বর্তমানে টেস্ট স্ট্যাটাস আছে ১২টি দেশের, ওয়ানডে স্ট্যাটাস আছে ২০টি দেশের। টি-২০ ক্রিকেট খেলছে প্রায় ৮০টির মতো দেশ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন এই দেশগুলোর বাইরে পৃথিবীতে বাকি যে দেশগুলো আছে তাদের ক্রিকেটের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কি না? জেনে অবাক হতে পারেন, কখনো টেস্ট ক্রিকেট খেলেনি এমন দেশ থেকে ৫২ জন টেস্ট ক্রিকেটার উঠে এসেছেন।
স্কটল্যান্ড এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। সেই দেশে জন্ম হয়েছে টম ক্যাম্পবেল, মাইক ডেনিস, গ্যাভিন হ্যামিল্টনসহ ১১ জন টেস্ট ক্রিকেটারের। ক্যাম্পবেল দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেললেও বাকি ১০ জন খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। কিন্তু আজকের আলোচনা এমন কিছু দেশকে নিয়ে যাদের নাম শুনলে আপনি চোখ কপালে উঠিয়ে বলবেন, “এমন জায়গা থেকেও টেস্ট ক্রিকেটার আসতে পারে!”
১) পানামা
প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খালের জন্য বিখ্যাত পানামা কেন্দ্রীয় আমেরিকার একটি উপেক্ষিত রাষ্ট্র। কিন্তু এই দেশটিতে জন্মেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানদের একজন জর্জ হ্যাডলির জন্ম এই পানামায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে হ্যাডলি ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং কান্ডারি। ২২ টেস্ট ম্যাচে ৬০.৮৩ গড়ে ২১৯০ রান করেছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণীর গড় আরো ঈর্ষণীয়, ৬৯.৮৬। ১৯৩৪ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন হ্যাডলি। তার দুর্দান্ত ব্যাটিংশৈলীর জন্য তাকে ডাকা হতো ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ নামে। তখনকার দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ভার বহনের দায়িত্বটা ছিল তার উপরেই। তাই ধারাভাষ্যকাররা তাকে ডাকতেন ‘অ্যাটলাস’ নামে।
২) জার্মানি
টি-২০ ক্রিকেট খেলা শুরু করলেও জার্মান সংস্কৃতি যাকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তা হলো ফুটবল। আশ্চর্যজনকভাবে, জার্মানিতে জন্মানো দুজন ব্যক্তি টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
জার্মানিতে জন্মানো ডোনাল্ড কার ইংল্যান্ডের হয়ে দুটো টেস্ট খেলেছেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত খেলেছেন ডার্বিশায়ার কাউন্টির হয়ে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত খেলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়েও। ডার্বিশায়ারের হয়ে ১৯৫৯ সালে ৪৪ গড়ে ২,২৯২ রান করেছিলেন কার, যার সুবাদে পরের বছর উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ম্যাচ রেফারি ও মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করেন কার।
পশ্চিম জার্মানিতে জন্ম নেয়া পল টেরিও খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে দুটি টেস্টে। তার খেলা দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার উইনস্টন ডেভিসের বলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাত ভেঙে যায় টেরির। কিন্তু পরবর্তীতে টেরি ভাঙা হাতে প্লাস্টার জড়িয়ে স্লিং ঝুলিয়ে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আবারো ব্যাটিংয়ে নামেন। এর ফলে অ্যালান লাম্ব অতিরিক্ত দুটো রান নিয়ে নিজের শতক পূর্ণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে আর খেলা হয়নি টেরির। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৬ হাজারের উপর রান করেছেন ৩৭ গড়ে।
৩) কুয়েত
কুয়েতে জন্ম নেয়া টেস্ট ক্রিকেটার আছেন তিনজন। তিনজনই সাদা পোশাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন পাকিস্তানের হয়ে। শান মাসুদ বর্তমানে পাকিস্তান টেস্ট দলের নিয়মিত মুখ।
বাকি দুজনের একজন শাকিল আহমেদ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২২ গড়ে ৩৬৫ উইকেট নিলেও ১৯৯৮ সালে একটির বেশি টেস্ট খেলার সৌভাগ্য হয়নি তার। অপরজন তানভীর আহমেদ। পাকিস্তানের হয়ে ৫ টেস্টে ১৭ উইকেট শিকার করেছেন তানভীর।
৪) ইতালি
টেনিস, ফর্মুলা ওয়ান, ফুটবল- এই নিয়ে ইতালি। কিন্তু আপনি কি জানেন যে টেস্ট ক্রিকেট খেলা অন্যতম সেরা একজন ক্রিকেটারের জন্ম ইতালিতে?
