আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দল কিংবা অপরাজেয় টেস্ট দলের নাম বলতে বললে সবার আগে কোন দলটির কথা আপনার মনে পড়বে? গত শতকের ষাটের দশকে সাউথ আফ্রিকা দল নির্বাসনে যাওয়ার আগে ১২ টেস্টের মধ্যে ৮টিতে জয় পেয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ড ৭২টি ম্যাচের মধ্যে ৩৬টি জয়ের বিপরীতে মাত্র ১৩টি টেস্টে পরাজয়ের স্বাদ পায়। তবে সর্বকালের সেরা দলের নাম বলতে গেলে ডন ব্রাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া, ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার নামই প্রাধান্য পাবে।
অস্ট্রেলিয়া (১৯৩০-১৯৫২)
১৯৩০ সালের ১লা জুন থেকে ১৯৫২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ৭০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল। এই ৭০ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১২টি টেস্ট ম্যাচে হেরেছিলো অজিরা। ৭০টি টেস্ট ম্যাচে তারা ৪৬টি জয় এবং ১২টি ড্র করে সেইসময়ে একক আধিপত্য বিস্তারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তখন তারা ১৫টি টেস্ট সিরিজ খেলে, যার মধ্যে শুধুমাত্র ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজে পরাজিত হয় বিল ওডফুলের অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া ১৩টি সিরিজ জয় এবং একটি সিরিজ ড্র করে তারা। অস্ট্রেলিয়ার সোনালি সময়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিল ওডফুল। সবচেয়ে বেশি পরাজয় এবং একমাত্র সিরিজ পরাজয়ও তার অধীনেই হয়।
কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ সহ বিল ওডফুল অস্ট্রেলিয়াকে ২৫ ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে সাতটি পরাজয়ের বিপরীতে ১৪টি জয় এনে দিয়েছিলেন। তার পরাজয়ের পাল্লাটা ভারি হওয়ার কারণ হিসেবে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিলে সেটা অজুহাত বলা যুতসই হবে না। তার নেতৃত্বাধীন সাতটি পরাজয়ের মধ্যে চারটি ছিলো কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজে। সেখানে অধিনায়ক হিসেবে সতীর্থদের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখা ছাড়া তার কিছুই করার ছিলো না। বিল ওডফুলের পর সে সময়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান। তিনি ২৪টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে ১৫ ম্যাচে জয় এনে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রায় আট বছর ক্রিকেট বন্ধ ছিলো। তা না হলে, তার পরিসংখ্যানের পাল্লা আরও ভারি হতে পারতো। ডন ব্রাডম্যানের পর লিন্ডসে হ্যাসেটের কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। তিনি ১৪টি টেস্ট নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বগুণে অস্ট্রেলিয়া ১৪টি টেস্টের মধ্যে ১২টি টেস্ট ম্যাচে জয় তুলে নেয়। পরাজয় মাত্র ১টিতে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ (১৯৮১-১৯৮৯)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট বিশ্বে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দুই বিশ্বকাপজয়ী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেইসময়ে ক্রিকেট বিশ্বে স্বৈরশাসকের মতো আধিপত্য বিস্তার করে। স্বৈরশাসকেরা যেমন তার জনগণদের সাথে অমানবিক আচরণ করেন, তেমনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের স্বর্ণযুগে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে জয় তুলে নিতো। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে একটানা ১৫ বছর টেস্ট সিরিজ হাতছাড়া করেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের স্বর্ণযুগের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে ১৯৮১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৫টি টেস্ট সিরিজ খেলে একটি সিরিজও হাতছাড়া করেনি। ১১টি সিরিজ জয় এবং চারটিতে ড্র নিয়ে তারা ছিলো অপরাজেয়।
