ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট হচ্ছে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের ট্রফিটা স্পর্শ করার স্বপ্ন প্রতিটা ফুটবলারেরই থাকে। বিশ্বকাপের যে মাহাত্ম্য তার সাথে অন্য কোনো টুর্নামেন্টেরই তুলনা চলে না। প্রতিটা দেশই বিশ্বকাপে ভালো করার জন্য নিজেদের সবটা উজাড় করে দেয়। কোনো দল সফল হয় আবার কোনো দল ব্যর্থতার জালে বন্দী হয়ে যায়। বিশ্বকাপে সফলতম দল হওয়ার জন্য ফুটবল বিশ্বের সব পরাশক্তিই নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সাফল্যের মানদণ্ডে তাদের অবস্থান কিন্তু এক নেই।
কেউ হয়তো সাফল্যের চুড়ায় বসে আছে, আবার কেউ হয়তো বহু চেষ্টা করেও চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি। পরিসংখ্যানমতে বিশ্বকাপের সফলতম দল কোনটি এই প্রশ্নের উত্তর আজ আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিশ্বকাপজয়ের পরিসংখ্যান নয়, অন্যান্য সব পরিসংখ্যানও খতিয়ে দেখা হবে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কোন দল কতগুলো জয় পেয়েছে, সবচেয়ে বেশি গোল কোন দল করেছে কিংবা কোন দলের পারফর্মেন্স সবচেয়ে ধারাবাহিক ছিল- খতিয়ে দেখা হবে এসব দিকও।
বিশ্বকাপজয়ের দিক থেকে সেরা দল কোনটি?
এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপে ভিন্ন আটটি দেশ বিশ্বকাপ জিতেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল, সব মিলিয়ে পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে দলটি। বিশ্বকাপ জয়ের দিক থেকে ব্রাজিলের পরেই আছে ইতালি ও জার্মানি। দু’দলই চারটি করে বিশ্বকাপ জিতেছে। এছাড়া দুবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন – এই তিনটি দল একবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে।
এই আটটি দলের মধ্যে জার্মানি ও ব্রাজিলের দুটি বিশ্বকাপজয় কিছুটা হলেও বিশেষ। লাতিন আমেরিকার একমাত্র দল হিসেবে ইউরোপে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল (১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ)। আর একমাত্র ইউরোপিয়ান দল হিসেবে লাতিন আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপ জিতে নেওয়ার কীর্তি শুধুমাত্র জার্মানিরই আছে (২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ)। এছাড়া ভিন্ন চারটি মহাদেশে বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্বটা একমাত্র ব্রাজিলেরই আছে। তাই বিশ্বকাপ জয়ের মানদণ্ড বিচারে সবদিক থেকেই ব্রাজিল বাকি দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে।
ফাইনাল খেলার দিক থেকে সেরা দল কোনটি?
সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপজয়ের রেকর্ড ব্রাজিলের থাকলেও সবচেয়ে বেশিবার ফাইনাল খেলার রেকর্ডটি কিন্তু জার্মানির। এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে আটটি ফাইনাল খেলেছে জার্মানি। এর মধ্যে চারটি ফাইনালে হেরে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশিবার রানার্স আপ হওয়ার রেকর্ডটা তাদের দখলেই। অর্থাৎ জার্মানির ফাইনালে জেতার হার ৫০%। এছাড়া প্রথম দল হিসেবে টানা তিন বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার রেকর্ডটাও জার্মানির দখলে। ১৯৮২-৯০ পর্যন্ত টানা তিনটি বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছিলো জার্মানি।
পরে ১৯৯৪-২০০২ সালে অনুষ্ঠেয় তিনটি বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলে জার্মানির রেকর্ডটাতে ভাগ বসায় ব্রাজিল। ফাইনাল খেলার দিক থেকে জার্মানির ঠিক পরেই ব্রাজিলের অবস্থান। সবমিলিয়ে সাতটি বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছে ব্রাজিল (যদিও ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফরম্যাটে কোনো ফাইনাল ছিল না, কিন্তু উরুগুয়ে-ব্রাজিলের শেষ ম্যাচটি অলিখিত ফাইনাল হয়ে যাওয়ায় সেটিকে ফাইনাল হিসেবেই গণ্য করা হলো)। এর মধ্যে পাঁচটি ফাইনালেই জিতেছে ব্রাজিল, অর্থাৎ ফাইনালে ব্রাজিলের জয়ের হার প্রায় ৭১%।
ফাইনাল খেলার দিক থেকে ব্রাজিল আর জার্মানির ঠিক পরেই ইতালির অবস্থান। সব মিলিয়ে ছয়টি ফাইনাল খেলে জিতেছে চারটি ফাইনালেই। ফাইনালে ইতালির সাফল্যের হার প্রায় ৬৭%। এরপরেই আর্জেন্টিনার অবস্থান, পাঁচটি ফাইনাল খেলে আলবিসেলেস্তারা জিতেছে দুবার। ফাইনালে আর্জেন্টিনার সাফল্যের হার ৪০%, যা বিশ্বকাপ জয়ী আট দলের মধ্যে সর্বনিম্ন! তিনবার রানার্স আপ হয়ে জার্মানির পর সবচেয়ে বেশিবার রানার্স আপ হওয়ার রেকর্ডটা আর্জেন্টিনার দখলেই। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশিবার ফাইনাল খেলা কিংবা সবচেয়ে বেশিবার রানার্স আপ হওয়া- দুদিক থেকেই সবার চেয়ে এগিয়ে আছে জার্মানি।
বিশ্বকাপের সব ম্যাচ বিবেচনায় সেরা দল কোনটি?
