বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলাগুলোর মধ্যে টেনিস একটি। আরো বিশেষভাবে বললে, একক টেনিস খেলা সারা পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এই খেলার নিয়মিত দর্শক সেই অনুপাতে কম। অথচ রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, মারিয়া শারাপোভা, উইলিয়ামস বোনদের চেনেন অনেকেই। অনেকেই তাদের ভক্ত, পত্রিকায় খবরও রাখেন। কিন্তু সমস্যা হয় টেলিভিশনে আপনি একদিন ফেদেরারদের দেখছেন সবুজ মাঠে, আবার একদিন নীল মাঠে, কোনোদিন আবার লাল মাটিতে। এমন কেন? কোনদিন আবার দেখেন ম্যাচ স্কোর ৬-৪, ৬-৪, আবার কোনদিন দেখছেন ৭-৬ (৪), ৭-৫, ৪-৬, ৩-৬, ৭-৫ এমন বিদঘুটে লম্বা স্কোর। এসব আবার কী? ফুটবলে তো গোল দেখেই বোঝা যায়! কিন্তু টেনিসে দেখছেন যে, বল মিস হলো, খেলোয়াড় উল্লাসও করলো, এ কি আবার খেলা হচ্ছে? আসলে কেন?
প্রিয় পাঠক, আমরা টেনিস ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম দুই খেলোয়াড়ের যুগে রয়েছি। একটু কঠিন নিয়মের কারণে অনেকেই খেলাটি দেখেন না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। দুই পর্বে টেনিসের খুঁটিনাটি সব আপনাদের সামনে নিয়ে আসার প্রয়াসের প্রথম পর্বে আজকে থাকছে টুর্নামেন্ট কী কী ও কেমন এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় টার্ম।
টেনিস মৌসুম
ক্লাব ফুটবলে যেমন প্রতি বছরের আগস্টে নতুন মৌসুম শুরু হয়ে পরের বছরের মে কিংবা জুনে শেষ হয়, ঠিক তেমনি টেনিসেও প্রতি বছরের জানুয়ারিতে নতুন মৌসুম শুরু হয়ে সেই বছরেরই নভেম্বরে শেষ হয়। অফিসিয়ালভাবে প্রত্যেক বছরের মৌসুমকে ডাকা হয় ‘এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর’ নামে। যেমন- এই বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে ‘২০১৮ এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর’, এবং এই ট্যুর চলবে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত।
টেনিস টুর্নামেন্টসমূহ
‘এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর’ এ যেসব ক্যাটাগরির টুর্নামেন্ট থাকে সেগুলো হলো গ্র্যান্ড স্ল্যাম, এটিপি ফাইনালস, ডেভিস কাপ, নেক্সট জেনারেশন, এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর মাস্টার্স ১০০০, এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ৫০০ ও এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ২৫০। এদের মধ্যে টেনিসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর ধরা হয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্যুরকে।
গ্র্যান্ডস্লাম
প্রতি মৌসুমে মোট চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেন। পুরুষদের সব গ্র্যান্ডস্লামই খেলা হয় পাঁচ সেটে, যেখানে বিজয়ীকে জিততে হবে তিনটি সেট। পুরুষদের বাকি সব এবং মেয়েদের সব টুর্নামেন্ট খেলা হয় তিন সেটে, যেখানে দুটি সেট জিততে হয় জয়ের জন্য।
প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বসে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের আসর। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান ওপেন গ্রাস কোর্টে (ঘাসের সার্ফেস। পরবর্তী পর্বে সার্ফেসগুলো নিয়েও থাকবে বিস্তারিত) খেলা হলেও ১৯৮৮ থেকে এখন পর্যন্ত আউটডোর হার্ড কোর্টে খেলা হয়ে আসছে বছরের প্রথম এই স্ল্যামটি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পুরুষ এককের ইতিহাসে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ৬টি করে শিরোপা জিতেছেন রজার ফেদেরার, নোভাক জোকোভিচ এবং রয় এমারসন। আর নারী এককে সর্বোচ্চ ১১টি অস্ট্রেলিয়ান শিরোপার মালিক মার্গারেট কোর্ট।