জয়-পরাজয়ের ব্যবধানটাও উল্লেখযোগ্য। ৬৯টি টেস্ট ম্যাচে ৪০টি জয়ের বিপরীতে মাত্র সাতটিতে পরাজয়ের স্বাদ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্লাইভ লয়েড এবং ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের সেরা সময় কাটিয়েছিল। ক্লাইভ লয়েড সেইসময়ে ৩২টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯টিতে জয় এনে দেন। আর ভিভ রিচার্ডস ৩৬টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে জয় এনে দেন ২১টিতে! তৎকালীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল প্রতিপক্ষরে কাছে একপ্রকার মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলো। ভিভ রিচার্ডস এবং রিচি রিচার্ডসনরা প্রতিপক্ষের ফাস্ট বোলারদের হেলমেট ছাড়াই তুলোধোনা করতেন। অন্যদিকে ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার এবং কোর্টনি ওয়ালশরা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের প্রতিনিয়ত নাস্তানাবুদ করতেন।
অস্ট্রেলিয়া (১৯৯৯-২০০৭)
শুধুমাত্র পরিসংখ্যান বিবেচনায় আনলে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দল হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করবে স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংদের অস্ট্রেলিয়া। শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটেই নয়, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সেসময় অস্ট্রেলিয়া অপরাজেয় ছিলো। একমাত্র দল হিসেবে একাধারে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় অজিরা।
অস্ট্রেলিয়ার ভয় জাগানো সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো ভারসাম্যপূর্ণতা। তাদের ঐতিহাসিক আট বছরের সময়কালে, ইনিংসের গোড়াপত্তনের দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন ম্যাথিউ হেইডেন এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গার। তাদের শুভসূচনার পর দলের রানের চাকা সচল রাখতেন রিকি পন্টিং। মিডল অর্ডারে স্টিভ ওয়াহ, ড্যামিয়েন মার্টিন, মার্ক ওয়াহ, মাইক হাসি এবং মাইকেল ক্লার্করা দাপটের সাথেই খেলে গিয়েছিলেন। বল হাতে গ্লেন ম্যাকগ্রা-শেন ওয়ার্ন জুটির পাশাপাশি ব্রেট লি, জ্যাসন গিলেস্পিরা প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ ধসিয়ে দিতেন।
১৯৯৯ সালের ১লা অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া একক আধিপত্য চালিয়েছিল। এ সময়ে অজিরা ২৮টি টেস্ট সিরিজ খেলে ২৪টিতেই জেতে। হাতছাড়া হয় মাত্র দুটি সিরিজ। জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যান আরও বেশি সমৃদ্ধ। ৯৩টি টেস্ট ম্যাচের ৭২টিতেই জয় এবং ১১টি ড্র, পরাজয় মাত্র দশটিতে। অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনজন। এদের মধ্যে স্টিভ ওয়াহ ৫০টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে ৩৯ ম্যাচে জয় এনে দেন। পরাজয় মাত্র ছ’টিতে। সেসময় রিকি পন্টিং ৩৭টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বগুণে অস্ট্রেলিয়া ২৯টি টেস্ট জয়ের বিপরীতে মাত্র তিনটি টেস্ট ম্যাচে পরাজিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন অধিনায়ক হিসেবে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ছ’টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার মধ্যে চারটি জয় এবং একটিতে পরাজয়ের মুখ দেখেন তিনি।
