বলা হচ্ছে, সিনিয়ররা খেললে জিতছে বাংলাদেশ; নইলে নয়। এটা তামিমের ক্ষেত্রে আরও সত্যি। বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ব্যাটিং মানেই তামিম ইকবালের রান পাওয়ার ওপর ভরসা করা। একদিকে তামিমরা এই সিনিয়ররা প্রতিনিয়ত দলকে টানছেন, অন্যদিকে তরুণরা ঠিক নিজেদের খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই অবস্থায় তরুণদের না পারা, তাদের পাশে থাকা, দলের পারফরম্যান্স, এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তামিম ইকবাল।
এখন জুনিয়রদের পারফরম্যান্স নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে দলের যা করার আপনারা সিনিয়ররা করছেন। জুনিয়ররা যে পারছে না, এটা কি দুশ্চিন্তার ব্যাপার?
আমি ঠিক দুশ্চিন্তার ব্যাপার মনে করি না। এরা কিন্তু শুরুতে সবাই পারফর্ম করেছে। এখন হয়তো হচ্ছে না নানা কারণে। ওরা চেষ্টা করছে। ওদের সময় দিলে আমি মনে করি, ওরা পারবে। আমি এই তরুণদের ওপরই ভরসা রাখতে চাই।
আপনার সাথে তিন ফরম্যাটে কয়েকজন ওপেনার দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ আপনাকে সেই অর্থে সঙ্গ দিতে পারছে না। এটা হতাশার নয়?
হতাশার না। হয়তো তাদের সেরকম পারফরম্যান্স হচ্ছে না। কিন্তু আমি দলে সাথে থেকে যা জানি, যারাই দলে এই দায়িত্ব পালন করছেন তারা সবাই প্রচন্ড পরিমাণ চেষ্টা করেন। যতটুকু নিজেদের উন্নতি করা দরকার সেটা তারা করছে। হয়তো প্রত্যাশামতো ফলাফল পাচ্ছি না। কিন্তু আমার কারো সামর্থ্যের উপর কোনো সন্দেহ নেই। আমার সাথে যে-ই ব্যাট করেছে তারা সবাই যোগ্য, বাংলাদেশে অন্তত দশ বছর সার্ভিস দেয়ার জন্য। আমার কাছে মনে হয় দুই-একটা ম্যাচ দরকার তাদের, ভালো একটি ইনিংস হলেই ওরা স্থায়ী হয়ে যাবে।
ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে এদের ভালো করে আসা উচিত। কিন্তু সেখান থেকে ভালো করে এসেও তো তরুণরা সেভাবে চ্যালেঞ্জটা নিতে পারছে না।
দেখেন, ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের কথা বলে। আপনি দুনিয়ার সব সুযোগ সুবিধা দিতে পারেন, কিন্তু প্লেয়ারদের মধ্যে যদি চ্যালেঞ্জটা না থাকে তাহলে কিন্তু কোনো লাভ নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ থাকাটা। ভালো করার স্পৃহাটা থাকতে হবে। বোলিংয়ের কথা যদি বলি, বোলারদের লম্বা স্পেল খেলার চেষ্টা করতে হবে। এটা নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ; কী আমার পক্ষে আছে আর কী আমার পক্ষে নেই এসব না ভেবে ভালো করার চেষ্টা করা উচিত।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের প্রথম টেস্টের কথাই ধরুন, আমরা তো সেখানে গিয়ে তর্ক করতে পারি না যে আমাদের ফ্ল্যাট উইকেট দেন। কন্ডিশন যেটা ছিল সেটাকে আমাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া উচিত ছিল, সেটা আমরা নিতে পারিনি। এমন অনেক টেস্ট সিরিজ আছে যেখানে আমরা ভালো করেছি, চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ভালো করেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও একই কথা, চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। ১০ জন গড়পড়তা চিন্তা করলে আপনাকে আলাদা চিন্তা করতে হবে। ভাবতে হবে, এই ফরম্যাটে, এই উইকেটে আমি নিজেকে কিভাবে ভালো করতে পারি। ব্যক্তি যদি নিজে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় তাহলে সহজ হয়ে যাবে।
বোর্ডের তরফ থেকে যা দেয়া দরকার তারা দিচ্ছে। এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করতে পারি? একটা ভালো মাঠ দিচ্ছে, উইকেট দিচ্ছে, সব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে; এর চেয়ে বেশি তো আর তারা দিতে পারে না। তারা তো আমাদের হাত ধরে খেলিয়ে দিতে পারবে না। আমাদের নিজেদের দায়িত্ব হলো ঐ অবস্থা থেকে আমাদের নিজেদের জন্য ভালো পারফরম্যান্সটা বের করে নিয়ে আসা।
তরুণরা পারছে না। কিন্তু সিনিয়ররা পারছেন কী করে?
