নাহ, ডাবল সেঞ্চুরিটা বোধহয় হলো না! ভাবলেন রেজিনাল্ড আর্সকিন ফস্টার। চিনতে পারলেন না তো? টিপ ফস্টার বললে বোধহয় চিনতে পারবেন। পাঁচ টেস্টের অ্যাশেজ খেলতে দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া এসেছেন তিনি, প্রথম টেস্টেই দাঁড়িয়ে আছেন এক অভাবনীয় রেকর্ডের সামনে। তখন পর্যন্ত অভিষেক টেস্টের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ছিল অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান চার্লস ব্যানারম্যানের, নিজের এবং দেশের অভিষেক টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন ১৬৫ রান। সেই রান ইতঃমধ্যেই পার হয়ে এসেছেন ফস্টার, দাঁড়িয়ে আছেন অভিষেকেই ডাবল সেঞ্চুরির সামনে। কিন্তু এইমাত্র নবম উইকেট হিসেবে আউট হয়ে গেলেন অ্যালবার্ট রেলফ। এগারো নাম্বারে যিনি নামছেন, তিনি যে কতক্ষণ টিকবেন, বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু ফস্টারকে অবাক করে দিয়ে টিকে গেলেন সেই ব্যাটসম্যান। নিজে করলেন ৪০ রান, ফস্টারের সাথে গড়লেন ১৩০ রানের জুটি। ডাবল সেঞ্চুরি তো হলোই, ফস্টার পৌঁছে গেলেন ট্রিপল সেঞ্চুরির কাছাকাছিও। অভিষেকেই ট্রিপল সেঞ্চুরি, ভাবা যায়!
কিন্তু না, ট্রিপল সেঞ্চুরি আর হলো না ফস্টারের। ব্যক্তিগত ২৮৭ রানে সন্ডার্সের বলে নোবেলের কাছে ধরা পড়লেন তিনি। ট্রিপল সেঞ্চুরি হলো না বটে, কিন্তু অভিষেকেই ২৮৭ রানের যে রেকর্ড তিনি করলেন, ধারণা করা হয় ব্র্যাডম্যানের মতো এই রেকর্ডও অস্পর্শনীয় রয়ে যাবে সারাজীবন।
কিন্তু আমাদের আজকের গল্প টিপ ফস্টারকে নিয়ে নয়, গল্পটা সেই এগারো নাম্বারে নামা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে। সেই ব্যাটসম্যানের নাম উইলফ্রেড রোডস।
উইলফ্রেড রোডসের জন্ম ইয়র্কশায়ারের কার্কহিটনে, ১৮৭৭ সালের অক্টোবর মাসে। টেস্ট ক্রিকেটের জন্মও সে বছরই। বাবার নাম ছিল আলফ্রেড রোডস, কার্কহিটন ক্রিকেট দলের দ্বিতীয় একাদশের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। সন্তান উইলফ্রেডকেও ক্রিকেটার হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, কিনে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের সরঞ্জামও। উইলফ্রেডের বয়স যখন ১৬ বছর, তখন ক্রিকেটটাকে গুরুত্বের সাথে খেলতে শুরু করেন, কিছুদিনের মধ্যে ঢুকেও যান কার্কহিটনের দ্বিতীয় একাদশে। সেই সাথে একটা চাকরি নিতে হয় স্থানীয় রেলওয়েতে। ভালোই সামলাচ্ছিলেন দু’দিক। কিন্তু একদিন সঠিক সময়ে মাঠে পৌঁছানোর জন্য রেলের ঘণ্টা বাজাতে ভুলে যান, ফলে চাকরিটা হারাতে হয় তাকে। শাপে বর হলো তার জন্য। একটা খামারে কাজ নেন তিনি, ক্রিকেটে আরও বেশি মনোযোগ দিতে সক্ষম হন। এদিকে মাঠের খেলায় ক্রমেই উন্নতি করছিলেন, যার ফলে কার্কহিটনের প্রথম একাদশে ঢুকে যান। শুরু হয় উইলফ্রেড রোডসের উত্থান।