পুরো বিশ্বকাপকে একটা লিগ হিসেবে বিবেচনা করলে সেই লিগের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকবে ব্রাজিল। এ পর্যন্ত ব্রাজিল বিশ্বকাপে সর্বমোট ১০৪টি ম্যাচ খেলেছে, তাতে ৭০টি জয়, ১৭টি ড্র ও ১৭টি হারে সবমিলিয়ে ২২৭ পয়েন্ট নিয়ে সবার উপরেই আছে সেলেসাওরা। এরপরেই আছে জার্মানি, ১০৬ ম্যাচ খেলে ৬৬ টি জয়, ২০টি ড্র ও ২০টি হার নিয়ে ২১৮ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানরা। ৮৩ ম্যাচে ১৫৬ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইতালি। ১৪০ পয়েন্ট নিয়ে আর্জেন্টিনা ও ৯৯ পয়েন্ট নিয়ে স্পেন রয়েছে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে।
ম্যাচপ্রতি পয়েন্ট গড়েও সবার উপরে ব্রাজিল, প্রতিম্যাচে গড়ে ২.২ পয়েন্ট পেয়েছে সেলেসাওরা। গড়ে ২.১ পয়েন্ট নিয়ে ব্রাজিলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে জার্মানি। ইতালির গড় পয়েন্ট ১.৯ আর আর্জেন্টিনার গড় পয়েন্ট ১.৮। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে ম্যাচজয়, মোট পয়েন্ট কিংবা গড় পয়েন্ট- সবদিক থেকেই সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ব্রাজিল।
গোলের দিক থেকে সেরা দল কোনটি?
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডটি জার্মানির। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে ২২৪টি গোল করেছে জার্মানি। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গোলসংখ্যা ২২১টি। ১৩১টি গোল করে আর্জেন্টিনা রয়েছে তৃতীয় স্থানে আর ১২৮টি গোল করে এর পরের স্থানটি ইতালির। তবে গোল করায় ব্রাজিলের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও সেলেসাওদের চেয়ে ১৯ গোল বেশি হজম করায় গোল ব্যবধানে ব্রাজিলের চেয়ে পিছিয়েই আছে জার্মানি।
বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার দিক থেকে এগিয়ে কোন দল?
এ পর্যন্ত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপের সবগুলো আসরেই মূলপর্বে খেলেছে একমাত্র ব্রাজিল। জার্মানি দুটি বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলেনি। তবে এক্ষেত্রে একটা কথা আছে। ১৯৩০ বিশ্বকাপে বাছাইপর্বের কোনো বাঁধা ছিল না, সেবার জাহাজে করে উরুগুয়েতে যেতে অনীহার কারণেই জার্মানরা মূলপর্বে খেলেনি। আর ১৯৫০ বিশ্বকাপে জার্মানি খেলেনি কারণ সেবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিতর্কিত অবস্থানকে কেন্দ্র করে ফিফা তাদের খেলার অনুমতি দেয়নি। জার্মানি যদি বাছাইপর্ব পার হতে না পারার কারণে বিশ্বকাপে খেলতে ব্যর্থ হতো তবে সেটাকে ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা যেত, কিন্তু এক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। ব্রাজিল আর জার্মানি বাদে বাকি দলগুলো কমপক্ষে একবার হলেও বাছাইপর্বে বাদ পড়েছে। তাই এদিক থেকে ব্রাজিল আর জার্মানি কিছুটা হলেও বাকি দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে।
ধারাবাহিকতায় কোন দলটি এগিয়ে আছে?