এটাতে রহস্যের কিছু নেই। আমরা এতদিন ধরে জাতীয় দলে খেলছি। ১০-১৫ বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে একেকজনের। এটাই তো আমাদের সেরাটা দেওয়ার সময়। আমি মনে করি, আমাদের সিনিয়ররা যেটা করা উচিত, সেটা করতে পারছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আপনার কাছ থেকে বা মুশফিকের কাছ থেকে তরুণদের শেখা উচিত। এসব তরুণ ক্রিকেটার কী আপনাদের কাছে এই ধরনের সহায়তা চাচ্ছেন?
দেখুন, আমরা তো একই সাথে থাকি। আমার দুয়ার তো সবসময় সবার জন্য খোলা থাকে। কারো যদি মনে হয় আমার সাথে কোনো আলাপ করলে, একটু টিপস নিলে উপকার হবে, তাহলে আমি তো সবসময় হাজির আছি। ওরাও সেটা জানে যে, আমি সবসময় ওদের পাশে থাকতে তৈরি আছি।
একটু ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আলাপ করা যাক। টেস্টে এত বাজে ফলের কারণ কী ছিলো?
আমাদের টেস্ট সিরিজ যতটা ভালো খেলা উচিত ছিল তার আশেপাশেও খেলতে পারিনি। অনেকে উইকেট ও বলের (ডিউক) কথা বলছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমরা এর চেয়ে আরও ভালো খেলতে পারতাম। উইকেট কঠিন ছিল, কিন্তু যেমন খেলেছি এর থেকে ভালো দল আমরা। আর টেস্ট সিরিজের মানসিকভাবে আমরা ডাউন ছিলাম। আমাদের জন্য ওয়ানডে সিরিজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমরা জানতাম ওয়ানডে ফরম্যাটে আমরা সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডে সিরিজে ঘুরে দাঁড়ানোর রহস্যটা কী ছিলো?
আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে মাশরাফি ভাইয়ের দলে যোগ দেয়ার বড় অবদান ছিল। তিনি হয়তো অন্যের হয়ে ব্যাটিং ও বোলিং করে দেননি। কিন্তু তিনি দলের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিবর্তন করতে অনেকে সাহায্য করেছেন। একটা বাজে টেস্ট সিরিজের পর প্লেয়ারদের মধ্যে অনেক নেতিবাচক মনোভাব থাকে, পরিষ্কার মনোভাব থাকে না। তিনি যে ইতিবাচক মনোভাবটা নিয়ে এসেছেন, সেটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটা বড় কারণ ছিল। এরপর যেভাবে করে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটা খেললাম, কঠিন উইকেটে আমরা কোনো সময় হাল ছেড়ে দেইনি।
দ্বিতীয় ম্যাচে খুব কাছে গিয়ে হেরে গেলেন আপনারা…
আমরা চাচ্ছিলাম প্রথম দুই ম্যাচেই সিরিজটা জয় করে নিতে। কারণ গায়ানার উইকেট আমাদের হয়ে কথা বলছিল। বল স্পিন করছিল, মাঠ বড় ছিল। সেন্ট কিটস অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফেভারে ছিল।
দ্বিতীয় ম্যাচ হারের পর কী ধরনের কথাবার্তা হলো?
হারার পর মাশরাফির ভাইসহ বসেছিলাম, তার অনেক বড় ইনপুট ছিল। আমরা যদি আগে থেকেই চিন্তা করে নেই যে ওরা আমাদের থেকে এগিয়ে আছে তাহলে আমরা খেলার আগেই হেরে গেছি, তাহলে শেষ ওয়ানডে খেলার কোনো মানে হয় না। আমরা আগে চিন্তা না করে মাঠে পারফর্ম করে দেখাতে চেয়েছি।
ওখানে বসেই বলছিলেন, ওই উইকেটে ব্যাট করা সহজ ছিলো না।
কষ্ট করে উইকেটে ছিলাম আমরা। সেটার ফলাফল পেয়েছি। এরপর স্বভাবতই দলের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আমার কাছে মনে হয়, এমন টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টিতে ফিরে আসা বিশেষ পারফরম্যান্স ছিল।
আপনার ও সাকিবের দুটো অসাধারণ জুটি ছিলো। এই দুটোকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
পার্টনারশিপটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল টেস্ট সিরিজ থেকে কামব্যাক করার জন্য। ঐ উইকেটে ব্যাট করা কোনোভাবেই সহজ ছিল না। সেই সময় যদি আমি অথবা সাকিব উইকেটটা ছুড়ে ফেলতাম, তাহলে বিষয়টা আরও কঠিন হতো। কারণ অনেক ডট বল হচ্ছিলো। আমাদের মনোযোগ ঠিক ছিল, আমরা জানতাম এই উইকেটে স্কোরবোর্ডের দিকে না তাকিয়ে টিকে থাকাই রান করার একমাত্র উপায়। আমাদের কেউ একজন যদি আউট হয়ে যেতাম, তাহলে ওই পার্টনারশিপটাও হতো না, আর আমাদের রানটাও বাড়তো না। তখন ম্যাচের গতিপথ ভিন্ন হতে পারতো। এই পার্টনারশিপটা সিরিজ জয় ও টি-টুয়েন্টি জয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল।
আপনারা দুজনেই নিজেদের স্বাভাবিক খেলার বাইরে গিয়ে খেলেছেন বলে মনে হয়?
