সন্দ্বীপ লামিচানে নজর কেড়েছিলেন আরও আগে। নেপাল ক্রিকেট দলের একমাত্র তারকা তিনি। নেপালের ক্রিকেট হুট করে আলোচনায় এসে হুট করেই মুখ থুবড়ে পড়লেও, একটুও কমেনি লামিচানের লেগস্পিনের ঘূর্ণিপাক। উল্টো মাইকেল ক্লার্কের হাতে নিজেকে আরও ঝালিয়ে নিয়েছেন তিনি। এশিয়ার পর, ইংলিশ ক্রিকেট; স্বপ্ন ছিল খেলবেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই সুযোগও হয়েছে। বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি লিগ মাতিয়েছেন। ভারতের জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলেছেন। এবার খেলছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। তার দল সিলেট সিক্সার্স। নিজের ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্স, লেগস্পিনার হয়ে ওঠার গল্প, সংগ্রাম আর সৌভাগ্যের সঙ্গে নেপালের ক্রিকেট নিয়ে বিস্তর আলাপ করেছেন লামিচানে। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সেই সাক্ষাতকার তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
দুই বছর আগে আপনি বলেছিলেন বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে পারলে আপনার স্বপ্ন পূরণ হবে। সে কথা মনে পড়লে কী মনে হয়?
অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগপর্যন্ত আমি কেবল এশিয়া আর ইংলিশ কন্ডিশনে খেলেছি। সে কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় খেলার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সে দেশে আমার খেলার একটাই সুযোগ ছিল, তা হলো বিগ ব্যাশ। আমি আমার পরিবারকে গর্বিত করতে চেয়েছিলাম, নেপালের মানুষকে গর্বিত করতে চেয়েছিলাম; সর্বোপরি নিজে গর্বিত হতে চেয়েছিলাম। যে স্বপ্নটা আমি দেখেছিলাম, তা আমি সত্যি করতে পেরেছি।
আপনি কী মনে করেন যে বিগ ব্যাশ আপনাকে আরও শক্তিশালী করেছে?
একদম তা-ই। বিভিন্ন ধরনের লিগ খেলাটা আপনাকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। অন্যান্য দেশের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় খেলার ধরন আলাদা। উইকেটের ব্যাপারে আপনাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ব্যাটসম্যান আপনার প্রতিটি বলেই ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করবে। এশিয়ার কন্ডিশনে স্পিনারদের জন্য বল করাটা অনেক সহজ, কারণ এখানে বল টার্ন করে। অস্ট্রেলিয়ায় এই সুবিধা নেই।
কোন ব্যাপারটা আপনাকে বিগ ব্যাশ থেকে বিপিএলে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছে?
বিগ ব্যাশ ও বিপিএলে কিছু কমিটমেন্টের ব্যাপার থাকে। আমি আরও ১০-১১ মাস আগে বিপিএলের সঙ্গে চুক্তি করেছি। আমি বিপিএলের নীতিগুলো বিগ ব্যাশকে জানিয়েছি, তারপরই বিপিএলে যোগ দিয়েছি।
বিপিএলে নির্দিষ্ট সময়ে খেলা যায়। আপনারা যদি আমাকে এখানে নিতে চান, তাহলে আমি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলতে পারবো। এভাবেই আমি সিলেট সিক্সার্স ও বিপিএলের জন্য আলাপ করে নিয়েছি।
আমি মনে করি সামনে যা-ই আসুক , সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। তো আমি আপাতত বিগ ব্যাশ ভুলে বিপিএল নিয়েই আছি।
কীভাবে আপনি লেগস্পিনার হলেন?