তিনি সাবেক ইংরেজ অধিনায়ক টেড ডেক্সটার। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন একজন নান্দনিক ব্যাটসম্যান। জন্ম তার মিলানে, ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী হওয়ার জন্য প্যারিসের সাথে যার প্রতিযোগিতা। তার দুর্দান্ত ব্যাটিংশৈলীর জন্য তাকে ডাকা হত ‘লর্ড টেড’ নামে। ইংল্যান্ডের হয়ে ৬২ টেস্টে ৪,৫০২ রান করেছেন তিনি, পাশাপাশি হাত ঘুরিয়ে পেয়েছেন ৬৬ উইকেট।
৫) ব্রাজিল
ফুটবলে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের দেশে জন্মেও টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করেছিলেন একজন ভারতীয় ক্রিকেটার। রিও ডি জেনেইরো শহরে জন্ম নেয়া অশোক গান্দোত্রা দুটি টেস্ট খেলেছেন ভারতের হয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলা ও দিল্লির হয়ে খেলেছেন অশোক। ভারতের চা শিল্পের একটি বড় নাম অশোক গান্দোত্রা।
৬) পর্তুগাল
পর্তুগালে যখন খেলাধুলার আলোচনা করা হয়, তখন অবধারিতভাবেই ইউসেবিও, লুই ফিগো, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, হোসে মরিনহোর সাথে চলে আসে ফুটবল। কিন্তু সেখানেও জন্মগ্রহণ করেছিলেন দুজন টেস্ট ক্রিকেটার।
একজন মইসেস হেনরিকেস, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ভারতের বিপক্ষে ২০১৩ সালে টেস্ট অভিষেক হয় তার। সারা বিশ্বের ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-২০ আসরগুলোর পরিচিত নাম মইসেস হেনরিকেস একজন কার্যকরী অলরাউন্ডার। ডানহাতি ব্যাটসম্যান হওয়ার পাশাপাশি ডানহাতে মিডিয়াম ফাস্ট বল করে থাকেন।
পর্তুগালে জন্ম নেয়া আরেকজন টেস্ট ক্রিকেটার ডিক ওয়েস্টকট। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ৫ টেস্টে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
৭) নরওয়ে
নিশীথ সূর্যের দেশে জন্ম নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে টেস্টে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাস্টার নুপেন। ১৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে একবার দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। সেই ম্যাচে ১১ উইকেট নেন নুপেন ও দল জেতে ২৮ রানের ব্যবধানে।
৮) মালয়েশিয়া
অসাধারণ কিছু ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় উপহার দেয়া মালয়েশিয়াতেও দুজন টেস্ট ক্রিকেটার জন্মগ্রহণ করেন। একজন ভারতের হয়ে ১৯৩২ সালে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলা লাল সিং। তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলা প্রথম শিখ এবং খেলোয়াড়ি জীবনে স্পেশালিস্ট একজন ফিল্ডার ছিলেন।
বাঁহাতি অজি স্পিনার স্টিভেন ও’কিফিও মালয়েশিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ টেস্টে ৩৫ উইকেট নিয়েছেন ও’কিফ। ভারতের বিপক্ষে একই টেস্টে দুবার পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন তিনি। দুই ইনিংসেই ৩৫ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
৯) পেরু
ফুটবল ও ভলিবলের জন্য প্রসিদ্ধ পেরুও ইংল্যান্ডকে তাদের একজন টেস্ট অধিনায়ক উপহার দিয়েছিল। পেরুর লিমাতে জন্ম নেন ১৯৫০-৫১ এর অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেয়া ফ্রেডি ব্রাউন। ২২ টেস্টে ২৫ গড়ে ৭৩৪ রান করেছেন ব্রাউন। ৩৩৫ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ২২ শতক ও ৫৬ অর্ধ-শতকে ১৩ হাজারের উপর রান করেন ব্রাউন।
১০) মিশর
গ্রিক বাবা-মায়ের সন্তান জন ট্রাইকোস জন্মগ্রহণ করেন মিশরের জাগাজিগে। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার আগে তাদের হয়ে ৩টি টেস্ট খেলেন ট্রাইকোস। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দেন তিনি। অবসরের পরে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়াতে। অর্থাৎ জন ট্রাইকোস পাঁচ-পাঁচটি দেশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
১১) জাম্বিয়া
জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণবর্ণের ক্রিকেটার হেনরি ওলোঙ্গার জন্ম জাম্বিয়ায়। ১৯৯৫ সালে টেস্টে অভিষেক হয় তার। জিম্বাবুয়ের হয়ে ৩০ টেস্ট ম্যাচ খেলা ওলোঙ্গার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় সম্পূর্ণ ক্রিকেটের বাইরের কারণে। রবার্ট মুগাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলতে নামায় তাকে দ্রুত দল থেকে ছাঁটাই করা হয়। মাথায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ নিয়ে জিম্বাবুয়ে থেকে একপ্রকার পালিয়েই যান তিনি।
হেনরি ওলোঙ্গার আগেও একজন টেস্ট ক্রিকেটার এসেছেন জাম্বিয়া থেকে। বাঁহাতি ইংরেজ স্পিনার ফিল এডমন্ডস জন্মগ্রহণ করেন জাম্বিয়ার লুসাকায়। মিডলসেক্সের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলা এই স্পিনার ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৫১ টেস্ট।