ক্লে কোর্টকে (লাল মাটির সার্ফেস) বলা হয় টেনিসের সবচেয়ে কঠিনতম সার্ফেস। সেই ক্লে কোর্টেরই একমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যাম হলো রোঁলা গাঁরো তথা ফ্রেঞ্চ ওপেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন শেষ হওয়ার ঠিক চার মাসের মাথায় ফ্রান্সের বিখ্যাত প্যারিস শহরে অনুষ্ঠিত হয় এই টুর্নামেন্টটি। সর্বোচ্চ ১০টি রোঁলা গাঁরো শিরোপা জিতে ফ্রেঞ্চ ওপেনের ইতিহাসে সফলতম পুরুষ খেলোয়াড় ‘কিং অফ ক্লে’ খ্যাত রাফায়েল নাদাল। অন্যদিকে নারী এককে সবচেয়ে বেশি ৭টি ফ্রেঞ্চ ওপেন টাইটেল জিতেছেন ক্রিস এভার্ট।
ফ্রেঞ্চ ওপেন শেষ হতে না হতেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম ‘উইম্বলডন’ আয়োজনের। মূলত প্রতি বছর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ক্লাব’ এ আয়োজন করা হয় টেনিসের সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাকর টুর্নামেন্টের। প্রায় দেড়শো বছর ধরে চলা ‘উইম্বলডন’ শুরু থেকেই গ্রাস কোর্টে আয়োজিত হয়ে আসছে। পুরুষ এককে সর্বোচ্চ ৮টি উইম্বলডন শিরোপা জিতেছেন গ্রাস কোর্টের এযাবতকালের সেরা খেলোয়াড় রজার ফেদেরার। নারী এককে সবচেয়ে বেশি ৯টি উইম্বলডন জেতার রেকর্ড রয়েছে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার।
এবারে পালা ইউএস ওপেনের। আগস্টের শেষ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অনুষ্ঠিত হয় বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ইউএস ওপেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মতো ইউএস ওপেনও পূর্বে গ্রাস কোর্টে খেলা হলেও বর্তমানে আউটডোর হার্ড কোর্টে (কংক্রিট ভিত্তিক সার্ফেস) খেলা হয়ে থাকে টুর্নামেন্টটি। ইউএস ওপেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৭টি পুরুষ এককের শিরোপা জিতেছেন রিচার্ড সিয়ার্স, বিল লার্নড এবং বিল টিলডেন। ৮টি শিরোপা জিতে নারী এককে সবার উপরে রয়েছেন মলা ম্যালোরি।
২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতে পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ডস্লাম জেতা খেলোয়াড় এখন রজার ফেদেরার। ১৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম এবং ১৪ টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে ফেদেরারের পরপরই রয়েছেন যথাক্রমে রাফায়েল নাদাল এবং পিট সাম্প্রাস। এবং নারী এককে উন্মুক্ত যুগে সর্বোচ্চ ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপার মালিক সেরেনা উইলিয়ামস।
এটিপি ফাইনালস
গ্র্যন্ড স্ল্যাম ইভেন্টের পর টেনিসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর ধরা হয় এটিপি ফাইনালস এবং ডব্লিউটিএ (WTA) ফাইনালসকে। পুরুষ র্যাংকিংয়ে শীর্ষ আটে থাকা আটজন খেলোয়াড়কে নিয়ে প্রতি বছরের নভেম্বরে আয়োজন করা হয় এটিপি ফাইনালস। ঠিক তেমনিভাবে নারী এককের শীর্ষ আটের খেলোয়াড়দের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ডব্লিউটিএ ফাইনালস। সবচেয়ে বেশি ছয়বার এটিপি ফাইনালস জিতেছেন রজার ফেদেরার। আরেকদিকে সবচেয়ে বেশি আটবার ডব্লিউটিএ ফাইনালস জিতেছেন মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। ২০১৭ সাল থেকে অনূর্ধ্ব-২১ বছর বয়সী টেনিস খেলোয়াড়দের জন্য এটিপি ফাইনালসের আদলে আয়োজন করা হয় ‘নেক্সট জেনারেশন এটিপি ফাইনালস’।
টেনিস বিশ্বকাপ
‘ডেভিস কাপ’কে বলা টেনিসের বিশ্বকাপ। সারা বছর ধরে চলা এই টুর্নামেন্টের মূল পর্বে ওঠা ১৬ দেশের পুরুষ খেলোয়াড়দের মধ্যে চলে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩২ বার ডেভিস কাপ জিতেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডেভিস কাপের আদলে নারীদের জন্য প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘ফেড কাপ’।
মাস্টার্স সিরিজ
