সমালোচকরা বলতেই পারেন, সাকিব অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছে। সেই আত্মবিশ্বাসই বিপাকে ফেলেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে। চলমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের প্রথম টেস্টের শুরুটা যেভাবে হয়েছে, নিশ্চিত করেই বলা যায় কেবল অধিনায়ক সাকিব আল হাসানই নয়; দলের আর কেউও দুঃস্বপ্নের মতো ওই ম্যাচের কথা আর মনে করতে চাইবেন না। কিন্তু সাকিব কি আসলেও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন? নাকি এটা স্রেফ কৌশলের অংশ ছিল? বড় বড় দলগুলোর মধ্যে এসব দেখা যায়।
মানতেই হবে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যথেস্ট শক্তিশালী দল। কিন্তু ক্যারিবিয়ান কন্ডিশনে বাস্তবতাটা হয়তো মেনে নিলেও পারতেন সাকিব। তাতে করে অন্তত অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্টের আগে বলা, “খুব একটা দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারলেই হচ্ছে।” কথাটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতো না।
সাকিব কোনো দুশ্চিন্তা না দেখলেও ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ৪৩ রানে পুরো দলের গুটিয়ে যাওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার বিষয়। অধিনায়ক হিসেবে দ্বিতীয় দফার শুরুতেই তার উপর যে প্রত্যাশা সমর্থক-ক্রিকেট বোর্ড রেখেছে; সেই প্রত্যাশার ভার সামলে এখন দলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোটাও দুস্কর হয়ে যাচ্ছে তার জন্য।
কিন্তু সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, মহাতারকা। খারাপ সময়ে তিনি ঘুরে দাঁড়াবেন, সেই প্রত্যাশাও তার উপরেই করা হয়। তারপরও, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের শুরুর ব্যর্থতা যেন তাকে শিখর থেকে শূন্যে টেনে নামিয়েছে। অথচ এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই ঠিক ৯ বছর আগে প্রথমবারের মতো টেস্ট অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। সেবার কেবল নেতৃত্ব দিয়েই নয়, সিরিজ জিতে ফিরেছিলেন বল-ব্যাটে দারুণ পারফরম্যান্স দিয়েও।
টস ভাগ্যেও মিলছে না সুফল
সাকিব আল হাসানের টস ভাগ্য বেশ ভালো। যদিও অ্যান্টিগায় স্বাগতিক দলই টস জিতেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে টস জিতেছেন সাকিব। টস জয়-পরাজয় টেস্ট ক্রিকেটে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাই বলে সেই টসের পর বোলিং নিতে হবে নাকি ব্যাটিং নিতে হবে সেটা যেমন বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো। ক্যারিবিয়ান সফরে এবার সেসব যেন ঠিক ঠিক ভাবে করতে পারছে না বাংলাদেশ দল। টস জিতেও তাই মিলছে না সুফল, ব্যবধান গড়ছে উল্টোপথে।
অ্যান্টিগা টেস্টের কথাই ধরা যাক। টস হেরে আগে ব্যাট শুরু করলো বাংলাদেশ। ধারাভাষ্যকারদের পক্ষ থেকে আগেই বলা হচ্ছিলো, এই উইকেটে ব্যাট করা অনেকটা পুলসিরাতের মতো হবে। সেটা অন্তত প্রথম দুদিন। ঘটলোও তাই। বাংলাদেশ ফুরিয়ে গেল ২০ ওভারেরও আগে! অনেকটা একই কাজ হওয়ার কথা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও।
কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। এই পুলসিরাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম দিনে খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসে তুলে ফেলল ৪০৬ রান!