তার পেশাদার ক্রিকেট জীবন শুরু হয় স্কটল্যান্ডের গালা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। সে সময় ব্যাটিংয়ে ওপেন করতেন তিনি, ডান হাতে ব্যাট করতেন। আর বল করতেন বাঁ হাতে, মিডিয়াম পেস বোলার ছিলেন। প্রথম মৌসুমে নেন ৯২ উইকেট। সে সময় নিজের বলের কার্যকারিতা লক্ষ্য করে পেস বোলিং থেকে স্পিনে সরে আসেন। পরের মৌসুমে উইকেট কম পেয়েছিলেন বটে, তবে গড়ের চেহারাটা ভালো হয়েছিল আগের চেয়ে। এরপর আর গালা ক্রিকেট ক্লাবে থাকার মানে হয় না। এমসিসির একজন সদস্যের পরামর্শে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে খেলার জন্য চলে আসেন ইংল্যান্ডে।
প্রথমে ধর্ণা দেন ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবে। কিন্তু অর্থ সমস্যার কারণে তারা ফিরিয়ে দেয় উইলফ্রেডকে। বাধ্য হয়ে উইলফ্রেড যান ইয়র্কশায়ারের দরজায়। সে সময় ববি পিলের বদলি হিসেবে একজন বাঁহাতি স্পিনার খুঁজছিল ইয়র্কশায়ার। একটা ট্রায়াল ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে যান উইলফ্রেড। কিন্তু সেই ম্যাচে তার পারফরম্যান্স হলো জঘন্য। ফলাফল, ইয়র্কশায়ার নিতে রাজি হলো না তাকে।
উইলফ্রেডের কপাল খুলল ১৮৯৮ সালে। হেডিংলি’র নেটে বল করার জন্য ডাকা হলো তাকে, সেখান থেকে সুযোগ পেয়ে গেলেন কিছু প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলার। সেই বছরেরই ১২ মে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হলো তার। সুযোগ পেয়েই চমক দেখালেন, প্রথম ম্যাচেই তুলে নিলেন ৬ উইকেট। দ্বিতীয় ম্যাচে আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠলেন, ৪৫ রানের বিনিময়ে নিলেন ১৩ উইকেট। মৌসুম শেষ করলেন ১৫৪ উইকেট নিয়ে, যে কারণে ১৮৯৯ সালে যে পাঁচজন ‘উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হলেন, তাদের একজনের নাম উইলফ্রেড রোডস।
রোডস জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নামলেন ১৮৯৯ সালের জুন মাসের ১ তারিখে। সেই ম্যাচে তিনি ব্যাট করতে নেমেছিলেন দশ নাম্বারে। দশ নাম্বারে কারা ব্যাট করে, তা পাঠকরা জানেন নিশ্চয়ই! সেখান থেকে ব্যাটিং অর্ডারে ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠতে থাকেন। উঠতে উঠতে এক সময় ওপেনিং জুটিতে স্যার জ্যাক হবসের পার্টনারও হয়ে যান! উইলফ্রেড রোডস সেই তিনজন খেলোয়াড়ের একজন, যিনি টেস্টে ১ থেকে ১১ সব পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। বাকি দু’জন – ভারতের ভিনু মানকড় এবং অস্ট্রেলিয়ার সিড গ্রেগরি।
রোডস সারা জীবনে টেস্ট খেলেছেন ৫৮টি, ২ সেঞ্চুরিসহ রান করেছেন ২,৩২৫, উইকেট নিয়েছেন ১২৭টি। এই পরিসংখ্যানে নিশ্চিতভাবেই একজন সাদামাটা অলরাউন্ডারের ছবি ফুটে উঠবে মনের মধ্যে। জেনে রাখুন, আসল ‘অলরাউন্ডার’ উইলফ্রেড রোডস লুকিয়ে আছেন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে। প্রায় ৪০,০০০ (আসলে ৩৯,৯৬৯) রানের সাথে নিয়েছেন ৪,২০৪ উইকেট। চক্ষু ছানাবড়া ধরনের পরিসংখ্যান বৈকি!
