২০০৪ সাল থেকে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি প্রতি বছরের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে ফরম্যাট ভেদে সেরা খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করে আসছে। আর সব ফরম্যাট মিলিয়ে যে খেলোয়াড় সেরার সেরা মর্যাদা পান, তাকে বর্ষসেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করে আইসিসি। পুরস্কারটিকে অনেকটা ফুটবলের ব্যালন ডি’অরের সাথে তুলনা করা যায়। যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছেই আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়া অবশ্যই বড় একটি অর্জন। কিংবদন্তী ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই পুরস্কারের নাম রাখা হয়েছিল ‘স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ট্রফি’।
গত দুই বছর ধরে আইসিসির এই বর্ষসেরা বিভাগে একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বিশেষ করে গতবারের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, স্যার গ্যারফিল্ড ট্রফির পাশাপাশি টেস্ট ও ওয়ানডে– দুই ফরম্যাটের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। টানা তৃতীয়বার স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ট্রফি জেতার অনন্য এক অর্জন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল এই রানমেশিনকে।
তবে এবার আর কোহলি পারেননি। তার এই বছরটা খুব খারাপ কেটেছে সেটা বলার উপায় নেই। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। তবে দুর্দান্ত এক বছর কাটিয়ে কোহলির সাম্রাজ্যে হানা দিয়েছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। সত্যি বলতে, বছরের পুরো সময়টা স্টোকস যেভাবে কাটিয়েছেন, সেটাকে স্বপ্নীল বললেও কম বলা হবে। ২০১৯ ছিল বিশ্বকাপের বছর, আর সেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন এই ইংলিশ অলরাউন্ডার।
ফাইনালে ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা যখন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল, তখন একা বুক চিতিয়ে লড়ে দলের সম্ভাবনা টিকিয়ে রেখেছিলেন স্টোকস। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চের চাপ সামলে তার ৮৪ রানের অনবদ্য ইনিংসটি ইংলিশদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মূল কারণ ছিল। শুধু বিশ্বকাপ নয়, পুরো বছর জুড়েই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছিলেন স্টোকস। ২০ ওয়ানডে খেলে ব্যাট হাতে ৭১৯ রানের পাশাপাশি বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট।
তবে শুধুমাত্র ওয়ানডের পারফরম্যান্স দিয়ে স্টোকসের পক্ষে বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়া সম্ভব ছিল না। বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার টেস্ট পারফরম্যান্স। আর টেস্ট পারফরম্যান্সের কথা উল্লেখ করতে গেলে বড় একটি অংশ জুড়ে থাকবে হেডিংলি টেস্ট। তার ১৫৩ রানের অপরাজিত ইনিংসটি অনেকের মতে ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ম্যাচজয়ী ইনিংস। ১১ টেস্টে ৮২১ রান ও ২২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। দুই ফরম্যাটে এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কারণেই অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ও জোনাথন ট্রটের পর তৃতীয় ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে স্যার গ্যারফিল্ড ট্রফি জিতলেন স্টোকস। পুরস্কার জয়ের পর নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ট্রফির মতো সম্মানজনক পুরস্কার জয় অবশ্যই আমার জীবনের অন্যতম আনন্দময় ঘটনা। সত্যি বলতে এসব ব্যক্তিগত অর্জনের পরিপূর্ণ সংমিশ্রণের কারণেই আমরা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের শিরোপা জিততে পেরেছিলাম। হেডিংলির সেই অবিশ্বাস্য জয় কিংবা লর্ডসের ফাইনালে বিশ্বজয়– সবকিছুতেই আমার সতীর্থদের বড় একটি ভূমিকা ছিল। সবাই মিলে বড় কিছু জয় করাটা অবশ্যই আলাদা তৃপ্তি দিচ্ছে। শেষ বারো মাস আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিল। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু অর্জন করার জন্য এসব সুখস্মৃতি বড় একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কার জিতলেও টেস্ট কিংবা ওয়ানডে– কোনো ফরম্যাটের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার কিন্তু স্টোকসের কাছে আসেনি। স্বদেশী স্টিভেন স্মিথ ও মার্নাস ল্যাবুশেনের সাথে জোর টক্কর শেষে টেস্টের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন অজি পেসার প্যাট কামিন্স। বছরের শুরু থেকেই দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে আসছিলেন তিনি। ১২ ম্যাচে ৫৯ উইকেট নিয়ে বছর শেষ করেছেন আইসিসির টেস্ট র্যাংকিংয়ের সেরা বোলার হিসেবে। অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে স্টোকসের মতো কামিন্সও তার সতীর্থদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন,
