ক্রিকেটে কিছু কিছু ব্যাপার চিরন্তন সত্যের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই যেমন বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলা কিংবা বিশ্বকাপ এলেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকা। এই দুটি সত্যের মতো আরেকটি সত্য হচ্ছে সিডনির কোনো খেলোয়াড়ের হাত ধরে অজিদের বিশ্বমঞ্চে জ্বলে ওঠা। অসাধারণ সব ক্রিকেটারের জন্মস্থান এই সিডনি, অস্ট্রেলিয়ার চার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের মধ্যে এক রিকি পন্টিং বাদে বাকি তিনজন– অর্থাৎ অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ ও মাইকেল ক্লার্ক– প্রত্যেকে এই শহর থেকেই এসেছেন। মার্ক ওয়াহ, জ্যাসন গিলেস্পি, মিচেল স্টার্ক, স্টিভ স্মিথের জন্মস্থানও এই সিডনি।
বিশ্বকাপে খেলা ১৮৫০ জন খেলোয়াড়ের পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে দেখা গেছে যে ব্যাটিং ও বোলিং পারফরম্যান্সের বিচারে সিডনির অবস্থান সবার উপরে। এই শহরের বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের নিয়ে ১৫ সদস্যের একটি স্কোয়াড বানানো সম্ভব, অন্য কোনো শহরই এতজন বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় উপহার দিতে পারেনি।
এ তো গেলো বিশ্বকাপজয়ী সদস্য বিবেচনায় শহরগুলোর অবস্থানের কথা, তবে বিশ্বকাপে মোট রানের বিচারে সবার উপরে রয়েছে কলম্বো। এই শহরের খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত মোট ৮১৮৬ রান সংগ্রহ করেছে, কিন্তু তাদের ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৯! আসলে কলম্বোর খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছে, সবমিলিয়ে ৪৬৭ ম্যাচ খেলার কারণেই মোট রানের তালিকায় তাদের অবস্থান এত ওপরে। ব্যাটিং গড়ের বিচারে অবশ্য এখানেও সবার ওপরে সিডনির অবস্থান, দ্বিতীয় স্থানে আছে হোবার্ট আর তৃতীয় স্থানে দিল্লী।
বোলিংয়ের বিচারেও সবার ওপরে রয়েছে সিডনি আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন মিচেল স্টার্ক। মাত্র ১৫ গড়ে ৪৯ উইকেট তুলে নিয়েছেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের এই বোলার। রিচার্ড হ্যাডলি, শেন বন্ড, ম্যাট হেনরি, ক্রিস হ্যারিসদের কল্যাণে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ক্রাইস্টচার্চ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের হয়ে না খেলেও দেশটির এই শহরটিকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছেন বেন স্টোকস। এই ইংলিশ অলরাউন্ডারের জন্ম যে ক্রাইস্টচার্চেই! অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, কেভিন পিটারসেন, ইমরান তাহিরের মতো এমন আরো অনেক খেলোয়াড় আছেন যারা নিজেদের জন্মস্থানের হয়ে না খেলে বেছে নিয়েছিলেন অন্য কোনো দেশ। মাইকেল হোল্ডিং, কোর্টনি ওয়ালশের মতো অসাধারণ বোলারের জন্মস্থান কিংস্টন রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে।
সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় সবার উপরে রয়েছে লাহোর, তবে গড়ের দিকে এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ার ডুবো নামের এক অখ্যাত শহর। মূলত গ্লেন ম্যাকগ্রার কল্যাণে বাকি শহরগুলোর তুলনায় নিউ সাউথ ওয়েলসের এই শহরটি এগিয়ে গেছে। এরপরের দুটি স্থানে রয়েছে যথাক্রমে চন্ডিগড় ও লঞ্চেস্টন।
পরিসংখ্যানের সব হিসাব তো গেলো, এখন সত্যিই যদি আন্তঃশহর বিশ্বকাপের আয়োজন করা হতো তবে ফলাফলটা ঠিক কেমন দাঁড়াতো? বিশ্বজুড়ে ৪৫০টির বেশি শহরের পরিসংখ্যান নেওয়া হলেও মাত্র ৩১টি শহর পাওয়া গেছে যেখান থেকে ন্যূনতম এগারো জন খেলোয়াড় বিশ্বকাপ খেলেছে। এর মধ্যে ঢাকা আর নাইরোবি থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে এসেছেন, তবে বিশ্বকাপে তাদের পারফরম্যান্স তেমন আহামরি কিছু না।
