উইকেট নেওয়ার পর তাসকিনের উদযাপনটা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন বিশাল কোন এলবাট্রস নীল সমুদ্রের বুকে পাখা মেলে দিয়েছে। রাজকীয় ভঙ্গিতে বাতাস কেটে সাঁ সাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। তাসকিন আহমেদ ২২ গজে এলবাট্রস হতে চেয়েছেন বারবার। গতি আর ইয়র্কারের তোপে শিকার তুলেছেন বারবার। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন অনন্য এক যোদ্ধা হিসেবে।
কিন্তু যোদ্ধাদেরও কখনও আহত হতে হয়। আবারও ফিরতে হয় বীরের বেশে। তাসকিনের সময়টা ভালো যাচ্ছে না একেবারেই। ইনজুরি, বাজে পারফরম্যান্স; সবমিলিয়ে যা তা অবস্থা। অথচ, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে কি অসাধারণ এক শুরুটাই না হয়েছিল তার! সবকিছু বদলে যেতে থাকলো ২০১৬ সালে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের অভিযোগের পর। যোদ্ধার মতো সেটাও পার করে ফিরেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালে নিদাহাস ট্রফির ইনজুরি তাকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। দৃশ্যপট থেকেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ডানহাতি এই প্রতিভাবান ফাস্ট বোলার।
২৩ বছর বয়সী তাসকিন নিজের সক্ষমতা ভোলেননি। তিনি জানতেন তিনি ফিরতে পারবেন, আবারও এলবাট্রস পাখির মতো ডানা মেলে উদযাপন করতে পারবেন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে। তাই তো পাখির নজর রেখেছিলেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। যে বিপিএল দিয়ে জাতীয় দলে ডক পাওয়া, সেই টুর্নামেন্টকেই ফেরার দরজা হিসেবে দেখলেন তরুণ ফাস্ট বোলার তাসকিন। সিলেট সিক্সার্সের হয়ে আরও একবার জিততে চাইলেন সমর্থক, নির্বাচকদের মন। তাসকিন জিতেছেন। তার ঝড়ের মতো গতি আর নিখুঁত নিশানায় এরই মধ্যে তাকে চলমান বিপিএল টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে তো নাম লিখিয়েছেই, আবারও ফিরিয়েছে জাতীয় দলের ছায়াতলে। আসন্ন নিউজিল্যান্ড সিরিজে ১৫ সদস্যের দলে জায়গা হয়েছে তার।
দলে ফেরার পথে তাসকিনের পাশাপাশি আরেক পেসার শফিউল ইসলামও নির্বাচকদের নজরে ছিলেন। কিন্তু তিনি হেরেছেন কেবল তাসকিনের গতির সামনে। ব্ল্যাক ক্যাপদের বিপক্ষে গতির ঝড় চায় বাংলাদেশ দলের ম্যানেজমেন্ট। সঙ্গে উইকেটের ফুলঝুরি। চলমান পারফরম্যান্সে দুটোই একসাথে দিতে পারছেন তাসকিন। তাই ফলাফলটাও মিলল তারই পক্ষে।
১.
২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফির ইনজুরি কাটাতে জোর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন তাসকিন। টানা ৩ মাস মাঠের বাইরে ছিলেন। চেয়েছিলেন আফগানিস্তান সিরিজ দিয়ে জাতীয় দলে ফিরতে। নির্বাচকরাও তাকে এই সিরিজের জন্য ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাসকিনের। পিঠের ইনজুরি থেকে যখন বের হয়ে আসছেন, তখনই আবাহনী লিমিটেডের মাঠে অনুশীলন করতে গিয়ে কব্জিতে চোট পেলেন। সেলাই লাগলো সাতটি। পিঠের ব্যথাটাও বাড়লো তার। এতোটাই বেড়ে গেল যে, তাসকিন পড়ে গেলেন বিছানায়। ফলাফল, আফগানিস্তান সিরিজে ফেরা হলো না তার।
সেই ইনজুরি যখন কাটালেন, বাংলাদেশ তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সিরিজ খেলছে। তাসকিন ডাক পেলেন ‘এ’ দলে। আয়ারল্যান্ডের খেলতে গেলেন, সুযোগ পেলেন শেষ ম্যাচে। আবারও ইনজুরি। থার্ড ম্যান অঞ্চল থেকে বল থ্রো করতে গিয়ে সেই কব্জিতে আবারও চোট পেলেন। এবার দিতে হলো দুটি সেলাই। মাঝপথেই সিরিজ থেকে ফিরতে হয়েছিল তাকে।
সেবার দেশে ফিরে খুব আক্ষেপ নিয়ে তাসকিন বলেছিলেন,
”এটা আসলে আমার দুর্ভাগ্য বলা যায়। একই জায়গায় আগে ব্যথা পেয়েছিলাম, এখন আবার সেই জায়গাতেই ফাটলো। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি সাড়ে পাঁচ-ছয় মাস পর খেলতে নামলাম। কিছু করার নেই আসলে।”
২০১৮ সালে তাসকিন ওই নিদাহাস ট্রফিতে দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেন, এরপর ইনজুরি আর অফ ফর্ম মিলিয়ে জাতীয় দলের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি। ২০১৭ সালেও খুব একটা নজরকাড়া ছিলেন না।
তাসকিন ভেঙে পড়েছিলেন। একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিলেন। বারবার ইনজুরির দুর্ভাগ্যকে সামনে এনে ভাগ্যকে দোষারোপ করতেন। কিন্তু বিধাতা হয়তো তার জন্য একটু বেশিই ভালোকিছুর অপেক্ষায় রেখেছিলেন।
২.
এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) একটু দেরিতে শুরু হয়েছে। আগে থেকেই সেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কারণটা জাতীয় নির্বাচন।
বিপিএলে তাসকিন নাম লেখালেন সিলেট সিক্সার্সের হয়ে। তাতে বোধ হয় তার দুটো লাভ হয়েছিল। প্রথমত, দলের স্ট্রাইক বোলার হওয়ার সুযোগটা পেতে সহজ হয়েছিল, দ্বিতীয়ত দলের কোচ পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার ওয়াকার ইউনিস হওয়ায় ফাস্ট বোলার হিসেবে তাসকিনের জন্য সুবিধা হয়েছিল। দিন শেষে দ্বিতীয় সুবিধাটা তাসকিনকে তার লক্ষ্যের দিকে পৌঁছে দিয়েছে। পুরো টুর্নামেন্ট ধরে সাফল্য পেয়েছেন মুঠোভরে, বারবার উড়েছেন নীল সমুদ্রের এলবাট্রস হয়ে।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেস বোলিং কোচ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। নিজের ক্যারিয়ারে তিনি যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনই প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের পেস বোলিং কোচ হয়ে সেই দলকেও নিজের মতোই সফল করার পেছনে তার উৎসাহের কমতি ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু দুঃসময়ে তার অধীনে তাসকিনের যতটা সফল হওয়ার কথা ছিল তা তিনি তাসকিনকে করতে পারেননি। কিন্তু তরুণ এই ফাস্ট বোলারের পিছনে তিনি যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। হয়তো ওয়ালশেরই দুর্ভাগ্য, তাসকিনের ভাগ্যটা তার টোটকায় ব্যাটে-বলে হয়নি।
সেই তাসকিন ঘুরে দাঁড়ালেন ওয়াকার ইউনিসের অধীনে। তাসকিন ফিরলেন একেবারে সেই পুরনো রুপে। যে রুপে তিনি নিজেও রোমাঞ্চিত হয়েছেন, কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকে রোমাঞ্চিত করেছেন।
এ কথা মিথ্যে নয় যে, তাসকিনের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ পেস আক্রমণে শক্তি সঙ্কটে ছিল। তাসকিনের অভাবটা ভালোই টের পেয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু তাসকিন ঠিক নিজেকে ফিরে পাচ্ছিলেন না।
কিন্তু তাসকিন এবারের বিপিএলে তার কোচের অধীনে বুঝতে পেরেছেন তার সমস্যা কোথায়। ওয়ালশের সাথে তাই ওয়াকারের তুলনা করাও সহজ ছিল তার জন্য। তাসকিনের ভাষায়,
”ওয়ালশ খুব নরম মানুষ। ওয়াকার বেশ কড়া। কিন্তু তারা যখন শেখান, দুজনেই নিজের সন্তানের মতোও করেই শেখান।”
ফাস্ট বোলার হিসেবে তাসকিনের মূল অস্ত্র গতি। কিন্তু আধুনিক ক্রিকেটে টিকে থাকার লড়াইয়ে আরও বাড়তি কিছু প্রয়োজন ছিল। তাসকিন বলেছেন,
”ওয়ালশ আমাকে বাউন্স আর কাট করতে শিখিয়েছেন। ওয়াকার ইউনিসের কাছে আমি শিখেছি কীভাবে রিভার্স সুইং করাতে হয়। তিনি নতুন বলেও সুইং করাতে পারেন।”
তাসকিনের পরিস্থিতি অনুযায়ী, দ্রুত সফলতা প্রয়োজন ছিল। সেটার কারণ আসন্ন নিউজিল্যান্ড সফর, সেখান থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপ। ওয়ালশ যেভাবে শেখান, তাতে লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটের জন্য বেশ সহায়ক। অন্যদিকে, ওয়াকার তাসকিনকে শিখিয়েছেন কীভাবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সফল হওয়া যায়।
ওয়াকার ইউনিস সম্পর্কে তাসকিন আরও বলেছেন,
‘ওয়াকার আমাকে বলেছেন, যেহেতু আমি ফাস্ট বোলার তাই আমাকে একদিকে যেমন বলের গতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে, একই সময়ে আনতে হবে বৈচিত্র্য। আরও সহজ করে বলতে গেলে ওয়ালশ আমাকে আমার বেসিকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন, ওয়াকার চেয়েছেন আমি যেন স্বাধীনভাবে বল করতে পারি।’
৩.