দায়িত্ববান ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বশীল ব্যাটিং
১
১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে রাজত্ব চালিয়েছিল ডন ব্রাডম্যান, লিন্ডসে হ্যাসেটের অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আট বছর (১৯৩৮-১৯৪৬) ক্রিকেট মাঠে গড়ায়নি। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ক্রিকেট বন্ধ থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার জয়রথ বন্ধ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিল ব্রাউন, উইলিয়াম পন্সফ্রড, ডন ব্রাডম্যান, স্টেনলি ম্যাককেইব এবং বিল ওডফুল ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের বোলারদের শাসন করতেন। তাদের ব্যাটে চড়েই জয় তুলে নিতো অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাত্র দু’বছর আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলেছিলেন ডন ব্রাডম্যান। তখনও অজিদের সোনালি সময় শেষ হয়নি। ‘দ্য ডনের’ অবসরের পর লিন্ডসে হ্যাসেট, আর্থার মরিস, কেইথ মিলার এবং নেইল হার্ভেরা অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডার সামাল দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ১১জন ব্যাটসম্যান সহস্রাধিক রান করেছিলো। সবচেয়ে বেশি ৪৮ ম্যাচ খেলা ডন ব্রাডম্যান ১০৩.৬১ ব্যাটিং গড়ে ২৭টি শতক এবং ১১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬,৫২৮ রান করেছিলেন। স্টেনলি ম্যাককেইব ৪৮.২১ ব্যাটিং গড়ে ২,৭৪৮ রান, লিন্ডসে হ্যাসেট ৪৯.২০ ব্যাটিং গড়ে ২,৩৬২ রান এবং আর্থার মরিস ৫৩.১১ ব্যাটিং গড়ে ২,৩৩৭ রান করে অজিদের প্রতিনিয়ত সফলতা এনে দিতেন। এই চারজন ব্যাটসম্যানই দুই সহস্রাধিক রান করার কৃতিত্ব গড়েন।
২
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা উদ্বোধনী জুটি হিসাবে গণ্য করা হয় গর্ডন গ্রীনিজ এবং ডেসমন্ড হেইন্সের জুটিকে। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা ৬৯টি টেস্টের মধ্যে ডেসমন্ড হেইন্স ৬৮টি এবং গর্ডন গ্রীনিজ ৬৬টি টেস্টে মূল একাদশে ছিলেন। গ্রীনিজ-হেইন্সের পর রিচি রিচার্ডসন, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, ল্যারি গোমেস এবং জেফ ডুজনদের নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং লাইনআপ সাজানো ছিলো।
গড়পড়তা সবাই রান করলেও শুধুমাত্র ক্লাইভ লয়েডের ব্যাটিং গড় পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিলো। সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকায় সবার উপরে আছেন বাংলাদেশের খেলা প্রথম বিশ্বকাপের কোচ গর্ডন গ্রীনিজ। তিনি ৬৬টি টেস্ট ম্যাচে ১২টি শতক এবং ২০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৭.৫৬ ব্যাটিং গড়ে ৪,৬১৪ রান করেছিলেন। এছাড়া ডেসমন্ড হেইন্স ৪১.৪৩ ব্যাটিং গড়ে ৪,২৬৮ রান, ভিভ রিচার্ডস ৪৬.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ৪,২২০ রান, রিচি রিচার্ডসন ৪৮.১১ ব্যাটিং গড়ে ৩,৩২০ রান, জেফ ডুজন ৩৬.০৬ ব্যাটিং গড়ে ২,৮৮৫ রান, ল্যারি গোমেজ ৪১.৮৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৩৪৫ রান এবং একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে ৫০+ ব্যাটিং গড়ে রান করা ক্লাইভ লয়েড ৬১.৬৩ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ২,৩৪২ রান।
৩
