২০১৪ সালের ২৪ মে, সময়টা একেবারে গভীর রাত। ঘন্টার কাঁটা তিন থেকে চারের দিকে দৌড়াতে শুরু করতেই একে একে টিভির টিমটিমে আলোগুলো নিভে যেতে শুরু করেছে। নিস্তদ্ধ রাত হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডিয়েগো গডিনের গোল কি চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে তরী ডোবাবে? সবাই ভেবেও নিয়ে ছিল তাই, কিন্তু রাতটার ভাগ্য যে অন্যভাবে লেখা ছিল।
স্টপেজ টাইম চলছে, যার মানে ডু অর ডাই মুহূর্ত। লুকা মদ্রিচের কর্নার কিক উড়ে আসছে পেনাল্টি বক্সের দিকে, তারপর যখন বলটা জালে আঘাত করল সময়টা তখন ৯২:৪৮ সেকেন্ড! রামোসের মাথার কীর্তিতে শুধু পর্তুগালের রাজধানী কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছে মাদ্রিদ ডার্বি চলতে থাকা টেলিভিশন সেটটাও। তারপর আর কী? একে একে বেলের হেডার, মার্সেলোর বাম পায়ের জোরালো শট আর সিআর৭-এর পেনাল্টিতে ৪০ বছর পর আবারও ফাইনালে ৪ গোল খেয়ে মাঠ ছাড়তে হল রোজিব্লাঙ্কোসদের। আর লস ব্লাংকোসদের কী অবস্থা? লা ডেসিমা শিরোপা নিয়ে তখন উচ্ছাসে মাতোয়ারা পুরো রিয়াল ক্লাব শিবির, স্প্যানিশ গ্ল্যাডিয়েটরের মাথার আঘাতের আগ পর্যন্তও যাদের আশা ছিল একেবারে ম্রিয়মাণ।
গল্পের শুরুটা হয়েছিল গোয়াদেল কুইভার নদীর স্রোতে, আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে দৌঁড়ে বেড়ানো ছোট্ট রামোস তার পায়ে প্রথম ধুলো মাখালেন স্থানীয় কামাস ক্লাবের হয়ে। সেভিয়ার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞ স্কাউটদের চোখে পড়তে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। সেভিয়াতে যোগ দিয়েছিলেন ১০ বছর বয়সে, হেসুস নাভাস-অ্যান্তোনিয়ো পুয়ের্তার সাথে গায়ে গা মিশিয়ে ইয়ুথ ক্লাবে ৭ বছর কাটানোর পর ডাক পেলেন সেভিয়ার বি-টিমে। স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর তাকে আর আলাদাভাবে প্রমাণ করতে হয়নি, পরের বছর গন্তব্য সরাসরি সেভিয়ার মূল দল।
১৮ বছরের তরুণ, তেজোদ্দীপ্ত শরীরের আসল খেলা এখনো শুরুই করেননি। ঝলক দেখালেন সেভিয়ার হয়ে খেলা প্রথম এবং একমাত্র মৌসুমেই, মাঠের ধুলো ওড়ালেন ৪১ ম্যাচে। ঘরের মাঠে গোল করে থামিয়ে দিলেন রিয়াল মাদ্রিদের জয়ের আশা, সাথে নজর কাড়া হলো মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজেরও।
একজন ডিফেন্ডার হয়ে লীগের সেরা উদীয়মান হওয়া মুখের কথা নয়, তাই মুখের লাগাম দিতেই পেরেজ ছুড়ে দিলেন ২৭ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব। ১৯ বছরের একজন ডিফেন্ডারের জন্য দামটা যে বড্ড বেশি, তাও আবার এখন থেকে ১২ বছর আগের গল্প। সেভিয়ার জন্য এমন লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা প্রায় অসম্ভবই ছিল, আর হলোও তাই। রেকর্ড দামে জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি দিলেন রাজধানীর উদ্দেশ্যে।
লস ব্লাংকোসদের প্রায় প্রতিটা জার্সির পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একেকজন কিংবদন্তীর গল্প। তাই ফার্নান্দো হিয়েরোর ৪ নম্বর জার্সিটা পরিয়ে দেওয়া হলো সার্খিও রামোসের গায়ে। একজন ডিফেন্ডার হয়েও মৌসুমে ২১ গোলের অবিশ্বাস্য রেকর্ডের গন্ধটা হয়ত তখনও লেগেছিল হিয়েরোর জার্সিতে, কারণ হিয়েরো পরবর্তী যুগেও রক্ষণভাগের মূল খেলোয়াড় হয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ধ্বস নামানো অব্যাহত রেখেছেন “মি. ৯২:৪৮”।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম দুই মৌসুম সেন্টার ব্যাক হিসেবে খেলছিলেন নিয়মিতভাবেই, কিন্তু ক্রিস্টোফ মেটজেল্ডার আর পেপে আসার পর তাদের জায়গা দিতে সরে যেতে হয় মাঠের ডানদিকে। তবে সেখান থেকেও নিজের মুহুর্মুহু গোলের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন, টানা চার মৌসুমে ৬ গোল করে জানান দিচ্ছিলেন যে আক্রমণেও কম যান না। আর গোলগুলোও রিয়াল মাদ্রিদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, সহজ কথায় বলা যায় একেবারে ট্রফি জেতানো গোল।
