যেখানে মেয়ার্সের সঙ্গী আরও পাঁচজন!

কে-ই বা না চায় তার টেস্ট অভিষেকটা রাঙিয়ে দিতে? কে না চায় বিশ্বকে জানিয়ে দিতে যে ‘এসেছে নতুন তারকা, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’? ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে ফিফটি, কিংবা সেঞ্চুরি। আর ডাবল সেঞ্চুরি হলে সে তো সোনায় সোহাগা! 

এবার সেটিই বাস্তব করে দেখিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাইল মেয়ার্স। সাগরিকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ২১০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে নিজের অভিষেককে শুধু স্বপ্নের মতোই করে তোলেননি, তার সাথে হারের কিনারায় থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এনে দিয়েছেন অসাধারণ এক জয়। 

এই ইনিংসের মধ্য দিয়ে মেয়ার্স ঢুকে গেলেন অভিজাত এক ক্লাবে, যে ক্লাবে মেয়ার্স ছাড়াও রয়েছেন আরো পাঁচজন। ক্লাবে থাকার যোগ্যতা, থাকতে হবে অভিষেক টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি — যে যোগ্যতা পূরণ করেছেন ক্লাবে থাকা সবাই। চলুন, ফিরে দেখা যাক তাদের সে ইনিংসগুলো।

টিপ ফস্টার (ইংল্যান্ড)

Image Credit: Getty Images

এই ক্লাবের গোড়াপত্তন ঘটেছিল আজ থেকে ১১৮ বছর আগে, ১৯০৩ সালে। ১৪ ডিসেম্বর সিডনিতে ৫ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। মোট চারজনের অভিষেক সে টেস্টে ঘটলেও সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন টিপ ফস্টার। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ২৮৫ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ১২ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়াতে কিছুটা বিপদেই পড়ে ইংল্যান্ড। তখনই মাঠে নামেন টিপ ফস্টার। তখনও সিডনি স্টেডিয়ামে থাকা দর্শকরা জানে না, এক মহাকাব্যিক ইনিংস দেখতে চলেছে তারা!  

ব্যাট হাতে নামলেন ফস্টার, আর খেলে ফেললেন ২৮৭ রানের এক অনবদ্য ইনিংস; এখনও যেটি দখল করে আছে অভিষেক টেস্টে সবোর্চ্চ ইনিংসের স্থান। আর এটাও বলাই যায়, এই ইনিংসটির সুবাস ক্রিকেট ইতিহাসে থাকবে বিরাট সময় ধরে।

ফস্টারের ইনিংসটির পর অস্ট্রেলিয়ার জেতার আশা অনেকটুকুই কমে যায়। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছিল; ফস্টারের ইনিংসে ভর করে ৫৭৭ করা ইংল্যান্ডকে রুখে দিতে গিয়ে অজিরা অলআউট হয় ৪৮৫ রানে, ইংল্যান্ডের টার্গেট দাঁড়ায় ১৯৪। ৫ উইকেট হাতে রেখে সে লক্ষ্যে সহজেই পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড। সিরিজে লিড পায় ১-০ ব্যবধানে। 

লরেন্স রো (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

Image Credit: Getty Images

এ ক্লাবের দ্বিতীয় সদস্য কাইল মেয়ার্সের পূর্বসূরী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের লরেন্স রো। ১৯৭২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কিংস্টনে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন উইন্ডিজ অধিনায়ক গ্যারি সোবার্স। ওপেনার জোয়ি ক্যারিউ ৪৩ রানে প্যাভিলিয়নে ফেরার পর মাঠে নামেন লরেন্স রো, অপর প্রান্তে ওপেনার রয় ফ্রেডরিক্স। এ দু’জনের জুটিতে তরতরিয়ে এগোতে থাকে উইন্ডিজের ইনিংস। সেঞ্চুরি করে ১৬৩ রানে আউট হন ওপেনার রয়, ততক্ষণে রয়-রো তৈরি করে ফেলেছেন ২৬৯ রানের জুটি।  

রয় ডাবল সেঞ্চুরি মিস করে গেলেও করেননি অভিষিক্ত লরেন্স রো। দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তুলে ফেলেন অভিষেক টেস্টে দ্বিশতক, দলকে পৌঁছে দেন বড় সংগ্রহের নোঙরে। ২১৪ রান করে যখন তিনি ফিরছেন প্যাভিলিয়নে, তখন উইন্ডিজের সংগ্রহ ৪ উইকেটে ৪৮৮। শেষ পর্যন্ত ৫০৮ রান করে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক গ্যারি সোবার্স।   

তবে রো চমক তখনও বাকি। নিউ জিল্যান্ডকে ৩৮৬ রানে অলআউট করে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসের ডাবল সেঞ্চুরিয়ান রো এবার তুলে ফেলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, অপরাজিত থাকেন ঠিক ১০০ রানে! একই সাথে ভাগীদার হন আরেকটি রেকর্ডের, অভিষেক টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি রানের(৩১৪)! সৃষ্টিকর্তা যেন দু’হাত ভরে দিয়েছিলেন রো-কে।

৩ উইকেটে ২১৮ করে দ্বিতীয় ইনিংস ডিক্লেয়ার করা উইন্ডিজ যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিততে পারেনি। ৩৪১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে কিউইরা তোলে ৬ উইকেটে ২৩৬, সক্ষম হয় টেস্ট ড্র করতে। তবে জয়-পরাজয়ের চেয়ে টেস্টটি মুখ্য হয়ে উঠেছিল লরেন্স রোর অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে। পুরো টেস্টের লাইমলাইট কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি একাই।

ব্রেন্ডন কুরুপ্পু (শ্রীলংকা)

Image Credit: Getty Images

এই ইনিংসটি বিখ্যাত ধীরগতির জন্য। ১৯৮৭ সালের ১৬ই এপ্রিল কলম্বোতে টস জিতে লংকানদের ফিল্ডিং করতে পাঠান কিউই অধিনায়ক জেফ ক্রো। ওপেনিংয়ে নামেন অভিষিক্ত ব্রেন্ডন কুরুপ্পু। মাঠে নামার পর আর ফিরে তাকাননি, খেলে ফেলেন ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস, যেটিতে বল ব্যয় হয়েছে ৫৪৮; সময়ের হিসাবে যা ৭৭৭ মিনিট(১৩ ঘন্টা)!