স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার অকল্পনীয় সাফল্য পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো তাদের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। ম্যাথিউ হেইডেন থেকে শুরু করে গিলক্রিস্ট পর্যন্ত সবাই-ই চোখের পলকে ম্যাচের চিত্রপট বদলে দিতে পারতেন। একজন ব্যর্থ হলে অপরজনের ব্যাট ঠিকই হাসতো। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭ সালের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সোনালি সময়ে ১৪ জন ক্রিকেটার সহস্রাধিক রান করেছিলেন। এই তালিকায় শেন ওয়ার্ন এবং ব্রেট লির নামও ছিলো। ম্যাথিউ হেইডেন এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গার প্রায় প্রতি ম্যাচেই শুভ সূচনা এনে দিতেন। হেইডেন ২৬টি শতকের সাহায্যে ৫৫.২৬ ব্যাটিং গড়ে ৭,৫৭১ রান এবং ল্যাঙ্গার ২০টি শতকের সাহায্যে ৪৮.৭৫ ব্যাটিং গড়ে ৬,৪৩৪ রান করেন।
তবে সেইসময়ে অজিদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন রিকি পন্টিং। তিনি ২৯টি শতক এবং সমান সংখ্যক অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৫.১০ ব্যাটিং গড়ে ৭,৮৭৮ রান করেছিলেন। ড্যামিয়েন মার্টিন এবং স্টিভ ওয়াহও নিজ নিজ ব্যাটিং পজিশন থেকে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মার্টিন ১৩টি শতকের সাহায্যে ৪৮.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ৪,০৮৯ রান এবং স্টিভ ওয়াহ ১৩টি শতকের সাহায্যে ৫৩.৩২ ব্যাটিং গড়ে ৩,২৫৩ রান করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণযুগে। শুধুমাত্র তারাই নন, সেইসময় সুযোগ পাওয়া প্রায় প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই তার সদ্ব্যবহার করেছিলেন। স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বাধীন অবস্থায় না খেললেও রিকি পন্টিংয়ের অধীনে মাত্র দু’বছরে (২০০৫-০৭) ১৮টি টেস্টে ৮৬.১৮ ব্যাটিং গড়ে সাতটি শতক এবং আটটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১,৮৯৬ রান করেছিলেন মিস্টার ক্রিকেট মাইক হাসি। ড্যারেন লেহমান, মার্ক ওয়াহ, মাইকেল ক্লার্করাও ব্যাটহাতে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন।
বোলারদের ভয়ংকর রূপ
ডন ব্রাডম্যানদের অস্ট্রেলিয়া এবং স্টিভ ওয়াহদের অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইনআপ পেস এবং স্পিন দু’বিভাগ নিয়েই সাজানো ছিলো। কিন্তু গত শতকের আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইনআপ দুর্দান্ত সব পেসারদের নিয়ে সাজানো ছিলো, যাদের সামলাতেই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা হিমশিম খেয়ে যেতেন।
১
ডন ব্রাডম্যান, লিন্ডসে হ্যাসেটের অস্ট্রেলিয়ার চারজন বোলার একশোর বেশি উইকেট শিকার করেছিলেন। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের তালিকার প্রথম দুজন ছিলেন লেগব্রেক গুগলি বোলার। নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছিলেন ক্ল্যারি গ্রিমেট। তিনি ২৮টি টেস্ট ম্যাচে ২১.৯৫ বোলিং গড়ে ১৬৯টি উইকেট শিকার করেছিলেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেন ষোলবার এবং ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেন মোট ছ’বার।
এরপরের স্থানে আছেন উইলিয়াম ও’রেইলি। তিনি গ্রিমেটের সাথে ১৯৩২-৩৬ সাল পর্যন্ত জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপে ধস নামাতেন। ও’রেইলিও লেগব্রেক গুগলি বোলার ছিলেন। তিনি ২৭টি টেস্ট ম্যাচে ২২.৫৯ বোলিং গড়ে ১৪৪ উইকেট শিকার করেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট ১১ বার এবং ম্যাচে দশ উইকেট ৩ বার শিকার করেন। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারদের তালিকায় পরের দুজন পেসার। ডানহাতি ফাস্ট বোলার রে লিন্ডওয়াল ২৯টি টেস্টে ২০.৪০ বোলিং গড়ে ১১৩ উইকেট এবং বাঁহাতি ফাস্ট বোলার বিল জন্সটন ২৪টি টেস্টে মাত্র ১৯.২২ বোলিং গড়ে ১১১ উইকেট শিকার করেছিলেন।
২