এই শহরগুলোর মধ্যে কিছু শহর ব্যাটিং বিভাগে খুবই শক্তিশালী, যেমন ধরা যাক দিল্লীর কথা। বিরাট কোহলি, বীরেন্দর শেহওয়াগ, গৌতম গম্ভীর, শিখর ধাওয়ানের মতো অসাধারণ সব ব্যাটসম্যান এই শহর থেকেই এসেছেন। কিন্তু মানসম্পন্ন বোলার উপহার দিতে না পারায় তারা বেশ পিছিয়ে পড়েছে। শচীন টেন্ডুলকার ও সুনীল গাভাস্কারের শহর মুম্বাই থেকেও এক আশিস নেহরা ছাড়া উল্লেখ করার মতো কোনো বোলার নেই।
আবার এর উল্টো চিত্রও আছে, ওয়েলিংটন কিংবা পোর্ট এলিজাবেথের মতো শহর থেকে বেশ কিছু ভালো বোলার এসেছে। তবে গুণসম্পন্ন ব্যাটসম্যান সেভাবে এই শহর থেকে উঠে আসেনি। কিংস্টনে ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেলের মতো ব্যাটসম্যান আছেন যারা নিজেদের দিনে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতে পারবেন, বোলিং বিভাগে আছেন মাইকেল হোল্ডিং, কোর্টনি ওয়ালশের মতো দুই কিংবদন্তী। কিন্তু মাত্র চার-পাঁচজন মানসম্পন্ন খেলোয়াড় দিয়ে কি কোনো বড় কিছু জেতা সম্ভব?
ঠিক এসব কারণেই উপরে উল্লেখিত শহরগুলোর গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। সবকিছু বিবেচনায় শেষ আটে জায়গা পাবে অকল্যান্ড, ক্রাইস্টচার্চ, লাহোর, সিডনি, কলম্বো, মেলবোর্ন, জোহানেসবার্গ এবং কেপ টাউন। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত এবং উইন্ডিজের কোনো শহরই শেষ আটে আসতে পারেনি। বিশাল দেশ ভারতের প্রতিভাও বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, তাই এককভাবে কোনো শহরই তেমন দাপট দেখাতে পারেনি। অন্যদিকে উইন্ডিজ তো বেশকিছু দ্বীপরাষ্ট্রের সমন্বয়ে তৈরি, তাই একই কারণে তাদের কোনো শহরও কোয়ার্টার ফাইনালের লাইনাপে নেই।
উপরের ছবিতে আট দলের পূর্ণাঙ্গ একাদশ দেওয়া আছে। এখন এই আটটি দলকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। কোয়ালিটি ফাস্ট বোলার এবং অসাধারণ সব অলরাউন্ডারের জন্মস্থান ক্রাইস্টচার্চের বেশ ভালো নামডাক আছে, তবে ক্রেইগ ম্যাকমিলান এবং বেন স্টোকস বাদে এই শহর থেকে সেই অর্থে কোনো পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান উঠে আসেনি। সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা কেপ টাউনে, দারুণ সব ব্যাটসম্যান থাকলেও এক ভার্নন ফিল্যান্ডার ছাড়া আহামরি কোনো বোলার এই শহরের নেই।
এসব দিক থেকে জোহানেসবার্গের দলটা অবশ্য বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। গ্রায়েম স্মিথ, কুইন্টন ডি কক, গ্রান্ট এলিয়ট, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের মতো দারুণ সব ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি কাগিসো রাবাদা, অ্যান্ড্রু হল, আদ্রিয়ান কুইপারের মতো বোলারও এই শহর থেকে এসেছেন। তবে আমাদের এই গবেষণার মূল ক্ষেত্র তো বিশ্বকাপে, সেই মঞ্চে অবশ্য এসব খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স সেই অর্থে অসাধারণ কিছু না।
মেলবোর্নে ম্যাক্সওয়েল, ডিন জোন্স কিংবা শেন ওয়ার্নের মতো সুপারস্টার থাকলেও বাকিদের পারফরম্যান্স আহামরি কিছু না। এসব কারণে এই চারটি দল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেবে, অর্থাৎ সেমিফাইনালে চলে যাবে সিডনি, লাহোর, অকল্যান্ড এবং কলম্বো।
সেমিফাইনাল
