ঐতিহাসিক ফাইনালিসিমায় রীতিমতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, যাতে ৩-০ গোলের জয়ের ব্যবধানটাও কম মনে হয়েছে অনেকের।
সেখান থেকেই উঠে এসেছে প্রশ্ন, ইতালির ইউরো জেতাটা কি অঘটন ছিল? নাকি আর্জেন্টিনা এতটাই ভালো দল হয়ে উঠেছে যে তাদের কাছে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকেও মনে হচ্ছে অতি সাধারণ কোনো এক দল?
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটা আগে দিয়ে ফেলাই যায়, আর্জেন্টিনা উন্নতি করেছে বটে, তবে এতটা নয়। তবে কি ইতালির ইউরো জেতাটা অঘটনই ছিল?
ঠিক অঘটন বলা উচিত নয়, তবে এটিও সত্য যে ইতালি ইউরো জেতার সবচেয়ে বড় দাবিদার ছিল না, এমনকি টুর্নামেন্টে তাদের খেলার মানের হিসেব করলেও সবচেয়ে যোগ্য চ্যাম্পিয়নও ছিল না তারা। সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে দেখে নেয়া দরকার সে পথ, যেটি পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া থেকে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আজ্জুরিরা।
২০১২ ইউরোর ফাইনালে পৌঁছানোটা যেন ইতালির জন্য ছিল খাদের কিনারে পৌঁছানোর মতো, এরপর বাকিটা খাদে পড়ে নিম্নমুখী অভিযান। ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ, ২০১৬ ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায়, এরপর ২০১৮ বিশ্বকাপে সুযোগই না পাওয়া।
রবার্তো মানচিনি যখন দায়িত্ব নেন দলের, মনে হচ্ছিল, ইতালিয়ান ফুটবলের এপিটাফ লেখা হয়ে গিয়েছে। তবে সাবেক ম্যানসিটি কোচ দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বদলে যায় আজ্জুরিরা, টানা ২৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়ে ইউরো ২০২০-এ যায় তারা। হট ফেভারিট হিসেবে নয়, তবে ইতালি যে ফিরছে, সেটির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল বটে।
ইউরোতে গিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতালি সেই আভাসকেই যেন বাস্তব রূপ দেয়, যে ইতালি ফিরে এসেছে তাদের পুরনো রূপে। কিন্তু ইউরো শেষে ইতালি যেন আবার ফিরে যায় তাদের ২০১৮-পূর্ব রূপে।
ইংল্যান্ডকে ফাইনালে হারানোর পর থেকে ১১টি ম্যাচ খেলেছে ইতালিয়ানরা, সেখানে জয় পেয়েছে মাত্র তিনটিতে। হেরেছে তিনটি, তার মধ্যে একটি নর্থ মেসিডোনিয়ার কাছে, যে ম্যাচ হেরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে তারা।
এছাড়া স্পেনের কাছে উয়েফা নেশনস লিগের সেমিফাইনালে হার, তারপর আর্জেন্টিনার কাছে ফাইনালে পর্যদুস্ত হওয়া। মানচিনি যে আজ্জুরিদের পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছিলেন, সেটি যেন থমকে পড়েছে, এবং সঙ্গে এসেছে সে অমোঘ প্রশ্ন – তবে কি ইতালি ভাগ্যদেবীর কৃপায়ই ইউরো জিতেছে?