ক্লাইভ লয়েড এবং ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং বিভাগের দায়িত্ব সামলাতেন ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং এবং কোর্টনি ওয়ালশ। চারজন পেসারই সেসময় শতাধিক উইকেট শিকার করেছিলেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলেন ম্যালকম মার্শাল। তিনি ৫৫টি টেস্টে ম্যাচে মাত্র ১৯.২৫ বোলিং গড়ে ২৯৫টি উইকেট শিকার করেছিলেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট বাইশবার এবং ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছিলেন চারবার।
এছাড়া জোয়েল গার্নার ৩৭টি টেস্টে ২১.৯৮ বোলিং গড়ে ১৫৭ উইকেট, মাইকেল হোল্ডিং ৩৬টি টেস্টে ২২.২৭ বোলিং গড়ে ১৫১ উইকেট এবং কার্টনি ওয়ালশ ৩৪টি টেস্ট ম্যাচে ২৪.২৪ বোলিং গড়ে ১২২ উইকেট শিকার করতে সক্ষম হন। সেইসময়ে পেসারদের ১,০৬৮টি উইকেটের বিপরীতে স্পিনাররা মাত্র ৬২টি উইকেট শিকার করেছিলো।
৩
স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার কাছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো শেন ওয়ার্ন এবং গ্লেন ম্যাকগ্রার বোলিং জুটি। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর এবং বৈচিত্র্যময় বোলিং জুটি তারা। এছাড়া ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি এবং স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলও প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বেশ নাস্তানাবুদ করতেন। শেন ওয়ার্ন এবং ম্যাকগ্রা তিন শতাধিক, ব্রেট লি এবং গিলেস্পি দু’শতাধিক এবং ম্যাকগিল শতাধিক উইকেট শিকার করেছিলেন নির্দিষ্ট এই সময়ে। কোনো অধিনায়কের হাতে যখন চার-পাঁচজন উইকেট শিকারি বোলার থাকেন, তখন তার চিন্তার কারণ থাকে না। সেদিক থেকে অন্যসব দলের চেয়ে এগিয়ে ছিলো অস্ট্রেলিয়া। শেন ওয়ার্ন ৭১টি টেস্টে ২৫.৪৪ বোলিং গড়ে ৩৮৩টি উইকেট শিকার করেছিলেন। তাকে যোগ্য সমর্থন দিয়ে ৭২টি টেস্টে মাত্র ২০.৭০ বোলিং গড়ে ৩২৫টি উইকেট শিকার করেন গ্লেন ম্যাকগ্রা।
এই দুজনের বোলিং তাণ্ডবের পর অন্য বোলারদের খুব বেশি কিছু করা লাগতো না। তবুও ব্রেট লির মতো গতিতারকা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না! ব্রেট লি ৬১টি টেস্টে ৩০.৬৯ বোলিং গড়ে ২৪৭ উইকেট নিয়েছিলেন। আরেক পেসার জেসন গিলেস্পি ৫৭টি টেস্টে ২৭.০৯ বোলিং গড়ে ২০৯টি উইকেট শিকার করেছিলেন। শেন ওয়ার্নের রাজত্বে জন্মগ্রহণ করার কারণে নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। যে ক’টি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন, নিজেকে আরও বেশি সুযোগ পাওয়ার দাবিদার করে গিয়েছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণযুগে স্পিন সহায়ক পিচে দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে কিংবা শেন ওয়ার্নের অবর্তমানে দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবেই পালন করেন ম্যাকগিল। তিনি ঐ সময়ে ৩০টি টেস্টে ৩০.১১ বোলিং গড়ে ১৪৪টি উইকেট শিকার করেছিলেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট নয়বার এবং ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেন একবার।
সাফল্যের মূলমন্ত্র
১
ডন ব্রাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ব্রাডম্যানেরই ছিলো। ওপেনারদের শুভ সূচনার পর মোমেন্টাম ধরে রাখার দায়িত্ব পড়ে পরবর্তী ব্যাটসম্যানের কাঁধে। কিংবা ওপেনারদের ব্যর্থতার পর দলের হাল ধরার দায়িত্ব নিতে হয়, তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানকে। বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান যদি ঐ পজিশনে ব্যাট করেন, তাহলে তো চিন্তার কোনো কারণই নেই। নিজের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করা ডন ব্রাডম্যান সেসময় ৪০টি টেস্টের ৫৬ ইনিংসে ২০টি শতক এবং দশটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১০৩.