অর্থাৎ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা যেভাবে সফল হয়েছেন, তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি বাংলাদেশের পেসাররা।
ধুঁকছে কেবল বাংলাদেশের পেসার
অ্যান্টিগা টেস্টে বাংলাদেশের পেসারদের প্রাপ্তি বলতে অভিষিক্ত আবু জায়েদ রাহীর পাওয়া ৩ উইকেট। দলে আরও দুজন পেসার ছিলেন। রুবেল হোসেন ও কামরুল ইসলাম রাব্বি। ১ উইকেট পেয়েছেন রাব্বি, রুবেল উইকেটশূন্য। অর্থাৎ, তিনজন পেসার নিয়েও ৬ উইকেট নিয়েছে স্পিনাররা।
অন্যদিকে, একই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে কেমার রোচ একাই ৫ উইকেট নিয়েছেন। এই ইনিংসে চারজন বোলার কাজে লাগায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাদের সবাই পেসার। বাকি ৫ উইকেটও তারাই নিয়েছেন। অর্থাৎ, একই উইকেটে বল করেও পেসাররা একরকম নখদন্তহীন।
প্রথম ম্যাচের কথা মাথায় রেখে দ্বিতীয় টেস্টে স্পিনারদের উপরেই নির্ভর হচ্ছে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রথম ম্যাচে থাকা ৩ পেসার কমিয়ে আনা হয়েছে ২ জনে। দলে নেওয়া হয়েছে বাড়তি স্পিনার। জ্যামাইকা টেস্টের প্রথমদিনে ৪ উইকেট হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যার সবগুলো নিয়েছে বাংলাদেশের স্পিনাররাই।
হতাশ ক্লাইভ লয়েড
জ্যামাইকা টেস্ট এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আলোচনায় এখনও অ্যান্টিগা টেস্ট। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি সাবেক ক্রিকেটার ক্লাইভ লয়েড। ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ এমনটা খেলবে তা তিনি কখনোই ভাবেননি।
লয়েড বলেছিলেন, “আমি অবাক হচ্ছি বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখে। যতটা আশা করেছিলাম, তা একেবারেই হয়নি। অথচ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আমাদের বিপক্ষে অনেক ভালো খেলেছিল। আমাদেরকে হারিয়েছিল। কী হলো এবার জানি না আমি।”
বলা হয়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সামনে লড়েছিল তুলনামূলক কম শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। তাই সেবারের সিরিজে স্বাগতিকদের হোয়াইটওয়াশ করে ছেড়েছিল বাংলাদেশ। লয়েডের মতে, এবার সেই অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। দলে এসেছে বেশকিছু ভালো ক্রিকেটার যারা কি না দীর্ঘদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সার্ভিস দিতে পারবে।
লয়েডের ভাষায়, “এই মুহূর্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে বেশকিছু ভালো ক্রিকেটার আছে। এরা ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে। কেমার রোচ, ব্রাফেট এরা খুব ভালো খেলছে। বিশেষ করে রোচ দারুণ করছে। তার কথা না বললেই নয়।”
মন্দেরও ভালো ও উল্টোপথে সাকিবের হাঁটা
অ্যান্টিগা টেস্টের আগে সাকিব যেভাবে ভাবছিলেন, যেভাবে বলছিলেন; ম্যাচ শেষে একেবারেই পালের উল্টো পাশে হাওয়া দিয়েছেন। যেখানে উইকেট, কন্ডিশনকে খুব একটা ঝামেলা হিসেবে নিচ্ছিলেন না তিনি।
অথচ খেলা শেষে দায় দিলেন এই কন্ডিশন আর উইকেটকে। শুরুতে তিনি বলেছিলেন, “এই উইকেতে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যথেষ্ট বল আসবে। আশা করি দ্রুতই আমাদের ব্যাটসম্যানরা উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। তাছাড়া আমরা প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছি। সুতরাং কন্ডিশনের সঙ্গেও মানিয়ে নিয়েছি। সব ধরণের চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা তৈরি আছি।”
সাকিবের বক্তব্যের পর প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ, যা কি না টেস্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দলীয় রান এবং ৪৪ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
তখন সাকিব বলেন, “এই কন্ডিশনে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। আমরা এ ধরণের কন্ডিশনে খেলতে অভ্যস্ত নই। এ ধরনের উইকেটেও আমরা খেলিনি। আমাদের জন্য এটা অনেক কঠিন ছিল। আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনটি বিভাগেই হেরেছি।”
দ্বিতীয় টেস্টের আগে জ্যামাইকাতে সাকিব নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানান। বাংলাদেশকে এবার প্রতিটি সেশন ধরে ধরে জিতবে হবে, তাহলেই কেবল ভালো ফল আসবে; এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশের এই অধিনায়ক। বাস্তবে অবশ্য সেটা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা পেরেছে বাংলাদেশ। প্রথম দিনে ২৯৫ রান তুলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, হারিয়েছে ৪ উইকেট। যার ৩টি পেয়েছেন ডানহাতি স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ।
তিনি অবশ্য প্রথম দিনকে ‘ভালো’ হিসেবে দেখছেন। প্রথম দিনের খেলা শেষে তিনি বলেন, “জ্যামাইকাতে প্রথম দিনে উইকেটে বেশ টার্ন ছিল। খানিকটা মন্থরও ছিল। আমরা যারা স্পিনার, তারা লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে বল করার চেষ্টা করেছি। যা হয়েছে, তার চেয়েও দুটি উইকেট আমরা নিতে পারলে ভালো হতো। তারপরও আমার মনে হয়, সবমিলিয়ে ভালোই হয়েছে।”
টেস্ট ব্যর্থতা ও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অবহেলা
২০১৪ সালের শেষদিকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, তারপর থেকেই সীমিত ওভারে দারুণ সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা যেন টেস্ট এলেই ব্যর্থতা ভর করছে। এর পিছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলায় জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অবহেলা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকেও যে খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয় তা-ও নয়।
অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, জাতীয় দলের সিরিজই সব। যখন সিরিজ থাকে না তখনও খুব আগ্রহ নিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলতে দেখা যায় না তারকা ক্রিকেটারদের। যে কারণে বিদেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেটে ব্যাট করতে গেলেই মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। সাফল্য দু’হাত ভরে ধরা দেয় ঘরের মাঠে। বিদেশে গেলে মুদ্রার ওপিঠ।
ফিচার ইমেজ- AFP