০৬-০৭ মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে গোল করে বার্সেলোনার কাছ থেকে ৩০তম লা লিগাটা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, পরের মৌসুমেই ওসাসুনার বিপক্ষে তার বাড়িয়ে দেওয়া বল থেকে গোল করে গঞ্জালো হিগুয়েন ঘরে নিয়ে আসেন ৩১তম লা লিগা শিরোপাটি। লীগ ট্রফি আর দেশের হয়ে ইউরো শিরোপা জয় তাকে প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত করে নেয় ফিফা এবং উয়েফার বর্ষসেরা দলে।
সার্খিও রামোসের মূল অস্ত্র কী? সেট পিসে তার অসাধারণ দক্ষতার কথা বললে কি খুব ভুল হবে? রিয়াল মাদ্রিদের খেলা হবে অথচ ফ্রি কিক বা কর্নার কিকের সময় রামোসের মাথা আকাশে ভাসবে না সেরকম ম্যাচের সংখা হয়ত হাতেগোনাই হবে। এরিয়াল পাওয়ারের সাথে গ্রাউন্ড ট্যাকলেও রামোসকে পরাস্ত করা খুব একটা সহজ হবে না, তবে ভয়াবহ রাফ ট্যাকলের জন্য রামোসের বদনামও কম না। নামের পাশে ২১টা লাল কার্ড, ক্লাব ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তকমাটা এখনো গায়ে লেগে আছে। তবে সেটাও পুষিয়ে দিচ্ছেন নিজের অন্যান্য স্কিল দ্বারা। গতি, পাস ডিস্ট্রিবিউশন আর রাইটব্যাক পজিশনে খেলার সময়ে ঝালাই করা ক্রসিং দক্ষতা দিয়ে আক্রমণভাগ আর রক্ষণভাগের কাজ সমানভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে মাঠের তিন পজিশনে খেলতে পারার গুণ আর পিছন থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা। ব্যস হয়ে গেল একটা নিখুঁত সার্খিও রামোস।
২০১০-১১ মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে লিওনেল মেসিকে লাথি আর পুয়োলকে ধাক্কা মেরে বসায় তাকে মাঠ ছাড়তে হয়, একইসাথে ছুঁয়ে ফেলেন ফার্নান্দো হিয়েরোর ১০টা লাল কার্ড দেখার রেকর্ড। সাথে দেখতে হয় বার্সেলোনার বিপক্ষে ৫-০ গোলের বিশাল হার! ২০১১-১২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালের টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস তাকে কিছুদিনের জন্য ক্লাবের ভিলেনে পরিণত করে। তার কিছুদিন আগেই কোপা ডেল রে শিরোপাটি তার হাত থেকে ছিটকে বাসের নিচে পড়ে কিছুটা দুমড়ে যায়।
পরের মৌসুমেই রেফারিকে কটূক্তি করে চার ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা এবং ১ মিনিটের মাথায় পরপর দুইবার হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার কথাটা হয়ত মাথা থেকে বেশিরভাগ মাদ্রিদ ভক্তই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন এল ক্লাসিকোতে শেষ মুহুর্তে গোল করে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছিয়ে দিয়ে, যে ম্যাচে নিজেই আবার অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নেমেছিলেন।
তারপরের ঘটনাকে ইতিহাস রচয়িতা বললেও কম বলা হয়ে যাবে। একে একে ৯২:৪৮ মিনিটে গোল করে লা ডেসিমা জয়, ২০১৬ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে গোল করে লা আনডেসিমা জয় আর সুপার কাপে আবারও ৯৩ মিনিটে গোল করে শিরোপা স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে সেই শিরোপা নিয়েই বাড়ি ফেরা, যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্যই স্বপ্ন বটে।
৯০ মিনিটের পরের অতিরিক্ত সময়কে কেন “রামোস টাইম” বলা হবে না তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন। কেন? এই মৌসুমেই এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার বিপক্ষে শেষ মুহুর্তের ড্র আর লা করুনার বিপক্ষে শেষ মুহুর্তের জয়ের নায়ক যে সোনালী মাথার অধিকারী এই রামোসই।
জাতীয় দলের হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের পিছনের অন্যতম মূল কারিগর রামোস ছিলেন বিশ্বকাপের ড্রিম টিমে, এমনকি ইউরো কাপের সেরা দলেও। এগুলো ছাড়াও ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ২৪ বার নির্বাচিত হয়েছেন বিভিন্ন সেরা দলের ডিফেন্ডার হিসেবে। গোল বা শিরোপা সংখ্যা দিয়ে রামোসকে বিচার করলে ভুল হবে, দলের উপর তার প্রভাবটা একটু খুঁটিয়ে দেখলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। বলা যায় রিয়াল মাদ্রিদের নামের সাথে রামোসের নামটা একেবারে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে গেছে, কারণটা যে সেই লিসবনের অবিস্মরণীয় লা ডেসিমা জয়ের রাত।