৬৩ ব্যাটিং গড়ে ৫,০৭৮ রান করেন। ডনের অবসরের পর তিন নম্বরে ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করেছিলেন লিন্ডসে হ্যাসেট এবং নেইল হার্ভে। হ্যাসেট ১৩ ইনিংসে ৫৭.১৬ ব্যাটিং গড়ে ৬৮৬ রান এবং হার্ভে ৬ ইনিংসে ৫৬.০০ ব্যাটিং গড়ে ২৮০ রান করেছিলেন। এছাড়া তিন নম্বর পজিশনে স্টেনলি ম্যাককেইবও ১২ ইনিংস ব্যাট করেছিলেন। তিনি ডন ব্রাডম্যান থাকাকালীন এই ১২ ইনিংস খেলেন এবং বেশ সফলও হন। ১২ ইনিংসে ৬৯.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৬২৫ রান করেছিলেন।
২
ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বগুণ, ভিভ রিচার্ডস এবং রিচি রিচার্ডসনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, গর্ডন গ্রীনিজ এবং ডেসমন্ড হেইন্সের ওপেনিং জুটি, উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান জেফ ডুজনের শেষদিকের প্রতিরোধ, সেইসাথে মার্শাল, হোল্ডিং, গার্নার ও ওয়ালশের বিধ্বংসী বোলিং এক সুতোয় গাঁথলে প্রতিপক্ষের বেহাল দশা সহজেই অনুমেয়। ডেসমন্ড হেইন্স-গর্ডন গ্রীনিজের জুটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ব্যাট হাতে নামতেন রিচি রিচার্ডসন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং পজিশন তিন নাম্বারে রিচার্ডসন ৬৩ ইনিংস ব্যাট করেন। ১০টি শতক এবং ১১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫১.০১ ব্যাটিং গড়ে ৩,০১০ রান করেছিলেন তিনি।
৩
স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকজন ম্যাচ উইনার ছিলো। তারা একসাথে অনেক ম্যাচ খেলার কারণে নিজেদের মধ্যে বেশ ভালো বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছিলো। অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার জয়যাত্রার ৯৩টি টেস্টের মধ্যে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ৯২টি টেস্টে দলে ছিলেন। উইকেটের পিছনে থেকে শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণি বোলিং, গ্লেন ম্যাকগ্রার দু’দিকের সুইংয়ের পাশাপাশি ব্রেট লির বুলেট গতিতে ছোঁড়া বল বেশ দক্ষতার সাথে তালুবন্দী করতেন গিলি।
উইকেটরক্ষকের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি সাত নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে প্রতিপক্ষের হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ ছিনিয়ে আনতেন গিলি। টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে প্রতিপক্ষ যখন একটু স্বস্তিতে থাকতো, তখনই পাল্টা আক্রমণ করতেন তিনি। সাত নম্বর পজিশনে ৭৩টি ইনিংস ব্যাট করে ১২টি শতক এবং ১৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৮.৬৯ ব্যাটিং গড়ে ৩,৭৯৮ রান করেছিলেন। তার স্ট্রাইক রেট ছিলো অভাবনীয়, টেস্ট ক্রিকেটে তিনি ৮৪.৫৩ স্ট্রাইক রেটে রান করেন।
শেন ওয়ার্ন এবং গ্লেন ম্যাকগ্রার বোলিং জুটির পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিলো তিন নম্বর পজিশনে রিকি পন্টিংয়ের দুর্দান্ত ব্যাটিং। হেইডেন-ল্যাঙ্গারের জুটি ভাঙার পর দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করতেন রিকি পন্টিং। তিনি ১১৫ ইনিংসে ২৬টি শতক এবং ২৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭০.৭৮ ব্যাটিং গড়ে ৬,৮৬৬ রান করেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা টেস্ট দল কোনটি? এমন প্রশ্নের জবাবে ডন ব্রাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া, ক্লাইভ লয়েড, রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার নামই আসবে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মাথায়।