সেটিই উত্তর কি না, সেটি বলবার আগে একবার দেখে নেয়া যাক ইউরোতে কী ফর্মেশন ও একাদশ নিয়ে খেলেছে ইতালি। সাধারণ ৪-৩-৩ নিয়েই শুরু করেছিলেন মানচিনি, গোলকিপার হিসেবে জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মা, তার সামনে জর্জিও কিয়েলিনি ও লিওনার্দো বোনুচ্চি সেন্টারব্যাক হিসেবে। চোটে পড়ার আগ পর্যন্ত লিওনার্দো স্পিনাজ্জোলাই ছিলেন লেফটব্যাক, এবং শুরুতে আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি কিংবা রাফায়েল তোলোয় রাইট ব্যাক হিসেবে খেললেও নকআউট পর্বে সেখানে ছিলেন জিওভান্নি ডি লরেঞ্জো।
মিডফিল্ডে জর্জিনোর সঙ্গে ছিলেন নিকোলা বারেল্লা এবং মার্কো ভেরাত্তি, ব্যাকআপ হিসেবে ম্যাতেও পেসিনা। লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে এবং সিরো ইমোবিলে পুরো টুর্নামেন্টেই খেলেছেন আক্রমণভাগে, তবে বদলি হিসেবে দুর্দান্ত খেলে নকআউট পর্বে ডমিনিকো বেরার্দিকে বেঞ্চে পাঠিয়ে একাদশে জায়গা করে নেন ফেদেরিকো কিয়েসা।
গ্রুপপর্বে রীতিমতো দুর্দান্তই খেলে ইতালি, নিজেদের চিরায়ত ‘কাত্তানেচ্চিও’ বা ডিফেন্সিভ ফুটবল নয়, বরং আক্রমণাত্মক ফুটবলের পসরা সাজিয়েই তিন ম্যাচে সাত গোল করে নয় পয়েন্ট নিয়ে নকআউট পর্বে ওঠে আজ্জুরিরা।
কিন্তু সেখান থেকেই যেন উলটো পথে হাঁটার শুরু তাদের। যে উলটো পথ নিয়ে গিয়েছে নর্থ মেসিডোনিয়ার কাছে হারে, কিংবা আর্জেন্টিনার হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ায়।
দ্বিতীয় রাউন্ডে অস্ট্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি। ৯০ মিনিটেও গোল করতে পারেনি তারা, কিন্তু বেঞ্চ থেকে নামেন কিয়েসা ও পেসিনা, সঙ্গে ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি ও আন্দ্রেয়া বেলোত্তি। ইতালিয়ানদের এই দারুণ বদলিদের এনে দেয়া উদ্যমের সঙ্গে খর্বশক্তির অস্ট্রিয়া আর পারেনি, কিয়েসা ও পেসিনার গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আজ্জুরিরা। অস্ট্রিয়ানদের হয়ে সাসা কালাজিচ একটি গোল শোধ করেছিলেন বটে, লাভ হয়নি।
কোয়ার্টার ফাইনালে অবশ্য বেলজিয়ামকে ভালোভাবেই হারিয়েছিল ইতালি, বারেলা ও ইনসিনিয়ের গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল তারা প্রথমার্ধেই। পরে রোমেলু লুকাকু পেনাল্টি থেকে ব্যবধান ২-১ করেন, এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম এমন সব সুযোগ হেলায় হারায়, তাতে তারা যে সেমিফাইনালে যাওয়ার যোগ্য ছিল না, সেটিই প্রমাণ করে। ম্যাচশেষে এক্সপেক্টেড গোল (এক্সজি) হিসেবে এগিয়ে ছিল অবশ্য বেলজিয়ানরাই, ১.৮৩-১.৭৩ ব্যবধানে।
তবে ইতালি ভাগ্যদেবীর সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছে স্পেনের বিপক্ষে সেমিফাইনালে। এখানে সামান্য আলোচনা করা যাক, ইতালির ট্যাকটিকাল সেটআপ নিয়ে।
ডিফেন্সে মানচিনি চেষ্টা করতেন ব্যাক-থ্রি তৈরি করতে, তবে সাধারণত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে ড্রপ-ইন করিয়ে নয়, বরং রাইটব্যাক ডি লরেঞ্জোকে ওভারল্যাপ না করিয়ে ডিফেন্সিভ লাইন ঠিক রেখে।
স্পিনাজ্জোলা চোটে পড়ার আগ পর্যন্ত বাম পাশ দিয়ে আক্রমণের দায়িত্ব তারই ছিল, এবং দুর্দান্ত ওভারল্যাপ করে সেটি করছিলেনও তিনি। এক্ষেত্রে মিডফিল্ডে ভেরাত্তির দায়িত্ব ছিল স্পিনাজ্জোলার রেখে যাওয়া স্পেস কভার করা, যেহেতু লেফট উইং থেকে ইনসিনিয়ে ইনভার্টেড ফরোয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করেন। একমাত্র কিয়েসার ছিল পুরোপুরি স্বাধীনতা, যেখানে খুশি যাওয়ার, যেহেতু ইতালির আক্রমণের মূল উৎস তিনিই ছিলেন।
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ইতালির মিডফিল্ড ঠিক আদর্শ মিডফিল্ড তো নয় বটেই, বরং অনেকটা ডিসফাংশনাল। জর্জিনহো ফিজিক্যাল মিডফিল্ডার নন, নন ভেরাত্তিও। বরং দুজনই কন্ট্রোলার, এবং সঙ্গে বারেলা বা পেসিনা বক্স-টু-বক্স। স্পেনের মতো মিডফিল্ড-নির্ভর দলের পাস সার্কুলেশন বন্ধ করতে যে ফিজিক্যালিটি কিংবা ওয়ার্করেট দরকার ছিল, তা বারেলা ব্যতীত আর কারও ছিল না ইতালির মাঝমাঠে।
ফলাফল? মাঝমাঠে রীতিমতো ইতালিকে নাচিয়ে ছেড়েছিল স্পেন। মিকেল ওয়ারজাবাল কিংবা দানি ওলমো ফিনিশিং করতে ভুলে না গেলে অনেক আগেই খেলা শেষ হয়ে যেত; পেদ্রি-সার্জিও বুস্কেটস-কোকের তৈরি মিডফিল্ডের সঙ্গে কোনোমতেই যে পেরে উঠছিল না ইতালি!
