চাওয়া ছিল, তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর নিষ্প্রভ থাকার দিনেও বাংলাদেশ জিতবে। আফিফ হোসেন ধ্রুব আর মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাটে সেটা হয়েছে। চাওয়া ছিল, বল হাতে কেউ মাঝের ওভারগুলোতে উইকেট এনে দেবেন দলকে। তাসকিন আহমেদের সৌজন্যে সেটাও হয়েছে। প্রথম দুই ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটা অধিনায়ক তামিম ইকবালকে ঘড়া উপুড় করেই বর দিয়েছে। যেভাবে চাইছেন, যা চাইছেন, সেটাই যেন মিলে যাচ্ছে ব্যাটে-বলে। তবে অধিনায়ক শব্দটা ছেঁটে ফেললেই আর লেখা যাচ্ছে না লাইনটা। দুই ম্যাচে মিলে রান করেছেন ২০, আউট হওয়ার চেয়েও বড় প্রশ্ন জাগিয়েছেন আউট হওয়ার ধরনে।
দুটো ম্যাচেই আউট হয়েছেন প্রায় একই বলে, একই ভাবে। ফজলহক ফারুকির ইনসুইংগুলো আড়াআড়ি ব্যাটে খেলতে গিয়ে হয়েছেন এলবিডব্লিউ। টাইমলাইন ধরে একটু পিছিয়ে গেলে প্রায় একই রকম আউটের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে গত নিউ জিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা সিরিজেও। সবশুদ্ধ তাই শেষ ১১ ইনিংসের ৫টাতেই তামিম কাটা পড়েছেন লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে। এখন বললে কে মানবে, এই মানুষটাই ক্যারিয়ারে প্রথম এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ার আগে খেলে ফেলেছিলেন ৪৩ ম্যাচ, প্রথম ৬৯ ইনিংসে এলবিডব্লিউর শিকার হয়েছিলেন মাত্র দু’বার!
অথচ কোচ-বিশ্লেষক থেকে শুরু করে তামিমের দাবি মানলে, তখনই তার এলবিডব্লিউ হওয়ার কথা ছিল বেশি। সবাই এক বাক্যেই মেনে নেন, লেগ সাইডের বলগুলোতে তখন তিনি হাঁসফাঁস করতেন রীতিমতো। তামিম তো বলেন, অন সাইডে তার শটই ছিল না। যার প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি অজস্র। স্মৃতি হাতড়ে দৃষ্টান্তগুলো বের করতে না চাইলে নিচের স্থিরচিত্রটাতেও চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন একবার। ইংলিশ বোলারের ডেলিভারিটায় পুলই করতে চেয়েছিলেন, প্রতিদানে চারও পেয়েছিলেন, কিন্তু শরীরের অবস্থান দেখলে টেকনিকের ‘অ আ ক খ’ না জেনেই বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার, শটটায় তামিমের কর্তৃত্ব ছিল না একদমই।
শটের ওপর তামিম কর্তৃত্ব হারাতেন তখনকার ব্যাট হোল্ড করার ধরনের কারণেও। ফুটওয়ার্কের ওপর তার আস্থা ছিল না একদমই, ‘স্ট্যান্ড অ্যান্ড ডেলিভার’ নীতি মেনে হাত ছুড়ে দিতেন বলের লাইন বিচার করা মাত্রই। লর্ডসে তামিমের সেই বিখ্যাত সেঞ্চুরির দিন ধারাভাষ্য কক্ষে বসে যে কথা উচ্চারণ করতে শোনা গিয়েছিল নাসের হুসেইনকেও, ‘টেকনিক নিয়ে ও (তামিম) একদমই ভাবিত নয়, রানটা হলেই হলো।’
আর তামিম তখন ব্যাটটাও মাটির সঙ্গে ঠেসে রাখতেন বোলারের ফ্রন্ট ফুট কন্ট্যাক্ট হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ, ব্যাট সুইংয়ের ক্ষেত্রে তাকে বেশি পথ পাড়ি দিতে হতো সীমিত সময়ে। আর, তড়িঘড়ি করতে গিয়ে গোলযোগ পাকিয়ে যাওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রথমবার এলবিডব্লিউ হওয়ার আগে ৩২ বার হয়েছিলেন ক্যাচ আউটের শিকার, এই পরিসংখ্যানটাই বোধ হয় বলে দেয় অনেক কিছু।
নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে আর টুকিটাকি কিছু টেকনিক্যাল পরিবর্তন এনে তামিম ব্যাটিংয়ে এনেছেন নিয়ন্ত্রণ, ব্যাটে এনেছেন তার সুদিন। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ৮০ ম্যাচে ৫০.১৫ গড়ে রান করেছেন ৩৫৬১। সেঞ্চুরি করেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজেও।
কিন্তু, এখন সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে? উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। দুরন্ত ফর্মের পিঠে চড়ে সেবার বিশ্বকাপে হাজির হয়েছিলেন তিনি, তবে বিশ্বকাপটা কেটেছিল হতাশায় মোড়া। ৮ ম্যাচে ২৯.৩৭ গড়ে করেছিলেন ২৩৫ রান। এবং, সেই বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ থেকে শুরু করে পরের শ্রীলঙ্কা সিরিজ পর্যন্ত টানা ছয় ম্যাচে হয়েছিলেন বোল্ড আউট, এর মধ্যে তিনবার আবার প্লেড অন।
ওই ম্যাচগুলোর ভিডিও ফুটেজ আগাপাশতলা নেড়েচেড়ে দেখা যাচ্ছে, লেগ-মিডল স্টাম্পে গার্ড নেওয়া তামিমের ট্রিগার মুভমেন্ট অর্থাৎ, সামনের পায়ের ফরোয়ার্ড প্রেসটা শেষ হতো মিডল স্টাম্পে এসে। দুটো স্টাম্প উন্মুক্তই থাকত তাই, বোলাররা স্টাম্প তাক করার সুযোগ পেতেন বেশি। সঙ্গে অফ স্টাম্পের বাইরের বলগুলোর নাগাল পেতেও হাতকে বাড়িয়ে দিতে হতো অনেকটা সামনে। ফলাফল, নিজের এক সময়ের শক্তির জায়গা অফ সাইডেও দুর্বল হয়ে পড়া, বেশি পরিমাণ বলের লাইন মিস, প্লেড অন, বোল্ড।
তামিমও যে এই বোল্ড সমস্যার অবসান চাইছিলেন, সেটা আমরা বুঝতে পারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরবর্তী ওয়ানডে সিরিজে (২০২০ সালের মার্চে)। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তামিমের প্রাথমিক মুভমেন্টে ফ্রন্ট ফুট এসে পড়ছে অফ স্টাম্প কিংবা এরও অনেক বাইরে। বোল্ড আউট হওয়ার সম্ভাবনা তাই কমে গিয়েছে অনেকটাই। ‘করিডর অব আনসার্টেনটি’ কিংবা এরও বাইরের বলগুলো তাই তামিম খেলতে পারছেন আগের চেয়ে ভালো।
কিন্তু কার্নোর ইঞ্জিন তৈরি করা যেমন অসম্ভবের সমার্থক, ব্যাটিংয়ে শতভাগ নিঁখুত টেকনিক অর্জন করাও তো তা-ই। মাঠের এক পাশে খুব ভালো হওয়ার মানে আরেকটা পাশে অবধারিতভাবেই দুর্বল হয়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ক্রিকেটার শক্তির জায়গার ওপর জোর দেওয়ার বদলে দুর্বলতা ঢাকতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন, তামিমও সেটাই করেছেন। এবং, ওই দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে বোলারদের জন্য অন্য আরেকটা লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন।
