১৮৭৭ সাল থেকে ২০২০ সাল মাঝের এই ১৪৩ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ক্রিকেট বিশ্ব টেস্ট ম্যাচ দেখেছে ২,৩৮৭টি। এর মধ্যে ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে ১,৬১৯ ম্যাচে, আর ড্র হওয়া টেস্টের সংখ্যা ৭৬৬টি। টাই হয়েছে দুটি টেস্ট ম্যাচ। এর মধ্যে সাতটি টেস্ট ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। আর দশটি টেস্ট ম্যাচ মাঠে বল গড়ানোর আগেই বাতিল হয়েছে, যেটার সর্বশেষ সংযোজন বাংলাদেশ-পাকিস্তান করাচি টেস্ট। সবচেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ (১,০২২ ম্যাচ) খেলেছে ইংল্যান্ড। তবে ক্রিকেটের এই বনেদি ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ৮৩০ টেস্টের মধ্যে অজিরা জয় পেয়েছে ৩৯৩ টেস্টে।
সাদা পোশাকের এই অভিজাত ফরম্যাটের বয়স প্রায় দেড়শ’। এ সময়ে ম্যাচ হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক, কিন্তু আপনি-আমি কিংবা আমাদের মতোই সাধারণ দর্শকেরা মনে রেখেছি স্রেফ কয়েকটি ম্যাচ। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু এরকমই মনে রাখার মতো কিছু টেস্ট ম্যাচ। স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো সর্বোচ্চ রান তাড়া করা তিনটি ম্যাচের দিকে নজর দেওয়া যাক।
অস্ট্রেলিয়া – ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অ্যান্টিগা ২০০৩
২০০৩ সালে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সিরিজের শুরু থেকেই দাপট দেখাচ্ছিল স্টিভ ওয়াহর দল। অ্যান্টিগা টেস্টের আগের তিনটি টেস্টই জিতে নেয় অজিরা। তাই ক্যারিবীয়দের জন্য সিরিজের চতুর্থ টেস্ট ছিল অস্তিত্বের লড়াই। ঘরের মাঠে খাবি খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল স্বাগতিকদের। তাই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অ্যান্টিগা টেস্টই বেছে নিল তারা। আর তাতেই ইতিহাস রচনা।
টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামে অস্ট্রেলিয়া। অ্যান্টিগা টেস্টের প্রথম দিনেই অলআউট অজিরা। মাত্র ২৪০ রানে অলআউট সফরকারীরা। সর্বোচ্চ ৪১ রান আসে স্টিভ ওয়াহের ব্যাট থেকে, সাত উইকেট নেন জার্মাইন লসন। আশ্চর্যজনকভাবে, প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও রানও অজিদের সমান। অলআউট হবার আগে অধিনায়ক ব্রায়ান লারার ব্যাটে ভর করে ২৪০ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে অজিরা পাহাড়সম টার্গেট দাঁড় করায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে। উদ্বোধনী জুটিতে আসে ২৪২ রান। ১১১ করে জাস্টিন ল্যাঙ্গার ফিরলেও চালিয়ে যেতে থাকেন ম্যাথু হেইডেন। শেষ পর্যন্ত হেইডেনের ১৭৭ আর অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর অপরাজিত ৪৫ রানের সুবাদে ৪১৭ রান তুলতে সক্ষম হয় অজিরা।
জিততে হলে ক্যারিবীয়দের প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে, অজেয়কে জয় করতে হবে। জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ৪১৮। অ্যান্টিগায় উপস্থিত দর্শক এবং স্ক্রিনে যারা খেলা দেখছিলেন, তারা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, চতুর্থ টেস্টও হারতে যাচ্ছে ব্রায়ান লারার দল। কারণ, দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ৪০০-এর অধিক রান তারা করে টেস্ট জয়ের রেকর্ড আগে কখনও দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। সেখানে জয়ের জন্য দরকার ৪১৮!