এখন পর্যন্ত চলতি বিপিএলে তাসকিন খেলেছেন মোট ১০ ম্যাচ। উইকেট নিয়েছেন ২০টি। তার নিকটতম উইকেটশিকারি ঢাকা ডায়নামাইটসের সাকিব আল হাসান। বাঁ হাতি এই স্পিনার নিয়েছেন ১৭ উইকেট। রংপুর রাইডার্সের ডানহাতি পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজা ১৭ উইকেট নিয়ে রয়েছেন তৃতীয় অবস্থানে। চলতি টুর্নামেন্টে তাসকিন ৪ উইকেট পেয়েছেন দুইবার। একবার রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে, একবার চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে। এখন পর্যন্ত উইকেটশূন্য থেকেছেন মাত্র এক ম্যাচে।
সবকিছু মিলিয়েই আসন্ন নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য ১৫ সদস্যের দলে তাসকিনের নাম তালিকায় লিখতে নির্বাচকদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
দল ঘোষণার দিন নির্বাচকরা তাসকিনের ব্যাপারে বলেছেন,
”তাসকিন অনেক দিন ঘরে ইনজুরিতে ছিল। সে আমাদের রিহ্যাভের বিসিবির প্রোগ্রামেই ছিল। ওকে আমরা যথেষ্ট নার্সিং করেছি। তারপর ইনজুরি কাটিয়ে বিপিএলে ভালো করেছে। আমাদের একটা প্ল্যান আছ, প্রথমে চিন্তা করেছিলাম লঙ্গার ভার্সনের জন্য। যেহেতু এখন খেলে যাচ্ছে। সামনে ওয়ানডে সিরিজ আছে। আমরা ওয়ানডে সিরিজের জন্য দেখেছি। আমরা সামনে দেখব কেমন করে, তারপর চিন্তা করবো।”
তাসকিন ছাড়াও পছন্দের তালিকায় ছিলেন শফিউল ইসলাম। এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত ৯ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়েছেন তিনি। কেন শফিউল নয়, কেন তাসকিন; সেই উত্তরও দিয়েছেন বাংলাদেশ দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি বলেছেন,
”আমাদের চারজন পেস বোলার আগের সিরিজগুলোতে খেলে গেছে। এখানে তাসকিনের একটু গতি আছে, সেই চিন্তা থেকেই শফিউলের চেয়ে সে এগিয়ে থেকেছে। শফিউলও আমাদের চিন্তাতে আছে। শফিউলকে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সুযোগ দিয়েছি, ইনজুরির কারণে হয়তো সে খেলতে পারেনি। তাকে কিন্তু আমরা একদম বাইরে রাখিনি। আমাদের ফাস্ট বোলিংয়ে যে পুল আছে সেখানে সে ব্যাকআপ হিসেবে আছে। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ফাস্ট উইকেটে খেলতে হবে, সেই কারণে তাসকিন কিছুটা এগিয়ে এসেছে।”
দিন শেষে তাসকিন আবারও হাঁটতে পারছেন নিজের স্বপ্নের পথে। যেমনটা তিনি বলেছেন আগেই,
”আমার স্বপ্ন বিশ্বকাপ। ২০১৮ সাল আমার ইনজুরিতে কেটেছে। যদি বিশ্বকাপে খেলাটা হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে খুব কষ্ট পাবো। সেখানে সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজের ১১০ পার্সেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো আমি।”
তাসকিনের চেষ্টাটা অবিরত থাকুক। সফলতার স্বাস্থ্যকর বাতাসে তাসকিন উড়ুক সাঁ সাঁ করে, ডানা মেলা বিশাল এলবাট্রসের মতো করে।