স্টাম্প ঢেকে দাঁড়ানোতে বোল্ড আউট হওয়ার সম্ভাবনা কমেছে যেমন, তেমনি বেড়েছে এলবিডব্লিউ হওয়ার সম্ভাবনা। ফরোয়ার্ড প্রেসে পেছনের পায়ের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু সামনের পা-টা এসে পড়ছে উইকেটের প্রায় সমান্তরালে, যে কারণে তার দু’পায়ের মাঝে তৈরি হচ্ছে গুণ চিহ্ন, খেলতে হচ্ছে বলের অ্যাক্রোস দ্য লাইনে।
এমনিতে স্ট্যান্স নেওয়ার সময় তামিমের ভারসামাই ঠিক থাকলেও ট্রিগার মুভমেন্টের পরে শরীরের ভারসাম্যটা আর থাকছে না। মাথাটা হেলে পড়ে যাচ্ছে ডানে (তামিমের বাঁয়ে অবশ্যই)। যা পরিষ্কার হয়েছে সিরিজের প্রতিটি আউটেই, বলের লাইনে গিয়ে খেলার যে কথা শেখানো হয় ক্রিকেটের সব পাঠশালায়, সেটা তামিম অনুসরণ করতে পারছেন না একদমই।
সমস্যা আছে আরও। সামনের পা-কে মাটিতে স্থাপন করার আগে আগের চেয়ে খানিকটা বেশি পথ পরিভ্রমণ করে আসতে হচ্ছে দেখে ফরোয়ার্ড প্রেস শেষ হতে হতে বল পেরিয়ে ফেলছে ক্রিজের অর্ধেকের বেশি পথ। নিচের কোলাজটাতেই দেখুন। ২০১৯ বিশ্বকাপে মোহাম্মদ শামির করা বলটা (গতি ঘণ্টায় ১৪০ কি.মি.) উইকেটে পড়ার আগেই তামিম শেষ করে এসেছেন তার ট্রিগার মুভ। কিন্তু, এই সিরিজে দেখা যাচ্ছে, ফারুকির করা বলটা (গতি ঘণ্টায় ১৩৬ কি.মি.) উইকেটে পড়ে এগিয়েও গিয়েছে বেশ কিছুটা পথ, শামির চেয়ে ফারুকির বলটায় গতি কম হওয়া সত্ত্বেও তামিম তার প্রাথমিক নড়াচড়া শেষ করলেন সদ্যই। বলের লাইন অনুযায়ী পা সরিয়ে নেওয়ার জন্য তামিম তাই এখন সময়ও পাচ্ছেন কম। এলবিডব্লিউর সম্ভাবনা এতে করে বেড়ে যাচ্ছে আরও।
প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় কমে যাওয়া প্রভাব ফেলছে শরীরের ভর স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও। বেশ কিছু বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সামনের পায়ের আঙুলের ডগা মাটি ছোঁয়নি তখনও। মানেটা হচ্ছে, শরীরের ভারটা পুরোপুরিভাবে সামনের পায়ে বদলের আগেই ডেলিভারিগুলো খেলতে হচ্ছে তাকে। দ্রুতগতিতে হাত নামিয়ে এনে যে বলগুলো খেলতে পারছেন, সে বলগুলোতেও শরীরের ভারসাম্যটা ঠিক থাকছে না, টাইমিংটাও অনেক সময় যুৎসই হচ্ছে না। ব্যাটে বল লাগার আগেই তাই পায়ে বল লাগার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে বহুলাংশে।
তামিম ইকবালের নবোদ্ভূত এই সমস্যা ধরা পড়েছে বাংলাদেশের নতুন ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের চোখেও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছেন,
‘আমার কাছে মনে হয়, ফুটওয়ার্কটাই বড় কারণ। তামিম চাইছে ওর সামনের পা সোজা করতে। এটা আসলে শীঘ্রই হওয়ার ব্যাপার না, তবে আমরা দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছি। সে যদি আরও তিন-চার বছর খেলতে চায়, তবে ওর পা কিছুটা সোজা করতে হবে। সে যদি এলবিডব্লিউ না হয়, তবে ওকে আউট করা খুব কঠিন। ও আরও বেশি রান করতে পারবে, সাফল্য পাবে।’
তামিম অবশ্য তিন-চার বছরের ভাবনা করছেন বলে মনে হয় না। বিশ্বকাপে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চাইলে তো একটা বছরই পাচ্ছেন!