শুরুটা ভাল হলো না ক্যারিবীয়দের। ৭৪ রান তুলতেই নেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান। টেস্টের চতুর্থ ও পঞ্চম দিন এমনিতেই পিচে বোলাররা অতিরিক্ত সুবিধা পাবে। সেখানে প্রতিপক্ষের পেস বোলিং লাইনআপে যদি গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পিদের মতো পেসাররা থাকে, তখন সেই ম্যাচ জেতাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। তবে ম্যাচের আসল রোমাঞ্চ, থ্রিল, সাসপেন্স তখনও বাকি। ৭৪ রানে চার উইকেট হারানোর পরের গল্পটা রামনরেশ সারওয়ান আর শিবনারায়ণ চন্দরপলের। ম্যাকগ্রা-লি’দের বলের সুতো খুলে ফেলার অবস্থা। ওয়ানডে স্টাইলে ব্যাট চালাতে থাকেন এই দুই ক্যারিবিয়ান।
নীরস একটা টেস্ট ম্যাচ মুহূর্তেই পায় প্রাণের সঞ্চার। গ্লেন ম্যাকগ্রা বিভিন্নভাবে সারওয়ানের মনঃসংযোগে চিড় ধরানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৭ বছরের টগবগে তরুণ ঠাণ্ডা মাথায় তার জবাব দিচ্ছিলেন ব্যাটে। সব ক্ষোভ সীমানার দড়ির ওপারে আছড়ে ফেলেছিলেন। কারণ, সেই দিনটা যে ছিল ক্যারিবীয়দের!
ধীরে ধীরে ম্যাচ তাদের নাগালের মধ্যে চলে আসে। দলীয় ২৮৮ রানের সময় ১০৫ রান করে ব্রেট লির বলে ফিরে যান সারওয়ান। চন্দরপল একপ্রান্ত আগলে রেখে বাকি ব্যাটসম্যানদের নিয়ে সামনে এগোতে থাকেন। সেঞ্চুরির পর দলীয় ৩৭২ রানের সময় চন্দরপল আউট হন। ম্যাচ জিততে তখনও দরকার ৪৬ রান হাতে তিন উইকেট। অষ্টম উইকেটে ওমারি ব্যানক্স এবং ভ্যাসবার্ট ড্রেকস কাজের কাজটা সেরে ফেলেন। রেকর্ড রান তাড়া করে তিন উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় ব্রায়ান লারার দল।
অ্যান্টিগায় ইতিহাস রচনা করে জয়ের আনন্দে ভাসেন গেইল-সারওয়ান-চন্দরপলেরা। ঐতিহাসিক অ্যান্টিগা টেস্টের ম্যাচ অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন শিবনারায়ন চন্দরপল। টেস্ট ক্রিকেটের রান তাড়া করে জয়ের ধারণাই বদলে দিয়েছিল সেই ঐতিহাসিক অ্যান্টিগা টেস্ট।
অস্ট্রেলিয়া – দক্ষিণ আফ্রিকা, পার্থ ২০০৮
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তবে এবার জয়ী দল ‘মাদিবা’র দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা।
দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে অজিদের দেওয়া ৪১৪ রানের টার্গেটে খেলতে নেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না প্রোটিয়াদের জন্য। কেননা, এর আগে টেস্ট ইতিহাসেই কেবলমাত্র একবারই ৪০০-এর অধিক রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ছিল। কে জানে, এটাই হয়তো টনিক হিসেবে কাজ করছে গ্রায়েম স্মিথ, হাশিম আমলা, জ্যাক ক্যালিসদের জন্য!
ম্যাচ জিততে স্মিথদের দরকার ৪১৪ রান হাতে সময় দু’দিন। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা মোটেও ভালো হলো না প্রোটিয়াদের। বড় টার্গেট ছুঁতে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল একটা উড়ন্ত সূচনা। কিন্তু তা আর হলো কই?
