১.
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন অ্যান্ডি স্যান্ডহাম। ১৯২৬ সালে নিজের শেষ টেস্টে এই ট্রিপল করেছিলেন তিনি, প্রতিপক্ষের নাম ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেটা ছিল শুরু। এরপর এখন পর্যন্ত ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়েছে আরও ২৯টি, করেছেন ২৫ জন। শেষ এই কীর্তি গড়েছেন ভারতের করুণ নায়ার। দুটো করে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন ৪ জন। সেই ৪ জনের নাম: স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, ব্রায়ান লারা, বীরেন্দর শেবাগ এবং ক্রিস গেইল।
অ্যান্ডি স্যান্ডহামের কীর্তির চার বছর পরের কথা। ১৯৩০ সালে অ্যাশেজ খেলতে ইংল্যান্ডে গেল অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল, সেই সিরিজে রানের ফুলঝুরি ছোটালেন স্যার ডন। ৫ টেস্টের সিরিজে ৯৭৪ রান তুলে যে রেকর্ড করলেন, তা আজও অক্ষয় হয়ে আছে। সে সিরিজেই নিজের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, হেডিংলির তৃতীয় টেস্টে তার ৩৩৪ রানের পরও সেই টেস্ট ড্র হয়েছিল। ইংল্যান্ডের পক্ষে ব্যাট হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ওয়ালি হ্যামন্ড।
টেস্ট ক্রিকেটের তৃতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরি আসে এই হ্যামন্ডের ব্যাট থেকেই। ব্র্যাডম্যানের ট্রিপলের তিন বছর পর নিউ জিল্যান্ড সফরে গেল ব্রিটিশরা, সেই সফরেরই দ্বিতীয় টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন হ্যামন্ড, ৩৩৬ রানে অপরাজিত থেকে হয়ে যান টেস্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, পিছনে ফেলে দেন স্যার ডনকেও।
টেস্টের চতুর্থ ও ব্র্যাডম্যানের দ্বিতীয় ট্রিপলটি আসে এর এক বছর পরে, ১৯৩৪ সালে। আবার অ্যাশেজ খেলতে ইংল্যান্ডে আসে অস্ট্রেলিয়া, এবং আবার ডনের ট্রিপল সেঞ্চুরি। সেটাও কোন ভেন্যুতে? সেই হেডিংলিতে! সব ব্যাটসম্যানেরই কিছু পয়া মাঠ থাকে, ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে যে সেটা হেডিংলি, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়াই যায়।
প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পাওয়ার জন্য টেস্টের জন্মের পরে যেখানে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর, সেখানে অ্যান্ডি স্যান্ডহাম ‘ডেডলক’ খোলার ৮ বছরের মাথাতেই আরও তিনটে! কে যেন বলেছিলেন, ‘অসম্ভবকে একবার সম্ভব করা গেলে তা নিয়মিতভাবে সম্ভবে পরিণত হয়।’ কথাটা যে তিনি খুব একটা ভুল বলেননি, উপরের ঘটনা তার প্রমাণ।
২.
৯৯ রান কিংবা ১৯৯ রানে আটকে গেছেন, এমন ব্যাটসম্যানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ৯৯ রানে আটকে যাওয়া যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক একটা ব্যাপার, ১৯৯ রান হলে তো কথাই নেই। পাঠক শুনলে অবাক হতে পারেন, ২৯৯ রানেও আটকে গেছেন দু’জন খেলোয়াড়। সেই দু’জনের মধ্যেও স্যার ডন আছেন! বাকিজনের নাম মার্টিন ক্রো। স্যার ডন আবার ২৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। তাদেরকে নিয়ে লেখার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
৩.
পুড থার্লো জীবনে খেলেছেন একটি টেস্ট, উইকেট পাননি একটিও। বোঝাই যাচ্ছে, একেবারে যাচ্ছেতাই বোলার ছিলেন তিনি। তারপরও তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিনি শুধুমাত্র একটি কারণে। নিজের কোনো কীর্তি নয়, তার কারণেই ট্রিপল সেঞ্চুরি করা হয়নি ব্র্যাডম্যানের।
ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংস নিয়ে কথা হলে অবধারিতভাবে চলে আসে এরিক হলিসের নাম। এই বোলারের বলেই যে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন নিজের শেষ ইনিংসে। অথবা এমনিতে বোলার হিসেবে ম্যালকম ন্যাশ এমন কোনো পরিচিত নাম নন। কিন্তু স্যার গ্যারি সোবার্সের ৬ বলে ৬ ছক্কা মানেই ম্যালকম ন্যাশ। যেমনটা, যুবরাজ সিংয়ের ক্ষেত্রে স্টুয়ার্ট ব্রড, হার্শেল গিবস মানে ড্যান ভ্যান বাঞ্জ।