অবশ্য পুরো টেস্টটিই হয়ে থাকবে ধীরগতিতে খেলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আড়াই দিন সময় লাগিয়ে ৩৯৭/৯ উইকেটে নিজেদের ইনিংস ঘোষণা করে শ্রীলংকা। ব্রেন্ডনকে টেক্কা দিতেই কি না কিউই অধিনায়ক ক্রো খেললেন ১২০ রানের ইনিংস। খরচ হয়েছে ৩৯৮ বল, সময় ১০ ঘন্টা! ৫ উইকেটে ৪০৬ রান তুলতে তুলতে ৫ দিন সমাপ্ত, খেলা ড্র!

অভিষেকে দ্বিশতকই শুধু নয়, ব্রেন্ডন শ্রীলংকার প্রথম খেলোয়াড় যিনি তার অভিষেক টেস্টে কোনো সেঞ্চুরি করেছেন। এছাড়াও আরেকটি রেকর্ড বগলদাবা করছেন তিনি, ১৩ ঘন্টা যাবৎ খেলা তার এই ইনিংসটি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সবচেয়ে ধীরগতির দ্বিশতক।

ম্যাথু সিনক্লেয়ার

১৯৯৯ সালের বক্সিং ডে টেস্ট। ২ ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি নিউ জিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১ ম্যাচ জিতে এগিয়ে থাকা ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ অভিষেক ঘটায় এক তরুণের, নাম ম্যাথু সিনক্লেয়ার।

টসে জিতে ফিল্ডিং করতে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৩ রানেই প্যাভিলিয়নের পথ দেখায় ওপেনার ক্রেইগ স্পেয়ারম্যানকে। ৩ নম্বরে ব্যাটিং করতে নামেন অভিষিক্ত ম্যাথু। আর এরপর? ইতিহাস!

Image Credit: Getty Images

 

আউট হওয়ার আগে দলকে উপহার দিলেন ৪৪৭ বলে ২১৪ রানের ইনিংস, যাতে ছিল ২২টি বাউন্ডারি। নিজের সক্ষমতা প্রমাণই শুধু নয়, দলকেও এনে দিলেন এক বড় সংগ্রহ। ৫১৮ রানে ইনিংস ঘোষণা করা নিউ জিল্যান্ডকে আর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারেনি উইন্ডিজ, ১৭৯ রানে অলআউট হয়ে ফলোঅনের গ্যাঁড়াকলে পড়েও দ্বিতীয় ইনিংসে সাকুল্যে তুলতে পারে ২৩৪। নিউ জিল্যান্ড জিতে নেয় ইনিংস এবং ১০৫ রানে। ম্যাথু হন প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ। 

জ্যাক রুডলফ (দক্ষিণ আফ্রিকা)

এ ক্লাবের পঞ্চম সদস্য প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান জ্যাক রুডলফ। জাতীয় দলের হয়ে খেলার আকুলতা পূরণ হতে পারত আরো আগেই, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কোটা ব্যবস্থার ফলে বারবার ছিটকে যেতেন রুডলফ। অবশেষে ২০০৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরে দলে সুযোগ হয় তার, জায়গা পান চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে। আর প্রমাণ করেন, তাকে কেন দলে নেওয়া দরকার।

টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। তবে তার সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়াতে। এক হাবিবুল বাশার কিছুটা চেষ্টা করলেও বাকিদের আসা-যাওয়ার মিছিলে বাংলাদেশ অলআউট হয় ১৭৩ রানে। একাই ধ্বংসলীলা চালান প্রোটিয়া বোলার পল অ্যাডামস।

ব্যাটিংয়ে নেমে ৪১ রানেই জ্যাক ক্যালিস এবং হার্শেল গিবসকে হারায় আফ্রিকা। আর ঠিক সে মুহূর্তেই হাল ধরেন অভিষিক্ত জ্যাক রুডলফ। অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন ৪২৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি, যাতে রুডলফের অবদান ২২২।

Image Credit: Getty Images

 

পাহাড়সম চাপ মাথায় নিয়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টাইগাররা, দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ২৩৭ রানে। দক্ষিণ আফ্রিকা জয় পায় ইনিংস এবং ৬০ রানের। ম্যাচসেরা হন অভিষিক্ত জ্যাক রুডলফ।

এ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান কাইল মেয়ার্স। তিনিসহ এখন এ ক্লাবের সদস্য মোট ৬। তবে স্বপ্নের মতো ক্যারিয়ার শুরু করলেও এদের কেউই পরবর্তীতে আর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। মেয়ার্স পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। 

This article is in Bangla language. It is about the five more members in the double hundred on debut club, which has recently included the youngster Kyle Mayers' after his incredible feat in the first test vs Bangladesh.

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version