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকদের মধ্যে সবার উপরে আছেন ১৯৯ সেঞ্চুরিওয়ালা স্যার জ্যাক হবস, তার রান ৬১,৭৬০। এই তালিকার ১৭ নাম্বারে আছেন রোডস, তার রান ৪০,১৪০। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এত রান নেই স্বয়ং ব্র্যাডম্যানেরও! অবশ্য ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট বাহুল্যমাত্র। এই ভদ্রলোক টেস্টেই যা করে দেখিয়েছেন, তারপর আর ফার্স্ট ক্লাসের কথা না বললেও চলে।
এ তো গেল ব্যাটিংয়ের হিসাব। বোলিংয়ে উইলফ্রেড রোডসের ৪,২০৪ উইকেট এখনও রেকর্ড। অলরাউন্ডার বাদ দিন, এত উইকেট নেই আর কোনো ফুলটাইম বা স্পেশালিস্ট বোলারেরও! এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৬৮ বার, যা কি না দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম স্থানে আছেন টিচ ফ্রিম্যান। এক ম্যাচে ১০ উইকেটও নিয়েছেন ৬৮ বার, যা কি না ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি বলও তার করা; সংখ্যাটা চোখ কপালে তোলার মতো, ১,৮৫,৭৪২! আর অনুমেয়ভাবেই সবচেয়ে বেশি রানও দিয়েছেন তিনিই, যার পরিমাণ ৭০,৩২২।
ক্যাচ ধরেছেন ৭৬৪টা, যা সপ্তম সর্বোচ্চ। ৩০,০০০ রান আর ২,০০০ উইকেটের যে এলিট ক্লাব আছে, তার সংখ্যা মাত্র ৪ জন। একজন উইলফ্রেড রোডস, বাকি তিনজন জর্জ হার্স্ট, ফ্রাঙ্ক উলি এবং ডব্লিউ জি গ্রেস। সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার দখলে, খেলেছেন ১,১১০ ম্যাচ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রাঙ্ক উলি, তিনি খেলেছেন ৯৭৮ ম্যাচ। এবং রোডস হচ্ছেন ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের এক মৌসুমে ১০০০ রান করেছেন এবং ১০০ উইকেট নিয়েছেন ১৬ বার! ‘রেকর্ডের বরপুত্র’ বুঝি একেই বলে!
দুর্দান্ত রকমের অ্যাক্যুরেসি আর ফ্লাইট ছিল তার বোলিংয়ের মূল বৈশিষ্ট্য। প্রখ্যাত ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্ডাস তাকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,
“ফ্লাইট ছিল তার ব্রহ্মাস্ত্র। কখনো বাঁক নিচ্ছে, কখনো উঠছে, কখনো নামছে, কখনো লোভ দিচ্ছে, কখনো বিধ্বংসী হয়ে উঠছে… সব বল যেন একই রকম, অথচ কী অপূর্ব বৈচিত্র্য যেন! প্রত্যেকটা ওভার যেন ভানুমতির খেল, প্রতিটা বল যেন ষড়যন্ত্রের পালাবদল; কিছু বল যেন নেহায়েত নির্বিষ নিরীহ, কিছু বলে যেন শৈল্পিক ছোঁয়া, আর হঠাৎ এক একটা প্রাণঘাতী ‘মাস্টার বল’!”
এখানে একটা কথা আসতে পারে। উইলফ্রেড রোডস খেলা শুরু করেছেন ১৮৯৮ সালে, অবসর নিয়েছেন ১৯৩০ সালে। শেষ টেস্ট যখন খেলেন, তখন তার বয়স ৫৩ বছর। প্রায় ৩২ বছরের ক্যারিয়ারে এমন অনেক কিছুই করা যায়, যা কেউ কখনো ভাবেনি আগে। কিন্তু তাতে তো উইলফ্রেড রোডসের কীর্তি মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না! প্রায় ৫৩ বছর বয়সে কেউ যদি টেস্ট খেলে প্রতি ওভারে ১ রানেরও কম দেয়, তাহলে সে কৃতিত্বকে অস্বীকার করার উপায়ও নেই।
লেখাটা শেষ করা যাক দুটো তথ্য দিয়ে।
টিপ ফস্টারের সেই ইনিংসের পর ২৯২ রানে পিছিয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে মারকাটারি স্টাইলে ব্যাট করতে লাগল তারা। তবে সব আলো কেড়ে নিলেন ভিক্টর ট্রাম্পার। দল যখন ৪৮৫ রানে অলআউট হয়ে গেল, তখন তিনি ১৮৫ রানে অপরাজিত। ইংল্যান্ডের অন্য কোনো বোলার তেমন সুবিধে করতে না পারলেও রোডস ঠিকই ৯৪ রানে তুলে নিলেন ৫ উইকেট। তার বোলিংয়ের কারণে ভিক্টর ট্রাম্পার পর্যন্ত এক পর্যায়ে বলতে বাধ্য হন,
‘ফর গডস সেইক, উইলফ্রেড! একটু তো দম নেয়ার সুযোগ দাও!’
এ তো গেলো প্রতিপক্ষের প্রশংসা বাক্য। সতীর্থরা রোডসকে কী চোখে দেখতেন, তার একটা নমুনা পাওয়া যাবে জর্জ হার্স্টের কথা থেকে। জর্জ হার্স্টকে একবার প্রশ্ন করা হয়, ‘হু ইজ দ্য গ্রেটেস্ট অলরাউন্ডার?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
“Nobody knows, but he batted right-hand and bowled left, and he came from Kirkheaton.”