সিডনি ও অকল্যান্ড – প্রতিবেশী দুই দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের এই দু’টি শহরের মধ্যে লড়াইটা বেশ জমজমাট হওয়ার কথা। মার্টিন ক্রো, মার্ক গ্রেটব্যাচ, মার্টিন গাপটিলের মতো অসাধারণ ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি আন্দ্রে অ্যাডামস, লকি ফার্গুসন, ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মতো দুর্দান্ত সব বোলার অকল্যান্ডে আছে। কিন্তু সিডনির দলটায় তারকার ছড়াছড়ি একটু বেশিই, তাই ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে অকল্যান্ডকে হার মানতেই হবে।
অন্যদিকে লাহোর এবং কলম্বো – দুই দলই শক্তিমত্তার দিক থেকে অনেক ভারসাম্যপূর্ণ। মাহেলা জয়াবর্ধনে, অরবিন্দ ডি সিলভা, আশাঙ্কা গুরুসিনহার মতো ব্যাটসম্যান তো আছেই, সাথে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, থিসারা পেরেরা, চামিন্দা ভাস কিংবা পারভেজ মাহারুফ থাকায় কলম্বোর বোলিংটাও বেশ শক্তিশালী। তবুও লাহোরের দলটার কাছে কলম্বোর এই দল সেমিফাইনালে হেরে বিদায় নেবে।
সিডনি বনাম লাহোরের মধ্যকার ফাইনাল
এতসব সমীকরণের পর ফাইনালে উত্তীর্ণ দুই দল হিসেবে লাহোর ও সিডনিকে পাওয়া গেলো। দুই দলই শক্তিমত্তার বিচারে অনেক বেশি কাছাকাছি অবস্থানে আছে, উভয় দলেই চার-পাঁচজন খেলোয়াড় আছে যারা বিশ্বকাপজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ফাইনালিস্ট দুই দলের ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সিডনির ব্যাটিং লাইনআপ দেখলে যেকোনো দলের বোলিং লাইনআপ ভড়কে যেতে পারে। ডেভিড ওয়ার্নার, মার্ক ওয়াহ, স্টিভ স্মিথ, মাইকেল ক্লার্ক, অ্যালান বোর্ডার আর সাথে স্টিভ ওয়াহ– এতগুলো বড় নাম একসাথে দেখলে কি ভড়কে যাওয়াটাই স্বাভাবিক না? সবচেয়ে বড় কথা, এসব তারকারা বিশ্বকাপেও দারুণ সফল ছিলেন। জ্যাসন গিলেস্পি, প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, নাথান ব্রাকেনদের নিয়ে দলটির পেস বোলিং লাইনআপও দারুণ। কিন্তু একজন নিয়মিত উইকেটরক্ষক আর বিশ্বমানের স্পিনারের অভাবে এই দলটা শতভাগ ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারেনি।
অন্যদিকে লাহোরের মূল শক্তির জায়গা তাদের বৈচিত্র্যময় বোলিং লাইনআপ। ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, সাকলাইন মুশতাক, আব্দুল কাদির– এই চারজনকে একসাথে সামলাতে গেলে যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়াটা স্বাভাবিক। মোহাম্মদ ইউসুফ, বাবর আজম, কামরান আকমল, সেলিম মালিক আর উমর আকমলকে নিয়ে গড়া তাদের ব্যাটিং লাইনআপটাও দারুণ। তাছাড়া ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, আব্দুল রাজ্জাকদের মতো অলরাউন্ডার থাকাটা ব্যাটিং লাইনাপকে বাড়তি শক্তি যোগাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সিডনির মতো তাদের কোনো বিশেষ দুর্বলতা নেই। দলে কামরান আকমল থাকায় নিয়মিত উইকেটরক্ষক নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না আবার পেস এবং স্পিন– দুই বিভাগেই অসাধারণ সব খেলোয়াড় থাকায় সব ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের বোলিং লাইনআপ অনেক বেশি কার্যকরী হবে। তাই ফাইনালের লড়াইয়ে লাহোরের চেয়ে কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকবে সিডনি।
তবে বর্তমানে যা অবস্থা, তাতে এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী খুব বেশিদিন আর লাহোর সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারবে না। ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আকরামদের মতো কিংবদন্তীরা এখন আর এই শহর থেকে উঠে আসছে না। অন্যদিকে সিডনি আর ক্রাইস্টচার্চ এখনো দারুণ সব খেলোয়াড় তৈরি করে যাচ্ছে। তাই এমনটা অব্যাহত থাকলে এই গবেষণার ফলাফল হয়তো কিছুদিন পর উল্টেও যেতে পারে।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো
১) শচীন রূপকথা
২) নায়ক
৩) সাকিব আল হাসান – আপন চোখে ভিন্ন চোখে