গ্র্যান্ড স্ল্যাম এবং এটিপি ফাইনালসের পর টেনিসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর হিসেবে বিবেচিত করা হয় এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর মাস্টার্স ১০০০ কে, সংক্ষেপে এটিপি মাস্টার্স সিরিজকে। ১০০০ বা ৫০০ বা ২৫০ এগুলোর মানে হলো এই টুর্নামেন্ট জিতলে খেলোয়াড় পাবেন সংখ্যার সমান পয়েন্ট। বর্তমানে সারা বছর জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে মোট নয়টি এটিপি মাস্টার্স টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এটিপি মাস্টার্স সিরিজের কোনো টুর্নামেন্টে কেউ চ্যাম্পিয়ন হলে তার র্যাংকিং পয়েন্টের সাথে আরো ১০০০ পয়েন্ট যোগ হয়। এ কারণে এই সিরিজের অফিশিয়াল নাম ‘এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর মাস্টার্স ১০০০’। ঠিক একই রকম কারণ প্রযোজ্য ‘এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ৫০০’ এবং ‘এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ২৫০’ এর বেলায়।
এটিপি মাস্টার্স সিরিজের ইতিহাসে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ৩০টি টাইটেল জিতেছেন রাফায়েল নাদাল এবং নোভাক জোকোভিচ। আর এটিপি ৫০০ এর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২০টি টাইটেলের মালিক রজার ফেদেরার। অন্যদিকে এটিপি ২৫০ টুর্নামেন্ট সবচেয়ে বেশি ২৬ বার জিতেছেন সাবেক অস্ট্রিয়ান খেলোয়াড় থমাস মুস্টার। সব মিলিয়ে টেনিসের সর্বোচ্চ ১০৯টি সিংগেলস টাইটেলস জিতেছেন জিমি কনর্স।
র্যাংকিং
এটিপি, ডব্লিউটিএ এবং আইটিএফ কর্তৃক আয়োজিত টেনিসের নিয়মিত টুর্নামেন্ট ছাড়াও প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে টেনিস এক বিশেষ আকর্ষণীয় ইভেন্ট। অলিম্পিকসহ টেনিসের সব ধরনের ট্যুরে মূলত পুরুষ একক, নারী একক, পুরুষ দ্বৈত, নারী দ্বৈত, মিশ্র দ্বৈত সহ অন্যান্য বিশেষ ডিসিপ্লিনে খেলা হয়ে থাকে। সারা বছর ধরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের মাধ্যমে অর্জিত পয়েন্টের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় এটিপির পুরুষ এবং ডব্লিউটিএর নারী র্যাংকিং।
টেনিসের র্যাংকিং একটু বিদঘুটে। ধরা যাক, ফেদেরার এবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন। সব গ্র্যান্ডস্লামের পয়েন্ট ২০০০। তো তিনি পেলেন ২০০০ পয়েন্ট। এখন পরেরবার তাঁকে এই ২০০০ পয়েন্ট ডিফেন্ড করতে হবে জিতে। যদি জিতে যান তবে নতুন কোনো পয়েন্ট যোগ হবে না, কিন্তু হেরে গেলে অর্জিত পয়েন্ট খোয়াবেন। টেনিসেরও শীর্ষস্থান অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন!
কিছু প্রয়োজনীয় টার্মস
সিঙ্গেলস
যখন একজন খেলোয়াড়ের প্রতিপক্ষ একজন থাকে, সে খেলাকে বলা হয় সিঙ্গেলস বা একক।
ডাবলস
দুজন বনাম দুজনের ম্যাচকে বলা হয় ডবলস।
এড ও ডিউস কোর্ট
কোনো একজন খেলোয়াড়ের ডানপাশকে বলা হয় ডিউস কোর্ট ও বামপাশকে বলা হয় এড কোর্ট।
ফল্ট ও ডবল ফল্ট
সার্ভ করার সময় বল নির্দিষ্ট দাগের মধ্যে না পড়লে বলা হয় ফল্ট। টানা দুটি ফল্টকে বলা হয় ডবল ফল্ট। ডবল ফল্টে প্রতিপক্ষ এক পয়েন্ট পায়।
ফোরহ্যান্ড
আপনার শক্তিশালী হাতের পাশ বরাবর যে শট নেয়া হয় তাঁকে বলে ফোরহ্যান্ড।
ব্যাকহ্যান্ড
যে শট নেয়ার জন্য আপনার হাতকে শরীরের অপর পাশে নিয়ে গিয়ে খেলতে হয়। ব্যাকহ্যান্ড শট নেয়া ফোরহ্যান্ডের চেয়ে কঠিন। ব্যাকহ্যান্ড টেনিসে বড় একটি টার্ম। যেসব প্লেয়ার দুই হাতে ব্যাকহ্যান্ড শট নেন, তাদের ডবল হ্যান্ড ব্যাকহ্যান্ড (যেমন- নাদাল) বলা হয়, আর যারা এক হাতে নেন, তাদের সিঙ্গেল হ্যান্ড ব্যাকহ্যান্ড বলা হয় (যেমন- ফেদেরার}।
এইস
কোনো সার্ভ যদি প্রতিপক্ষ একদমই ধরতে না পারে তবে তাকে এইস বলা হয়।
ড্রপশট
ঠিক নেটের কাছে যে শটটি ফেলা হয় তাকে ড্রপশট বলে। ড্রপশটে ফেদেরারের জুড়ি মেলা ভার।
আনফোর্সড এরর
কোনো সহজ শট মিস করলে একে বলা হয় আনফোর্সড এরর।
এছাড়াও টেনিসে আরো অনেক ছোট ছোট টার্ম রয়েছে। স্কোরিং টার্মগুলো পরের লেখায় আলোচনা করা হবে।
টেনিস একটি রাজসিক ও বহুল জনপ্রিয় খেলা। পাঠকদের সুবিধার্থে এই পর্বে টুর্নামেন্টগুলোর প্রকৃতি ও কিছু প্রয়োজনীয় টার্ম আলোচনা করা হলো। পরবর্তী পর্বে থাকবে টেনিস খেলায় কীভাবে স্কোরিং করা হয় এবং সার্ফেসগুলোর প্রকৃতি ও কেন সার্ফেসভেদে খেলায় ফারাক হয়।
ফিচার ছবিসত্ত্ব: SportsClub
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: Meherabul Haque Rafi