সেরা টেস্ট খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতাটা আমার জন্য ভীষণ সম্মানজনক ব্যাপার। সত্যি বলতে আমি এত বড় পুরস্কার জেতার কথা সেভাবে চিন্তাও করিনি। বছরটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমি আমার সতীর্থদের কাছে কৃতজ্ঞ। সকলের কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবেই আমরা অ্যাশেজের শিরোপা ধরে রাখতে পেরেছিলাম।
ওয়ানডে ফরম্যাটে সারা বছর রানের বন্যা বইয়ে দেওয়া রোহিত শর্মা জিতেছেন আইসিসির সেরা ওয়ানডে খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ৬৪৮ রান করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার পাশাপাশি ২৮ ম্যাচে সাত সেঞ্চুরিতে ১৪০৯ রান করে ব্যাট হাতে দারুণ সময় পার করেছিলেন এই ভারতীয় ওপেনার। পুরস্কার জয়ের পর তিনি বলেন,
আমাকে এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য মনে করায় আমি আইসিসিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং ধন্যবাদ জানাতে চাই বিসিসিআইকে আমাকে ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ২০১৯ সালে দল হিসেবে আমরা যেভাবে পারফর্ম করেছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট। সবকিছু আরেকটু ভালো হতে পারতো। তবে এসবের মাঝেই অনেক ইতিবাচক কিছু রয়েছে যা আমাদের ২০২০ সালে ভালো করতে সাহায্য করবে।
টি-টুয়েন্টিতে অবশ্য সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত না করে একটি বিশেষ পারফরম্যান্সকে বছরের সেরা টি-টুয়েন্টি পারফরম্যান্স হিসেবে নির্বাচিত করে বিসিসিআই। নাগপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ মাত্র ৭ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে এই পুরস্কার জিতে নিয়েছেন ভারতের উদীয়মান পেসার দীপক চাহার। এই পারফরম্যান্সের মাধ্যমে সাত বছর আগে অজন্তা মেন্ডিসের গড়া সেরা টি-টুয়েন্টি বোলিং ফিগারের রেকর্ড ভেঙে দেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এত বড় পুরস্কার জয়ের পর তিনি বলেন,
পুরস্কার জিতে আমি খুবই আনন্দিত। আমি আইসিসি এবং বিসিসিআইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাকে এই পুরস্কারের যোগ্য মনে করার জন্য এবং আমাকে জাতীয় দলে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এই ম্যাচ আমার জন্য বিশেষ কিছু ছিল। দীর্ঘদিন পর দলে সুযোগ পেয়ে মাত্র সাত রানে ছয় উইকেট পাওয়া আমার জন্য স্বপ্নীল পারফরম্যান্স ছিল।
প্রত্যাশিতভাবে সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন অজি ব্যাটসম্যান মার্নাস ল্যাবুশেন। স্টিভেন স্মিথ মাথায় আঘাত পাওয়ার পর বদলি হিসেবে সুযোগ পেয়ে সেই যে রানের ফোয়ারা ছোটানো শুরু করলেন, সেই ধারা বছরের শেষ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। র্যাংকিংয়ের ১১০ নাম্বারে থেকে বছর শুরু করা ল্যাবুশেন ১১ টেস্টে ১,১০৪ রান করে বছর শেষ করেছেন র্যাংকিংয়ের চতুর্থ স্থানে! পুরস্কার জয়ের পর তিনি বলেন,
এই পুরস্কার জয় আমার জন্য ভীষণ রোমাঞ্চকর। এবারের গ্রীষ্মটা আমার দারুণ কেটেছে, তবে এই ভালো সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটনোই আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। আমাদের দলটি অসাধারণ, এই দলের একটি অংশ হতে পেরে আমি সত্যিই নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি।
শুরুতেই বিরাট কোহলির টানা পুরস্কার জয়ের ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলাম। ভারতীয় অধিনায়ক অবশ্য একেবারে খালি হাতে ফেরেননি। বিশ্বকাপে স্টিভেন স্মিথকে যখন দর্শকরো দুয়োধ্বনি দিচ্ছিলেন, তখন দর্শকদের সেই দুয়ো থামাতে বলে অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। আর তার পুরস্কার হিসেবে আইসিসির স্পিরিট অফ ক্রিকেট জিতেছেন তিনি। পুরস্কার জয়ের ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
অনেকটা সময় নেতিবাচক কারণে শিরোনাম হয়েছি, তারপর এই পুরস্কার জয়ের ব্যাপারটি আমার জন্য সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত একে অপরের কঠিন সময়ে তার পাশে থাকা। স্লেজিং কিংবা মাঠে তামাশা করা এক ব্যাপার আর দুয়োধ্বনি দেওয়া আলাদা ব্যাপার। দ্বিতীয় ব্যাপারকে আমি কখনোই সমর্থন করি না।
এছাড়া ব্যাট হাতে দারুণ সময় কাটানোর পুরস্কার হিসেবে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন স্কটল্যান্ডের কাইল কোয়েটজার। আর বছরের সেরা আম্পায়ার নির্বাচিত হওয়ায় ‘ডেভিড শেফার্ড ট্রফি’ জিতেছেন ইংলিশ আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ।