বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা ফুটবল। দুই দলের দশজন-দশজন করে মোট বিশজন খেলোয়াড় ছুটতে থাকে একটি চর্মগোলকের পিছে, আর দু’জন গোলকিপার প্রস্তুত থাকে নিজেদের গোলপোস্ট রক্ষায়। কখনো একদল আক্রমণের পর আক্রমণ শানাতে থাকে, আবার পরমুহূর্তেই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বিপক্ষ দলটি পাল্টা আক্রমণের ঝাঁপি খুলে বসে।
কোনো জটিলতা নেই, নেই কোনো মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো নিয়মের বেড়াজাল। একদমই সাদামাটাভাবে চলে দু’দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কিন্তু তারপরও ৯০টা মিনিট মাঠের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে গ্যালারির পাঁড় সমর্থক, কিংবা টিভি সেটের সামনে বসে থাকা দর্শক, সবাইকে অফুরন্ত নাটকীয়তা আর শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা উপহার দেয় এই খেলা।
তবে সৌন্দর্য্যের ফুল ফোটানো নয়, খেলোয়াড়দের মূল লক্ষ্য অবশ্যই থাকে প্রতিপক্ষের জালে বেশি বল জড়িয়ে নিজ দলের জয় নিশ্চিত করা। সেটি করতে গিয়ে তারা অনেক সময় এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করে থাকে, যা বেশ দৃষ্টিকটু, এবং তাতে করে সামগ্রিকভাবে খেলাটির ব্যাপক সৌন্দর্য্যহানিও ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় ফুটবলে এমন একটি কদর্য কৌশল নিয়ে বেশ সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সেটি হলো ট্যাকটিকাল ফাউল। নামের মাঝেই নিহিত রয়েছে যার সংজ্ঞা।
মনে করুন, একটি দল দারুণভাবে আক্রমণের সূচনা করেছে। ফরওয়ার্ড যেভাবে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে পড়েছে এবং গোলমুখ বরাবর এগিয়ে চলেছে, তাতে গোলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বেশ ভালোরকম। বিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারদের পক্ষে গতি দিয়ে ওই ফরওয়ার্ডকে হার মানানো সম্ভব না। সে যদি তার নিজের গতি অক্ষুণ্ন রাখতে পারে, তাহলে গোলকিপারকে পরাস্ত করতে পারা মানেই গোল নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। কারণ, তার সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোর মতো আর কেউই যে নেই।
এমন সময় আক্রমণকারী ফরওয়ার্ডের পাশে পাশে, কিংবা পেছন পেছন ছুটতে থাকা ডিফেন্ডারটি বেছে নিল একটি ব্যতিক্রমী কৌশল। সে বুঝে গেছে, স্বাভাবিকভাবে ওই ফরওয়ার্ডকে রোখা যাবে না। তাই সে পেছন থেকে একটি বুদ্ধিদীপ্ত ফাউল করে বসল। খুবই আলতো একটি ধাক্কা দিল, বডি-চেক করল, কিংবা মাটি কামড়ে ট্যাকল করল তাকে। ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেল ফরওয়ার্ড।
এটি অবশ্যই অপরাধ, কিন্তু হলুদ কার্ড দেখার মতো সাংঘাতিক কোনো অপরাধও নয়। তাই রেফারির কাছ থেকে আসল কেবলই একটি ফ্রি-কিকের নির্দেশ। আর সেই ফ্রি-কিকটি নেয়ার আগেই ডিফেন্ডাররাও সবাই চলে গেল গোল রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করতে। ফলে খানিক আগেও যেখানে গোলের সম্ভাবনা ছিল ৭০-৩০, আকস্মিকভাবে তা নেমে এলো ৫০-৫০ এ।
আবার তখন যদি ফরওয়ার্ডটি পড়ে না-ও যেত, এবং বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখত, তারপরও কিন্তু তার গতি কিছুটা হলেও কমে যেত। জোর হারাত তার শট নেয়ার পা-টা। সার্বিকভাবে আক্রমণের ধার যেত ম্লান হয়ে। ফলে অন্য কোনো ডিফেন্ডারের পক্ষে এগিয়ে এসে বল পুনর্দখল করা, কিংবা গোলকিপারের পক্ষে ঠিকভাবে বলটি ঠেকিয়ে দেয়ার সুযোগও তৈরি হতো।
এভাবে খেলার স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থায় কোনো গোলের সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে, স্বাভাবিক প্রবাহকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দেয়া বা শ্লথ করে দেয়ার মাধ্যমে সেই গোলের সম্ভাবনাকে নস্যাতের যে কৌশল, সেটিই হলো ট্যাকটিকাল ফাউল। এ ধরনের ফাউলের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক নামও রয়েছে: DOGSO, যার পূর্ণরূপ Denial of an Obvious Goal-Scoring Opportunity!
কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল খেলে যেসব দল, এ ধরনের ফাউলের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তাদেরই থাকে সবচেয়ে বেশি। কেননা, স্বাভাবিকভাবেই কোনো একটি দল আক্রমণ শুরু করলে প্রায় সব খেলোয়াড়ই চলে যায় নির্দিষ্ট একটি অর্ধে। সেই আক্রমণটি বানচাল করে দিয়ে পাল্টা আক্রমণের সূচনা যদি ঘটে, সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ডিফেন্ডার উপস্থিত থাকে হাতেগোনা দুই-একজন। তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ফুটবল খেলে আক্রমণকারীকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়, তাই তারা বেছে নেয় ট্যাকটিকাল ফাউলের পথ।
এক্ষেত্রে তাদের দর্শন খুবই পরিষ্কার: রেফারি যদি ফ্রি-কিকের বাঁশি বাজায়, কিংবা যদি কার্ডও দেখিয়ে দেয়, তাতেও সমস্যা নেই। প্রতিপক্ষের আক্রমণের গতিকে ধীরগতির করে দেয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত গোল হজমের সম্ভাবনা এড়ানোই মুখ্য।
যেহেতু কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর দলগুলো ট্যাকটিকাল ফাউলের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি, তাহলে নিশ্চয়ই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে এটিও খুব সহজেই বলে দেয়া যায় যে ট্যাকটিকাল ফাউল বেশি করে সেই দলগুলো, যাদের বিরুদ্ধে কাউন্টার অ্যাটাক সবচেয়ে বেশি হয়। এখন প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের দলের বিরুদ্ধে কাউন্টার অ্যাটাক সবচেয়ে বেশি হয়? অবশ্যই সেই দলগুলোর বিপক্ষে, যারা খেলে পজেশন নির্ভর ফুটবল, অর্থাৎ ম্যাচের সিংহভাগ সময় বলের দখলদারিত্ব রেখে দেয় নিজেদের কাছে।
তাই মোটেই বিস্ময় জাগে না, যখন দেখা যায় ইউরোপের ‘পজেশন কিং’ ম্যানচেস্টার সিটির দিকেই সবচেয়ে বেশি আঙ্গুল ওঠে ট্যাকটিকাল ফাউলের। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বর্তমান কোচ ওলে গানার সলশায়ের এবং সাবেক কোচ হোসে মরিনহো, এমনকি প্রিমিয়ার লিগের সাবেক রেফারি মার্ক ক্ল্যাটেনবার্গ থেকে শুরু করে ওয়েস্টহ্যাম বস ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি, প্রত্যেকের মুখেই এক কথা: মাত্রাতিরিক্ত ট্যাকটিকাল ফাউল করছে পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা।
এ কথা বললেও একদমই অত্যুক্তি হবে না যে, ইউরোপীয় ফুটবলে ম্যানচেস্টার সিটি ও ট্যাকটিকাল ফাউল পরস্পরের সমার্থক হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? স্রেফ গুগলে গিয়ে লিখুন, tactical foul, দেখবেন প্রথম পাতার অধিকাংশ রেজাল্টই কোনো না কোনোভাবে ম্যানচেস্টার সিটির সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ট্যাকটিকাল ফাউলের প্রধান অপরাধী হিসেবে বেশ মোটা দাগেই চিহ্নিত হয়ে গেছে সিটিজেনরা।
আসলেই কি সিটি এই অপবাদের যোগ্য? পরিসংখ্যান আংশিকভাবে সে কথাই বলছে। আমরা যদি ফিরে তাকাই ২০১৮-১৯ মৌসুমের দিকে, প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি ফাউল করেছে তারাই। তাদের নামের পাশে রয়েছে মোট ৩২৮টি ফাউলের দায়। এ তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লিভারপুল। তারা মোট ফাউল করেছে ৩১৫টি।
কিন্তু একটি ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না, সিটি ও লিভারপুল তো প্রায় সব ম্যাচেই বল পজেশনে আধিপত্য বজায় রাখে। সেক্ষেত্রে তাদের তো ফাউলের তালিকায় একদম নিচের দিকেই থাকার কথা। কেননা, একটি দল তো তখনই ফাউল বেশি করবে, যখন তাদের খেলোয়াড়দের পায়ে বল কম থাকবে। সুতরাং একটি বিষয় পরিষ্কার, খুব অল্প সময়ের জন্য বলের দখল হারালেও, যখনই সিটি বা লিভারপুল বল হারায়, তারা বল ফিরে পেতে কিংবা প্রতিপক্ষের ছন্দপতনের লক্ষ্যে ফাউলের আশ্রয় নেয়।
এবার আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। ট্যাকটিকাল ফাউল সাধারণত প্রতিপক্ষের অর্ধেই বেশি হয়ে থাকে। কেননা, অধিকাংশ আক্রমণাত্মক দলই প্রতিপক্ষের সীমানায় প্রবল বিক্রমের সাথে হানা দেয়। এবং যখনই প্রতিপক্ষের কারো পায়ে বল চলে যায় এবং সে পাল্টা আক্রমণের সূচনা করতে চায়, আক্রমণাত্মক দলটি তাকে ফাউল করে তার পাল্টা আক্রমণকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিতে চায়। তাই দেখা যাক, প্রতিপক্ষের অর্ধে কোন দলটি সবচেয়ে বেশি ফাউল করেছিল ২০১৮-১৯ মৌসুমে।
যেমনটি দেখতে পাচ্ছেন, প্রতিপক্ষের অর্ধে ফাউল করার তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে লিভারপুল। তাদের মোট ৩১৫টি ফাউলের মধ্যে ৬৩.১৭ শতাংশই ছিল প্রতিপক্ষের সীমানায়। অন্যদিকে সিটিও পিছিয়ে নেই খুব একটা। তারা তাদের মোট ৩২৮টি ফাউলের মধ্যে ৫৮.৮৪ শতাংশ করেছে প্রতিপক্ষের সীমানায়। তাহলে যদি প্রতিপক্ষের সীমানায় ফাউল করাকে আমরা ট্যাকটিকাল ফাউল হিসাবে গণ্য করি, সেক্ষেত্রে লিভারপুল (১৯৯) ও সিটির (১৯৩) মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি নয়।
তবে এই একটি পরিসংখ্যান থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা বোধহয় উচিৎ হবে না। সিটি ও লিভারপুল দুই দলই প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য দলের চেয়ে প্রচুর পরিমাণে ফাউল করে, এবং প্রতিপক্ষের অর্ধে তাদের ফাউলের পরিমাণও অনেক বেশি, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, দুইটি দলই কিন্তু খুবই হাই-প্রেসিং ফুটবল খেলে। তাই তাদের কাছ থেকে এমন পরিসংখ্যান অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।
এবার আমরা বিবেচ্য হিসেবে আরেকটি বিষয়কে নিতে পারি। সেটি হলো, বল হারানোর পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফাউল করে কোন দলটি।
এখানেও কিন্তু লিভারপুল ও সিটি কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। ২০১৮-১৯ মৌসুমে বল হারানোর পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফাউলের রেকর্ডটি ছিল আর্সেনালের দখলে (৮.২ সেকেন্ড), এরপরই ৮.৩ সেকেন্ড নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানটি এভারটনের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল সিটি ও লিভারপুলও। এবং আমরা যদি আরো এক বছর পিছিয়ে যাই, ২০১৭-১৮ মৌসুমেও গড়ে বল হারানোর ৭.৬ সেকেন্ড পরই ফাউল করত সিটি (দ্বিতীয় দ্রুততম), আর ৮.৩ সেকেন্ড পর লিভারপুল (তৃতীয় দ্রুততম)।
দেখা যাচ্ছে, বল হারানোর পরই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ফাউল করে বসা এবং তার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ছন্দপতন করে দেয়া ট্যাকটিকাল ফাউল হয়, সেক্ষেত্রে সিটির প্রায় সমতুল্যই লিভারপুল।
তাহলে আমাদের প্রশ্ন, ট্যাকটিকাল ফাউলের অপবাদের ‘দাবিদার’ যতটা সিটি, ঠিক ততটাই লিভারপুলও। কিন্তু তারপরও সব দায়ভার কেন সিটিকেই নিজের কাঁধে নিতে হয়? কেন এমনকি লিভারপুল-ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইটেও বলা হয়, সিটির ট্যাকটিকাল ফাউলের প্রবণতার ফলেই নাকি গত মৌসুমে শিরোপাবঞ্চিত হয়েছে ‘দ্য রেডস’রা?
এই প্রশ্নের সদুত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল চমকপ্রদ একটি তথ্য। গার্দিওলার অধীনে সিটির বিরুদ্ধে ট্যাকটিকাল ফাউলের অপবাদ অনেক আগে থেকেই ছিল বটে, কিন্তু সে আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে একটি ডকুমেন্টারি! ২০১৮ সালের আগস্টে অ্যামাজনে মুক্তিপ্রাপ্ত ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘অল অর নাথিং’-এ দেখা যায় গার্দিওলার সহকারী মিকেল আরতেতা বলছেন,
“ডেভিড, কেভিন, গুন্ডো! ফাউল করো। যদি ট্রানজিশন (বলের দখল পরিবর্তন) হয়, ফাউল করো।”
এই উক্তির মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ফুটবলভক্তদের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে, বলের দখল হারানোর পর কিংবা প্রতিপক্ষের পাল্টা আক্রমণকে নষ্ট করতে ফাউলই সিটির প্রধান অস্ত্র। তাছাড়া সিটির ফিল্ড সেট-আপ থেকেও বিষয়টি অনেকটাই দৃশ্যমান হয়ে যায়।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় নিয়মিতই ছয়জন আউটফিল্ড খেলোয়াড়কে বলের আগে মোতায়েন করেন গার্দিওলা। অর্থাৎ সিটির ফরওয়ার্ডদের পাশাপাশি মাঝমাঠের খেলোয়াড়রাও আক্রমণ শানাতে পার করে ফেলেন প্রতিপক্ষের সীমানার অর্ধাংশ। এরকম পরিস্থিতিতে সিটি যদি বলের দখল হারায়, স্বাভাবিকভাবেই উন্মুক্ত রক্ষণ সীমানার কারণে তাদের অবস্থা প্রচণ্ড ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, আর তখন তারা ফাউল করে বসলে তা একটু বেশিই চোখে লাগে।
গার্দিওলা অবশ্য বরাবরই নিজের নামে নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে নারাজ। তাই গত বছর শেষ দিকে যখন ট্যাকটিকাল ফাউল প্রসঙ্গে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন,
“আমরা চেষ্টা করি (ইতিবাচক) খেলতে। অবশ্যই আমরা অনেক সময় ফাউল করি। কিন্তু আমার দলের ফোকাস কখনোই থাকে না প্রতিপক্ষের সাথে খারাপ কিছু করা। আমরা চাই খেলায় আক্রমণাত্মক হতে, আমাদের নিজেদের খেলাটা খেলতে। কিন্তু কখনো আমাদের উদ্দেশ্য এমন থাকে না যে তারাও একই কাজ করতে গেলে আমরা যেন তা নেতিবাচকভাবে এড়াতে পারি। আমি আমার ক্যারিয়ারে কখনো এমন কাজ করিনি, এবং আমার ক্যারিয়ারে এমনটি কখনো হবেও না, কারণ আমি একদমই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খেলাটিকে বুঝি।”
সে দফায় নিজের কঠোর অবস্থানের মাধ্যমে সমালোচনা এড়াতে সক্ষম হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে আবারও পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছে বিষয়টি। আরো মজার ব্যাপার হলো, এবার তা হয়েছে তার নিজেরই এক শিষ্যের কারণে। যেই রদ্রিকে গত জুলাইয়ে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে সিটিতে নিয়ে এসেছেন গার্দিওলা এবং নিয়মিতই খেলাচ্ছেন, সেই রদ্রিই ফাঁস করে দিয়েছেন তার গুমর।