সাকিবকেও তার স্বাভাবিক খেলার চেয়ে ভিন্ন ধাঁচে খেলতে হয়েছে। ওই উইকেটে কিছুই করা যাচ্ছিলো না। সেখানে আগ্রাসী ব্যাটিং করে হয়তো আপনি আউট হয়ে যেতেন না হয় আমরা যেটা করেছি সেটা করতেন। ম্যাচের ৩০ ওভারের পরে উইকেট কিছুটা সহজ হয়েছিল। প্রথম ৩০ ওভার কিছুই করা যাচ্ছিলো না। আমার কাছে মনে হয় আমাদের দুজনেরই এটা বিশেষ পারফর্মেন্স ছিল।
বিশ্বকাপের তো আর বেশি দিন বাকি নেই। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি কেমন চলছে?
বিশ্বকাপের বেশি দিন নেই, কিন্তু আমাদের প্রচুর খেলা আছে। আশা করবো টিম ম্যানেজমেন্ট যাদের নিয়ে ভাবছেন তাদের যথেষ্ট সময় দেয়া হোক। আশা করি যথেষ্ট সুযোগ পেলে ভালো করবে। তারা সবাই খুবই প্রতিভাবান। আশা রাখি সুযোগ পেলে তারা জায়গা পাকা করতে পারবে।
এশিয়া কাপে আমাদের লক্ষ্য কী?
প্রথম দুই ম্যাচ আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দ্বিতীয় রাউন্ডে কোয়ালিফাই করতে হবে। আমাদের প্রস্তুতিটা হচ্ছে সেই জন্যই। আমরা যদি এখন ফাইনাল কিংবা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চিন্তা করি সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রথম দুই ম্যাচ জিততে হবে। প্রথম দুই প্রতিপক্ষ নিয়েই আমাদের পরিকল্পনা করা উচিত।
এশিয়া কাপের আগে আপনারা কি আত্মবিশ্বাসী?
আমরা এমন কোনো প্রতিপক্ষের সাথে খেলবো না যাদের সাথে আমরা এর আগে খেল নি। আমরা সব প্রতিপক্ষের সাথেই খেলেছি আর ভালো খেলে আমাদের দিনে ওদের হারিয়েছি। আশা করি এই দুটি ম্যাচে আমরা ভালো প্রস্তুতি নিয়ে যাবো এবং আমাদের সেরা খেলাটা খেলার চেষ্টা করবো।
আরব আমিরাতে তো আপনি পিএসএল খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতা দলের কাজে লাগবে?
গত কয়েক বছর ধরে কোনো না কোনো সময় আমরা সেখানে খেলেছি। উইকেট কী ধরনের হতে পারে- এটা নিয়ে কিছুটা হলেও আমাদের আইডিয়া আছে। যখন ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু হবে এবং পরিকল্পনা নিয়ে কথা হবে তখন অবশ্যই এই বিষয়ে আলোচনা করবো।
ব্যাটিং কোচ হিসেবে নীল ম্যাকেঞ্জিকে কেমন মনে হলো?
আমার কাছে মনে হয় তার বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক কিছু দেয়ার আছে। যতদিন ওর সাথে কাজ করেছি আমার মনে হয় হয়েছে সে দারুন একজন কোচ। সে যেভাবে ব্যাটিং নিয়ে চিন্তা করে, আমার কাছে মনে হয় আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে তার কাছ থেকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মুখিয়ে আছি তার সাথে কাজ করার জন্য। সে আমাকে যেসব কথা বলেছে তা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে খুবই ভালো লেগেছে। আমি ওর কথাগুলো শুনে নিজেকে আরও শানিত করতে পারি তাহলে, আমার মনে হয় আমি আরও ৫-১০% আরও উন্নতি করতে পারবো। ওই উন্নতি করার জায়গাটা আছে। আশা করি ওর সাথে কাজ করে অনেক কিছু নিতে পারবো এবং অন্যরাও একইভাবে চিন্তা করবে।