দলীয় ১৯ রানের সময় জনসনের শিকার ওপেনার নিল ম্যাকেঞ্জি। তবে আমলাকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান স্মিথ, যাকে বলে, ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট। ব্রেট লি, মিচেল জনসনদের পেস আর সুইংয়ের বিপরীতে অনেকটা হাত খুলে খেলতে থাকেন স্মিথ। ১৭২ রানের সময় আবারও সেই জনসনের বলেই লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে পা দেন প্রোটিয়া দলপতি। এর আগে তুলে নেন টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৮তম সেঞ্চুরি।
তিন উইকেটে ২২৭ রানে দিন শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। উইকেটে দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান জ্যাক ক্যালিস ৩৩* এবং এবি ডি ডিলিয়ার্স আছেন ১১* রানে। টেস্টের পঞ্চম দিনে ম্যাচ জিততে দরকার আরও ১৮৭ রান। হাতে উইকেট আছে ৭টি। তবে টেস্টের পঞ্চম দিনে উইকেটে পেসাররা এক্সট্রা বাউন্স পাবে, স্পিনও ধরবে বেশ জোরেশোরে। পঞ্চম দিনে লাঞ্চের আগেই ব্যক্তিগত ৫৭ রানে ফিরে যান জ্যাক ক্যালিস।
এরপর ডি ভিলিয়ার্স এবং জেপি ডুমিনি অজি বোলারদের সমস্ত চেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নোঙর করান। ছয় উইকেটের সহজ জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ডি ভিলিয়ার্স খেলেন অপরাজিত ১০৬ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস। তাকে যোগ্য সঙ্গই দিয়েছিলেন আরেক প্রান্তে ৫০ রানে অপরাজিত থাকা জেপি ডুমিনি।
জয়টা সহজ হলেও গুরুত্বের বিচারে এই টেস্টের মাহাত্ম্য কোনো অংশেই কম নয়। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার ওঠে ডি ভিলিয়ার্সের হাতে। পার্থে চতুর্থ ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। অসাধারণ এক টেস্ট উপহার দেয় গ্রায়েম স্মিথের দল।
ভারত – ইংল্যান্ড, চেন্নাই ২০০৮
২০০৮ সালে ইংলিশরা ভারত সফরে গিয়েছিল কেভিন পিটারসেনের নেতৃত্বে। চেন্নাইয়ে সিরিজের প্রথমটিতে রেকর্ড গড়ে ম্যাচ জিতে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। ইংলিশরা আগে ব্যাট করে ৩১৬ রান তোলে। ভারত তাদের প্রথম ইনিংসে গুটিয়ে যায় মাত্র ২৪১ রানে, ৭৫ রানের লিড পায় ইংলিশরা। দ্বিতীয় ইনিংসে তারা যোগ করে আরও ৩১১ রান। অর্থাৎ, জয়ের জন্য ভারতের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৮৭ রান।
বড় রান তাড়া করতে নেমে দারুণ শুরু পায় ভারত। বীরেন্দর শেবাগ এবং গৌতম গম্ভীরের ১১৭ রানের জুটি। ৬৬ রান করা শেবাগ অ্যান্ডারসনের বলে কলিংউডের হাতে ক্যাচ দেন। ওয়ান ডাউনে ‘দ্য ওয়াল’-খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ও বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত শচীন টেন্ডুলকারের হার না মানা ১০৩, সাথে যুবরাজ সিংয়ের অপরাজিত ৮৫ রানের উপর ভর করে লক্ষ্যে পৌছাঁয় ভারত।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। আর সব মিলিয়ে তৃতীয়।
২২ গজে উইলো আর চর্মগোলকের এই ধ্রুপদী লড়ায়ে কতকিছুই না মিশে থাকে! আর সেটা যদি সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেট হয়, তাহলে তো কথাই নেই। রঙ বদলায় ম্যাচের ক্ষণে ক্ষণে। প্রতিটি সেশনেই থাকে কোনো না কোনো চমক। ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা’ ক্রিকেটে অসম্ভব বলে যে কিছুই নেই, এটিই যেন প্রমাণ মেলে বার বার।