ধারাবাহিকতার বিচারে সবার চেয়ে এগিয়েই রয়েছে জার্মানি, ১৮ বার অংশ নিয়ে মাত্র একবারই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানরা। অন্যদিকে ব্রাজিল প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে তিনবার। জার্মানি যেখানে ১৩ বার বিশ্বকাপের সেরা চারদলের একটি হয়েছে সেখানে ব্রাজিল সেরা চারে ছিল এগারো বার। তাই ধারাবাহিকতার বিচারে ব্রাজিলের চেয়ে এগিয়েই থাকবে জার্মানি।
ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে সেরা দল কোনটি?
ব্যক্তিগত নৈপুণ্য বিচার করলে বাকি দলগুলোর তুলনায় ব্রাজিল বেশ এগিয়েই থাকবে। সব মিলিয়ে সাতজন ব্রাজিলিয়ান বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। ইতালি ও আর্জেন্টিনা উভয় দল থেকেই তিনজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা। সবমিলিয়ে পাঁচজন ব্রাজিলের খেলোয়াড় বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। এসব পুরস্কারের দিক থেকে জার্মানি কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা কিন্তু একজন জার্মান। তিনি হলেন মিরোস্লাভ ক্লোসা, বিশ্বকাপে মোট ১৬টি গোল করেছেন তিনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ব্রাজিলের রোনালদো, বিশ্বকাপের তিনি করেছেন ১৫টি গোল। ১৪টি গোল নিয়ে এরপরেই রয়েছেন জার্মানির জার্ড মুলার।
এছাড়া সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলার পুরস্কার হিসেবে ১৯৭০ বিশ্বকাপ থেকে ফিফা ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছে। এখানেও ব্রাজিলের আধিপত্য, তারা সব মিলিয়ে চারবার ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। স্পেন আর ইংল্যান্ড দুবার করে এই পুরস্কার জিতেছে। এছাড়া জার্মানি ও আর্জেন্টিনাও একবার করে ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
শেষকথা
পরিসংখ্যান ঘেঁটে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, বিশ্বকাপে সাফল্যের দিক থেকে ব্রাজিল আর জার্মানি বাকি দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে। যদিও জার্মানি আর ইতালি দুই দলই চারবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে, কিন্তু গড় পয়েন্ট, গোলসংখ্যার দিক থেকে জার্মানির চেয়ে বেশ পিছিয়েই আছে ইতালি। যদি ব্রাজিল আর জার্মানির মধ্যে তুলনা করা হয়, তবে দেখা যায় যে জার্মানির চেয়ে একবার বেশি বিশ্বকাপ জেতার সাথে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে জয়, মোট পয়েন্ট, গড় পয়েন্ট ও গোল ব্যবধানেও জার্মানির চেয়ে এগিয়েই আছে সেলেসাওরা। অন্যদিকে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করা, সর্বোচ্চবার ফাইনাল খেলা ও ধারাবাহিকতায় ব্রাজিলের চেয়ে এগিয়ে জার্মানরাই।
তবে এক্ষেত্রে একটা সত্য আমাদের মেনে নিতে হবে, অলিম্পিকে পদক তালিকায় একটা দল যত বেশি রৌপ্য পদক বা ব্রোঞ্জ পদক জিতুক, সেই দলের চেয়ে একটি স্বর্ণপদক বেশি পাওয়া দল পদক তালিকায় ওই দলের চেয়ে উপরের দিকেই থাকবে। তেমনি অন্য পরিসংখ্যানে জার্মানি ব্রাজিলকে যদি টপকেও যায়, তারপরেও ব্রাজিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সফলতম দল হিসেবেই অবস্থান করবে। জার্মানিকে বিশ্বকাপের সফলতম দল হতে গেলে সবার আগে ব্রাজিলের সমান পাঁচবার বিশ্বকাপ জিততে হবে। বিশ্বকাপের সংখ্যা সমান হলে তবেই অন্য পরিসংখ্যান বিচার করে জার্মানিকে সফলতম দল বলা যাবে। ব্রাজিলের সমান পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতার জন্য জার্মানির সামনে এই আসর বেশ বড় সুযোগ হয়েই এসেছে। এখন দেখা যাক জার্মানি কি পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলকে টপকে বিশ্বকাপের সফলতম হতে পারে নাকি ব্রাজিলই বিশ্বকাপের সফলতম দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে।
ফিচার ইমেজ : Behance