“আমার মনে হয়, আমার জন্য এটি একটি খুবই বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ আমি এই বিশেষ পজিশনে আগে কখনো খেলিনি। আগে আমার জন্য দলে এই নির্দিষ্ট ভূমিকা কখনো ছিল না। আমাদের দলে কয়েকজন খুবই আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় রয়েছে, এবং অনেক সময়ই প্রতিপক্ষ দলগুলো পাল্টা আক্রমণ করে বসে, যখন আমি একদমই একা। তবে এটি আমার জন্য ভালো একটি বিষয়। আমি নতুন অনেক কিছু শিখতে পারছি। যেমন, কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে, কখন নিজের জায়গায় স্থির থাকতে হবে, কখন একটি ট্যাকটিকাল ফাউল করতে হবে, এবং কখন আমাকে লাফ দিতে হবে।”
ইএসপিএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিটিতে নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান দিচ্ছিলেন রদ্রি, কিন্তু তারই এক পর্যায়ে এভাবে মুখ ফসকে ট্যাকটিকাল ফাউলের কথাটি বলে ফেলেন তিনি। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই, তার এই অকপট স্বীকারোক্তিকে মাটিতে পড়ার সুযোগ দেয়নি সমালোচকরা, বিশেষত যারা এতদিন অপেক্ষায় ছিল একটি মোক্ষম সুযোগের।
তাহলে নিশ্চয়ই সকলে বুঝতে পারছেন, কেন এবং কীভাবে ট্যাকটিকাল ফাউল নামক অপরাধে অপরাধী হওয়ার তকমা সেঁটে গেল সিটির নামের সাথে। কিন্তু এখন প্রশ্ন, আসলেই কি ট্যাকটিকাল ফাউল নষ্ট করছে ফুটবলের সৌন্দর্য্য?
এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেয়া আসলে অসম্ভব। কেননা, সৌন্দর্য্য জিনিসটি আপেক্ষিক। কেউ কেউ হয়তো বুদ্ধিদীপ্ত ফাউলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের আক্রমণে জল ঢেলে দেয়ার মাঝেই সৌন্দর্য্য খুঁজে পায়। তাই তাদের কাছে গিয়ে যদি বলা হয়, ট্যাকটিকাল ফাউল কদর্য একটি বিষয়, তারা স্রেফ আপনার মুখের উপর হাসবে।
এখন তবে চিন্তা করা যাক, ট্যাকটিকাল ফাউলের ফলে আসলেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কি না। আর এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যে উদাহরণটি আসবে, তা হলো ২০১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল।
রিয়াল মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মধ্যকার ম্যাচের ৯২ মিনিট পেরিয়ে গেছে। আর এক মিনিট পরই বাজবে রেফারির লম্বা বাঁশি। দুই দলের মাঝেই বিস্তার করছে ১-১ সমতা। নির্ধারিত সময়ের অন্তিম মিনিটে একটি ফ্রি-কিক পেল রিয়াল মাদ্রিদ। কাজে লাগাতে পারল না তারা সুযোগটি। বরং শুরু হলো অ্যাটলেটিকোর আশাজাগানিয়া এক কাউন্টার অ্যাটাক। আক্রমণের অগ্রভাগে আঁতোয়া গ্রিজমান, ফার্নান্দো তোরেস ও ইয়ানিক ক্যারাসকো। দুর্দান্ত গতিতে মদ্রিচ ও ক্যাসেমিরোকে পাশ কাটিয়ে ক্যারাসকো ঢুকে পড়লেন প্রতিপক্ষের সীমানায়।
ক্যারাসকোর সামনে তখন রিয়ালের মাত্র একজন ডিফেন্ডার (দানিলো) এবং গোলকিপার নাভাস, আর বল বাড়িয়ে দেয়ার জন্য দুই দিকে রয়েছেন দুই সতীর্থ গ্রিজমান ও তোরেস। ঠিক তখনই তাকে পেছন থেকে ছুটে এসে খুব বাজেভাবে ট্যাকল করলেন রামোস। ভারসাম্য হারিয়ে মাটিয়ে পতিত হলেন তিনি, আর ঘটল প্রতিশ্রুতিশীল একটি আক্রমণের অপমৃত্যু। ওই গোলটি হলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারত অ্যাটলেটিকো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শ্যুটআউটে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদেরকে।