আমি আমার ভাইদের সাথে, বন্ধুদের সাথে রাস্তায় খেলতাম। শুরুর দিকে আমি মিডিয়াম পেস করতাম, অফস্পিন করতাম। মোদ্দা কথা, আমি সব ধরনের বল করতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যাটসম্যানকে আউট করা অনেক কঠিন হয়ে যেত। কীভাবে বল করলে ওদেরকে আউট করা যায়, তা ভাবতে শুরু করলাম। সেখান থেকে আমার লেগস্পিন করা শুরু। খেয়াল করলাম, সবাই আমার লেগস্পিন খেলতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। তাদেরকে সহজেই ফাঁদে ফেলতে পারলাম। এভাবেই আসলে আমার লেগস্পিন করা শুরু।
আপনি যখন লেগস্পিন করা শুরু করলেন, তখন কোন বোলারকে অনুসরণ করতেন?
আমি যখন লেগস্পিন শুরু করি, কাউকেই অনুসরণ করিনি। কারণ আমাদের বাড়িতে কোনো টিভি ছিল না। আমি যতটা পারতাম রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনতাম। তারপর যখন বাড়িতে টিভি এল, তখন থেকে শেন ওয়ার্নকে দেখতে থাকলাম। ইউটিউবে ওয়ার্নারের ভিডিওগুলো আমার শেখার কাজটাকে আরও সহজ করে দিয়েছিল।
হংকংয়ে টি-টোয়েন্টি ব্লিটজ দেখার পর মাইকেল ক্লার্ক অস্ট্রেলিয়ায় তার ক্লাব দলে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব আপনার ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
অনেকটা। কারণ এক নেপালি ছেলে, যার কিছুই নেই, সে ক্রিকেট দিয়ে তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছে, গর্বিত করতে চাইছে। তিনি আমাকে সিডনিতে আমন্ত্রণ জানান, তার ক্লাবে খেলার প্রস্তাব দেব। নেপালের একজন এতসব সুযোগ সুবিধা বিনামূল্যে পাচ্ছে, সঙ্গে গাদাখানেক স্পন্সরের সহায়তা; সবকিছুরই উপলক্ষ মাইকেল ক্লার্ক। অস্ট্রেলিয়ায় খেলার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য বিশাল একটা অর্জন ছিল, কারণ আমার স্বপ্নই ছিল সেখানে খেলতে যাওয়া। এটা দারুণ ব্যাপার।
আপনি যখন চিঠি পেলেন, তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
মুহূর্তটা ভালো ছিল, পাশাপাশি বিস্মিত হয়েছিলাম। ভাবছিলাম, আসলেই? এটা কি সত্যি? আমাকে মাইকেল ক্লার্ক ডেকেছেন? কিন্তু এটাও সত্যি যে হংকংয়ে থাকতেই তিনি আমাকে এ বিষয়ে কিছু ধারণা দিয়েই রেখেছিলেন। আমরা দুজন ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথা বলতাম। শেষ পর্যন্ত যখন এই খবরটা পেলাম, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
সর্বশেষ আসরে আপনি আইপিএলে তিনটি ম্যাচ খেলেছেন। তো দিল্লী ডেয়ারডেভিলসে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ওখানে খেলতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। কারণ সবাই খুব ভালো ছিল। দারুণ একটা টুর্নামেন্ট হয়েছিল। আগে কখনও এমন জায়গায় খেলিনি। আমার জন্য, নেপালের জন্য গর্বের বিষয় ছিল। ব্যাপারটা এমন ছিল যে,মোট নেপালের একটা ছেলে তার দেশকে গর্বিত করছে, বিদেশে গিয়ে আইপিএলের মতো বড় পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত আমি টুর্নামেন্টের শেষ তিন ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলাম, ভালো পারফরম্যান্স করেছিলাম। সবকিছু অসাধারণ ছিল।
সেই দিল্লি দল আসন্ন আসরের জন্য আপনাকে অবিক্রিত রেখেছে…
এই মুহূর্তে আমরা বেশ ভালো দল। গেলবারের সব ভুলগুলো শুধরে আমরা এবার দল হিসেবে ভালো করতে চাই।
দিল্লির ক্যাম্পে রিকি পন্টিংয়ের সাথে আপনার বোঝাপড়া কেমন ছিল?
আইপিএল চলাকালীন সময়ে তার সাথে আমার অনেক কথা হতো। আমি এমন একটা ছেলে যে প্রতিদিন শিখতে চায়। যে প্রশ্ন করতে চায়। আমি ক্রিকেটের সবকিছুর ব্যাপারে জানতে চাইতাম। কারণ আমি যদি বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে পারি, তাহলে সেরাটা দিতে পারার সক্ষমতা হবে।
ইমরান তাহিরের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পরামর্শ নিয়েছেন? উনি তো আপনার দল সিলেট সিক্সার্সের হয়ে খেলছেন।
হ্যাঁ, উনি খুবই ভালো মানুষ। এই মুহূর্তে আমরা একই দলে। অনুশীলন বলেন, ফিল্ডিং বলেন; যখনই সময় হয় আমরা আলাপ করি।
আধুনিক সময়ে লেগস্পিনারের অভাব চোখে পড়ার মতো। এর পেছনে কী কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?
এর ঠিক কীংবা কারণ, তা নির্দিষ্ট করে আমার জানা নেই। আপনি যতক্ষণ ব্যাটসম্যানকে চাপে রাখতে চাইবেন, ততক্ষণ আপনাকে সঠিক জায়গায় বল করতে হবে। আমার মনে হয় না, ঠিক জায়গায় বল করলে আপনাকে কেউ মারতে পারবে। লেগস্পিন এমন একটা জিনিস যেখানে ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলা সহজ হয়, যদি কি না সে আপনার বলের ভেরিয়েশন বুঝতে না পারে। এটা একটা কারণ হতে পারে যে, লেগস্পিনাররা দেরিতে হলেও ক্রমশ টি-টোয়েন্টিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে।
নেপালে নিজের তারকাখ্যাতি কতটা উপভোগ করেন?
হ্যাঁ, নেপালের মানুষ অনেক ভালো। কিন্তু এখন আমার জন্য আর আগের মতো সবকিছু নেই। আগে যখন রাজধানীতে যেতাম, মনের মতো ঘুরতে পারতাম। এখন তা পারি না। আপনি চাইলেই নিজের পুরো সময় সবাইকে দিতে পারবেন না। কারণ আপনার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। কিন্তু আমি যখনই নেপালে যাই, চেষ্টা করি সবাইকে সময় দেওয়ার, যেন কেউ মন খারাপ না করে।
ভবিষ্যৎ ক্রিকেটীয় জাতি হিসেবে নেপাল নিয়ে আপনার দর্শন কী?
ভালো প্রশ্ন। চার বছর আগে আমি এই জায়গা থেকে শুরু করেছিলাম। অর্থাৎ, ২০১৪ সালে আমরা বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি। তারপর নেপালের ক্রিকেট কিছুটা পর্দার আড়ালে চলে যায়। এখানে অনেক ব্যাপার আছে। আমি জানি না কী হয়েছে কিংবা কেন আমাদের এখন কোনো ক্রিকেট বোর্ড নেই। এমনকি আমার অভিষেকের সময়ে ক্রিকেট বোর্ড আইসিসি কর্তৃক বরখাস্ত হয়। আমি এখনও জানি না কী হয়েছে। আশা করি সবকিছু দ্রুতই সমাধান হবে। আমরা যদি ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো ভিত গড়তে পারি, আমরা ভালো করতে পারবো।
আপনি আপনার এলাকায় বেশ জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী ছিলেন। সেই ক্যারিয়ার ছাড়ার কারণে কোনোরকম আফসোস হয়?
না, একেবারেই হয় না। মাঝে মাঝে এটা নিয়ে আমি ভাবি, কিন্তু বেশি ভাবি না। কারণ এটা আমার শখ ছিল।