কিন্তু ৬০ মিনিটের মাথায় খেলার স্রোতের বিপরীতেই দুর্দান্ত ব্যক্তিগত স্কিল ও এরিক গার্সিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ডিফেন্ডিংয়ে ভর করে ইতালিকে এগিয়ে নেন কিয়েসা। আলভারো মোরাতা বেঞ্চ থেকে সমতা ফেরান, খেলা গড়ায় টাইব্রেকে, এবং সেখানে শেষ পর্যন্ত ইতালিই জিতে যায়।
কথায় আছে, ‘উইনিং ইট ডার্টি’, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের খেলাকে বারবার নষ্ট করে জয় নিয়ে ফেরা। ইতালি যদি সেটিও করত, তবে বলা যেত, স্পেনকে নিজেদের খেলা খেলতে দেয়নি তারা। কিন্তু বাস্তবিকে স্পেন নিজেদের খেলাটাই খেলেছিল, কেবলমাত্র বারবার সুযোগ নষ্ট করেই জিততে পারেনি তারা।
ফাইনালে শুরুতেই গোল খেয়ে বসার পর থেকে অবশ্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মরিয়াই ছিল ইতালি। ৬৭ মিনিটে সমতাসূচক গোলও পেয়ে যায় তারা, ৮৬ মিনিটে অবশ্য কিয়েসা চোটের জন্য উঠে যেতে বাধ্য হয়।
এবং আশ্চর্যজনকভাবে ইতালির আক্রমণভাগ ধার হারিয়ে ফেলে তারপরই। এটি আরেকটি উদাহরণ, আক্রমণভাগে ইতালি কতটুকু একজনের উপর নির্ভরশীল ছিল, এবং ইউরোর পর থেকে কিয়েসার চোটই বারবার ভুগিয়েছে তাদের।
এবং শেষ পর্যন্ত ফাইনালটি ছিল ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের বোকামির, যেখানে তিনি ১১৯ মিনিটে মাঠে নামান মার্কাস র্যাশফোর্ড ও জ্যাডেন স্যাঞ্চোকে, যারা কেউই তাদের ক্লাবের হয়ে নিয়মিত পেনাল্টি নেন না। এবং শেষ পেনাল্টিটি তিনি দেন ১৮ বছরের বুকায়ো সাকাকে।
ফলাফল যা হওয়ার ছিল তাই, ডোনারুম্মা নায়ক হয়ে ওঠেন; র্যাশফোর্ড, স্যাঞ্চো, ও সাকা, তিনজনই গোল করতে ব্যর্থ হন শুটআউটে।
আলোচনা থেকে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ইতালি ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলেনি, তাদের মিডফিল্ডও দুর্দান্তভাবে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখেনি, এবং তাদের আক্রমণভাগও ছিল একচোখা, অথবা, কিয়েসামুখী।
তবে তাদের সঙ্গে ভাগ্যদেবী যে ছিলেন, সেটি বোঝা গিয়েছিল স্পেনের বিপক্ষে নেশনস লিগের ম্যাচে। এবার আর সুযোগ নষ্ট করেনি স্প্যানিশরা, ফেরান তোরেসের জোড়া গোলে ঠিকই জিতে নিয়েছিল ম্যাচটি, এবং সেখানেও মানচিনিকে ট্যাকটিকসে বশ মানিয়েছিলেন লুইস এনরিকে।
এবং দেখা গিয়েছে ফাইনালিসিমায়ও, মেসিদের সামনে ইতালি তাই করেছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
ইতালি তাই যোগ্য দল হিসেবেই ইউরো জিতেছিল, সে কথা আর বলা যাচ্ছে না। বরং বলা যেতে পারে, ভাগ্যদেবী, প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার এবং কোচ, সবার থেকেই তারা পেয়েছিল আশীর্বাদ, আর তাতেই রোমে এসেছিল শিরোপা, মাঠে সেরা দল হিসেবে নয়।