স্যার ডনের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির দুই বছর পরের কথা। ১৯৩২ সাল, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেছে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম তিন টেস্টে জিতে ৩-০’তে এগিয়ে গেল সফরকারীরা।
চতুর্থ টেস্টে টসে জিতে ব্যাট করতে নামল দক্ষিণ আফ্রিকা, জড়ো করল ৩০৮ রান। ৭ উইকেট নিলেন ক্ল্যারি গ্রিমেট।
ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম ইনিংসে রানের পাহাড়ে উঠে গেল অস্ট্রেলিয়া, মূল কৃতিত্ব ব্র্যাডম্যানের। একপ্রান্তে উইকেট পড়তে থাকলেও তিনি ছিলেন অবিচল। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮২ এল অধিনায়ক বিল উডফুলের ব্যাট থেকে, তিনজন মারলেন ডাক; এর মধ্যে ছিলেন অ্যালান কিপ্যাক্সও। ২৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন ব্র্যাডম্যান।
২৯৯ রানে আউট হওয়া মানেই যথেষ্ট আক্ষেপের ব্যাপার, অপরাজিত ২৯৯ মানে তো আরও আক্ষেপ। তার কোনো দোষ নেই, এটা ভেবে অন্তত সান্ত্বনা পেলেও পেয়ে থাকতে পারেন ব্র্যাডম্যান। আসল ‘দোষী’র নাম পুড থার্লো। তবে তিনি যেভাবে আউট হলেন, তাতে ভাগ্যের চাইতে তার দায়ই বেশি।
নবম উইকেট পড়েছিল দলের ৪৯৯ রানে। এরপর থার্লোকে স্ট্রাইকিং থেকে দূরে রেখে নিজে খেলছিলেন ব্র্যাডম্যান। বোলার সিরিল ভিনসেন্ট যখন ওভারের শেষ বল করলেন, তখন তার রান ২৯৮। সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক হাতে রাখবেন, এরকমটাই ইচ্ছে ছিল হয়তো তার। কিন্তু ১ রান নেয়ার পরই তিনি দেখলেন, অপর প্রান্ত থেকে দৌঁড় শুরু করেছেন থার্লো। যেন ব্র্যাডম্যান না, ট্রিপল সেঞ্চুরি বাকি আছে তারই!
ব্র্যাডম্যান বুঝে গেলেন, তার পক্ষে পৌঁছানো অসম্ভব, তবে থার্লো পৌঁছাতে পারেন এখনও। ফিরে যাওয়ার সঙ্কেতও দিলেন তিনি। কিন্তু হায়! আর কখনোই ক্রিজে পৌঁছানো হলো না থার্লোর। ২৯৯ রানেই তাই অপরাজিত রয়ে গেলেন স্যার ডন!
প্রফেশনাল প্লেয়ারদের নানারকম বিধিনিষেধ থাকে। ইচ্ছে করলেও তারা অনেক কিছু করতে পারেন না। এই ঘটনার পর ডন থার্লোকে কী বলেছিলেন, তা হয়তো এখন আর জানাও যাবে না।
ট্রিপল সেঞ্চুরি মিসের পরে ডনের কি আফসোস হয়েছিল? হয়েছিল নিশ্চয়ই, কারণ তিনি রক্তমাংসের মানুষই তো ছিলেন, নাকি? হয়তো আর কখনো ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পাবেন না, এমনটা মনে হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। তবে সেসব মনে হওয়া উড়িয়ে দিলেন দুই বছর পর। আবার ট্রিপল সেঞ্চুরি করে জোড়া ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক হয়ে গেলেন। তাতে কি সেই ১ রানের আফসোস কমল কিছুটা?
হয়তো!
৪.
মার্টিন ক্রো’র ঘটনায় কাউকে দোষ দেয়ার উপায় নেই। টেস্ট ক্রিকেট অখণ্ড মনোযোগের খেলা, এক মুহূর্তের বেখেয়ালে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। ক্রো’র ক্ষেত্রেও তা’ই হয়েছিল। টানা প্রায় দেড়দিন ব্যাট করেছেন, সতীর্থ অ্যান্ড্রু জোন্সকে নিয়ে গড়েছেন ৪৬৭ রানের জুটি। মাঝে জোন্স ফিরে গেলেও তিনি ছিলেন অবিচল।
ঝামেলাটা করে ফেলল তার ব্যক্তিগত স্কোর। ২৯৯ রানে দাঁড়িয়ে যখন তার আরও মনোযোগী হওয়ার কথা, ঠিক তখনই মনোযোগে চিড় ধরল তার। পরবর্তীতে এই নিয়ে বহুবার আফসোস করেছেন ক্রো। বলেছেন, দেশের হয়ে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার চিন্তা তার মনঃসংযোগে বাধার সৃষ্টি করেছিল। বলটাকে যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখার কথা ছিল, সেখানে ট্রিপল সেঞ্চুরির চিন্তায় ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল বলের অবয়ব। যার ফল হিসেবে অর্জুনা রানাতুঙ্গার অতি নিরীহদর্শন বলে উইকেটকিপার হাসান তিলকারত্নের কাছে ধরা পড়েন তিনি।
৫.
থার্লোর পাপ ব্র্যাডম্যান মোচন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নিজের পাপ আর মোচন করা হয়নি ক্রো’র। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিনই এই ১ রানের আক্ষেপ তাড়া করেছে তাকে। সেই আক্ষেপ নিয়েই বছরতিনেক আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন তিনি।
ক্রিকেটদেবতা কখনো কখনো তার ভাণ্ডার উপচে দেন তার পূজারীর কোলে, আবার কখনো কখনো নিংড়েও নেন!