আপনি যদি ক্যারাসকোকে জিজ্ঞেস করেন, ট্যাকটিকাল ফাউল ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয় কি না, তাহলে কী উত্তর পাবেন, নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। আবার রামোসের মুখ থেকে হয়তো ভিন্ন কিছুই শুনতে পাবেন,
“ট্যাকটিকাল ফাউল? আরেহ, এটা তো খেলারই অংশ!”
যতদিন পর্যন্ত ফিফা ট্যাকটিকাল ফাউলকে নিষিদ্ধ না করছে, ততদিন এটিকে ‘খেলার অংশ’ হিসেবে মানতেই আমরা বাধ্য। এবং ট্যাকটিকাল ফাউলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করাও খুবই অবাস্তব একটি সম্ভাবনা। কারণ অনুরূপ একটি সিদ্ধান্ত ফিফা নিয়েছিল ১৯৯৮ সালেও, যখন তারা পেছন থেকে ট্যাকলে সরাসরি লাল কার্ডের নিয়ম করেছিল। তাদের এমন সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য ছিল খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু খুব বেশিদিন তারা এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে পারেনি।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথম সেই নিয়মের শিকার হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হা সেকজু। মেক্সিকোর বিপক্ষে গোল করার এক মিনিট পরই পেছন থেকে স্লাইডিং ট্যাকল করার অপরাধে লাল কার্ড দেখেন তিনি। সেটিই ছিল প্রথম ও শেষবার। কারণ শীঘ্রই নিয়মটিকে বাতিল ঘোষণা করে ফিফা। তার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। পেছন থেকে যেকোনো ট্যাকলেই লাল কার্ড দেখানো হলে ফুটবল অনেক বেশি রক্ষণশীল খেলায় পরিণত হতো, এবং তাতে করেও খেলার সৌন্দর্য্যহানি ঘটত।
ঠিক একই কারণেই ফুটবল থেকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা যাবে না ট্যাকটিকাল ফাউলকে। যদি তর্কের খাতিরে আমরা মেনেও নিই যে, এটি নীতিবিরুদ্ধ একটি কাজ এবং এতে ফুটবলের অসম্মান হয়, তারপরও কি নির্দিষ্ট কোনো ধরনের ফাউলকে ট্যাকটিকাল ফাউল হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কীভাবে কোনো ট্যাকটিকাল ফাউলের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া যাবে?
তাছাড়া যদি সম্ভাব্য সব ধরনের ট্যাকটিকাল ফাউলকেই বাদ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তাতেও তো ফুটবল খেলার সৌন্দর্য্য বরবাদ হয়ে যাবে। ক্রিকেটে যেমন ব্যাটসম্যানদের সুবিধা করে দিতে গিয়ে বোলারদের উপর বিভিন্ন অবিচার করা হয়েছে, ফুটবলেও ফরওয়ার্ডদের সুবিধার জন্য ডিফেন্ডারদের সাথে একই রকম অবিচার করা হবে।
সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে এসে শেষ করতে পারি যে, সৌন্দর্য্য-হানিকর হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ট্যাকটিকাল ফাউল আসলেই ফুটবল খেলার একটি অংশ, এবং অদূর ভবিষ্যতেও এর কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
খেলাধুলার চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/