করা পৃথ্বী দিল্লীর হয়ে নয় ম্যাচে ১৫৩.১২ স্ট্রাইক রেইটে ২৪৫ রান সংগ্রহ করেছেন।
বয়সভিত্তিক, ঘরোয়া ক্রিকেট সব জায়গাতে পারফর্ম করেই দলে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ‘উইন্ডিজ-এ’ দলের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এবং লিস্ট-এ ম্যাচে শতক হাঁকানোর পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী কাউন্টি ক্লাব লিস্টারশায়ারের বিপক্ষেও ১৩২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। এরপরই মূলত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ডাক পান তিনি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ১৮ বছর ৩২৯ দিন বয়সে অভিষেক ঘটে তার। নিজের অভিষেক ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখেন ১৩৪ রানের ইনিংস খেলে। অভিষেক টেস্টে তার চেয়ে দ্রুততর শতক হাঁকিয়েছিলেন শুধুমাত্র শিখর ধাওয়ান এবং ডোয়াইন স্মিথ। ধাওয়ান ২০১৩ সালে মোহালিতে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৮৫ বলে শতক হাঁকিয়েছিলেন, আর ডোয়াইন স্মিথ ২০০৪ সালে কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে মাত্র ৯৩ বলে শতক হাঁকান।
ভারতের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে শতক হাঁকানোর রেকর্ডটিও এখন তার দখলে, বিশ্ব ক্রিকেটে যা চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসাবে অভিষেক টেস্ট শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তার উপরে রয়েছেন কেবল মোহাম্মদ আশরাফুল, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা এবং সেলিম মালিক। মাত্র ১৮ বছর ৩২৯ দিন বয়সে টেস্ট শতক হাঁকানো পৃথ্বী শ’ সপ্তম সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট শতক হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছেন। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার উপরে আছেন শুধুমাত্র শচীন টেন্ডুলকার। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসাবে শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
মোহাম্মদ আশরাফুল
সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে শতক হাঁকানোর রেকর্ডটি বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুলের দখলে। তিনি ১৭বছর ৬১দিন বয়সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শতক হাঁকিয়েছিলেন। কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচেই এই কীর্তি গড়েন তিনি। বাংলাদেশ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৯০ রানে সবক’টি উইকেট হারায়, দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ২৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন আশরাফুল। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ২১২ বলে ১৬টি বাউন্ডারিতে ১১৪ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। আশরাফুল তার ৬১ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ছয়টি টেস্ট শতক হাঁকিয়েছেন।
মুশতাক মোহাম্মদ
মাত্র ১৫ বছর ১২৪ দিন বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে পাকিস্তানের মুশতাক মোহাম্মদের। তিনি তার প্রথম টেস্ট শতক হাঁকান ১৭ বছর ৭৮ দিন বয়সে ভারতের বিপক্ষে। ১৯৬১ সালে দিল্লীতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের ৫ম টেস্টে এই শতক হাঁকান বিখ্যাত মোহাম্মদ ভাইদের একজন মুশতাক। তিনি পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে ২০৫ মিনিট ব্যাট করে ১৯টি চারের মারে ১০১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। মুশতাক মোহাম্মদ তার ৫৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে দশটি শতক হাঁকিয়েছিলেন, তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা ৭২টি।
শচীন টেন্ডুলকার
ভারতের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৯৮৯ সালের ১৫ই নভেম্বর। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর ২০৫ দিন। তিনি তার ৫১টি টেস্ট শতকের মধ্যে প্রথম শতকটি হাঁকান ১৭বছর ১০৭ দিন বয়সে। ম্যানচেস্টার টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ১৮৯ বলে ১৭টি চারের মারে ম্যাচ বাঁচানো ১১৯* রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ম্যাচের প্রথম ইনিংসেও ৬৮ রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। এখনও ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসাবে টেস্ট শতক হাঁকানোর রেকর্ড তারই দখলে।
হ্যামিল্টন মাসাকাদজা
জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যান হ্যামিল্টন মাসাকাদজা অভিষেক টেস্টেই শতক হাঁকান। ২০০১ সালের ২৭শে জুলাই হারারেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে তিন নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ৩১৬ বলে ১২টি চারের মারে ১১৯ রানের লড়াকু ইনিংস খেলেন ১৭ বছর ৩৫২ দিন বয়সী মাসাকাদজা, যার মাধ্যমে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে রুখে দিয়েছিলো জিম্বাবুয়ে। তিনি এখনও জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন, ৩৬ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে তার শতক সংখ্যা পাঁচটি।
ইমরান নাজির
পাকিস্তানের মারকুটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ইমরান নাজিরের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৭ বছর ৭৮ দিন বয়সে। তিনি তার প্রথম টেস্ট শতক হাঁকান ১৮ বছর ১৫৪ দিন বয়সে। ২০০০ সালের ১৮ই মে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ব্রিজটাউন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮০ বলে ২০টি চারের মারে ১৩১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এরপর তার টেস্ট ক্যারিয়ার খুব বেশি লম্বা হয়নি। মাত্র আটটি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানের এই ওপেনার, যাতে তিনি দুইটি শতক হাঁকিয়েছিলেন।
সেলিম মালিক
পাকিস্তানের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান সেলিম মালিকের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৮ বছর ৩২৩ দিন বয়সে। তিনি তার অভিষেক ম্যাচ খেলেন ১৯৮২ সালে করাচিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচেই টেস্ট শতক হাঁকান তিনি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দলীয় দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯১ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। পাকিস্তানের এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান তার ১০৩ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৫টি শতক হাঁকিয়েছেন।
Featured Image Credit: Associated Press