২০১৫ সালে ওয়ানডেতে স্পিনারদের করা গড়ে প্রতি চারটি বলের মধ্যে একটা ছিল রিস্ট স্পিনারদের করা। পরিসংখ্যানটা বাড়তে বাড়তে প্রতি দুই বলের মধ্যে একটাতে পৌঁছে গিয়েছিল এরপর। পরবর্তীতে, ২০২১ সাল থেকে আবারও ধীরে ধীরে দৃশ্যপট দখলে নিচ্ছেন ফিঙ্গার স্পিনাররা। ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে সেই গল্পটাই বলেছেন সিদ্ধার্থ মঙ্গা।
১৭ জুন, ২০১৮।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে ১৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয় ভারত। শুধু পরাজয়ই নয়, পরাজয়ের ধরণেও একটা মিল পাওয়া যায় ঐ টুর্নামেন্টেরই আরেকটা ম্যাচের সাথে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩২১ রান ডিফেন্ড করতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারত, ফাইনালে আগে ব্যাট করে ভারতের বিপক্ষে ৩৩৮ রান তুলেছিল পাকিস্তান। এরপরই ভারতের ক্রিকেটে ঘটে একটা বড়সড় পরিবর্তন। ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে এক প্রকার ছেঁটেই ফেলা হয় দুই ফিঙ্গার স্পিনার, ডানহাতি অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং বাঁহাতি রবীন্দ্র জাদেজাকে, দলে ভেড়ানো হয় লেগস্পিনার যুজবেন্দ্র চাহাল আর বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদবকে। ব্যাটিং সামর্থ্য বিবেচনায় জাদেজা অবশ্য আবারও ফিরেছিলেন দলে, তবে ফেরা হয়নি অশ্বিনের। অন্যদিকে, কুলদীপ-চাহালের অন্তর্ভুক্তিতে ভারতের মাঝের ওভারের বোলিং শক্তিটা বেড়ে যায় অনেকখানি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ঐ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আটটা দলের মধ্যে মাত্র তিনটা দলের কোন রিস্ট স্পিনার ছিল না, নিউ জিল্যান্ড এবং বাংলাদেশের সাথে অপর দলটার নাম ভারত। সেই হিসেবে দলে রিস্ট স্পিনারদের জায়গা দেওয়ার দৌড়ে ভারত কিছুটা পিছিয়েই পড়েছিল, কিন্তু এরপর থেকে তাদেরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চাহাল-কুলদীপ সামলে নিতে শুরু করলেন মাঝের ওভারে ভারতের স্পিন আক্রমণের দায়িত্বটা। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও জাদেজার সাথে এই দুজন রিস্ট স্পিনারই ছিলেন স্কোয়াডে। তবে চার বছর পরে, ঘরের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক চিত্র, ভারতের একাদশে থাকছেন সেই অশ্বিন-জাদেজা, চাহালের জায়গা হয়নি পনেরো সদস্যের দলে।
চলতি বিশ্বকাপে ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, চেন্নাইয়ে। ভারতের একাদশে তিন বিশেষজ্ঞ স্পিনার ছিলেন, বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদবের সাথে ছিলেন দুই ফিঙ্গার স্পিনার অশ্বিন আর জাদেজা। দুজনেই পূর্ণ দশ ওভার করে বোলিং করেছিলেন সেদিন, বিশ ওভারে ৬২ রান খরচ করে তুলেছিলেন মোট চারটি উইকেট। অশ্বিন অবশ্য আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিপক্ষে সুযোগ পাননি একাদশে, তার জায়গাটা নিয়েছিলেন ডানহাতি পেসার শার্দূল ঠাকুর।
তবে ফিঙ্গার স্পিনারদের নতুন করে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা শুধু যে ভারতেই ঘটছে, এমনটা নয়। তাব্রেইজ শামসি বা ইশ সোধিরাও এখন আর দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউ জিল্যান্ড দলের প্রথম পছন্দের স্পিনার নন, চলতি বিশ্বকাপের শুরুটাও তাদের ছাড়াই করেছে দলদুটো। রবি বিষ্ণই বা রাহুল চাহারের মতো আইপিএলে ভালো করা স্পিনারদের আপাতত ওয়ানডের জন্য বিবেচনাতেই রাখছে না ভারতীয় দল।
এটা ঠিক যে, মাঝের একটা লম্বা সময় ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটে রাজত্ব করছিলেন রিস্ট স্পিনাররা। বিশেষ করে এগারো থেকে চল্লিশ ওভারের মধ্যে ফিল্ডিংয়ের বাধ্যবাধকতার নিয়মের পরিবর্তন, দুটো নতুন বলের ব্যবহার, ফিঙ্গার স্পিনারদের বোলিং অ্যাকশনের ত্রুটি, সব মিলিয়ে রিস্ট স্পিনারদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল দলগুলো। আর যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে যেখানে ওয়ানডেতে প্রতি চারটি স্পিন বলের মধ্যে একটি ছিল স্পিনারদের করা, ২০১৬-পরবর্তী সময়ে সেই হিসাবটা দাঁড়ায় প্রতি দুই বলের একটিতে। ২০২১ সালের পর থেকে রিস্ট স্পিনের পরিসংখ্যান আবারও কমতে থাকে, ফিরে যায় সেই চার বলের মধ্যে একটির পরিসংখ্যানে।
কিন্তু কেন? রিস্ট স্পিনাররা কেন হঠাৎ ব্রাত্য হয়ে পড়লেন দলগুলোতে?
এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দলগুলো ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন আর বিশেষজ্ঞ স্পিনার চাইছে না, বরং চাইছে ব্যাটিং জানেন এমন স্পিনার। কিছুটা ব্যাটিং জানেন, ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ আর আফগানিস্তানের রশিদ খান ছাড়া এমন রিস্ট স্পিনার যেহেতু নেই বললেই চলে, অগত্যা ফিঙ্গার স্পিনাররাই ভরসা।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের হয়ে মাঝের ওভারগুলোতে নিয়মিত বোলিং করতেন ইশ সোধি, সাফল্যও পেতেন। কিন্তু ব্যাটিংয়ে অবদান রাখতে না পারায় সোধি তার জায়গা হারিয়েছেন দলে, অলরাউন্ডার রাচিন রবীন্দ্র আর গ্লেন ফিলিপসের আঙুলের ঘূর্ণনেই সোধির অভাবটা পূরণ করে নিচ্ছে নিউ জিল্যান্ড।
একই কথা প্রযোজ্য ভারতের ক্ষেত্রেও, কুলদীপ-চাহাল দুজনের কেউই অলরাউন্ডার না হওয়ায় ভারত তাদের মধ্যে থেকে বেছে নেয় যেকোন একজনকেই, সাথে ঝুঁকেছিল অক্ষর প্যাটেলের দিকে। বিশ্বকাপের আগে শেষ মুহূর্তের চোটে অক্ষর ছিটকে যাওয়ায় ডাক পান অশ্বিন, শেষের দিকের কাজ চালানো ব্যাটিংটা যিনি জানেন ভালোমতোই। আর একাদশে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যার সাথে অশ্বিনের প্রতিযোগিতা, সেই শার্দূল ঠাকুরও ডানহাতি পেস বোলিংয়ের সাথে টুকটাক ব্যাটিং পারেন।
তবে কি কার্যকারিতা হারাচ্ছেন রিস্ট স্পিনাররা?
না। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে রিস্ট স্পিনারদের কার্যকারিতা যে কমে গেছে, এমনটা নয়, বরং ফিঙ্গার স্পিনাররাই নিজেদের আরো বেশি কার্যকর করে তুলছেন। ২০১৯ থেকে ’২০-এ ফিঙ্গার স্পিনারদের বোলিং গড় ছিল চল্লিশের ঘরে, পরবর্তীতে সেটা নেমে এসেছে ৩০ এর আশেপাশে। স্টাম্প থেকে ৪-৫ মিটার দূরে পিচ করানো বলগুলোতে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রতি ৫২ বলে একটা উইকেট পেতেন ফিঙ্গার স্পিনাররা, ২০২০ থেকে ’২৩-এ সেটা নেমেছে ৩৮ বলে। একই সময়ে, রিস্ট স্পিনাররা ঐ লেন্থে বল পিচ করিয়ে আক্রমণাত্মক বোলিং করেননি, বরং শর্ট বল করে রক্ষণের কাজটাই করতে চেয়েছেন।
অর্থাৎ, সহজ করে বললে, গত দুই-তিন বছরে ফিঙ্গার স্পিনাররা ওয়ানডে ক্রিকেটে আক্রমণাত্মক বোলিং করেছেন, এবং সফলও হয়েছেন উইকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে। অপরদিকে, রিস্ট স্পিনাররা করেছেন রান আটকে রক্ষণাত্মক বোলিংয়ের কাজটা, যেটা সাধারণ দৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা নয়।
তবে টি২০তে প্রথম পাওয়ারপ্লে শেষ হবার পরই একজন অতিরিক্ত ফিল্ডার বাউন্ডারিতে রাখার সুযোগ পায় দলগুলো, রিস্ট স্পিনারদের কদর তাই কমেনি ওই ফরম্যাটে।
সাধারণ ফিঙ্গার স্পিনাররা বোলিংয়ের সময়ে বলের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন সত্যি, কিন্তু সাধারণত রহস্য ব্যাপারটা খুব বেশি থাকে না। অপরদিকে রিস্ট স্পিনাররা সবক্ষেত্রে বলের ওপর পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না, কিন্তু রহস্যের মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারেন দারুণভাবে। গুগলির কথা একপাশে সরিয়ে রাখলেও, রিস্ট স্পিনারদের বল ছোঁড়ার ধরণটাই ব্যাটসম্যানদের জন্য একটা রহস্য সৃষ্টি করে, আর রিলিজ টাইম খুব কম থাকায় ব্যাটসম্যানদের জন্য প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়টাও কমে আসে। পাশাপাশি টি-টোয়েন্টিতে ত্রিশ গজের বাইরে একজন অতিরিক্ত ফিল্ডার রাখার সুযোগ থাকায় চার-ছক্কাও আটকে দিতে পারেন তারা। কিন্তু ওয়ানডেতে এই সুযোগটা থাকে না।
আর বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণের যে ব্যাপারটা, এই ব্যাপারটাও দলগুলোকে ফিঙ্গার স্পিনারদের প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। প্রায় সবগুলো দলই এখন আক্রমণাত্মক বোলিং করে উইকেট তুলে নেওয়ার জন্য পেসারদের ব্যবহার করে, স্পিনারদের কাজ থাকে রান আটকানো। এই কারণেই একজন লেগ স্পিনারের ১০-০-৭৬-২ বোলিং ফিগারের চেয়ে একজন অফ স্পিনারের ১০-০-৫৮-০ ফিগারটা খুব বেশি খারাপ মনে হয় না টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে। তাই ফিঙ্গার স্পিনার যদি উইকেট নাও পান, রান আটকানো আর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের দক্ষতার কারণে তিনি একটা অগ্রাধিকার পাবেন।
ফিঙ্গার স্পিনারদের মধ্যে আবার বাঁহাতি স্পিনারদের সাফল্যের পরিমাণ বেশি। এর অন্যতম কারণ, পৃথিবীতে ডানহাতি ব্যাটসম্যানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর জাদেজা-স্যান্টনার-মহারাজরা ব্যাটসম্যানদের থেকে বল টার্ন করিয়ে বাইরে নিয়ে যান, এবং সাফল্য পান। ২০১৭-২০ এর তুলনায় ২০২১-২৩ এর মধ্যে টার্নের বিবেচনায় পরের সময়কালেই এগিয়ে রয়েছেন স্পিনাররা, সম্ভবত বলের গতি সামান্য কমিয়ে দেওয়াটাই এর মূল কারণ। পাশাপাশি এটাও উল্লেখ্য, অফ স্পিনারদের পুনরুত্থানের এই গল্পে পিচের তেমন কোন সাহায্য নেই।
তবে সব কথার শেষ কথা, রিস্ট স্পিনার হোন বা ফিঙ্গার স্পিনার, একজন ভালো স্পিনার মানে একজন ভালো স্পিনারই। অ্যাডাম জাম্পা বা কুলদীপ যাদব তো ব্যাট হাতে রান করেন না, কিন্তু তবুও বল হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়েই তিনি জায়গা করে নেন একাদশে। তবে পাশাপাশি এটাও সঠিক, দলগুলো এখন ব্যাটিংয়ের গভীরতা চায়। আর সেই কারণেই ব্যাটিং জানা ফিঙ্গার স্পিনাররা কিছুটা হলেও অগ্রাধিকার পান, ব্যাটিং না জানা রিস্ট স্পিনারদের তুলনায়।
তাতেই আরো একবার পুনর্জীবন লাভ করলেন অঙ্গুলি-ঘূর্ণকেরা!